সিঙ্গেল মাদারদের প্রতিবন্ধকতা



শাহনাজ পারভীন এলিস
সিঙ্গেল মাদারদের প্রতিবন্ধকতা

সিঙ্গেল মাদারদের প্রতিবন্ধকতা

  • Font increase
  • Font Decrease

 

গল্পের শুরুটা মা হওয়ার আগের। কারণ প্রায় দশ বছর চেষ্টা করেও মা হতে পারছিলেন না মিতালি। আর এতো চেষ্টা করেও মা হতে না পারার যন্ত্রণায় মিতালী নিজেই যখন দগ্ধ- তখন শ্বশুরবাড়ির লোকদের কূটকথা, পরিবারের সদস্যদের অবহেলা আর সমাজের নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা তাকে আরও আহত করতে থাকে। তারপরও হাল ছাড়েনি মিতালি। কারণ কলেজ জীবনের বন্ধু, তার স্বামী মাহফুজ তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিচ্ছিলো, চিকিৎসাও চলছিলো। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি আর তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় বিয়ের এগারো বছর পর  মিতালির কোলজুড়ে আসে জমজ সন্তান মনন ও মেধা।

কিন্তু আবারও ছন্দপতন ঘটে মিতালির জীবনে। বাচ্চাদের বয়স দুই বছর হওয়ার আগেই রোড এক্সিডেন্টে মারা যান মাহফুজ। তারপর থেকে... কখনো বাবা, কখনোবা মা হয়ে সন্তানের পাশে থেকে জীবনযুদ্ধ শুরু করেন তিনি। এমন ঘটনা শুধু মিতালির জীবনে ঘটেছে এমন নয়, সমাজে নানা কারণেই বেড়েছে সিঙ্গেল মাদারের সংখ্যা। অথচ জীবনযুদ্ধে থাকা এমন নারী বা মায়েদের পাশে সমাজের লোকজন তাগিদ বোধ করেন না; উল্টো ইঙ্গিতপূর্ণ নানা কথা, অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্নে প্রতিনিয়ত তাদের বিদ্ধ করছেন। একটিবারও তারা ভাবেন না প্রতিটি মানুষ স্বাধীন সত্তার অধিকারী। কারো ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে লোকসমাজের অনধিকার চর্চা কাম্য নয়। সমাজে কোন নারী সিঙ্গেল মাদার হিসেবে সন্তানদের নিয়ে জীবনযাপন করতে চাইলে, তাকে নানা শব্দ চয়নে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নারী-পুরুষের সম্মিলনে গড়ে ওঠে পরিবার। কিন্তু একসঙ্গে বসবাস ও চলতে গিয়ে অনেক সময় মতপার্থক্যসহ নানা কারণে অনেক পরিবারেই ভাঙন দেখা দেয়। এক পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এরপর পাল্টে যেতে থাকে সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এমন পরিস্থিতিতে পড়া পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি মানসিক পীড়নের শিকার হতে হয়! কারণ সিঙ্গেল মাদার ও সিঙ্গেল নারীরা সমাজে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন, মানুষ হিসেবে তার ইচ্ছাকে সমাজ সম্মান দিতে চায় না। এর ফলে ওই নারীদের সামাজিক সমস্যা বাড়তে থাকে। যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন রকম সমস্যার মধ্য দিয়ে চলে তাদের জীবন যাপন। অনেক সময় বিয়ের জন্যও তাদের নানাভাবে উত্যক্ত করে ওই নারীদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়। বিয়েতে রাজি না হলে ওই নারীকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা এবং তার সম্পত্তি জবরদখলের চেষ্টা করা হয়। এসবের পরও শেষপর্যন্ত কোন নারী মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করলে, চারিত্রিক দোষ দিয়ে তাকে ঘরবন্দি বা একঘরে করে রাখার অনেক ঘটনাও দেখা যায়!

সাংসারিক জীবন থেকে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যাওয়ার পর- পুরুষরা সমাজে যতটা স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারে, নারীরা তা পারে না। সিঙ্গেল নারীর সমাজে টিকে থাকা রীতিমতো জীবনযুদ্ধ। কারণ অনেকেই মনে করে সিঙ্গেল মাদার মানে অসহায়! আবার কেউবা ভাবে- সিঙ্গেল মাদার একাকিত্ববোধ করেন। তাই অনেকে তাকে অকারণে সহানুভূতি দেখাতে চান। এতে তার মানসিক শান্তি আরও বিঘ্নিত হয়। তবে সন্তান যেখানে একজন মায়ের প্রধানতম পছন্দ সেখানে সংগ্রাম তার নিত্যসঙ্গী। তাই সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়- একলা পথচলা সংগ্রামী মায়েদের।

আমাদের সমাজে এখনো সিঙ্গেল মাদার- বিষয়টিকে খুব সহজে মেনে নিতে পারেন না অনেকে। তারা মনে করেন- সন্তান বড় করার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের সাহায্য ছাড়া মহিলারা অক্ষম। তাইতো একলা মায়েদের হাজারো প্রশ্নবাণে প্রতিনিয়ত জর্জরিত হতে হয়। সিঙ্গেল মাদার-এর সন্তানদেরও সমাজে নানারকম অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, ফলে তারাও একলা থাকতে বেশি পছন্দ করেন। এতে অন্যান্য বাচ্চাদের মতো সমাজে স্বাভাবিকভাবে মিশতে না পেরে- ক্রমশ তারা অসামাজিক হয়ে পড়ে।

সিঙ্গেল মাদার বা সিঙ্গেল প্যারেন্টস- পরিবার ও সমাজ কারো জন্যই সুখকর নয়। তারপরও সমস্যা যত কঠিনই হোক না কেন- পরিস্থিতি মানুষকে সমাধানের পথ খুঁজে নিয়ে বাধ্য করে। অল্প বয়সে বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা দুর্ঘটনায় বিধবা হওয়ার পর, দ্বিতীয় বিয়ে না করে অনেক নারীকেই বেছে নিতে হয় সিঙ্গেল মাদার জীবন। পিতৃ পরিচয় ছাড়াও সন্তানকে লালন-পালন করছে। এমন সিঙ্গেল মাদার বা একক মায়েদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, নেহায়েত কমও না। ফলে জানা-অজানা অনেক পরিবারে সন্তানেরা বেড়ে উঠছে মাতৃছায়ায়।

