বন্ধুত্ব, সমর্থন ও সহযোগিতার এক অনন্য নজির



ড. দেলোয়ার হোসেন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা এক শক্তিশালী বন্ধন হতে দুই দেশকে সহায়তা করছে। উভয় দেশের ভাষা, সাহিত্য, উত্সব, খেলাধুলা, শিল্প, ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং ধর্ম সহ অনেকগুলো সাধারণ সাংস্কৃতিক অনুশীলনে ব্যাপক সামঞ্জস্য দেখা যায়। এই সাধারণ সাংস্কৃতিক অনুশীলনগুলি একটি অভিন্ন পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, যা উভয় জাতির একে অপরের ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধগুলি বোঝা এবং সম্মান প্রদান করাকে সহজ করে তুলেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও গভীর ও বিস্তৃত হয়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিহাসের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ১৯৭১ সালে, যখন ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার অবিচল সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়। এই সমর্থন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল এবং এটি দুই দেশের মধ্যে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের ভিত্তি গঠন করেছে।

বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কারিগর। তিনি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের জনগণকে তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ক্ষেত্রে একত্রিতকরনের সময়। তিনি বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং এর বাইরেও এর ব্যাপ্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতির উপর ভিত্তি করে তাঁর একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল যেখানে সংস্কৃতির বিচরন হবে মুক্ত ও নির্ভয়। জাতিসংঘে তার বাংলায় ভাষণ তার এক অনন্য নজির।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়টি ছিল দুই দেশের জন্য এক স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করে, যা তার নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রসারের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও দেশটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে এই সময়ে। বাংলাদেশ ও ভারত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে গিয়েছে বহুদূর। তবে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অগ্রগতির এই সময়কাল সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সংকট অস্থিতিশীলতা যা ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্কের পরিব্যপ্তি হয়েছিল বাধাগ্রস্ত।

১৯৯৬ সালে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিসহ বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শান্তি চুক্তি ও গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দিকে নতুন করে মনোনিবেশ করা হয়। ভারতীয় শিল্পী ও সংগীতশিল্পীরা বাংলাদেশ সফর শুরু করেন এবং ভারতে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখা দেয়। আবারও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সম্পর্কের ক্রমোন্নতির ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার মাত্রাও হ্রাস পায়।

দুদেশের সম্পর্কের ধারাবাহিক বিস্তৃত অংশীদারিত্ব এবং গভীর বোঝাপড়া প্রচারের ক্ষেত্রে তাই অন্যতম কারণ হয়েছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গতিপথের একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন এবং সম্পর্ককে একটি নতুন দিকে নিয়ে যাওয়া উচ্চতা যা বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে যার খাতসমূহ - নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সংযোগ, কূটনীতি, সীমান্ত সম্পর্ক, পানি বণ্টন, এবং সংস্কৃতি। একের পর এক সম্মেলন এবং বৈঠকের পর বৈঠকের পর, ২০০৯ সাল থেকে সম্পর্ককে তার বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসা এবং গভীর আস্থায় রূপান্তরিত করেছে সহযোগিতা। এর পেছনে হাত ছিল সংস্কৃতির, তা বলাই বাহুল্য।

তবে উভয় দেশের গভীর সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে ১৯৭১ সালের আগে থেকেই। মহান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ও ভারত বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাদের সাংস্কৃতিক সহযোগিতা জোরদারকরণের ক্ষেত্রে। একটি সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি ১৯৭২ সালের ৩০ ডিসেম্বর, দু'দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় উভয় দেশ সাংস্কৃতিক বিনিময় (সি ই পি) পরিচালনা করতে সম্মত হয়। শিল্প ও সংস্কৃতি, গণমাধ্যম, চলচ্চিত্র ও সংবাদমাধ্যম, যুব ক্রিয়াকলাপ, প্রত্নতত্ত্ব, জাদুঘর, গ্রন্থাগার এবং শিক্ষা কার্যক্রম এইসবই এই চুক্তির আওতাভুক্ত ছিল। ত্রয়োদশ অনুচ্ছেদের অধীনে চুক্তির উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি যৌথ কমিশন সিইপির অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য পর্যায়ক্রমে সভা করবে, এই মর্মেই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।

উল্লেখ্য এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানুষে মানুষে যোগাযোগ, বাণিজ্য, ব্যবসা এবং সংযোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছেন তিনি সবসময়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারত দুটি পৃথক সার্বভৌম দেশ হলেও সাংস্কৃতিক সংযোগ দ্বারা সংযুক্ত যা বিভিন্ন সরকারী উদ্যোগের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে থাকে।

ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (আইজিসিসি) ভারতীয় কাউন্সিলের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যা ১১ মার্চ ২০১০ উদ্বোধন করা হয়।  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সেমিনার, কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজনের মাধ্যমে উভয় দেশের বিশেষজ্ঞ এবং পেশাদারদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সাংস্কৃতিক সংযোগকে উত্সাহিত করে এই কেন্দ্র। উভয় দেশ শিক্ষার্থী বিনিময়েও অংশগ্রহণ করে জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা হিসাবে। এর জন্য রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম। ভারত সরকার ২০০ টি বৃত্তি প্রদান করে আইসিসিআর স্কলারশিপ স্কিমের মাধ্যমে প্রতি বছর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। উভয় দেশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা সংলাপ প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। প্রায় ৩০০০ ভারতীয় শিক্ষার্থী বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন।

উভয় দেশ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণকল্পে। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে বাংলাদেশের শততম জন্মদিন ও ৫০তম বার্ষিকী, প্রখ্যাত ভারতীয় সংগীতশিল্পী এ আর রহমান বাংলাদেশের গীতিকার জুলফিকার রাসেলের সুরে 'জয় বাংলা' গানটি গেয়েছেন। এটি নির্দেশ করে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যে গভীর বন্ধন। যোগাযোগ উন্নত করা হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণকে আরও কাছাকাছি আনার প্রচেষ্টায় এবং এটি একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার। গত এক দশকে, দুই দেশ বেশ কয়েকটি সংযোগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যেমন কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা এবং গুয়াহাটি-শিলং-ঢাকা বাস সার্ভিস চুক্তি এবং কলকাতা-খুলনা ট্রেন সার্ভিস ২০১৫ সালের চুক্তি। এছাড়াও বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, এবং ভারত (বিবিআইএন) চুক্তি সাক্ষর করেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুপারিশ করেছেন ১০ বছরের কম বয়সী সকল বাংলাদেশী নাগরিকের জন্য ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার এবং ভিসা-অন-অ্যারাইভাল যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। এছাড়া বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে “Liberation War Honour Award” যা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছে।

