চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলতে পারে



ড. আতিউর রহমান
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলতে পারে

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলতে পারে

  • Font increase
  • Font Decrease

দীর্ঘ স্থিতিশীল সময় পার করে ফের আমরা একটি অস্থিতিশীল সময়ে প্রবেশ করলাম। অস্বীকার করার উপায় নেই যে মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বাড়ন্ত ছিল।এর প্রভাবে বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি জনজীবনে একধরণের দুর্ভাবনা তৈরি করেছে। অনানুষ্ঠানিক কাজে যুক্ত এবং নির্দিষ্ট কম আয়ের মানুষের জীবনচলা বেশ কষ্টের মধ্যেই ছিল।এরই মধ্যে গত ২৮ অক্টোবর (২০২৩) বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির ফলে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হলো তার কারণে সরবরাবহ চেইনে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ গ্রামগঞ্জ থেকে যেসমস্ত সবজি বা অন্যান্য পণ্য ঢাকা শহরে আসবে বা ঢাকা শহর থেকে সেখানে যাবে সেগুলোর সাপ্লাই সাইড বিঘ্নিত হবে।

আমরা জানি, এই সাপ্লাই সাইড যখন বিঘ্নিত হয় তখন সরবরাহ কমে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এমনিতেই ঢিলেঢালা মুদ্রানীতির প্রেক্ষাপটে টাকার পরিমাণ বাজারে বেশি আছে। তাই চাহিদার চাপ তো আছেই।এই দুই-এ মিলে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছি আমরা। ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি সবজি-আলু-চালের মতো নিত্যপণ্যগুলোর দাম ক্রমেই বাড়ছে। সুতরাং হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচির জেরে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে আরও যেটি ঘটে তা হচ্ছে, মানুষের মনে এক ধরণের আস্থাহীনতা তৈরি হয়, যার কারণে বিনিয়োগ কমে। এ রকম অস্থির সময়ে মানুষ বিনিয়োগ করতে চায় না। নতুন করে ব্যবসা-বাণিজ্য হাতে নিয়ে নতুন ঝুঁকি নিতে চায় না।

রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু মানুষকে নিয়ে কাজ করে তাদের কিন্তু এটা খেয়াল করা উচিত, যে তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষের আয় রোজগার কমে যাচ্ছে কি না।বিশেষ করে নগরে অনানুষ্ঠানিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাঁরা যদি রাস্তায় দাঁড়াতেই না পারে, তারা যদি ভ্যান নিয়ে চলাফেরা না করতে পারে, পণ্য যদি ট্রাকে করে না আসতে পারে, তাহলে এর প্রভাবে তো মানুষের আয় রোজগার কমবেই। সেইসঙ্গে অবধারিত ভাবেই বাড়বে জিনিসপত্রের দাম। সব মিলে একটি ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা যে তৈরি হবে তা বলার অপেক্ষাই রাখে না।

যারা অনানুষ্ঠানিক কাজ করেন, সেই শ্রেণিটি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবেই। আর যাদের আয় মোটামুটি ফিক্সড তারাও ক্ষতির মুখে পড়বে।এই স্বল্প আয়ের মানুষদের আয় না বাড়লেও জিসিসপত্রের দাম তো বাড়ছে। কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষদের আয় তো আমরা বাড়াতে পারছি না। অথচ তাদের বেশি দামে জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছে। বিশেষ করে তাদের কাছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে।রাজনৈতিক অস্থিরতায় এই খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।ইতিমধ্যে ১২% এর বেশি খাদ্য মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছি আমরা। আমার ধারণা ২৮ অক্টোবর থেকে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলো এতে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে। এর মধ্যে খাদ্যের দামই বেশি বাড়বে বলে আমার কাছে  মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলব, সরকারের যে সমর্থন আছে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পদক্ষেপ হিসেবে, টিসিবি মাধ্যমে খাদ্য বিক্রি করে জনদূর্ভোগ কমানো। অনুরোধ থাকবে, টিসিবির খাদ্যপণ্য বিক্রির এই পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারাও তাদের কারখানায় কর্মরত শ্রমজীবি মানুষের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে আরেকটু সদয় হতে পারেন।এর ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বে। কিছুটা হলেও সাধারণের স্বস্তি নিশ্চিত করা যাবে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে, যতো ধরণের আন্দোলন তারা করতে চায় তারা করুক, সমাবেশ করতে চায় তারা করুক, কিন্তু রাস্তঘাট বন্ধ করা হবে না-এই অঙ্গীকারটি তাদের করা উচিত। হরতাল-অবরোধের যে সংস্কৃতি পুরনায় চালুর চেষ্টা চলছে, এটা তো আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। এটা আবার চালু করাতে যে সমস্যা সৃষ্টি হলো, এর প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক ভাবে জনজীবনের সব কিছুর ওপরে পড়বে বলে ধরেই নেওয়া যায়। শিক্ষাখাতেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই সময়টায় স্কুলে স্কুলে পরীক্ষা হবার কথা। শিক্ষার্থীদের কী হবে?পরিস্থিতি এমন চললে, যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছেন, তারা সময় মতো টাকা ফেরত দিতে পারবেন না। এতে আরও নতুন সংকট তৈরি হবে।

আমরা জানি, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির পর দেশের অর্থনীতিতে এখন বড় সংকট হচ্ছে ডলার সংকট। এই সময়টাতে আমরা আশা করছিলাম, সংকট কাটিয়ে একটি সুস্থিতিশীলতার দিকে যাব। প্রণোদনা বাড়ায় সবে মাত্র প্রবাসী আয় বাড়তে শুরু করেছে।আর এই সময়টাতেই শুরু হলো এই অনিশ্চয়তা।নির্বাচন বা রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি সমঝোতার মাধ্যমে স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে গড়াতো তাহলে বাইরে থেকে রেমিটেন্স আরও বেশি আসতো। আমাদের রপ্তানি আয় আরও বাড়তো। সেইসঙ্গে বিনিয়োগও হয়তো বাড়তো। সব মিলে কর্মসংস্থানের ক্ষতি হতো না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এখন তো মনে হচ্ছে-এসবই আশার কথা। বাস্তবে তো বেশ চাপের মধ্যেই পড়লো দেশের অর্থনীতি।

রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব সরাসরি অর্থনীতিতে পড়লেও এর সমাধান রাজনৈতিক ভাবেই হতে হবে। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খুব বেশি কিছু করার নেই বলেই মনে করি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেটা করতে পারে সেটা হলো মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আরও যে সমস্ত ব্যবস্থা আছে, বিশেষ করে মুদ্রানীতিতে কঠোর হওয়ার যে সুযোগ, সেটা তারা করতে পারে।  এছাড়া একেবারে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে-যেমন কৃষি, এসএমই, কুটির শিল্পতে যে সহযোগিতা (ঋণ) তারা দেয় সেটার পরিমাণ আরও বাড়ানো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসা-বানিজ্যে দেয় ঋনের কিস্তির সংখ্যা বাড়াতে পারে। অথবা আরেকটু নমনীয় করতে পারে। এই সময়টা আসলেই অনেক কঠিন, যেসব জায়গাতে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঘটেছে, সেসব জায়গায় সরকার অবশ্যই আলাদা উদ্যোগ নিয়েছে, এটা হয়তো আরও নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এসব জায়গার ব্যাংকিং ব্যবস্হায় নমনীয়তার জন্য নীতিপরামর্শ দিতে হতে পারে।কিন্তু সমস্যা হবে এসব জায়গাতেও যদি সার পাঠাতে চায় সরকার পাঠাবে কি করে যদি অবরোধ থাকে? তবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিশ্চয় বাড়তি সামাজিক সুরক্ষা সরকার দিতেই পারে।সে জন্য আমার মনে হয় রাজনৈতিক আন্দোলন চলুক কিন্তু অর্থনীতির পায়ে কোনো বেড়ি দেওয়া উচিত হবে না।

রাজনৈতিক দলগুলোতে যারা অর্থনীতি জানেন-বোঝেন তারা যে সংকটটি আঁচ করতে পারছেন না তা কিন্তু নয়। তারা ঠিকই বোঝেন কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য হলো কেবলমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন। সেটা অর্জন করতে গিয়ে তারা মানুষের জন্য কি দূর্ভোগ সৃষ্টি করেন তা এতোটা আমলে নেন না। সেটার জন্য সমস্যা যারা মোকাবেলা করেন সেই সাধারণ মানুষেরা তখন সেই রাজনৈতিক দল থেকে নীরবে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এজন্য আমাদের মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর খেয়াল করা উচিত তাদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ কিভাবে আহত হয়, কিভাবে তাদের আয় রোজগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওইদিকে তাদের অবশ্যই নজর রাখা উচিত।

আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখছি, রিজার্ভ সংকট নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। আমার মনে হয় এনিয়ে এতো ভাবার দরকার নেই। এটা বাংলাদেশ ব্যাংক ভাববে। তবে যতোটা বলা হয় ততোটা খারাপ অবস্থায় নেই বাংলাদেশ। এটা দুশ্চিন্তার বিষয় হলেও খুব বেশি আতঙ্কের বিষয় নয়। কারণ রিজার্ভ তো সব সময় লাগে না। এটা যখন লাগে তখন ব্যবহার করতে হয়। এটা ‘রেইনি ডেইজের’ বিষয়, ‘শাইনি ডেইজের’ বিষয় নয়। তবুও দুশ্চিন্তা তো কিছু হয়-ই। প্রতি মুহূর্তে রপ্তানি ও প্রবাসি আয় তো কম বেশি বিদেশ থেকে আসছে।তাই এটা নিয়ে অযথা প্যানিক সৃষ্টি করার কারণ নেই। অনেকে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টানেন, কিন্তু আমি বলবো বাংলাদেশ সেই অবস্থায় নেই। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋনের পরিমান এখনও জিডিপির ২০ শতাংশের নীচেই। বছরে এখন দুই বিলিয়ন ডলারের মতো এই ঋণের কিস্তি ও সুদ করতে হয়।আর এর মধ্যে প্রাইভেট খাতের বিদেশি ঋণ বাবদ রয়েছে জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ। সবমিলে জিডিপির ২০ শতাংশের মতো। এই অঞ্চলের দেশসমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে কম। সুতরাং এটা নিয়ে এখনি এতোটা দুশ্চিন্তা করবার কারণ নেই।

আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে বড় বিনিয়োগগুলোকে খুব সামনে নিয়ে যেতে পারব না, সেই সঙ্গে বাস্তবায়নও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই একধরণের স্যোশাল কন্ট্রাক্ট রাজনীতিতে হতেই হবে। আশা করছি সকল রাজনৈতিক অংশীজনই বাংলাদেশের ভালো চায়। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদল বা ক্ষমতার হস্তান্তর যাই বলি না কেন তা নির্বাচনের মাধ্যমেই হতে হবে।আর তা করা গেলেই অর্থনৈতিক রূপান্তর টেকসই করা সম্ভব।সবাই যেন নিশ্চিত পরিবেশে কাজ করতে পারেন সেই রকম একটি পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনেক বড়। বাংলাদেশ ৪৭৫ বিলিয়ন ডলারের একটি অর্থনীতির দেশ, যা এখনি বিশ্বে ৩৫তম অর্থনীতি।  হয়তো অচিরেই ২৫তম অর্থনীতি হয়ে যাবে। সেই অর্থনীতিতে বাজার হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই অর্থনীতির জন্য আমদানি করা পণ্যের দরকার হবে। তবে স্বদেশী শিল্পের ভূমিকা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন।সেজন্যেও কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমাদের আমদানি করতেই হবে।সুতরাং সকলেই তো বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখবার চেষ্টা করবে। আমাদেরও বাজার খুঁজতে হয়। বর্তমানে পশ্চিমের অনেক জায়গায় আমাদের বাজার। মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু অনেক দেশের চেয়ে গ্লোবালাইজড। তাই পশ্চিম ও পূর্বের সঙ্গে মিলে মিশেই আমাদের চলতে হবে। সেজন্য বাংলাদেশের প্রতি যেমন আগ্রহ আছে বাইরের দেশগুলোর, তেমনি আমাদেরও আগ্রহ আছে বাইরের দেশগুলোর প্রতি।

