রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষের নেতৃত্বের নিরাপত্তা
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পাঁচ বছর পূর্তি ও মিয়ানমারে গণহত্যা দিবস পালন উপলক্ষে ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে সমাবেশ করেছে। সেখানে তাঁরা তাদের নিজ দেশে দ্রুত প্রত্যাবাসন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য সেফ জোন স্থাপন, নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন দাবি জানায়। এই সমাবেশে অবিলম্বে প্রত্যাবাসন শুরু করা, রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার, রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া, ১৯৮২ সালের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন বাতিল, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি ফিরিয়ে দেয়া, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য সেফ জোন প্রতিষ্ঠাসহ সাত দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সমাবেশের মাধ্যমে এসব দাবি বাস্তবায়নে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
বাংলাদেশের ভেতরে সন্ত্রাসীরা প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব শূন্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে যা কাম্য নয় এবং অবিলম্বে তা বন্ধ করতে হবে। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে সংগঠনটির চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত ভূমিকা পালন করে মুহিবুল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে উঠায় তাঁকে এই উদ্যোগ থেকে সরানোর জন্য হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীতে, ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে দুই রোহিঙ্গা নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করায় এই দুজনকেও হত্যা করা হয়। এই নিয়ে গত তিন মাসে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে প্রত্যাবাসনের পক্ষের অন্তত ১১ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছিল এবং তাঁদের নেতৃত্বে রোহিঙ্গা যুবকদের কয়েকটি দল আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিল। তাদের কার্যকরী পদক্ষেপে ক্যাম্পের মধ্যে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতা সীমিত হয়ে আসাতে সন্ত্রাসীরা অন্যদেরকে এধরনের কার্যক্রম গ্রহণ নিরুৎসাহিত ও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে এই হামলা চালায়।
নিহত রোহিঙ্গা নেতারা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, ক্যাম্পের দোকানপাটে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গা তরুণ ও যুবকদের নিয়ে আশ্রয়শিবিরে রাত্রিকালীন পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ছাড়া তাঁরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করতেন এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অবস্থান, তৎপরতা সম্পর্কে তথ্য দিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলোকে সহযোগিতা করতেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা, চাঁদাবাজি, মাদক ও সোনা চোরাচালানে যুক্তসহ অপহরণ, ধর্ষণ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা বেশ কিছু সংগঠন কার্যকর রয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গা না পাঠানো, দোকান থেকে চাঁদা তুলে দেওয়া এবং মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতে বাধা দেয়ায় সন্ত্রাসীরা এই দুজনকে হত্যা করে।এ ঘটনাগুলোর কারনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রায় ৮০০ আখড়ায় মাদকদ্রব্য কেনাবেচায় জড়িত রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা। গত পাঁচ বছরে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দল, সংঘর্ষ, গোলাগুলি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ঘটনায় ১২৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে অস্ত্র, মাদক সরবরাহ করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সক্রিয় রাখছে।আশ্রয়শিবির গুলোতে ১৭ ধরনের অপরাধের বিপরীতে ২ হাজার ৩০৯টি মামলা হয়েছে এবং এতে ৫ হাজার ২২৯ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। এসব ঘটনা বন্ধে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে নেতৃত্ব তৈরি করার পাশাপাশি তাদের সমর্থক বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রত্যাবাসনের বিরোধীদের চিহ্নিত করে তাদের কে প্রেষণার আওতায় আনতে হবে ও সন্ত্রাসী গুষ্ঠির অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে। ব্রিটিশরা রোহিঙ্গাদেরকে স্বাধীন-সার্বভৌম আরাকান রাষ্ট্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করেছিল। ১৮৭২ ও ১৮৯১ সালের আদমশুমারি থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ রেখেছিল, যা পরবর্তী কালে মিয়ানমারের সামরিক সরকারে জন্য রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে সহায়তা করে। এর পর ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে মিয়ানমার সরকার তাদেরকে রাষ্ট্রবিহীন প্রান্তিক জনগুষ্টিতে পরিনত করে।