সমাজের তীর্যক দৃষ্টি, আর্থিক অস্বচ্ছলতা সহ্য করেও সিঙ্গেল মায়েরা সন্তানদের কখনো ছেড়ে যান না, পাশে থাকেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে তাদের এগিয়ে নেন। সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে, সন্তানের সম্মান এবং তাদের সুখে সুখি হতে যুদ্ধ করছেন অনেক নারী। এই যুদ্ধে তারা সফলও হচ্ছেন। কার মূলে রয়েছে- বর্তমান সমাজে নারীরা এখন  আর শিক্ষা-দীক্ষায় পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই। উচ্চ শিক্ষিত নারীরা সিঙ্গেল মাদার হলেও তারা কর্মজীবী ও স্বাবলম্বী। অনেকে সামাজিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত। তাই কারো ওপর নির্ভরশীলতা ছাড়াই সন্তানদের নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছেন। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চ শিক্ষা দিতেও তাদের কারো সহানুভূতির প্রয়োজন হচ্ছে না।

সমাজের সচেতন মহলের প্রশ্ন- কবে সেই দিন আসবে, যেদিন সিঙ্গেল নারীকে তার জীবনযাপনের জন্য সমাজ কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ করবে না? তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে না?

মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, যারা সিঙ্গেল মাদার তারা যদি কর্মজীবী হোন- তাকে কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি সন্তানের প্রতি যেমন দৃষ্টি দিতে হয়, তেমনি সংসারের দিকেও নজরদারি রাখতে হয়। তারপরও শুনতে হয় সমাজের নানা কটূক্তি। এর কারণ কুসংস্কার ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তাই পরিবর্তন করতে হবে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির। একা চলা সংগ্রামী নারী ও মায়েদের পাশে থাকতে হবে বন্ধুর মতো, তাদের প্রতি সমাজের নারী-পুরুষ সবার সংবেদনশীল আচরণ নিশ্চিত করা ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।


লেখক: সাংবাদিক

   

দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব আমাদের যোগাযোগ, সংযোগ এবং তথ্য ভাগ করার উপায়কে পরিবর্তন করেছে। যদিও তরুণ প্রজন্ম এটিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে, বয়স্ক ব্যক্তিদের ওপর এর প্রভাব ক্রমবর্ধমান আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায়গুলি দীর্ঘকাল ধরে আদর্শ ছিল, বয়স্ক ব্যক্তিদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার একীকরণ একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করে।

ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি বাংলাদেশের আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। স্মার্টফোনের বিস্তার এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ইন্টারনেট অ্যাক্সেস সমস্ত বয়সের মানুষকে এই প্ল্যাটফর্মগুলির সাথে যুক্ত হতে সক্ষম করেছে। যদিও শহুরে এলাকার যুবকরা দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়া গ্রহণ করেছে, এর প্রভাব ক্রমশ গ্রামীণ এবং বয়স্ক জনসংখ্যায় ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের বয়স্ক ব্যক্তিরা কীভাবে অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং তথ্য অ্যাক্সেস করে তার জন্য এই পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী ফলাফল রয়েছে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যতম উল্লেখযোগ্য সুবিধা হল সামাজিক সংযোগের সুযোগ। একটি সমাজে যেখানে ঐতিহ্যগত সামাজিক সমাবেশগুলি প্রায়শই পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায়ের চারপাশে আবর্তিত হয়, সোশ্যাল মিডিয়া ভৌগলিক সীমানার বাইরে একজনের সামাজিক নেটওয়ার্ককে প্রসারিত করতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিরা দীর্ঘদিনের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে পারে, বিদেশে আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে এবং তাদের আগ্রহগুলি ভাগ করে এমন অনলাইন সম্প্রদায়গুলিতে জড়িত হতে পারে।

বাংলাদেশের বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া একটি মূল্যবান তথ্যের উৎস। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সংবাদ আপডেট, স্বাস্থ্য টিপস এবং শিক্ষামূলক বিষয় পাওয়া যায়। এটি বয়স্ক ব্যক্তিদের বর্তমান ঘটনা, স্বাস্থ্য সমস্যা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকতে সক্ষম করে, তাদের সামগ্রিক জ্ঞান এবং সুস্থতা বাড়ায়।

একাকীত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হওয়া বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সাধারণ চ্যালেঞ্জ। সোশ্যাল মিডিয়া পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য একটি ভার্চুয়াল স্থান প্রদান করে এই অনুভূতিগুলি উপশম করতে সাহায্য করতে পারে। মেসেজিং অ্যাপ বা ভিডিও কলের মাধ্যমেই হোক না কেন, বয়স্ক লোকেরা সংযোগের অনুভূতি বজায় রাখতে পারে এমনকি যখন শারীরিক দূরত্ব তাদের প্রিয়জনদের থেকে আলাদা করে। বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, এবং সোশ্যাল মিডিয়া বয়স্ক ব্যক্তিদের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়। তারা তরুণ প্রজন্মের সাথে ঐতিহ্যবাহী রেসিপি, গল্প এবং রীতিনীতি শেয়ার করতে পারে, দেশের স্থায়ী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিশ্চিত করে ।

সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক সুবিধা সত্ত্বেও বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায়ই ডিজিটাল সাক্ষরতার সাথে সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এই প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহার জটিলতার মুখোমুখি হন, যা তাদেরকে হতাশা এবং বর্জনের দিকে পরিচালিত করে। এই ডিজিটাল যুগে প্রবীণদের আরও ক্ষমতায়নের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ডিজিটাল বিভাজন দূর করা অপরিহার্য।