বিশ্ব ইতিহাসে দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত একই ব্যক্তির দ্বারা লেখা খুব বিরল। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে এটা সত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয় দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাকুর চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১-১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী এবং কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশের ৯০তম বার্ষিকী উভয় দেশ একত্রে সম্মানিত করে। এর বাইরেও কিছু নিয়ামক আছে যা বুঝতে সহায়তা করে দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতাকে।

সম্মোহনী নেতৃত্বের ইতিহাস

দুই দেশের সম্মোহনী নেতৃত্বের ইতিহাসও রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতায় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করেন। একইভাবে, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, অটল বিহারী বাজপায়ী সহ ভারতে অনেক সম্মোহনী নেতা ছিলেন। উভয় দেশের নেতৃত্ব তাদের সম্পর্ক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ইতিহাসের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা

বাংলাদেশ ও ভারতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যা খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দিকে মোটামুটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এই সময়ে, বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত অঞ্চলটি বিভিন্ন বৌদ্ধ এবং হিন্দু রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছিল। এই অঞ্চলটি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পরে ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে। এই সময়ে, এই অঞ্চলে হিন্দু ও ইসলামী সংস্কৃতির একটি অনন্য মিশ্রণ আবির্ভূত হয়েছিল, যা আধুনিক বাংলাদেশে ও ভারতে এখনও স্পষ্ট।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধের এক অনন্য নিয়ামক। এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে সংবাদ ও তথ্য সম্প্রচারে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। রেডিও স্টেশনটি ভারতের কলকাতায় থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। একদল বাঙালি সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত ছিল এই কেন্দ্রটি। এই কেন্দ্রের জন্য ভারত সরকারের সাহায্য ও এর মাধ্যমে বাংলাদেশীদের পরিচালিত কার্যক্রম নির্দেশ করে দুই দেশের মধ্যকার এক অটুট বন্ধনের।

অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বিমূর্ত মূল্যবোধ ও ভাষা বাংলা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বিমূর্ত মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠায় বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা, অহিংসা, শিক্ষা, সহিষ্ণুতা, লিঙ্গ সমতা, পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, দেশপ্রেম, পরিবেশবাদ এবং মানবাধিকার তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিফলিত গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধগুলি দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাস এবং বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে এবং ভবিষ্যতের সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করেছে। এটি অপরিহার্য যে উভয় দেশ এই মূল্যবোধগুলি প্রচার অব্যাহত রাখবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও বিকশিত হতে পারে এবং উভয় দেশই লাভবান হতে পারে।

এছাড়াও, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভারত সরকারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। ভারত বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সমর্থক এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য সহায়তা প্রদান করেছে। ভারতীয় শিল্পী এবং সংগীতশিল্পীরা নিয়মিত বাংলাদেশ সফর করেন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রোগ্রামরয়েছে যা উভয় দেশের শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ধারণা এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের অনুমতি দেয়। তাছাড়া, দুই দেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক বন্ধন হলো তাদের অভিন্ন ভাষা বাংলা। বাংলা বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের কিছু অংশের সরকারী ভাষা। এটি বিশ্বের পঞ্চম সর্বাধিক কথ্য ভাষা এবং এর সমৃদ্ধ সাহিত্য এবং কবিতার জন্য বেশ সুপ্রসিদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশসহ বেশ কয়েকজন শ্রেষ্ঠ লেখক ও কবি রচিত হয়েছে।

বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা, অহিংসার চর্চা ও শিক্ষা মূল্যায়ন

উভয়ই সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মের দিক থেকে বিস্তৃত দেশ। উভয় জাতির বৈচিত্র্যকে সম্মান করার এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া প্রচারের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই মূল্যবোধ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে উভয় দেশ একে অপরের সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সংস্কৃতিতে অহিংসা একটি অপরিহার্য অংশ। মহাত্মা গান্ধীর শিক্ষার মধ্যে এই মূল্যবোধের মূল রয়েছে, যিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার হাতিয়ার হিসেবে অহিংসাকে ব্যবহার করেছিলেন। এখনও দুই দেশ এই মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মূল বক্তব্য পর্যন্ত- “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।” দুই দেশেই শিক্ষা বেশ সমাদৃত এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। উভয় দেশই সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকার করে। দুই দেশের শিক্ষার্থীরা একে অপরের দেশে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছে বলেই শিক্ষা দুই দেশের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া প্রচারের একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

সহিষ্ণুতার দীর্ঘ ইতিহাস

বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই সহিষ্ণুতা একটি মৌলিক মূল্যবোধ। উভয় জাতির বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্মের মানুষের সাথে সহাবস্থানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। উভয় দেশই একে অপরের বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের প্রতি সহনশীলতা এবং শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে আরেকটি দিক, উভয় দেশই প্রধানত হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং শিখদের নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশ ও ভারতের হিন্দু মন্দির ও মুসলিম মসজিদ দুই দেশের অভিন্ন ধর্মীয় ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। তদুপরি, উভয় দেশ দুর্গা পূজা, ঈদ এবং দীপাবলির মতো ধর্মীয় উত্সব উদযাপনের ঐতিহ্য ভাগ করে নেয়।

নারীর ক্ষমতায়ন, পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষা উভয় দেশই নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। এই মূল্যবোধ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়, যেখানে উভয় দেশ নারী অধিকার প্রচার এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য মোকাবেলায় প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে আসছে একযোগে। পারিবারিক মূল্যবোধ বাংলাদেশী এবং ভারতীয় উভয় সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অঙ্গ। দুই দেশেই পারিবারিক মূল্যবোধের একটি শক্তিশালী চর্চা পরিলক্ষিত হয়। এই মূল্যবোধ দুই দেশের সংস্কৃতির মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। উভয়ই সামাজিক বৈষম্য মোকাবেলা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়, এক দেশের জনগণের প্রতি অন্য দেশের জনগণের ভ্রাতৃত্ব অনুভব করা, কেননা এর চর্চা যে তারা পায় একেবারে শৈশব থেকেই।