পশ্চিমানির্ভর তৈরি পোশাকখাত সহ সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাত নিয়ে বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়নে আমাদের স্মার্ট ডিপ্লোমেসি গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা অযথা অপ্রাসঙ্গিক এমন কোন কথা যেন না বলি যাতে শুধু শুধু বিতর্ক সৃষ্টি  হয়। কিংবা বাণিজ্যে প্রভাব পড়ে । তবে তাদেরও আমাদের খুব দরকার। কারণ একটি দেশে এতোগুলো বড় বড় ফ্যাক্টরি কিন্তু সব দেশে নেই। ইকোনমি অব স্কেল বলে একটা কথা আছে। সেই বিচারে আমাদের অবস্হান বেশ শক্ত। তাছাড়া আমাদের কারখানাগুলোর দ্রুত টেকসই কৌশল-নির্ভর রূপান্তর হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ৩০০ বেশি ফ্যাক্টরি সবুজ হয়ে গেছে। সুতরাং পশ্চিমের যে গ্রাহক আছে, তাদের আমাদের তৈরি এই টেকসই পণ্য দরকার। কম দামে তারা আমাদের থেকে পণ্যগুলো পায়। এক জায়গা থেকে তারা তা সংগ্রহ করতে পারছে। এটা কিন্তু একটি নির্ভরতার পারস্পারিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক মোটেও ঠুনকো নয়।

আমার মনে হয়, আমাদের সবসময়ই চেষ্টা করা উচিত, রপ্তানি ও আমদানি ঠিকঠাক রাখবার জন্য যাদের সঙ্গে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করি; তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা। একটি স্মার্ট বিদেশনীতি এখন আমরা অনুসরণ করছি।এটি যেন আমরা অব্যাহত রাখি। সাম্প্রতিক দশকে আমরা কিছু ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতারও মুখোমুখি হয়েছি। তবুও আমাদের বাণিজ্যিক জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছি। তবে হালে পরিস্থিতির দ্রুত বদল হচ্ছে। আমরা কি জানতাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে হঠাৎ করে হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ করবে? তারপর ইসরায়েল গাজায় এমন অমানবিক হামলা চালাবে? এই ঘটনার পর এর প্রভাব বিশ্বরাজনীতিতে পড়ছে। এর প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়বে ।এটাই স্বাভাবিক। তাই আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে। আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন কারণ নেই। সর্বক্ষণ আমাদের বাণিজ্যিক অংশিজনদের সাথে এনগেজ থাকতে হবে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব-কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বঙ্গবন্ধুর এই পররাষ্ট্র নীতি সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতা আসলেই আমাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। আমরা কারো সঙ্গে বৈরিতা করব না, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখব, এটা যেন মনোযোগ দিয়ে আমরা পালন করি। যারা পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে কাজ করেন তারা যেন খুব স্মার্টলি এই কথা গুলো মনে রাখেন। তবে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ যেন এই নীতিকৌশলের মধ্যমনি হিসেবে থাকে।এখন অব্দি আমরা এই কৌশলটি ধরে রাখতে পেরেছি।

জাতীয় নির্বাচন খুবই সন্নিকটে। আমাদের দেশের বাস্তবতার আলোকেই দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি হবে। এখনো যে অবস্থা আমাদের দেশের তাতে মনেকরি যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নটাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এখানে কৃষি, রপ্তানি শিল্প, ডিজিটাল পণ্য, বিশেষ করে স্কিল ডেভেলপমেন্ট, অর্থাৎ শিক্ষা ও সবার জন্য স্বাস্থ্য; সেই সঙ্গে সবার জন্য স্বাস্থ্য বীমা ইশতেহারে প্রধান্য পাওয়া উচিত। এখন প্রায়শঃই ক্যানসার-হৃদরোগ হচ্ছে, আকষ্মিকভাবে অনেক টাকা প্রয়োজন হয়, তাই সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা চালু করা খুবই জরুরি।

আশা করব, এই বিষয়টি যেন সব দলের অগ্রাধিকারে থাকে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিশেষ করে স্কিল ডেভেলপমেন্ট খুব জরুরি। অন্যদিকে, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবেলায় অভিযোজনের দিকে জোর দিতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। কম সুদের যে ঋণ আমরা পাব সেগুলো নেব আমরা। এই সব বিষয়গুলো একসঙ্গে মিলে একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশলের ওপর জোর দিতে হবে।

বিশ্বব্যবস্থার দ্রুত বদল হচ্ছে। যেসব দেশে দ্রুত পুঁজিবাদী উন্নয়ন ঘটছে সেখানে মূল্যবোধের অভাব ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪০ লক্ষ পরিবার এখন ‘একক পরিবার’। পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। সেই প্রভাব আমাদের দেশেও পড়তে শুরু করেছে। ডিভোর্স বাড়ছে আমাদের এখানে। অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্র হচ্ছে। এর প্রভাব সমাজেও পড়ছে। আগে যে সামাজিক ভাবে এক রাজনৈতিক দলের পরিবারের সঙ্গে ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের পরিবারে বিবাহ হতো। আজকাল সেই বাস্তবতা আর নেই। অবশ্য এর পেছনে আদর্শিক কারণও রয়েছে। তবু বলবো সমাজে মিলেমিশে থাকার এই যে মূল্যবোধ, এটা অনেকটাই কমে গেছে। সামাজিক পুঁজির বড়ো ধরণের ক্ষয় হয়েই চলেছে।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রধান মূল্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে কি? মুক্তিযুদ্ধে চেতনা বলতে আমরা বুঝি, উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-নির্ভর অংশগ্রহণমূলক একটি সমাজ; যে সমাজে ভালো মানুষদের ঠাঁই হবে। আজকের দিনে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি আমরা কিন্তু যারা নিঃস্ব, যারা প্রান্তিক তাদের ঠেলে দূরে পাঠিয়ে দিই। সবই কথার কথা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হতে হবে সবার, অন্তর্ভূক্তিমূলক। প্রান্তজনদের জায়গা আরও বেশি করে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে। গত দেড় দশকে এই লক্ষ্যে অনেকটা পথ নিশ্চয় হেঁটেছি। তবে আরও অনেক পথ আমাদের হাঁটা এখনও বাকি। আমরা যেন সেই লক্ষ্য পূরণে দ্বিধান্বিত না হই।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

   

রক্তচক্ষু উপেক্ষার সাহস না থাকলে সাংবাদিকতা নয়



আশরাফুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের বরপুত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঘুমন্ত জনগণকে জাগাতে বহু যুগ আগে উচ্চারণ করেছিলেন এক চরম সত্য। তিনি বলেছিলেন, ‘Freedom is not given, it is taken’. ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক, স্থানিক বা বৈশ্বিক সব স্তরেই এটি আজ চরম সত্য হিসেবে বিশ্বের পরাধীন কোটি মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়।