সোশ্যাল মিডিয়াতে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য গোপনীয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ। অনেকেই জানেন না কিভাবে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষা করা যায় বা সম্ভাব্য ঝুঁকি যেমন অনলাইন স্ক্যাম এবং পরিচয় চুরি ঠেকানো যায়। এই উদ্বেগগুলি মোকাবিলা করার জন্য অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যধিক ব্যবহার কিছু বয়স্ক ব্যক্তির জন্য সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। অনলাইনে অত্যধিক সময় ব্যয় করা সামনাসামনি মিথস্ক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে পারে, সম্ভাব্য একাকীত্বকে হ্রাস করার পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়া বোঝার এবং ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রজন্মগত ব্যবধান থাকতে পারে। এই ব্যবধানটি বিভিন্ন অনলাইন যোগাযোগ এবং গোপনীয়তার প্রত্যাশার সাথে পরিবারের বয়স্ক এবং অল্পবয়সী সদস্যদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বন্দ্বের কারণও হতে পারে।

অন্য কারো মতো, বয়স্ক ব্যক্তিরা অনলাইন হয়রানি বা সাইবার বুলিং এর লক্ষ্য হতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশের বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রজন্মগত ব্যবধান পূরণের প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি সংস্থা, এনজিও এবং সম্প্রদায় সংস্থাগুলি বিশেষভাবে বয়স্কদের জন্য ডিজাইন করা ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রোগ্রামগুলি অফার করতে সহযোগিতা করতে পারে। এই প্রোগ্রামগুলির মৌলিক কম্পিউটার দক্ষতা, ইন্টারনেট নিরাপত্তা, এবং সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার কভার করা উচিত। আন্তঃপ্রজন্মীয় শিক্ষার অভিজ্ঞতাকে উৎসাহিত করা অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। পরিবারের অল্পবয়সী সদস্যরা তাদের প্রবীণদের সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল টুলস সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারে, একতা এবং পারস্পরিক সমর্থনের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে।

অনলাইন নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা কর্মশালার আয়োজন করার মাধ্যমে বয়স্ক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা দিতে পারে। এই কর্মশালাগুলিতে ফিশিং প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেওয়া, শক্তিশালী পাসওয়ার্ড সেট করা এবং গোপনীয়তা সেটিংস কার্যকরভাবে ব্যবহার করার মতো বিষয়গুলিকে কভার করা উচিত ।

বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য তৈরি অনলাইন সম্প্রদায়গুলি তাদের সমবয়সীদের সাথে জড়িত থাকার জন্য একটি নিরাপদ স্পেস এবং স্বাগত জানাতে পারে। এই সম্প্রদায়গুলি ভাগ করা আগ্রহের উপর ফোকাস করতে পারে, যেমন শখ, স্বাস্থ্য উদ্বেগ, বা সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ। সরকার বয়স্ক বয়স্কদের জন্য ব্যবহারকারী-বান্ধব ইন্টারফেস তৈরি করতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলিকে উৎসাহিত করে এবং কম আয়ের বয়স্কদের জন্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেসে ভর্তুকি দিয়ে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির প্রচার করতে পারে।

পরিবারগুলি সক্রিয়ভাবে বয়স্ক সদস্যদের তাদের অনলাইন কার্যকলাপে জড়িত করতে পারে, তাদের পারিবারিক চ্যাটে অংশগ্রহণ করতে এবং ভার্চুয়াল উদযাপন এবং সমাবেশের আনন্দ ভাগ করে নিতে উৎসাহিত করতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ, তথ্য অ্যাক্সেস এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের বয়স্ক ব্যক্তিদের জীবনে প্রজন্মগত বিভেদ ঘটানো এবং তাদের জীবনকে উন্নত করার ক্ষমতা সোশ্যাল মিডিয়ার রয়েছে।

ডিজিটাল সাক্ষরতা, গোপনীয়তার উদ্বেগ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকির মতো এই সুবিধাগুলি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করার জন্য তাদের চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবিলা করা অপরিহার্য । লক্ষ্যযুক্ত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে এবং আন্তঃপ্রজন্ম সমর্থনের সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে, বাংলাদেশ বয়স নির্বিশেষে তার সকল নাগরিকের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

;

অশ্লীলতা কোন শিল্প নয়



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

অশ্লীলতা হলো একটি পরিভাষা, ‘যা এমন সব শব্দ, চিত্র ও কার্যক্রমকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যেগুলো সমসাময়িক অধিকাংশ মানুষের যৌন নৈতিকতার দৃষ্টিতে অপরাধ বা দোষ হিসেবে বিবেচিত। এর মূল ইংরেজি শব্দ অবসিনিটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ অবসেনাস থেকে, যার অর্থ ‘দুষ্ট, ঘৃণিত, রুচিহীন’। অশ্লীলতা শব্দটি দীর্ঘ সময় ব্যাপী যৌনতা-বিষয়ক সংজ্ঞা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, তবু বর্তমান সময়ে ‘উস্কানিমূলক ঘৃণ্য কাজ’ অর্থেও শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। সাধারণভাবে এটি অভিশাপ অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে, অথবা এমন যে কোন কিছুকে বোঝাতে ব্যবহৃত হতে পারে যা নিষিদ্ধ, অশালীন, ঘৃণিত বা বিরক্তিকর।

অশ্লীলতাকে বলা হয়- জঘন্যতা, কদর্যতা, নির্লজ্জতা, অভদ্রতা ও যৌন বিষয়ক কুৎসিত আচরণ। অশ্লীলতার দ্বারা নির্লজ্জ ও কুরুচিপূর্ণ কথা ও কাজকে বোঝানো হয়। এছাড়া যেসব কুকর্ম ধৃষ্টতাসহকারে প্রকাশ্যে করা হয় সেগুলোকেও অশ্লীল বলা হয়।

দীর্ঘদিন যাবৎ অশ্লীলতাকে নানা উপমায় অভিহিত করে এবং নানা বক্তব্যের রং মেখে শিল্পের নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অশ্লীলতা ও শিল্পের ধারণা ও সংজ্ঞা সম্পূর্ণ আলাদা। অশ্লীলতাকে যতই পরিশীলিত করে বলা বা প্রকাশ করার চেষ্টা হোক না কেন সেটা সেটা আরও কদর্যভাবে ধরা দেয়।