দেশপ্রেম, টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবাদ

বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই দেশপ্রেম একটি মৌলিক মূল্যবোধ। উভয় দেশেরই তাদের দেশের প্রতি গভীর ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা রয়েছে এবং জাতীয় পরিচয়ের একটি শক্তিশালী অনুভূতি রয়েছে। এই বোধ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, যেখানে উভয় দেশ তাদের দেশের স্বার্থ এবং মূল্যবোধপ্রচারের পাশাপাশি সম্মান দেখায় অপরের অনুভুতিরও। উভয় দেশেই পরিবেশবাদ গুরুত্ব পায় ব্যপক পরিসরে। সাথে যুক্ত আছে টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর প্রদান। এই বিষয়দুটি তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়, যেখানে উভয় দেশ পরিবেশগত সমস্যাগুলি মোকাবেলা এবং টেকসই উন্নয়নে একযোগে কাজ করে চলেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত। দুই দেশের মধ্যে একটি ইতিহাস, রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলন রয়েছে যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে এসেছে। তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, উভয় দেশ বছরের পর বছর ধরে একটি শক্তিশালী বন্ধন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধনের আরও কিছু নিয়ামক অন্বেষণ করা যায়, তাদের সম্পর্ককে রূপ দানকারী অভিন্নতাগুলকেও নেয়া হবে যাচাইয়ের ছাঁচের ভেতর দিয়ে।

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আরেকটি সাধারণ সাংস্কৃতিক অনুশীলন হ'ল তাদের রন্ধনপ্রণালী। উভয় দেশই মশলাদার এবং স্বাদযুক্ত খাবারের প্রতি ভালবাসা ভাগ করে নেয়, ভাত তাদের প্রধান খাবার। সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে বিরিয়ানি, সামোসা এবং ডাল। সরিষার তেল, জিরা এবং ধনিয়া সহ মশলার অনন্য ব্যবহারের জন্য বাঙালি রন্ধনপ্রণালী পরিচিত। উপরন্তু, উভয় দেশ চায়ের প্রতি ভালবাসাও দেখাতেও কুণ্ঠাবোধ করে না, তাই চা উভয় দেশে একটি জনপ্রিয় পানীয়।

সঙ্গীত ও নৃত্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্কের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাউল সঙ্গীত ও  যাত্রা এর মতো লোকসংগীত এবং নৃত্য উভয় দেশেই জনপ্রিয়। ভরতনাট্যম, কত্থক এবং মণিপুরী শাস্ত্রীয় নৃত্যও বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই জনপ্রিয়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার মতো অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দুই দেশ একযোগে কাজ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) এবং বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) মতো উদ্যোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারে একসাথে কাজ করে যাচ্ছে।

এ যেন এক অনন্য বন্ধন: বন্ধুত্ব, সমর্থন ও সহযোগিতা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধনের একটি অনন্য ও শক্তিশালী ইতিহাস রয়েছে যা প্রাচীন। এই সম্পর্কটি বন্ধুত্ব, সমর্থন, সহযোগিতা এবং গৌরবের মুহুর্তগুলির সাথে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এই সম্পর্ক একটি গভীর ও স্থায়ী বন্ধুত্বেরও প্রতীক, যা অভিন্ন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং এই অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রচারের জন্য পারস্পরিক অঙ্গীকারের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা। দুই দেশের সরকার এই সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এবং প্রয়োজনের সময় একে অপরের পাশে থেকেছে অবিচল সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে।

এছাড়াও তাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার অঙ্গীকারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দুই দেশ এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একসাথে কাজ করেছে। অবধারিতভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে হাজার বছরেরও বেশি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। উভয় দেশ অভিন্ন ইতিহাস, রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের উপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী বন্ধন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কূটনীতির শক্তির সাক্ষ্য বহন করে।

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার পর ভারতই প্রথম বৃহৎ রাষ্ট্র যেটি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সাথে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন একটি ইতিবাচক লক্ষণ, এবং আশা করা যায় যে উভয় দেশ তাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রচারের জন্য একসাথে কাজ চালিয়ে যাবে যেখানে সংস্কৃতি পালন করবে মুখ্য ভুমিকা, যা বলাই বাহুল্য। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী উত্তর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা কিংবা বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যকার বিরাজমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অনাস্থা ও বৈরিতা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর বন্ধন আরও সুদৃঢ় করবে এবং একসঙ্গে এগিয়ে চলার পথকে করবে আরও মসৃন ও সুন্দর।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী বিশেষজ্ঞ।

   

রক্তচক্ষু উপেক্ষার সাহস না থাকলে সাংবাদিকতা নয়



আশরাফুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের বরপুত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঘুমন্ত জনগণকে জাগাতে বহু যুগ আগে উচ্চারণ করেছিলেন এক চরম সত্য। তিনি বলেছিলেন, ‘Freedom is not given, it is taken’. ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক, স্থানিক বা বৈশ্বিক সব স্তরেই এটি আজ চরম সত্য হিসেবে বিশ্বের পরাধীন কোটি মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়।

৩ মে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস (World press freedom day) ঘিরে নানা আয়োজন চলে বিশ্বজুড়েই। প্রকাশিত হয়েছে অগণিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ। মুক্ত সাংবাদিকতার পথ প্রশস্ত করার দাবি নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের দেশে দেশে পথেও নামেন সাংবাদিকরা। যদিও সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, হত্যা-নির্যাতন, হুমকি-অপহরণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেমে নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি বছরই চলে এমন আয়োজন ও কর্মসূচি।

বলতে দ্বিধা নেই- ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাহীন কেউই সাংবাদিক নিপীড়নে পিছিয়ে নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোর দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই, তবে এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত বহু দেওয়া যাবে। ক্ষমতাসীনদের হাতে সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনাকে যদি বাধ্য হয়ে ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হিসবে মেনেও নিতে হয়, কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলের যারা সরকারকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে মুখে ফেনা তুলেন তাদের হাতেও যখন সাংবাদিকরা নিগৃহীত হন তখন তার কোন সদুত্তর মেলে না!