৩ মে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস (World press freedom day) ঘিরে নানা আয়োজন চলে বিশ্বজুড়েই। প্রকাশিত হয়েছে অগণিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ। মুক্ত সাংবাদিকতার পথ প্রশস্ত করার দাবি নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের দেশে দেশে পথেও নামেন সাংবাদিকরা। যদিও সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, হত্যা-নির্যাতন, হুমকি-অপহরণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেমে নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি বছরই চলে এমন আয়োজন ও কর্মসূচি।

বলতে দ্বিধা নেই- ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাহীন কেউই সাংবাদিক নিপীড়নে পিছিয়ে নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোর দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই, তবে এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত বহু দেওয়া যাবে। ক্ষমতাসীনদের হাতে সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনাকে যদি বাধ্য হয়ে ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হিসবে মেনেও নিতে হয়, কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলের যারা সরকারকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে মুখে ফেনা তুলেন তাদের হাতেও যখন সাংবাদিকরা নিগৃহীত হন তখন তার কোন সদুত্তর মেলে না!

২০২৩ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের সমাবেশে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর বর্বর হামলার ঘটনা ঘটে। কিছু দিন চলে হইচই। সময়ের সঙ্গে সেইসব ঘটনা চাপা পড়ে যায় নতুন ঘটনার ঘনঘটায়। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলির যে কোন দায়বোধ নেই তা প্রমাণিত, তাই কোন তদন্তও হয় না-শাস্তি তো বহু দূরের ব্যাপার।

সংবাদকর্মীদের গায়ে আঘাতের ক্ষত না শুকাতেই ঘটনায় জড়িত রাজনৈতিক নেতারা প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে চা-আড্ডায় মেতে উঠেন। প্রহৃত সাংবাদিকদের কেউ কেউ হয়ত উঁকি দিয়ে সেই আড্ডা দেখে ফেলেন, কিন্তু প্রভাবশালীদের কাছে হার মেনে নীরব অভিমানে সরে আসেন তারা।

সবশেষ, এফডিসিতে চলচ্চিত্রের খল অভিনেতাদের নেতৃত্বে বিনোদন সাংবাদিকদের ওপর যে নারকীয় হামলার ঘটনা ঘটলো তার কি বিচার হলো? এক অভিনেতার বাসায় কতক সাংবাদিক নেতার গোপন মিটিংয়ে ঘটনার আপসরফার খবর শোনা গিয়েছিল। একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। বেশ কিছু দিন পেরিয়ে গেলেও কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না।

এবারের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের পরদিন শনিবার যখন এই দিবস নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভা হয় সেখানে ‘বিষয়’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ‘পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতাকে’; সাংবাদিক নিপীড়নের প্রসঙ্গ ছিল সেখানে গৌণ। শীর্ষ গণমাধ্যমের সম্পাদক থেকে শুরু করে স্বয়ং তথ্য প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের অতিথি। নির্যাতিত কমিউনিটির মাঝেই যদি এমন আপস করার প্রবৃত্তি আর ক্ষমতার আশীর্বাদ পাওয়ার ব্যাকুলতা থাকে তবে সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিকার দাবি করাই তো একটা ‘অপরাধ’!

শুরুতেই স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষের প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি যে কেবল মুক্তিকামী মানুষদের ‘স্বাধীনতা’ ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন তাই নয়, জাতীয় কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র বসু এক ভাষণে আমাদের মজ্জাগত দাসত্বের প্রবৃত্তিকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘বন্ধুগণ, আমরা দাস হয়ে জন্মেছি। আসুন সংকল্প করি, আমরা মরবার পূর্বে স্বাধীন হব।’

সত্যিকথা বলতে চারপাশে কেবল দাসত্ব আর তোষামোদি দেখে দেখে আমরা নির্বিকার হয়ে পড়েছি। সাংবাদিকতায় আমরা যাদের পরম্পরা বহন করছি, সেই গৌরবের ইতিহাস আমাদের সামান্যই প্রভাবিত করছে।

১৯২২ সালের ১১ আগস্ট। প্রাণভরে সত্য উচ্চারণের আকাঙ্খা নিয়ে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতার ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিট থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করছিলেন অর্ধ-সাপ্তাহিক ধুমকেতু। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা কতটা প্রাতঃস্মরণীয় আখ্যান সৃষ্টি করতে পারে ধুমকেতু তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সমকালীন সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সেই ঘটনা স্মরণ করা এই জন্য জরুরি যে, মহান এ পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আমাদের আরও কতটা সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন তারই খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে সেই ঘটনার আখ্যানে।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মালিকানাধীন সান্ধ্য-দৈনিক নবযুগের সম্পাদনায় নিজের চিন্তা ও স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা অনুভব করে তরুণ কবি নজরুল নিজেই ‘ধুমকেতু’ নামে নিজেই একটি সংবাদপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে চেয়ে পাঠান আশীর্বাদ বাণী। কবিগুরুও তাকে ফেরান না। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদবাণীসহ প্রকাশিত ধুমকেতু একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে কি অনন্য ভূমিকাই না রাখে! সাহিত্যিক ও কবিবন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘‘জাতির অচলায়তন মনকে অহির্নিশি এমন করে ধাক্কা মেরে চলে ‘ধুমকেতু’ যে রাজশক্তি প্রমাদ গণে।’’

পরাধীন দেশে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ ধুমকেতুর যে কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল তা যেন অঙ্গিস্ফূলিঙ্গ হয়ে রাজশক্তির সিংহাসনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কালজয়ী সব কবিতা আর জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল স্বাধীনতার কথাকেই প্রবল পরাক্রমে বলতে পেরেছিলেন ধুমকেতুতে।

ধুমকেতুর একটি সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল লেখেন, ‘..সর্বপ্রথম, ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়..ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটুলি বেঁধে সাগর-পাড়ে পাড়ি দিতে হবে…’-কি দুঃসাহসিক উচ্চারণ!

‘ধুমকেতুর কবি নজরুল’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক এক লেখায় পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এক ঘটনার বয়ান লিপিবদ্ধ করেন। তিনি যা তুলে ধরেন তার সারমর্ম হচ্ছে, একদিন ধুমকেতুর কার্যালয়ে গোপীনাথ নামে এক যুবক স্বভাবসুলভ উৎফুল্ল কবি নজরুলকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘দেশ পরাধীন, সাহেবদের অত্যাচার-জুলুম দিন দিন বেড়ে উঠছে। সেই জ্বালার মধ্যে আনন্দ জাগে কি করে?’