বহু সংস্কৃতিতে অশ্লীল বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করে আইন প্রস্তুত করা হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বই ফ্যানি হিল বিভিন্ন সময়ে অশ্লীল বিচারের মুখোমুখি হয়েছে (যেমন, চিত্র: প্লেট একাদশ: স্নানের পার্টি; লা ব্রেকিয়েট)।

ব্যক্তি ও পারিবারিক সুস্থতার সাথে অশ্লীলতা মেলে না। কোন ব্যক্তি শারিরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হলে তার মাধ্যমে অশ্লীলতা প্রকাশ পেতে পারে।

সামাজিক সুস্থতার সাথেও অশ্লীলতা মেলে না। যে কোন সমাজে অস্থায়ী বিষয় হিসেবে ঢুকে কালক্রমে স্থায়ী রূপ লাভ করে থাকে। এর স্থায়ী হবার কারণ বহুমুখী। প্রথমত: সমাজস্থ মানুষের নৈতিকতায় শীথিলতার উপস্থিতি থাকলে অশ্লীল বিষয় পাত্তা পেয়ে যায়। সমাজে কোনরূ নৈতিকতার বালাই না থাকলে এটা আস্কারা পেয়ে পেয়ে বেড়ে চলে। যদি কোন দেশে সরকারি মিডিয়াতে অশ্লীল বিষয় প্রকাশিত হবার সুযোগ পায় তাহলে সেটা উদাহরণ হিসেবে সহজেই সেই দেশের জনমনে জায়গা করে নিতে পারে।

অশ্লীলতা একটি বড় অপরাধ। এটা সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে। সমাজকে কলুষিত করে। নিষ্পাপ ও কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের চরিত্র হনন করে যুবক-যুবতীদের কুকর্মের প্রতি প্রলুব্ধ করে।

আল্লাহ তায়ালা অশ্লীলতাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা।’(সূরা আল—আ’রাফ, আয়াত ৩৩)। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘প্রকাশ্য কিংবা গোপন অশ্লীল আচরণের নিকটেও যাবে না।’ (সূরা আল—আনআম, আয়াত ১৫১)।

অশ্লীল আচরণকারী সকলের নিকট ঘৃণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যার মধ্যে অশ্লীলতা আছে, তা তাকে ত্রুটিযুক্ত করে। আর যার মধ্যে লজ্জাশীলতা আছে, তা তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে।’ (তিরমিযি)।

‘আল কোরআনের আলোকে অশ্লীলতা হচ্ছে, অন্যের মন্দ কথা প্রকাশ করা, অনর্থক বিষয়ে কথা বলা, এমন অপবাদ ছড়ানো যে বিষয়ে নিজেদের জ্ঞান নেই, চারজন লোকের চাক্ষুষ সাক্ষী ব্যাতিত জেনার অপবাদ দেয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ইত্যাদি।

আল্লাহ বলেন, ‘হে মুহাম্মদ (স.) বলুন— আমার রব হারাম করেছেন যাবতীয় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা, পাপ কাজ, অসংগত বিরোধিতা, আল্লাহর সাথে এমন কিছু শরীক করা যার কোন প্রমাণ তিনি নাযিল করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা যা তোমরা জান না। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় রয়েছে আরো ২৩ টি আয়াত। শয়তান মানুষকে অশ্লীল কাজের প্ররোচণা দেয়- আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে মানুষ! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু আছে তা থেকে তোমরা আহার কর আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না।’ ব্যভিচার নিঃসন্দেহে অশ্লীলতা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।’

অশ্লীলতা মুখের ভাষায় নয়, আজকাল মুখের খাবারের অংশ হয়ে গেছে। মাদকের নিয়ন্ত্রণহীনতা, ব্যাপক ছড়াছড়ি এবং মাদকাসক্তি অশ্লীলতার প্রধান বাহন। একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যাক ।

ঢাকা থেকে বহুদূরে নওগাঁর নজিপুরে রাস্তার ধারে দাঁড়ালাম একটু চা খেতে। রাত হয়ে যাওয়ায় চায়ের দোকানের কর্মীরা বাড়ি চলে গেছে। আইসক্রীম ও ঠান্ডা পানীয় খোঁজ করতেই পাওয়া গেল। ওদের ফ্রিজে সবই আছে। কোকাকোলা, স্পাইট, লেমন ড্রিঙ্কস যার যেটা পছন্দ নিতে বলা হলো। হঠাৎ সেখানে এক কম বয়সী ভবঘুরে এসে হাজির। সে তোতলা করে কথা বলে তার জন্য এক বোতল স্পি..ট কিনে দিতে আরজি করলো। ভাবলাম সে হয়তো স্প্রাইট খেতে চাচ্ছে। তাই তাকে আমার হাতের স্প্রাইটের বোলটি এগিয়ে দিতে সে না করলো। বললো এটা নয়— স্পি..ট দে।

দোকানদার বুঝেছে তার মুখের ভাষা। সে ওতে দ্রুত সেখান থেকে তাড়ানোর জন্য দেরি না করে একটি অজানা বোতল এনে তাকে দিতেই সে খুব খুশি হয়ে নাচতে লাগলো। এজন বাস ড্রাইভার হঠাৎ এসে সেও একটি নিষিদ্ধ বোতল নিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে ঢক্ঢক্ করে গিলে নিল। মনে হলো দিন বদলের পালায় চালক ও ভবঘুরেদের মধ্যেও নিষিদ্ধ বোতল আমাদের খাদ্য ও পানীয়ের মধ্যে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। কিন্তু যদি মদ এভাবে তাদের পানীয় গ্রহণের চিন্তায় জায়গা করে নেয় তাহলে কি হবে?