২০২৩ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের সমাবেশে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর বর্বর হামলার ঘটনা ঘটে। কিছু দিন চলে হইচই। সময়ের সঙ্গে সেইসব ঘটনা চাপা পড়ে যায় নতুন ঘটনার ঘনঘটায়। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলির যে কোন দায়বোধ নেই তা প্রমাণিত, তাই কোন তদন্তও হয় না-শাস্তি তো বহু দূরের ব্যাপার।

সংবাদকর্মীদের গায়ে আঘাতের ক্ষত না শুকাতেই ঘটনায় জড়িত রাজনৈতিক নেতারা প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে চা-আড্ডায় মেতে উঠেন। প্রহৃত সাংবাদিকদের কেউ কেউ হয়ত উঁকি দিয়ে সেই আড্ডা দেখে ফেলেন, কিন্তু প্রভাবশালীদের কাছে হার মেনে নীরব অভিমানে সরে আসেন তারা।

সবশেষ, এফডিসিতে চলচ্চিত্রের খল অভিনেতাদের নেতৃত্বে বিনোদন সাংবাদিকদের ওপর যে নারকীয় হামলার ঘটনা ঘটলো তার কি বিচার হলো? এক অভিনেতার বাসায় কতক সাংবাদিক নেতার গোপন মিটিংয়ে ঘটনার আপসরফার খবর শোনা গিয়েছিল। একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। বেশ কিছু দিন পেরিয়ে গেলেও কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না।

এবারের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের পরদিন শনিবার যখন এই দিবস নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভা হয় সেখানে ‘বিষয়’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ‘পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতাকে’; সাংবাদিক নিপীড়নের প্রসঙ্গ ছিল সেখানে গৌণ। শীর্ষ গণমাধ্যমের সম্পাদক থেকে শুরু করে স্বয়ং তথ্য প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের অতিথি। নির্যাতিত কমিউনিটির মাঝেই যদি এমন আপস করার প্রবৃত্তি আর ক্ষমতার আশীর্বাদ পাওয়ার ব্যাকুলতা থাকে তবে সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিকার দাবি করাই তো একটা ‘অপরাধ’!

শুরুতেই স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষের প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি যে কেবল মুক্তিকামী মানুষদের ‘স্বাধীনতা’ ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন তাই নয়, জাতীয় কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র বসু এক ভাষণে আমাদের মজ্জাগত দাসত্বের প্রবৃত্তিকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘বন্ধুগণ, আমরা দাস হয়ে জন্মেছি। আসুন সংকল্প করি, আমরা মরবার পূর্বে স্বাধীন হব।’

সত্যিকথা বলতে চারপাশে কেবল দাসত্ব আর তোষামোদি দেখে দেখে আমরা নির্বিকার হয়ে পড়েছি। সাংবাদিকতায় আমরা যাদের পরম্পরা বহন করছি, সেই গৌরবের ইতিহাস আমাদের সামান্যই প্রভাবিত করছে।

১৯২২ সালের ১১ আগস্ট। প্রাণভরে সত্য উচ্চারণের আকাঙ্খা নিয়ে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতার ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিট থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করছিলেন অর্ধ-সাপ্তাহিক ধুমকেতু। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা কতটা প্রাতঃস্মরণীয় আখ্যান সৃষ্টি করতে পারে ধুমকেতু তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সমকালীন সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সেই ঘটনা স্মরণ করা এই জন্য জরুরি যে, মহান এ পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আমাদের আরও কতটা সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন তারই খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে সেই ঘটনার আখ্যানে।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মালিকানাধীন সান্ধ্য-দৈনিক নবযুগের সম্পাদনায় নিজের চিন্তা ও স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা অনুভব করে তরুণ কবি নজরুল নিজেই ‘ধুমকেতু’ নামে নিজেই একটি সংবাদপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে চেয়ে পাঠান আশীর্বাদ বাণী। কবিগুরুও তাকে ফেরান না। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদবাণীসহ প্রকাশিত ধুমকেতু একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে কি অনন্য ভূমিকাই না রাখে! সাহিত্যিক ও কবিবন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘‘জাতির অচলায়তন মনকে অহির্নিশি এমন করে ধাক্কা মেরে চলে ‘ধুমকেতু’ যে রাজশক্তি প্রমাদ গণে।’’

পরাধীন দেশে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ ধুমকেতুর যে কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল তা যেন অঙ্গিস্ফূলিঙ্গ হয়ে রাজশক্তির সিংহাসনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কালজয়ী সব কবিতা আর জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল স্বাধীনতার কথাকেই প্রবল পরাক্রমে বলতে পেরেছিলেন ধুমকেতুতে।

ধুমকেতুর একটি সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল লেখেন, ‘..সর্বপ্রথম, ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়..ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটুলি বেঁধে সাগর-পাড়ে পাড়ি দিতে হবে…’-কি দুঃসাহসিক উচ্চারণ!

‘ধুমকেতুর কবি নজরুল’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক এক লেখায় পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এক ঘটনার বয়ান লিপিবদ্ধ করেন। তিনি যা তুলে ধরেন তার সারমর্ম হচ্ছে, একদিন ধুমকেতুর কার্যালয়ে গোপীনাথ নামে এক যুবক স্বভাবসুলভ উৎফুল্ল কবি নজরুলকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘দেশ পরাধীন, সাহেবদের অত্যাচার-জুলুম দিন দিন বেড়ে উঠছে। সেই জ্বালার মধ্যে আনন্দ জাগে কি করে?’

দেখা গেল কয়েক দিনের মধ্যে ওই যুবকটি কলকাতা চৌরঙ্গীর মোড়ে পিস্তল সহ হাতেনাতে ধরা পড়ল। যুবকটির নাম গোপীনাথ, অমর বিপ্লবী। অবশ্য ধরা পড়ার পূর্বে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট মনে করে ডে সাহেব নামে আরেক ইংরেজকে গুলি করে হত্যা করেন ওই বিপ্লবী। সেই ঘটনার ডামাঢোলের মধ্যেই নজরুল লিখে ফেললেন, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক এক জ্বালাময়ী কবিতা। ধুমকেতুতে তা প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে ব্রিটিশ পুলিশ। যে কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘‘আর কত কাল থাকবি বেটী/মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে/অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল/দেবশিশুদের মারছে চাবুক/বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা আসবি কবে সর্বানাশী’’