দেখা গেল কয়েক দিনের মধ্যে ওই যুবকটি কলকাতা চৌরঙ্গীর মোড়ে পিস্তল সহ হাতেনাতে ধরা পড়ল। যুবকটির নাম গোপীনাথ, অমর বিপ্লবী। অবশ্য ধরা পড়ার পূর্বে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট মনে করে ডে সাহেব নামে আরেক ইংরেজকে গুলি করে হত্যা করেন ওই বিপ্লবী। সেই ঘটনার ডামাঢোলের মধ্যেই নজরুল লিখে ফেললেন, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক এক জ্বালাময়ী কবিতা। ধুমকেতুতে তা প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে ব্রিটিশ পুলিশ। যে কবিতায় কবি লিখেছিলেন, ‘‘আর কত কাল থাকবি বেটী/মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে/অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল/দেবশিশুদের মারছে চাবুক/বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা আসবি কবে সর্বানাশী’’

ফল যা হবার তাই হল, ধুমকেতু অফিসে হানা দিল পুলিশ। কুমিল্লা থেকে আটক হলেন নজরুল। আদালতে অকুতোভয় নজরুল যে জবানবন্দী দেন তা কেবল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেই নয়, মুক্ত সাংবাদিকতার ইতিহাসেও এক দৃষ্টান্ত। কবি দৃপ্তকণ্ঠে আদালতে উচ্চারণ করেন, ‘সত্য স্বয়ংপ্রকাশ তাকে কোন রক্ত আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না..’।

১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. সুইনহো ধুমকেতু সম্পাদক কবি নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। কারা অন্তরীণ নজরুল আলিপুর সেন্ট্রাল জেল হয়ে হুগলী কারাগারে স্থানান্তরিত হন। সেখানে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে দীর্ঘ ৩৯ দিন অনশন করে পরাধীন জাতিকে তিনি এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। এই সময়ে কবিগুরু তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করলেন তরুণ কবি নজরুলকে । কাজী নজরুল ইসলামের বীরোচিত এই আখ্যান যেমন বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা, তেমনি মুক্ত সাংবাদিকতার ঐতিহ্যিক পরম্পরাতেও এক চির অনুপ্রেরণা।

সমকালীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার অন্দরে প্রবেশ করে যদি আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে স্মরণ করি তবে লজ্জায় নত হতে হয়। সাংবাদিকতার মানস-মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! একটি স্বাধীন দেশে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমরা স্বাধীনতার জন্য রীতিমতো ‘কান্নাকাটি’ করছি। অথচ সত্য উচ্চারণে চিরকালই বাধা আসবে, গ্লানি থাকবে-তবু সত্যকে আলিঙ্গন করতে হবে-সাংবাদিকতায় এটিই বাস্তবতা। সেখানে সত্য উচ্চারণের পথ এতটা নিষ্কণ্টক হবে তা আমরা আশা করি কি করে? অতীত যেন আমাদের ভৎর্সনা করে বলছে, ‘বাধাকে, রক্তচক্ষুকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সাহস যদি না-ই থাকবে তবে এ পথ তোমার নয়’।

সমকালীন বাস্তবতাকে যদি বিবেচনায় আনি তবে যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা হল-ঔপনিবেশিক ও নব্য ঔপনিবেশিক দুঃশাসন থেকে মুক্ত হয়ে আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি সেখানেও আমাদের চ্যালেঞ্জ কম নয়। বলতে গেলে বর্তমানে রাজনীতি, প্রশাসন আর বণিকশ্রেণীর মাঝেও এক প্রবল ঔপনিবেশিক চরিত্র ধরা দিয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক ক্ষমতার সমীকরণও। এই সময়ের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রকে একসঙ্গে এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কতটা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত?

যা দৃশ্যমান হচ্ছে, দ্ব্যর্থহীনভাবে আত্মসমালোচনা করলে বলতেই হবে, বহুলাংশেই আপস করছি আমরা। সত্য উচ্চারণে কিছু কণ্ঠস্বর কখনো জ্বলে উঠে আবার স্থিমিত হয়ে যাচ্ছে কিংবা থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জ্বলে উঠা এই কণ্ঠস্বরগুলো যদি সংঘবদ্ধ করা যায় তবে অচলায়তন ভেঙে দেওয়া অসম্ভব নয়। আসুন আমরা সেই অভিপ্রায়কে বাস্তব করতে উদ্যত হই।

লেখক: বার্তা২৪.কম এর পরিকল্পনা সম্পাদক ও ইতিহাস গবেষক

;

বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!



কবির য়াহমদ
বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!

বন্যা আসছে, প্রস্তুতি নিন!

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র তাপদাহ শেষে স্বস্তির বৃষ্টির দেখা পেয়েছে দেশ। দেশের অন্য এলাকাগুলোর অনেকগুলোতে এখনো তাপের তীব্র দহন থাকলেও সিলেট অঞ্চলের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এখানে প্রায়ই যেন নিয়ম করে বৃষ্টি নামছে, তাপমাত্রা পরিস্থিতিও মোটামুটি সহনীয়। দেশ যখন পুড়ছে তাপে, তখন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা বিশেষ করে সিলেটে দেখা দিয়েছে বন্যার আশঙ্কা।

বন্যার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় যে খেতের ধানের, এটা এবার কৃষকেরা ঘরে তুলতে শুরু করেছেন। অনেক এলাকার ধান কাটা শেষের পর্যায়ে। এখন চলছে ধান শুকানো আর গোলায় তোলার পালা। কেবল ধানই নয়, খড়ও শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে শুরু করেছেন তারা, কারণ এই খড় গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বোরো ধান দেশের খাদ্যচাহিদার অন্তত ৫৫ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। দেশের হাওরভুক্ত ৭টি জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরে এই বোরোর চাষ বেশি হয়ে থাকে। এই ধান অতিবৃষ্টি, বন্যা ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে দেশের খাদ্যচাহিদায় ঘাটতি পড়ে না। তাই এই ধান চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া, বিশেষ করে রোদের উপস্থিতি অতি জরুরি। ভালোয়-ভালোয় শেষ পর্যায় এটা শেষের পথে। তবে এখন উঁকি দিচ্ছে বন্যার শঙ্কা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর পরিচালিত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর নদীগুলোতে পানির স্তর দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা বেশ কয়েকটি অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানটি পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। এফএফডব্লিউসি বলছে, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রাক-বর্ষার পানিপ্রবাহ অতিক্রম করতে পারে।