শিল্পকে বলা হয়েছে- মনের খোরাক। কিন্তু ইউরাপে সেই শিল্পকে কিছু মানুষ কদর্য পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে। নিজ দেশের গালি পরদেশের বুলি বলে একটা প্রবাদবাক্য খুবই প্রচলিত। পাবলিক ন্যুইসেন্স তৈরি করে এমন অশ্লীলতাকে আজকাল আমাদের দেশ অবাধে প্রমোট করা হচ্ছে। বডি পেইন্টের নামে উলঙ্গ হয়ে ঘুড়ে বেড়ানো ইউরোপের অনেক দেশের সংস্কৃতির অংশ। কেউ বিষভাবে কেউভাবে কিস। বিভাজন সেখান থেকেই উদ্ভব।

অতীতে প্রাচীন গ্রীসে, যৌনতা এবং শরীরের সৌন্দর্যের ওপর উল্লেখযোগ্য জনকর্ম একটি মুখ্য অংশ ছিল। সক্রেটিস এবং প্লেটো প্রমিত বিচারধারা উন্নত করে এবং যে ভাবনা দেয় যে দেহের শুচি এবং শারীরিক সৌন্দর্য মানব আত্মার উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষের অশ্লীল কাজে আগ্রহ বা আকর্ষণের পিছনে কিছু কারণ রয়েছে। দুর্বল সামাজিক পরিবেশে মানুষের মনোবিকার তৈরি হয়। এত ব্যক্তিগত মূল্যবোধ পরিবর্তন হতে পারে এবং এটি অশ্লীল কাজে আগ্রহ এবং আকর্ষণের কারণ হতে পারে।

মিডিয়া, সিনেমা, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মতামত, আদর্শ এবং মনোবৃত্তি আকার নেয়। অসুস্থ মতামত বা স্থায়িত্ব বৃদ্ধির কারণে, মানুষের অশ্লীল কাজে আগ্রহ তৈরি হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা, দিনের কাজে স্ট্রেস এবং মোহ পরিস্থিতিতে অশ্লীল কাজে আগ্রহের কারণ হতে পারে।

অশ্লীলতা দূর করার জন্য সমাজ, শিক্ষা, পরিবার, সরকার এবং ব্যক্তিগত স্তরে প্রয়াস প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক জ্ঞান এবং উচ্চ মরাল মূল্যবোধ দেওয়া উচিত। শিক্ষা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক মরাল তৈরি করে এবং অশ্লীল আচরণ থেকে দূরে থাকার মাধ্যম তৈরি করে। মিডিয়াতে শৃংখলা এবং সঠিক তথ্যের মধ্যমে অশ্লীলতা সংবাদ থেকে দূরে থাকার উপায় প্রদান করতে হবে।

সরকার বা নীতি নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অশ্লীলতা প্রতিরোধে দক্ষ আইনগত ব্যবস্থা প্রয়োজন। সরকারীভাবে যৌন উপাদান ব্যবস্থাপনা এবং যৌন শিক্ষার মধ্যে সহযোগিতা দেয়া উচিত, যাতে অশ্লীলতা দূর করার প্রয়াসে সাহায্য করা যায়।

প্রতিটি মানুষের জন্য ব্যক্তিগত সতর্কতা, নৈতিক শক্তি অর্জন এবং স্বাস্থ্যগত জীবনে সেই নৈতিক অবস্থান ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের যৌন আদর্শ এবং মূল্যবোধ পরিবর্তনে প্রভাব বিস্তারকারী খারাপ উপাদানগুলোকে প্রতিরোধে সক্ষমতা থাকতে হবে। অশ্লীলতা দূর করতে সমাজের সচেতনতা, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে কোন সম্প্রদায়ের মানুষদের আন্তরিক সমর্থন আদায় করা প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধানে সবার ইতিবাচক সমর্থন থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

অশ্লীলতা যে কোন সমাজের জন্যই শিল্প নয় কারণ, এটি সামাজিক সুস্থতার সঙ্গে মিলে না। উদাহরণস্বরূপ, শিল্পের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যাগুলি সমাধান করার চেষ্টা করা যায়, মানবাদিক মূল্যের উন্নতি সাধন করা যায় এবং মানবিক সংবাদ প্রয়োগ করে একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা যায়। কিন্তু অশ্লীলতার মাধ্যমে মানুষ আদিম, বর্বর ও বেপরোয়া হয়ে উঠে। ফলে সমাজের প্রচলিত উন্নত শিল্প খুব দ্রুত ধ্বংস হতে পারে।

অশ্লীলতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা কোনো কারণেই যে কোন সমাজে প্রবেশ করতে পারে। মৌলিকভাবে এটি একটি নির্দিষ্ট শিল্প নয়, বরং এদিয়ে চরম উন্নাসিকতার ও একধরণের হঠকারীতা শুরু হয়ে অনৈতিক ফসল উৎপাদিত হতে থাকে। তাই সামাজিক স্তরে অস্থায়ী বা স্থায়ী ক্ষতি আসবার উপায় হিসেবে এর ক্ষতিকর প্রভাব আপামর জনগোষ্ঠীকে কষ্ট দেয় ও হতাশ করে। ফলত: দ্রুত সামাজিক ভাঙ্গন শুরু হয়ে সামাজিক অসততা তৈরি হয়। মানুষ অন্যায় কাজকে ঘৃণা করতে ভুলে যায় এবং অন্যায় ও গর্হিত কাজকে উপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে পছন্দ করে। তাই অশ্লীলতা এবং অসৎ শিল্পের প্রতি আমাদের সমাজে সম্পূর্ণ প্রতিবাদ থাকা উচিত, যাতে আমরা একটি সুস্থ এবং উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হতে পারি।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;

মিয়ানমার পরিস্থিতি ও প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ৫ সেপ্টেম্বর, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ৪৩তম আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে মিয়ানমার বিষয়ক পাঁচ দফা ঐকমত্য বাস্তবায়নের বিষয়ে আসিয়ান নেতারা পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করে। তাঁরা মিয়ানমারে ক্রমাগত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানায় এবং এই সংকট জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগ, মানবিক সংকট এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে তাদের মত ব্যক্ত করে। তারা একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়ে মিয়ানমারকে সহায়তা করার ব্যাপারে আসিয়ানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। মিয়ানমারের জনগণের প্রয়োজনে মানবিক সহায়তা প্রদান সহজতর করতে এবং সহিংসতা বন্ধে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংলাপ প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আস্থা এবং পার্থক্য দূর করা জরুরি। আসিয়ান সদস্যারা একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় পাঁচ দফা ঐকমত্য বজায় রেখে তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে হবে।

মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীকে এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সহিংসতা কমাতে এবং বেসামরিক, ঘরবাড়ি এবং জনসাধারণের উপর লক্ষ্যবস্তু হামলা বন্ধ করতে অনুরোধ জানাতে হবে। আসিয়ান চেয়ারের বিশেষ দূতের প্রতি আস্থা তৈরি করতে হবে। মানবিক সহায়তার নিরাপদ এবং কার্যকর বিতরণ চালিয়ে যেতে হবে এবং মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সহায়তায় নিশ্চিত করতে হবে যাতে মানবিক সহায়তা সশস্ত্র সংঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আইডিপিদের কাছে পৌঁছে। এজন্য প্রয়োজনে বহিরাগত অংশীদার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরও সমর্থন জোগাড় করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। মিয়ানমারের সংকট ও এর প্রভাব মোকাবিলায়, মাদক ও মানব পাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসিয়ান সদস্য দেশগুলির মধ্যে এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। সদস্য দেশ হওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমার, সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এই আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেয়নি।

মিয়ানমারের সরকারবিরোধী দলগুলো জান্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্য পুনর্ব্যক্ত করেছে। মিয়ানমারের সরকারবিরোধী আন্দোলনকে বিভক্ত করার জান্তার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টার পর সামরিক একনায়কতন্ত্র নির্মূল এবং একটি ফেডারেল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক লক্ষ্যের ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির দুটি প্রধান সরকারবিরোধী সংগঠন। দেশটির জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) এবং এর উপদেষ্টা সংস্থা

ন্যাশনাল ইউনিটি কনসালটেটিভ কাউন্সিল (এনইউসিসি) জানিয়েছে যে জান্তার বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি ফেডারেল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা। ফেডারেল ইউনিয়ন গঠন করার জন্য সামরিক একনায়কত্বকে নির্মূল করার পাশাপাশি দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর সম্পৃক্ততা এবং অভ্যুত্থানের প্রবণতাও মুছে ফেলতে হবে। ২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক সরকার উৎখাত করে একটি ফেডারেল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সরকারের নির্বাচিত আইন প্রণেতারা এবং তাদের জাতিগত মিত্রদের নিয়ে এনইউজি গঠন করেছিল। এর সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স গ্রুপের (পিডিএফ) নেটওয়ার্ক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কিছু জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের (ইএও) পাশাপাশি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের অনেক মানুষ এনইউজিকে তাদের বৈধ সরকার এবং পিডিএফ গ্রুপগুলিকে তাদের সেনাবাহিনী হিসাবে বিবেচনা করে। সরকার ও বিরোধী শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপের পথ প্রশস্ত করতে কিছু প্রাক্তন সামরিক জেনারেলের নেতৃত্বে একটি সামরিক-পরিচালিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে জানা যায়। এনইউজি তাদের বিবৃতিতে বলেছে যে একটি ফেডারেল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধ নির্ধারণ করেছে তা থেকে বিচ্যুত করে এমন যে কোনও রাজনৈতিক পদক্ষেপকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে। তারা কেবল বর্তমান সরকারই নয়, পূর্ববর্তী সরকারগুলোর দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধ এবং জাতিগত জাতীয়তার বিরুদ্ধে তাদের নৃশংসতা মোকাবিলায় অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়বিচার প্রক্রিয়াকে বাধ্যতামূলক ও বাস্তবায়ন করবে।

মিয়ানমারের অন্যতম প্রাচীন ও শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের (কেএনইউ) পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান পাদোহ সাও তাও নি জানায় যে, একনায়কতন্ত্রের পতনের ক্ষেত্রে এনইউজির অবস্থান কেএনইউর মতোই। কেএনইউ’র সশস্ত্র শাখা, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং কারেন ন্যাশনাল ডিফেন্স অর্গানাইজেশন এনইউজির পিডিএফের পাশাপাশি মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারের জান্তা দেশটির জনগণকে দমন করার জন্য ক্রমবর্ধমান সহিংস বিমান হামলা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক হামলায় অনেক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। সামরিক জান্তা অভ্যুত্থানের পর থেকে ৩ হাজার ৯০০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। জান্তা ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলো বেশ কয়েক ধাপে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও বিরোধীদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়ন চলছে, একই সঙ্গে বিভিন্ন ফ্রন্টে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ও প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার হচ্ছে।

জান্তা সরকার এই নৃশংসতার কথা অস্বীকার করে বলেছে যে, তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বৈধ অভিযান চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র জান্তা সরকারকে দুর্বল করতে মিয়ানমারের উপর নিষেধাজ্ঞার পরিধি আরও বাড়িয়েছে। মিয়ানমারের জেট ফুয়েল সেক্টরের সঙ্গে জড়িত বা সহায়তাকারী বিদেশি কোম্পানি ও ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে এই নিষেধাজ্ঞা অনুমোদন করা হয়েছে এবং এটি বাস্তবায়ন হলে এই সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে। মার্কিন সন্ত্রাসবাদ ও আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি ব্রায়ান নেলসন জানায় যে, নাগরিকদের নিপীড়ন করতে সক্ষম এমন সম্পদ থেকে জান্তা সরকারকে বঞ্চিত করার জন্য নতুন এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

অভ্যুত্থানের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের ওপর কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জুন মাসে মুদ্রা বিনিময়ের জন্য মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজসহ রাজস্ব উৎপাদনকারী রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জান্তা নিয়ন্ত্রিত অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান মিয়ানমা ফরেন ট্রেড ব্যাংক (এমএফটিবি) ও মিয়ানমা ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (এমআইসিবি) ১০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পত্তি সোনালী ব্যাংকে ছিল যা গত জুনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় জব্দের তালিকায় পড়ে। ডলারের বিপরীতে মিয়ানমারের মুদ্রা চ্যাটের মান কমে যাওয়ায় বর্তমানে মিয়ানমার চীনের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। এই ব্যাংক থেকে মিয়ানমার ইতিপূর্বে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছিল, চায়না এক্সিম ব্যাংক মিয়ানমারকে ৫% সুদে এই ঋণ দেয়।