ফল যা হবার তাই হল, ধুমকেতু অফিসে হানা দিল পুলিশ। কুমিল্লা থেকে আটক হলেন নজরুল। আদালতে অকুতোভয় নজরুল যে জবানবন্দী দেন তা কেবল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেই নয়, মুক্ত সাংবাদিকতার ইতিহাসেও এক দৃষ্টান্ত। কবি দৃপ্তকণ্ঠে আদালতে উচ্চারণ করেন, ‘সত্য স্বয়ংপ্রকাশ তাকে কোন রক্ত আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না..’।

১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. সুইনহো ধুমকেতু সম্পাদক কবি নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। কারা অন্তরীণ নজরুল আলিপুর সেন্ট্রাল জেল হয়ে হুগলী কারাগারে স্থানান্তরিত হন। সেখানে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে দীর্ঘ ৩৯ দিন অনশন করে পরাধীন জাতিকে তিনি এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। এই সময়ে কবিগুরু তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করলেন তরুণ কবি নজরুলকে । কাজী নজরুল ইসলামের বীরোচিত এই আখ্যান যেমন বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা, তেমনি মুক্ত সাংবাদিকতার ঐতিহ্যিক পরম্পরাতেও এক চির অনুপ্রেরণা।

সমকালীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার অন্দরে প্রবেশ করে যদি আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে স্মরণ করি তবে লজ্জায় নত হতে হয়। সাংবাদিকতার মানস-মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! একটি স্বাধীন দেশে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমরা স্বাধীনতার জন্য রীতিমতো ‘কান্নাকাটি’ করছি। অথচ সত্য উচ্চারণে চিরকালই বাধা আসবে, গ্লানি থাকবে-তবু সত্যকে আলিঙ্গন করতে হবে-সাংবাদিকতায় এটিই বাস্তবতা। সেখানে সত্য উচ্চারণের পথ এতটা নিষ্কণ্টক হবে তা আমরা আশা করি কি করে? অতীত যেন আমাদের ভৎর্সনা করে বলছে, ‘বাধাকে, রক্তচক্ষুকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সাহস যদি না-ই থাকবে তবে এ পথ তোমার নয়’।

সমকালীন বাস্তবতাকে যদি বিবেচনায় আনি তবে যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা হল-ঔপনিবেশিক ও নব্য ঔপনিবেশিক দুঃশাসন থেকে মুক্ত হয়ে আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি সেখানেও আমাদের চ্যালেঞ্জ কম নয়। বলতে গেলে বর্তমানে রাজনীতি, প্রশাসন আর বণিকশ্রেণীর মাঝেও এক প্রবল ঔপনিবেশিক চরিত্র ধরা দিয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক ক্ষমতার সমীকরণও। এই সময়ের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রকে একসঙ্গে এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কতটা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত?

যা দৃশ্যমান হচ্ছে, দ্ব্যর্থহীনভাবে আত্মসমালোচনা করলে বলতেই হবে, বহুলাংশেই আপস করছি আমরা। সত্য উচ্চারণে কিছু কণ্ঠস্বর কখনো জ্বলে উঠে আবার স্থিমিত হয়ে যাচ্ছে কিংবা থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জ্বলে উঠা এই কণ্ঠস্বরগুলো যদি সংঘবদ্ধ করা যায় তবে অচলায়তন ভেঙে দেওয়া অসম্ভব নয়। আসুন আমরা সেই অভিপ্রায়কে বাস্তব করতে উদ্যত হই।

লেখক: বার্তা২৪.কম এর পরিকল্পনা সম্পাদক ও ইতিহাস গবেষক

;

বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!



কবির য়াহমদ
বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!

বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র তাপদাহ শেষে স্বস্তির বৃষ্টির দেখা পেয়েছে দেশ। দেশের অন্য এলাকাগুলোর অনেকগুলোতে এখনো তাপের তীব্র দহন থাকলেও সিলেট অঞ্চলের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এখানে প্রায়ই যেন নিয়ম করে বৃষ্টি নামছে, তাপমাত্রা পরিস্থিতিও মোটামুটি সহনীয়। দেশ যখন পুড়ছে তাপে, তখন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা বিশেষ করে সিলেটে দেখা দিয়েছে বন্যার আশঙ্কা।

বন্যার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় যে খেতের ধানের, এটা এবার কৃষকেরা ঘরে তুলতে শুরু করেছেন। অনেক এলাকার ধান কাটা শেষের পর্যায়ে। এখন চলছে ধান শুকানো আর গোলায় তোলার পালা। কেবল ধানই নয়, খড়ও শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে শুরু করেছেন তারা, কারণ এই খড় গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বোরো ধান দেশের খাদ্যচাহিদার অন্তত ৫৫ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। দেশের হাওরভুক্ত ৭টি জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরে এই বোরোর চাষ বেশি হয়ে থাকে। এই ধান অতিবৃষ্টি, বন্যা ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে দেশের খাদ্যচাহিদায় ঘাটতি পড়ে না। তাই এই ধান চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া, বিশেষ করে রোদের উপস্থিতি অতি জরুরি। ভালোয়-ভালোয় শেষ পর্যায় এটা শেষের পথে। তবে এখন উঁকি দিচ্ছে বন্যার শঙ্কা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর পরিচালিত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর নদীগুলোতে পানির স্তর দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা বেশ কয়েকটি অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানটি পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। এফএফডব্লিউসি বলছে, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রাক-বর্ষার পানিপ্রবাহ অতিক্রম করতে পারে।

পূর্বাভাসে যখন আকস্মিক বন্যার তথ্য, তখন ঠিক ঠিক সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধির তথ্য মিলছে। এরইমধ্যে সিলেটের দুটি নদ-নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ভারতে কয়েক দিন ধরে বৃষ্টির ফলে সিলেটের নদ-নদীগুলোয় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহস্পতিবারই দুটি পয়েন্টে নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পাউবোর তথ্যমতে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ মিটার। বর্ষা মৌসুমে বিপৎসীমা ১৩ দশমিক ৭৫ মিটার। শুক্রবার সকাল ৯ টা থেকে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে ১১. ০৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একইভাবে সারি নদের জৈন্তাপুরের সারিঘাট পয়েন্ট শুষ্ক মৌসুমে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৭০ মিটার। বর্ষা মৌসুমে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৩৫ মিটার। নদের ওই পয়েন্ট পানি ১১ দশমিক ৮৭ মিটারে অবস্থান করছিল, যা শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমার ওপরে। এ ছাড়া সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্ট এবং কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টেও পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। তবে ভারতের বৃষ্টিসৃষ্ট ঢল নামতে থাকলে অন্য পয়েন্টগুলোতে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