পূর্বাভাসে যখন আকস্মিক বন্যার তথ্য, তখন ঠিক ঠিক সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধির তথ্য মিলছে। এরইমধ্যে সিলেটের দুটি নদ-নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ভারতে কয়েক দিন ধরে বৃষ্টির ফলে সিলেটের নদ-নদীগুলোয় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহস্পতিবারই দুটি পয়েন্টে নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পাউবোর তথ্যমতে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ মিটার। বর্ষা মৌসুমে বিপৎসীমা ১৩ দশমিক ৭৫ মিটার। শুক্রবার সকাল ৯ টা থেকে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে ১১. ০৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একইভাবে সারি নদের জৈন্তাপুরের সারিঘাট পয়েন্ট শুষ্ক মৌসুমে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৭০ মিটার। বর্ষা মৌসুমে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৩৫ মিটার। নদের ওই পয়েন্ট পানি ১১ দশমিক ৮৭ মিটারে অবস্থান করছিল, যা শুষ্ক মৌসুমের বিপৎসীমার ওপরে। এ ছাড়া সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্ট এবং কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টেও পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। তবে ভারতের বৃষ্টিসৃষ্ট ঢল নামতে থাকলে অন্য পয়েন্টগুলোতে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

২০১৭ সালের মতো এবার দেশের বেরো খেত বন্যায় তলিয়ে যায়নি। কৃষকেরা আনন্দ লুট হয়নি বন্যায়। তবে ঘরে ফসল তোলার পর পরই বন্যার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে সেটা ভাবনার। এমনিতেই ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার স্মৃতি বিস্মৃত হতে পারেনি সিলেট অঞ্চলের মানুষ। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পাশাপাশি জানমাল, আর্থিক ও অবকাঠামোগত যে ক্ষতি সেটা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখনো সিলেটের অনেক অঞ্চলে দুই বছর আগের সেই বন্যার ক্ষতচিহ্ন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

২০২২ সালের বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল সিলেট নগরসহ জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা। দীর্ঘমেয়াদি ওই বন্যায় মাসখানেক সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয় মানুষকে। বন্যার পর দাবি ওঠেছিল সুরমা নদী খননের। এনিয়ে কিছু কাজ শুরু হলেও সেটা সমাপ্ত হয়নি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সিলেট নগরের কুশিঘাট থেকে বিশ্বনাথের দশগ্রাম পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়েছিল। এই ১৫ কিলোমিটারের খনন কাজ ১৫ মাসেও শেষ হয়নি। অথচ এই প্রকল্প চার মাসে সম্পন্ন করার কথা ছিল। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের কারণে খননকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য নির্ধারিত সময়ে খননকাজ শেষ করা যায়নি। প্লাস্টিক ও পলিথিনের কারণে মেশিনারি যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যায় বলে তাদের দাবি। শতভাগ সম্পন্ন করতে না পারলেও ৮০ ভাগ কাজ আগামী জুনের মধ্যে তারা সম্পন্ন করতে পারবেন বলেও তারা আশাবাদী।

গত বন্যার পর সুরমা নদীর নাব্যতা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, দাবি ওঠেছে নদী খননের। কেবল বন্যার ওই সময়ই নয়, সামান্য বৃষ্টিতেও সিলেট নগর ডুবে যাচ্ছে। খাল-ছড়াগুলো দখলে-দূষণে সংকীর্ণ, এবং অনেকগুলো ‘নাই’ হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টি নগরে সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা। তার ওপর আছে সিটি করপোরেশনের নানা উন্নয়নমূলক কাজ, যেগুলো পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে কোথাও কোথাও সৃষ্টি করছে বাধার। শুষ্ক মৌসুমের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পানির গতিপ্রবাহ নিয়ে ভাবা হয় সামান্যই, ফলে গ্রীষ্মের প্রকল্প বর্ষা পর্যন্ত দীর্ঘায়ত হয়ে যাওয়ার কারণে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে দেখা দিয়েছে প্রতিবন্ধকতা। আর শেষ পর্যন্ত তাই ভোগান্তির গন্তব্য মানুষ। এছাড়াও আছে হাওর এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও ভৌত অবকাঠামো, যেগুলো হাওরের বিশাল জলরাশির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘তিস্তা নদী অববাহিকা: সংকট উত্তরণ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সপ্তম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও এনভায়রনমেন্ট গভার্নড ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজেশনের পরিচালক জয়ন্ত বসু ‘জিওপলিটিকস অফ রিভার তিস্তা অ্যান্ড নিড টু পারসু নেচারবেইজড নেগোশিয়েটেড অ্যাপ্রোচ (এনবিএনএ)’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার আন্তদেশীয় নদীর সমস্যা আঞ্চলিক ভূরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এই অঞ্চলের সব দেশ প্রধানত কৃষি, জলবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য কারণে নদীর ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল। আর তাই এ অঞ্চলের অসম রাজনৈতিক ক্ষমতার উপস্থিতি; আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আন্তদেশীয় নদীর পানি ব্যবহারে সমন্বিত মডেল বাস্তবায়নে আন্তদেশীয় স্টেকহোল্ডার পর্যায়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে জয়ন্ত বসু বলেছিলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো সামগ্রিক অববাহিকাভিত্তিক পদ্ধতি নেই। যদিও উভয় দেশের মধ্য দিয়ে ৫৪টি আন্তসীমান্ত নদী বয়ে গেছে। এ জন্য একটি সামগ্রিক অববাহিকাভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।’ গবেষকদের এই সব গবেষণাপত্র নিয়ে আলোচনাই হয় কেবল, এসব নিয়ে কাজ হয় কমই। ফলে সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই থেকে যাচ্ছে। এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে ভূ-রাজনীতি, মনে করা হচ্ছে এখানে আমরা পিছিয়ে আছি অনেকটাই।

এখন যেখানে আমরা সেখানে একটা বন্যার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এটা নিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সতর্কতা দিয়েছে। এই সতর্কতা শুরুতে কৃষক পর্যায়ে ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, বেরো ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলেই যেন কাটা শুরু হয়। কৃষকেরা সে কাজটিই করেছেন। কৃষকের নিয়মিত কাজ শেষে এখন সরকার-প্রশাসনের দরকার বন্যা মোকাবেলা বিষয়ক প্রস্তুতি গ্রহণ করা। ভারতে বৃষ্টি কমলে দেশে বন্যা হবে না—স্রেফ প্রকৃতির ওপর নির্ভর না করে বন্যা হলে কী প্রক্রিয়ায় মানুষকে বাঁচানো যায় সে দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। হাতে আছে সময়, এই সময়টুকুর সঠিক ব্যবহার করাই হবে সময়ের কাজ।