এসব কারণে মিয়ানমার কিছুটা অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জব্দ করার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের মংদু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে চাল ও পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানা যায়। মিয়ানমার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায় যে, চাল, সয়াবিন, বাদাম ও পেঁয়াজসহ খাদ্যপণ্য শুধুমাত্র সিতওয়ের বাণিজ্যিক জোন দিয়েই রপ্তানি করা হবে। অনেক ইউরোপীয় কোম্পানি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারনে মিয়ানমার থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে ও নিচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে শুরু করে ভোক্তাপণ্য খাতে সৃষ্ট সে শূন্যতা পূরণ করছে এশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, তারা সেখানে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীন, থাইল্যান্ড ও জাপানের মতো দেশগুলোর সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকার কারণে এসব দেশের বাণিজ্যিক তৎপরতা বাড়ছে। বেসরকারি থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি-মিয়ানমারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে মিয়ানমার সরাসরি ৫.৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন করেছে যার মধ্যে হংকংসহ চীনের সম্পদের পরিমাণ ৫৫ শতাংশ বা ৩ বিলিয়ন ডলার। চলমান পরিস্থিতিতেও চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে।

চীনের ইউনিয়ন রিসোর্সেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইউনান এনার্জি ইনভেস্টমেন্ট দক্ষিণ মিয়ানমারে আইয়ারওয়াদি অঞ্চলে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। ২০২৭ সাল থেকে উচ্চক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে। এটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে চলবে এবং প্রায় ১.৪ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করবে। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ডকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়ে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণ প্রকল্প এবং চীনা কোম্পানিগুলোর নেতৃত্বে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রেল ও বন্দর নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। মিয়ানমারের তৈরি পোশাক শিল্পে চীনের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। মিয়ানমারে বর্তমানে তিন শতাধিক চীনা পোশাক শিল্প-কারখানা রয়েছে। মিয়ানমারে উৎপাদিত মোট পোশাকের প্রায় অর্ধেকই চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে উৎপাদন হয় । পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো মিয়ানমারে থেকে চলে যাওয়ার থাই কোম্পানিগুলোও এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসছে, তারা মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বিনিয়োগ করছে। থাই জ্বালানি কোম্পানিগুলো মিয়ানমারে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল ও গ্যাস গ্রুপ পিটিটি এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন, ফরাসি জ্বালানি সংস্থা মিয়ানমার থেকে চলে যাওয়ার তাদের দায়িত্ব গ্রহন করে। মিয়ানমার এই অঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইল্যান্ডের মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ১৫ শতাংশ সরবরাহ করে মিয়ানমার। থাই পানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সেখানে ব্যবসা বাড়াচ্ছে। স্থানীয় কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে তারা কারখানা স্থাপন করছে। থাই কোম্পানিগুলো নিজেদের দেশে মজুরি বাড়ার কারনে তারা স্বল্প মজুরির মিয়ানমারে বিনিয়োগের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। জাপান ও মিয়ানমার ঐতিহাসিকভাবেই মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ। জাপানের কিছু কোম্পানি মিয়ানমার থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিলেও এখনো অন্তত ৪০০ জাপানি প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মিৎসুবিশি করপোরেশন ও মিৎসুবিশি এস্টেট তাদের কার্যক্রম বাড়িয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে মিয়ানমারে টয়োটা মোটর তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকা স্বত্বেও এশীয় কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বৃদ্ধি মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলমান রাখতে সহায়তা করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করে। বাংলাদেশের মত থাইল্যান্ড ও চীন মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ। থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের উদ্বাস্তু সমস্যা, মাদক, মানবপাচার ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। থাইল্যান্ড নিজেদের এইসব সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ও আলোচনা চালায়। চীনের সঙ্গেও মিয়ানমারের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি দেশগুলো মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতেও তাদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করে লাভবান হচ্ছে। চলমান রোহিঙ্গা সংকট ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভাল। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ চাল, ডাল সহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আমদানি করতে পারে, এর পাশাপাশি বাংলাদেশের ঔষধের একটা বড় বাজার হতে পারে মিয়ানমার। বাংলাদেশের আটটি শিল্প গ্রুপ এখন বিলিয়ন ডলার ক্লাবে যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা তাদের অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হলে ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ তা থেকে যেভাবে লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশ তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উপকৃত হতে পারে।

;

উষ্ণায়নের বিপদ সম্পর্কে উদাসীনতা আর কতদিন?



ড. মাহফুজ পারভেজ
উষ্ণায়নের বিপদ সম্পর্কে উদাসীনতা আর কতদিন?

উষ্ণায়নের বিপদ সম্পর্কে উদাসীনতা আর কতদিন?

  • Font increase
  • Font Decrease

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা উষ্ণায়ন নিয়ে হরহামেশা কথা হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, "আর উদাসিতা নয়। এখনই কিছু করুন, নাহলে সংকটের ঝুঁকিতে থাকুন!" মধ্য শরতে উষ্ণ পরিবেশে গরমে নাকাল মানুষ বিলক্ষণ টের পাচ্ছেন সংকট ও ঝুঁকি।

ঝুঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে নগদে। বৈজ্ঞানিক তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৩ সালের গ্রীষ্মঋতু ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ। এই উষ্মতম প্রবণতার ধারা এখনও বিদ্যমান।শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১ আশ্বিন ১৪৩০ শরতকালের দ্বিতীয় ভাগের সূচনা হলেও বাতাস রুক্ষ। রোদ কড়া। গরমের দাপট অসহনীয়। মসৃণ পেলবতা-মাখা শারদীয় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার দেখাও পাওয়া যাচ্ছে না।

কারণ, চলতি বছর উষ্ণতম গ্রীষ্মকাল কাটাল পৃথিবী। এই তথ্য সামনে এনেছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ)।