২০১৭ সালের মতো এবার দেশের বেরো খেত বন্যায় তলিয়ে যায়নি। কৃষকেরা আনন্দ লুট হয়নি বন্যায়। তবে ঘরে ফসল তোলার পর পরই বন্যার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে সেটা ভাবনার। এমনিতেই ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার স্মৃতি বিস্মৃত হতে পারেনি সিলেট অঞ্চলের মানুষ। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পাশাপাশি জানমাল, আর্থিক ও অবকাঠামোগত যে ক্ষতি সেটা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখনো সিলেটের অনেক অঞ্চলে দুই বছর আগের সেই বন্যার ক্ষতচিহ্ন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

২০২২ সালের বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল সিলেট নগরসহ জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা। দীর্ঘমেয়াদি ওই বন্যায় মাসখানেক সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয় মানুষকে। বন্যার পর দাবি ওঠেছিল সুরমা নদী খননের। এনিয়ে কিছু কাজ শুরু হলেও সেটা সমাপ্ত হয়নি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সিলেট নগরের কুশিঘাট থেকে বিশ্বনাথের দশগ্রাম পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়েছিল। এই ১৫ কিলোমিটারের খনন কাজ ১৫ মাসেও শেষ হয়নি। অথচ এই প্রকল্প চার মাসে সম্পন্ন করার কথা ছিল। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের কারণে খননকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য নির্ধারিত সময়ে খননকাজ শেষ করা যায়নি। প্লাস্টিক ও পলিথিনের কারণে মেশিনারি যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যায় বলে তাদের দাবি। শতভাগ সম্পন্ন করতে না পারলেও ৮০ ভাগ কাজ আগামী জুনের মধ্যে তারা সম্পন্ন করতে পারবেন বলেও তারা আশাবাদী।

গত বন্যার পর সুরমা নদীর নাব্যতা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, দাবি ওঠেছে নদী খননের। কেবল বন্যার ওই সময়ই নয়, সামান্য বৃষ্টিতেও সিলেট নগর ডুবে যাচ্ছে। খাল-ছড়াগুলো দখলে-দূষণে সংকীর্ণ, এবং অনেকগুলো ‘নাই’ হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টি নগরে সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা। তার ওপর আছে সিটি করপোরেশনের নানা উন্নয়নমূলক কাজ, যেগুলো পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে কোথাও কোথাও সৃষ্টি করছে বাধার। শুষ্ক মৌসুমের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পানির গতিপ্রবাহ নিয়ে ভাবা হয় সামান্যই, ফলে গ্রীষ্মের প্রকল্প বর্ষা পর্যন্ত দীর্ঘায়ত হয়ে যাওয়ার কারণে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে দেখা দিয়েছে প্রতিবন্ধকতা। আর শেষ পর্যন্ত তাই ভোগান্তির গন্তব্য মানুষ। এছাড়াও আছে হাওর এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও ভৌত অবকাঠামো, যেগুলো হাওরের বিশাল জলরাশির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘তিস্তা নদী অববাহিকা: সংকট উত্তরণ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সপ্তম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও এনভায়রনমেন্ট গভার্নড ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজেশনের পরিচালক জয়ন্ত বসু ‘জিওপলিটিকস অফ রিভার তিস্তা অ্যান্ড নিড টু পারসু নেচারবেইজড নেগোশিয়েটেড অ্যাপ্রোচ (এনবিএনএ)’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার আন্তদেশীয় নদীর সমস্যা আঞ্চলিক ভূরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এই অঞ্চলের সব দেশ প্রধানত কৃষি, জলবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য কারণে নদীর ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল। আর তাই এ অঞ্চলের অসম রাজনৈতিক ক্ষমতার উপস্থিতি; আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আন্তদেশীয় নদীর পানি ব্যবহারে সমন্বিত মডেল বাস্তবায়নে আন্তদেশীয় স্টেকহোল্ডার পর্যায়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে জয়ন্ত বসু বলেছিলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো সামগ্রিক অববাহিকাভিত্তিক পদ্ধতি নেই। যদিও উভয় দেশের মধ্য দিয়ে ৫৪টি আন্তসীমান্ত নদী বয়ে গেছে। এ জন্য একটি সামগ্রিক অববাহিকাভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।’ গবেষকদের এই সব গবেষণাপত্র নিয়ে আলোচনাই হয় কেবল, এসব নিয়ে কাজ হয় কমই। ফলে সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই থেকে যাচ্ছে। এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে ভূ-রাজনীতি, মনে করা হচ্ছে এখানে আমরা পিছিয়ে আছি অনেকটাই।

এখন যেখানে আমরা সেখানে একটা বন্যার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এটা নিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সতর্কতা দিয়েছে। এই সতর্কতা শুরুতে কৃষক পর্যায়ে ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, বেরো ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলেই যেন কাটা শুরু হয়। কৃষকেরা সে কাজটিই করেছেন। কৃষকের নিয়মিত কাজ শেষে এখন সরকার-প্রশাসনের দরকার বন্যা মোকাবেলা বিষয়ক প্রস্তুতি গ্রহণ করা। ভারতে বৃষ্টি কমলে দেশে বন্যা হবে না—স্রেফ প্রকৃতির ওপর নির্ভর না করে বন্যা হলে কী প্রক্রিয়ায় মানুষকে বাঁচানো যায় সে দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। হাতে আছে সময়, এই সময়টুকুর সঠিক ব্যবহার করাই হবে সময়ের কাজ।

;

শিল্প-সাহিত্যে সম্মাননা: ক্ষমতার আনুগত্যই ‘মানদণ্ড’ নয়



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বয়সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের চেয়েও ৬ বছরের বড় ছিলেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস। রাজ আনুকূল্য পরিত্যাগ করে রাজার বিরুদ্ধে কলম ধরার অপরাধে নির্বাসিত হয়েছিলেন কবি। ‘মগের মুলুক’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নির্বাসিত গোবিন্দচন্দ্র দাসের জীবন কেটেছে নিদারুণ অর্থকষ্টে। বাংলা সাহিত্যকে ১০টি অমূল্য কাব্যগ্রন্থ উপহার দিলেও প্রতিভাধর এই কবির যাপিত জীবনের দুর্দশা ছিল প্রকট। শেষ জীবনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মতো মহৎপ্রাণ কিছু মানুষেরা অসুস্থ কবিকে অর্থসহায়তা দিয়ে উদাসীন সমাজের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে ওষ্ঠাগত কবি তাঁর কবিতায় জীবদ্দশায় স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সমাজ-রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমি মরলে তোমরা আমার চিতায় দেবে মঠ?’