;

শিল্প-সাহিত্যে সম্মাননা: ক্ষমতার আনুগত্যই ‘মানদণ্ড’ নয়



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বয়সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের চেয়েও ৬ বছরের বড় ছিলেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস। রাজ আনুকূল্য পরিত্যাগ করে রাজার বিরুদ্ধে কলম ধরার অপরাধে নির্বাসিত হয়েছিলেন কবি। ‘মগের মুলুক’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নির্বাসিত গোবিন্দচন্দ্র দাসের জীবন কেটেছে নিদারুণ অর্থকষ্টে। বাংলা সাহিত্যকে ১০টি অমূল্য কাব্যগ্রন্থ উপহার দিলেও প্রতিভাধর এই কবির যাপিত জীবনের দুর্দশা ছিল প্রকট। শেষ জীবনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মতো মহৎপ্রাণ কিছু মানুষেরা অসুস্থ কবিকে অর্থসহায়তা দিয়ে উদাসীন সমাজের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে ওষ্ঠাগত কবি তাঁর কবিতায় জীবদ্দশায় স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সমাজ-রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমি মরলে তোমরা আমার চিতায় দেবে মঠ?’

শিল্প-সাহিত্যের স্রষ্টাদের এই আক্ষেপ যুগে যুগে ধ্বনিত হয়ে আসছে। সবশেষ ঘটনাটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুণী শিল্পী সাদী মহম্মদের আত্মহনন। এসকল ঘটনা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে নীরবে চপেটাঘাত করে যায়। জীবদ্দশায় গুণীর কদর করতে বরাবরই ব্যর্থ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। বলা হয়ে থাকে যে সমাজে গুণীর কদর নেই, সেই সমাজে গুণীও জন্মায় না। সময়ের স্রোতে আমরা শ্রদ্ধায় নত হতে পারি, এমন গুণীজনদের ক্রমেই হারিয়ে ফেলছি। সেই শূন্যস্থান পূরণে আমাদের যোগ্য মানুষের অভাব প্রতিনিয়তই অনুভূত হচ্ছে।

ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধের সঙ্গে আপস না করা মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন কমে আসছে। বিপরীতে জায়গা করে নিচ্ছে স্তাবক ও অযোগ্য মানুষেরা। এতে করে সমাজে যে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে তা আমাদের ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে বিপন্ন করে তুলছে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদক ও পুরস্কার প্রদান নিয়ে মানুষের মনে যে নানা প্রশ্ন উঠতে দেখছি তা এই শূন্যতারই কার্যকারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা। যেখানে নীরবে নিভৃতে বহু গুণীজন স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনা নিয়ে কাটান সেখানে পদক-পুরস্কার নিয়ে সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা গুণীদের হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

এমন বাস্তবতার মাঝেই গত ৩০ এপ্রিল বাংলা একাডেমি ঘোষণা করল রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার-২০২৪। যে তিন গুণীকে এবার এই পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে তাঁদের রবীন্দ্র ও নজরুল সাধনা প্রশ্নাতীত। বাঙালি জাতির আত্মঅহংকারের প্রতীক এই দুই মহান কবির নামে প্রবর্তিত এ পুরস্কার নিয়ে এবার একাডেমি সংশ্লিষ্টরা তাদের বিচার-বিবেচনাকে প্রশ্নের উর্ধ্বে নিয়ে যেতে পেরেছেন, এটা আশাবাদের সঞ্চার করেছে।

বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। বহু গবেষণাগ্রন্থের লেখক ভীষ্মদেব চৌধুরীর রবীন্দ্র গবেষণায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে -দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫) ও প্রভাতসূর্য : রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা রবীন্দ্র অন্তঃপ্রাণ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকে তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতেও ভূমিকা রাখছেন।

বাঙালির হৃদয়স্পন্দন ও চেতনার বাতিঘর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। নির্বাক কবিকে ঘিরে সেই সময়কার গবেষক ও সাহিত্যিকরা নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং বিষয়-বৈচিত্রে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। কবির ঘনিষ্ঠজনরা তখনও জীবিত, রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে যা কিছু প্রয়োজন-তাও দুর্লভ ছিল না। তথ্যগত প্রাপ্যতার সঙ্গে গভীর নিষ্ঠা ও ভক্তি নিয়ে অনেক শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক কবিকে নানাভাবে মূল্যায়নের প্রয়াস পেয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের দুই যশস্বী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা দম্পতি আত্মনিয়োগ করেন নজরুল গবেষণায়। নজরুল গবেষণায় এই গুণী দুই গবেষকের গ্রন্থসংখ্যা বিপুল না হলেও কবিকে নিয়ে যে কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থ তাঁরা রচনা করেন তা এদেশে নজরুলচর্চায় বিশেষ ভাবে ভূমিকা রাখে। সে কারণে তাঁরা পথিকৃৎ গবেষক হিসেবেও নন্দিত হন।

মোহাম্মদ আবদুল কাইউম নজরুল গবেষণায় উপহার দেন ‘নানা প্রসঙ্গে নজরুল’ ও ‘নজরুল সংবর্ধনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ। অন্যদিকে রাজিয়া সুলতানার গবেষণা গ্রন্থ ‘কথাশিল্পী নজরুল’ ও ‘নজরুল-অন্বেষা’। প্রকাশিত এসব গ্রন্থসম্ভারের বাইরে এই দুই নজরুল গবেষক তাদের দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে নিষ্ঠার সঙ্গে অসংখ্য নজরুল গবেষক ও অনুরাগী সৃষ্টি করেছেন; যাঁরা পরবর্তী জীবনে বাংলাদেশে নজরুল চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও ড. রাজিয়া সুলতানা-দু’জনই কবি নজরুল ইনস্টিটিউট প্রবর্তিত ‘নজরুল পুরস্কার’ লাভ করেছেন। ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ১৯৯১ সালে লাভ করেছিলেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।