তাদের দাবি, এই বছরের জুন থেকে আগস্ট মাস পৃথিবীর উষ্ণতম সময় ছিল। এটাই ছিল উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে উষ্ণ গ্রীষ্মকাল ও দক্ষিণ গোলার্ধে সবচেয়ে উষ্ণ শীতকাল।

নাসার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বিল নেলসন বলেছেন, ‘‘এই রেকর্ড তাপমাত্রা শুধুমাত্র একটি সংখ্যা নয়। এটি বাস্তবে বিশ্বের ভয়াবহ পরিণতির কথা জানাচ্ছে। আমেরিকা ও কানাডায় দাবানল এবং ইউরোপ ও এশিয়ায় বন্যা হয়েছে। চরম আবহাওয়া বিশ্ব জুড়ে জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করেছে।’’

জুন, জুলাই এবং আগস্ট মাসে নাসার রেকর্ডে আগের যে কোনও গ্রীষ্মের তুলনায় এ বার ০.২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা ছিল। আগস্টের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। এনওএএ-র প্রধান বিজ্ঞানী সারাহ ক্যাপনিকের আশঙ্কা, ‘‘মনে হচ্ছে, সামনের বছরগুলিতে এই সব রেকর্ড ভেঙে যাবে।’’

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিবেদন অনুযায়ী তাপমাত্রায় বিপজ্জনক বৃদ্ধি এড়াতে বিশ্বকে "দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে", এটাই বিজ্ঞানিদের সর্বসম্মত আর্জি। কিন্তু তাদের আবেদন কতটুকু গ্রাহ্য করা হচ্ছে? উষ্ণায়নের বিপদ থেকে উদাসীনতার মধ্যে চলছে সারা বিশ্ব।

নাসা'র আগেও জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ক আন্তঃ সরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহটি ১২ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। যেটা কিনা প্রাক-শিল্পযুগের মাত্রার থেকেও বেশি।

এতে বিপদ আসবে মারাত্মক আকারে। আবহাওয়া পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রূপ নেবে বিশেষ করে চরম দুর্ভিক্ষ, দাবানল, বন্যা সেইসঙ্গে লাখ লাখ মানুষের খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। বাড়বে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই ও পরিবেশ দূষণ। বসবাসের পরিস্থিতি ভরে যাবে নানাবিধ সঙ্কুলতায়।

তাপমাত্রার এই সীমা অতিক্রম এড়াতে, বিশ্বের উচিত, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত, সুদূরপ্রসারী ও নজিরবিহীন পরিবর্তন আনা। এসব হলো উষ্ণায়ন প্রতিরোধের একমাত্র পন্থা, যা বিজ্ঞানি ও গবেষকগণ বারবার উল্লেখ করছেন।

তারা বলেছেন, রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে জরুরি ভিত্তিতে নীতিগত পদক্ষেপ নিতে হবে উষ্ণায়ন প্রতিরোধের জন্য। যাবতীয় পরিকল্পনা, প্রকল্প ও কর্মসূচি নিতে হবে 'উষ্ণায়ন কমিয়ে রাখার' নীতিকে সামনে রেখে। এমনকি, ব্যক্তিগত পর্যায়েও বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, শুধু রাষ্ট্র বা সরকার নয়, প্রত্যেকের একক প্রচেষ্টা বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসে বড় ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদনের প্রধান সমন্বয়কারী লেখক অরোমার রেভির মতে, "সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান কাজে লাগিয়ে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। তাই বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে বড় ধরণের পদক্ষেপ নিতে নাগরিক এবং ভোক্তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।"

গবেষকরা মানুষের প্রাত্যহিক জীবন থেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন, যেগুলো মানুষ চাইলে চর্চা করে জলবায়ু পরিবর্তনে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারেন। এরমধ্যে প্রধান হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি ঘরেবাইরে সবদিকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে শিক্ষিত করে কাজে লাগানো।

সমাজতাত্ত্বিকগণ সবসময় বলেন যে, একটি টেকসই কমিউনিটি জীবনযাত্রা প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যদের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করা জরুরি। একটি অংশীদার-ভিত্তিক নেটওয়ার্ক গড়ে সমাজের মানুষ তা করতে পারে। এতে বিভিন্ন সম্পদ ও বিপদ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যায় এবং একযোগে লড়াই করার প্রচেষ্টা নেওয়া যায়। একটি সবুজ জীবনযাত্রার মান অর্জন করার জন্য সমাজে বসবাসকারী মানুষের এরূপ সংঘবদ্ধতা অপরিহার্য।

সবুজ জীবনযাত্রার লক্ষ্যে সমাজে বসবাসকারী মানুষ সংঘবদ্ধতার মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো যখন প্রতিদিন অনুশীলন করবে, তখন তারা বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের মতো বিপদ সহনশীল পর্যায়ে রাখতে পারবে এবং সমাজের টেকসই পরিবেশগত উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে: ১) সচেতন হয়ে, ২) গাছ না-কেটে, ৩) বৃক্ষরোপণ করে, ৪) নদী, পাহাড়, বিল, ঝিল তথা প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও অটুট রেখে, ৫) যান্ত্রিক জীবনকে কমিয়ে রেখে, ৬) জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করে, ৭) ব্যক্তিগত বৈদ্যুতিক সামগ্রী তথা মোটরগাড়ি, এসি, ফ্রিজ ইত্যাদির ব্যবহার কমিয়ে, ৮) শিল্প ও কলকারখানা বর্জ্য ও ধুয়া পরিমিত রেখে, ৯) কেমিকেলের ব্যবহার ও পোড়ানো ক্রমশ বন্ধ করে, ১০) প্রাকৃতিক জীবনের সান্নিধ্যে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ সৃজন, লালন ও চর্চার মাধ্যমে।

এইসব সচেতনতা ও তৎসংশ্লিষ্ট কার্যকলাপ অবশ্যই অচেতন বা উদাসীন থেকে প্রতিপালন করা আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের মধ্যে উষ্ণায়নের বিপদ সম্পর্কে উদাসীনতা আর কতদিন চলবে, এটাই এক বিপদজনক প্রশ্ন।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;