শিল্প-সাহিত্যের স্রষ্টাদের এই আক্ষেপ যুগে যুগে ধ্বনিত হয়ে আসছে। সবশেষ ঘটনাটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুণী শিল্পী সাদী মহম্মদের আত্মহনন। এসকল ঘটনা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে নীরবে চপেটাঘাত করে যায়। জীবদ্দশায় গুণীর কদর করতে বরাবরই ব্যর্থ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। বলা হয়ে থাকে যে সমাজে গুণীর কদর নেই, সেই সমাজে গুণীও জন্মায় না। সময়ের স্রোতে আমরা শ্রদ্ধায় নত হতে পারি, এমন গুণীজনদের ক্রমেই হারিয়ে ফেলছি। সেই শূন্যস্থান পূরণে আমাদের যোগ্য মানুষের অভাব প্রতিনিয়তই অনুভূত হচ্ছে।

ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধের সঙ্গে আপস না করা মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন কমে আসছে। বিপরীতে জায়গা করে নিচ্ছে স্তাবক ও অযোগ্য মানুষেরা। এতে করে সমাজে যে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে তা আমাদের ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে বিপন্ন করে তুলছে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদক ও পুরস্কার প্রদান নিয়ে মানুষের মনে যে নানা প্রশ্ন উঠতে দেখছি তা এই শূন্যতারই কার্যকারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা। যেখানে নীরবে নিভৃতে বহু গুণীজন স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনা নিয়ে কাটান সেখানে পদক-পুরস্কার নিয়ে সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা গুণীদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

এমন বাস্তবতার মাঝেই গত ৩০ এপ্রিল বাংলা একাডেমি ঘোষণা করল রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার-২০২৪। যে তিন গুণীকে এবার এই পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে তাঁদের রবীন্দ্র ও নজরুল সাধনা প্রশ্নাতীত। বাঙালি জাতির আত্মঅহংকারের প্রতীক এই দুই মহান কবির নামে প্রবর্তিত এ পুরস্কার নিয়ে এবার একাডেমি সংশ্লিষ্টরা তাদের বিচার-বিবেচনাকে প্রশ্নের উর্ধ্বে নিয়ে যেতে পেরেছেন, এটা আশাবাদের সঞ্চার করেছে।

বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। বহু গবেষণাগ্রন্থের লেখক ভীষ্মদেব চৌধুরীর রবীন্দ্র গবেষণায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে -দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫) ও প্রভাতসূর্য : রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা রবীন্দ্র অন্তঃপ্রাণ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকে তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতেও ভূমিকা রাখছেন।

বাঙালির হৃদয়স্পন্দন ও চেতনার বাতিঘর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। নির্বাক কবিকে ঘিরে সেই সময়কার গবেষক ও সাহিত্যিকরা নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং বিষয়-বৈচিত্রে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। কবির ঘনিষ্ঠজনরা তখনও জীবিত, রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে যা কিছু প্রয়োজন-তাও দুর্লভ ছিল না। তথ্যগত প্রাপ্যতার সঙ্গে গভীর নিষ্ঠা ও ভক্তি নিয়ে অনেক শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক কবিকে নানাভাবে মূল্যায়নের প্রয়াস পেয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের দুই যশস্বী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা দম্পতি আত্মনিয়োগ করেন নজরুল গবেষণায়। নজরুল গবেষণায় এই গুণী দুই গবেষকের গ্রন্থসংখ্যা বিপুল না হলেও কবিকে নিয়ে যে কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থ তাঁরা রচনা করেন তা এদেশে নজরুলচর্চায় বিশেষ ভাবে ভূমিকা রাখে। সে কারণে তাঁরা পথিকৃৎ গবেষক হিসেবেও নন্দিত হন।

মোহাম্মদ আবদুল কাইউম নজরুল গবেষণায় উপহার দেন ‘নানা প্রসঙ্গে নজরুল’ ও ‘নজরুল সংবর্ধনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ। অন্যদিকে রাজিয়া সুলতানার গবেষণা গ্রন্থ ‘কথাশিল্পী নজরুল’ ও ‘নজরুল-অন্বেষা’। প্রকাশিত এসব গ্রন্থসম্ভারের বাইরে এই দুই নজরুল গবেষক তাদের দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে নিষ্ঠার সঙ্গে অসংখ্য নজরুল গবেষক ও অনুরাগী সৃষ্টি করেছেন; যাঁরা পরবর্তী জীবনে বাংলাদেশে নজরুল চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা-দু’জনই কবি নজরুল ইনস্টিটিউট প্রবর্তিত ‘নজরুল পুরস্কার’ লাভ করেছেন। ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ১৯৯১ সালে লাভ করেছিলেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।

২০২০ সালের ১২ জুন প্রয়াত হন ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। স্বামী মৃত্যুর পর ড. রাজিয়া সুলতানা প্রবাসেই কাটাচ্ছেন সন্তানদের সঙ্গে। গেল ৩০ এপ্রিল ২০২৪ বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র ও নজরুল গবেষণায় ৩ জনকে একাডেমি পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করে। নজরুল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ড. রাজিয়া সুলতানা।

স্বজনদের থেকে জানা গেছে, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত ড. রাজিয়া সুলতানা। পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর জেনেছেন দূরপ্রবাসে বসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি নাকি এই খবরে ভীষণ আনন্দিত! তাঁর চোখেমুখে পরিতৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, জানিয়েছেন তাঁর মেয়েরা। এই খবর জেনে আমরা নিশ্চয়ই আনন্দিত এজন্য যে, একজন গুণী গবেষক জীবন-সায়াহ্নে হলেও তাঁর গবেষণার জন্য রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হতে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির সংশ্লিষ্টরা এজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু আমরা এও প্রত্যাশা করি যে, একজন গুণী গবেষককে তাঁর গবেষণার স্বীকৃতি পেতে বার্ধক্য পর্যন্ত কেন অপেক্ষায় থাকতে হবে? একটি পুরস্কারকে উদযাপন করার মতো শারীরিক ও মানসিক স্ফূর্তি থাকতেই কেন আমরা তাদের পুরস্কৃত করতে ব্যর্থ হচ্ছি-সেই প্রশ্নও আজ বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে।