রোহিঙ্গা সংকট এবং এর কারণগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে চেষ্টা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের হাইকমিশন ও দূতাবাসগুলো। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাইকমিশন ও দূতাবাস এ যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। তাঁরা জানিয়েছে পাঁচ বছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দৃঢ়তার সাথে বাংলাদেশের সমর্থনে সংহতি জানিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পাশে আছে। তারা রোহিঙ্গা সংকট এবং এর কারণগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাবে। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা, সুরক্ষা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে দেশগুলো বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাবে। তাঁরা বাংলাদেশে অবস্থানকালে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, অর্থবহ ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের বিষয়কে গুরুত্ব দেয় এবং এর পাশাপাশি রাখাইনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মিয়ানমারে তাঁদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানায়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দানকারী কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের প্রতি ও তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখার কথাও জানিয়েছে বিদেশি মিশনগুলো।
চীন এবারও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করবে বলে জানিয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সামরিক সরকার আগের সব চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরু করবে বলে জানা গেছে তবে পরিচয় যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলেছে, সেই সাথে প্রথম ব্যাচ ফেরত নিতে আলোচনা চলছে।
আরাকানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ চলছে, মিয়ানমারে উদ্বাস্তু বেড়ে চলছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা তাদের গ্রামে ও বাড়িঘরে ফেরত যেতে পারছে না। আরাকান আর্মি ও রাখাইনের জনগণের কাছে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়ানোর কোন প্রচেষ্টার বিষয়ে জানা যায় নাই। বৌদ্ধ সংগঠন গুলো যেভাবে ঘৃণা ছড়িয়েছিল সেভাবে গ্রহন যোগ্যতা বাড়ানোর কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশজুড়ে প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে৷ মায়ানমারে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) ক্ষমতায় যেতে পারলে রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিবে বলে জানিয়েছে। এনইউজি তাদের বিবৃতিতে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়। মিয়ানমার সরকার, ও জনগণের মনোভাব ইতিবাচক এবং রাজনৈতিকভাবে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা না গেলে প্রত্যাবাসন বিলম্ব হতেই থাকবে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা জরুরি। আসিয়ান দেশগুলোকে মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ও রাখাইন প্রদেশে প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিতে হবে। জাপান, থাইল্যান্ড সিংগাপুর এই সব দেশের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য রয়েছে মিয়ানমারে সাথে। এসব দেশ প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার সরকারে উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ও রাখাইন প্রদেশে প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিতে হবে। গত পাঁচ বছরে তাঁরা মিয়ানমার সরকারের সাথে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতিতে সফলতা অর্জন করতে পারে নাই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে রোহিঙ্গা নেতৃত্ব ও অভিবাসী রোহিঙ্গাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। বিভিন্ন দেশে, জাতিসংঘে, জেনেভাতে রোহিঙ্গা অভিবাসী সংগঠনগুলোকে প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত ও সমর্থন যোগাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা তাদের সোচ্চার কণ্ঠস্বর পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও মিডিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরে। রোহিঙ্গা দের জন্য এ ধরনের কার্যক্রম নিতে হবে, তাদের এসব কর্মকাণ্ড চলমান নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে এবং একই সাথে রোহিঙ্গা সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে যাতে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তার উপর চাপ না ফেলে। ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও জনসংখ্যার চাপ কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে। দাতা সংস্থা গুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে ত্রান সহায়তা কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজ রোহিঙ্গা সংকট ও উত্তরন বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে এবং প্রত্যাবাসনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমস্যা সমাধানের সক্রিয় উদ্যোগ, মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত পূর্বক প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি এবং রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার আগ্রহ এবং ক্যাম্পেগুলোতে প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় নেতৃত্বের নিরাপত্তা সুসংহত করে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যেতে হবে।
ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।