আমরা জানি, কোন স্বীকৃতির আকাঙ্খা ব্যতিরেকেই এখনও বহু গুণীজন নিভৃতে তাদের জ্ঞান ও শিল্পসাধনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। কিন্তু অযোগ্যদের সম্মানিত করে রাষ্ট্র যখন নিজেই অসম্মানিত হয় তখন অনেকের মতো সেইসব গুণীজনরাও নিশ্চয়ই ব্যথিত হন। এবং এই বেদনার ভার সইতে না পেরে সাদী মহম্মদের মতো প্রতিথযশা সাধকশিল্পীকেও নীরব অভিমানে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাঁরা চালনা করেন তাদের মনে রাখা উচিত, পুরস্কারের মনোনয়নে কেবলমাত্র ক্ষমতার আনুগত্যই একমাত্র মানদণ্ড নয়।

লেখনির মুখে সত্য উচ্চারণে যে লেখকগণ নিঃশঙ্কচিত্ত হতে পেরেছেন ইতিহাসে তাদেরই ঠাঁই হয়েছে। রাজ আনুকূল্যে ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ববর্তী শাসকদের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ী হাতে, সেই প্রামাণ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন’ পরবর্তী যুগে একটি ফরমায়েশি গ্রন্থরূপে সকলের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসের নির্মোহ মূল্যায়নে সেই তথাকথিত ঐতিহাসিক স্বীয় মর্যাদাকে ধরে রাখতে পারেননি। আমরা যদি এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্মরণ করে সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে সমুন্নত রাখতে পারি, প্রকৃত গুণীদের যথাসময়ে মান দিতে পারি, তবেই দেশে অনেক জ্ঞানীর জন্ম হবে এবং আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে পারব। কবি গোবিন্দ দাসের মতো ‘মৃত্যুর পর চিতায় মঠ দেওয়া’ সমাজের চরিত্রকে বদলাতে পারব।

;

মে দিবস: শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়নের প্রতীক



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতি বছর ১ মে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়ন উদযাপন করা হয়। ২০২৪ সালে আমরা ১৩৮তম মহান মে দিবস উদযাপন করেছি। এই দিনটি শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের সময় শ্রমিকেরা অমানবিক পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে বাধ্য হতেন। তাদের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র এবং কাজের সময়সীমা দেওয়া হতো না। এই অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করেন।

১৮৮৬ সালের ১ মে, আমেরিকার শিকাগোতে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবিতে শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করেন। এই ধর্মঘট পরবর্তীতে সহিংসতায় পরিণত হয়; যার ফলে অনেক শ্রমিক নিহত ও আহত হন। এই ঘটনার স্মরণে ১ মে বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়।

বাংলাদেশেও মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার ও সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, বাংলাদেশের শ্রমিকেরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য অসংখ্য আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন।

বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। কিন্তু দেশটি চরম বৈষম্যের সম্মুখীন। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান, শ্রমিকদের শোষণ, কর্মসংস্থানের অভাব, ন্যূনতম মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব- এই সব সমস্যা শ্রমিক শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

এই বৈষম্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে, মে দিবসের তাৎপর্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দিনটি শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য সুবিধা, ছুটির অধিকার- এই সব দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকেরা অনেকদিন ধরেই সংগ্রাম করে আসছেন।

চরম বৈষম্যযুক্ত সমাজে, শ্রমিকদের লড়াই এখনো চলমান। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শ্রম আইন বাস্তবায়ন, শিশুশ্রম বন্ধ করা- এই সব দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কার্যকর শ্রম আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি- এই সব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে পারে।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য সমাজের সব স্তরের মানুষের ভূমিকা রয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করা উচিত।

শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো উচিত। এটি শ্রমিকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে জানতে এবং তা আদায়ের জন্য পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে। শ্রমিকদের সংগঠনকে সমর্থন করা উচিত, যাতে তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আরো শক্তিশালী হতে পারে।

‘মে দিবস’ শুধু একটি ছুটির দিন নয়, বরং এটি শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘদিনের লড়াই ও আত্মত্যাগের প্রতীক। চরম বৈষম্যযুক্ত সমাজে, মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও সংহতির বার্তা প্রচার করে।

এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য এখনো অনেক কিছু করার আছে। সরকার, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক ও সমাজের সব স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

মে দিবস শুধু অতীতের স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিও বহন করে। এই দিন আমরা শ্রমিকদের অবদান ও সংগ্রামকে স্মরণ করি। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রত্যয় জানাই এবং আরো ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাই।

বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। শ্রমিকেরা তাদের চাকরি, মজুরি ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং কর্পোরেট লোভের ফলে শ্রমিক শ্রেণির ওপর নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে।

শ্রমিকদের ঐক্য হলো তাদের অধিকার আদায়ের মূলশক্তি। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আন্দোলনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের দাবি আদায় করতে পারবে। শ্রমিকদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা অপরিহার্য।

শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। কার্যকর শ্রম আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, পেনশন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত।

শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন করা তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত। এছাড়াও শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

জলবায়ু পরিবর্তন শ্রমিক শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিবেশবান্ধব শিল্প ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শ্রমিকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের এই নতুন সুযোগ গ্রহণে সহায়তা করা উচিত।

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও কর্পোরেট লোভ শ্রমিক শ্রেণির জন্য একটি বড় হুমকি। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও কর্পোরেট লোভের বিরুদ্ধে লড়াই করে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব।

১৩৮তম মে দিবস শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়নের প্রতীক। এই দিনটি শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় এবং জীবন-যাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।

মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও সংগ্রামের দিন। এই দিন আমরা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তাদের অবদানকে স্মরণ করি। শ্রমিকদের ন্যায্য কর্মপরিবেশ, মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যেতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করে আমরা একটি আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

এই মে দিবসকে সামনে রেখে আসুন, আমরা শ্রমিকদের ঐক্য ও সংগ্রামের মন্ত্র ধারণ করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি!

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

;