২০২০ সালের ১২ জুন প্রয়াত হন ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। স্বামী মৃত্যুর পর ড. রাজিয়া সুলতানা প্রবাসেই কাটাচ্ছেন সন্তানদের সঙ্গে। গেল ৩০ এপ্রিল ২০২৪ বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র ও নজরুল গবেষণায় ৩ জনকে একাডেমি পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করে। নজরুল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ড. রাজিয়া সুলতানা।

স্বজনদের থেকে জানা গেছে, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত ড. রাজিয়া সুলতানা। পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর জেনেছেন দূরপ্রবাসে বসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি নাকি এই খবরে ভীষণ আনন্দিত! তাঁর চোখেমুখে পরিতৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, জানিয়েছেন তাঁর মেয়েরা। এই খবর জেনে আমরা নিশ্চয়ই আনন্দিত এজন্য যে, একজন গুণী গবেষক জীবন-সায়াহ্নে হলেও তাঁর গবেষণার জন্য রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হতে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির সংশ্লিষ্টরা এজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু আমরা এও প্রত্যাশা করি যে, একজন গুণী গবেষককে তাঁর গবেষণার স্বীকৃতি পেতে বার্ধক্য পর্যন্ত কেন অপেক্ষায় থাকতে হবে? একটি পুরস্কারকে উদযাপন করার মতো শারীরিক ও মানসিক স্ফূর্তি থাকতেই কেন আমরা তাদের পুরস্কৃত করতে ব্যর্থ হচ্ছি-সেই প্রশ্নও আজ বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে।

আমরা জানি, কোন স্বীকৃতির আকাঙ্খা ব্যতিরেকেই এখনও বহু গুণীজন নিভৃতে তাদের জ্ঞান ও শিল্পসাধনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। কিন্তু অযোগ্যদের সম্মানিত করে রাষ্ট্র যখন নিজেই অসম্মানিত হয় তখন অনেকের মতো সেইসব গুণীজনরাও নিশ্চয়ই ব্যথিত হন। এবং এই বেদনার ভার সইতে না পেরে সাদী মহম্মদের মতো প্রতিথযশা সাধকশিল্পীকেও নীরব অভিমানে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাঁরা চালনা করেন তাদের মনে রাখা উচিত, পুরস্কারের মনোনয়নে কেবলমাত্র ক্ষমতার আনুগত্যই একমাত্র মানদণ্ড নয়।

লেখনির মুখে সত্য উচ্চারণে যে লেখকগণ নিঃশঙ্কচিত্ত হতে পেরেছেন ইতিহাসে তাদেরই ঠাঁই হয়েছে। রাজ আনুকূল্যে ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ববর্তী শাসকদের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ী হাতে, সেই প্রামাণ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন’ পরবর্তী যুগে একটি ফরমায়েশি গ্রন্থরূপে সকলের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসের নির্মোহ মূল্যায়নে সেই তথাকথিত ঐতিহাসিক স্বীয় মর্যাদাকে ধরে রাখতে পারেননি। আমরা যদি এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্মরণ করে সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে সমুন্নত রাখতে পারি, প্রকৃত গুণীদের যথাসময়ে মান দিতে পারি, তবেই দেশে অনেক জ্ঞানীর জন্ম হবে এবং আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে পারব। কবি গোবিন্দ দাসের মতো ‘মৃত্যুর পর চিতায় মঠ দেওয়া’ সমাজের চরিত্রকে বদলাতে পারব।

;

মে দিবস: শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়নের প্রতীক



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতি বছর ১ মে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়ন উদযাপন করা হয়। ২০২৪ সালে আমরা ১৩৮তম মহান মে দিবস উদযাপন করেছি। এই দিনটি শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের সময় শ্রমিকেরা অমানবিক পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে বাধ্য হতেন। তাদের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র এবং কাজের সময়সীমা দেওয়া হতো না। এই অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করেন।

১৮৮৬ সালের ১ মে, আমেরিকার শিকাগোতে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবিতে শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করেন। এই ধর্মঘট পরবর্তীতে সহিংসতায় পরিণত হয়; যার ফলে অনেক শ্রমিক নিহত ও আহত হন। এই ঘটনার স্মরণে ১ মে বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়।

বাংলাদেশেও মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার ও সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, বাংলাদেশের শ্রমিকেরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য অসংখ্য আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন।

বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। কিন্তু দেশটি চরম বৈষম্যের সম্মুখীন। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান, শ্রমিকদের শোষণ, কর্মসংস্থানের অভাব, ন্যূনতম মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব- এই সব সমস্যা শ্রমিক শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

এই বৈষম্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে, মে দিবসের তাৎপর্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দিনটি শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য সুবিধা, ছুটির অধিকার- এই সব দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকেরা অনেকদিন ধরেই সংগ্রাম করে আসছেন।

চরম বৈষম্যযুক্ত সমাজে, শ্রমিকদের লড়াই এখনো চলমান। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শ্রম আইন বাস্তবায়ন, শিশুশ্রম বন্ধ করা- এই সব দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কার্যকর শ্রম আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি- এই সব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে পারে।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য সমাজের সব স্তরের মানুষের ভূমিকা রয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করা উচিত।

শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো উচিত। এটি শ্রমিকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে জানতে এবং তা আদায়ের জন্য পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে। শ্রমিকদের সংগঠনকে সমর্থন করা উচিত, যাতে তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আরো শক্তিশালী হতে পারে।

‘মে দিবস’ শুধু একটি ছুটির দিন নয়, বরং এটি শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘদিনের লড়াই ও আত্মত্যাগের প্রতীক। চরম বৈষম্যযুক্ত সমাজে, মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও সংহতির বার্তা প্রচার করে।

এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য এখনো অনেক কিছু করার আছে। সরকার, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক ও সমাজের সব স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

মে দিবস শুধু অতীতের স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিও বহন করে। এই দিন আমরা শ্রমিকদের অবদান ও সংগ্রামকে স্মরণ করি। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রত্যয় জানাই এবং আরো ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাই।

বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। শ্রমিকেরা তাদের চাকরি, মজুরি ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং কর্পোরেট লোভের ফলে শ্রমিক শ্রেণির ওপর নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে।

শ্রমিকদের ঐক্য হলো তাদের অধিকার আদায়ের মূলশক্তি। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আন্দোলনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের দাবি আদায় করতে পারবে। শ্রমিকদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা অপরিহার্য।

শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। কার্যকর শ্রম আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, পেনশন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত।

শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন করা তাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত। এছাড়াও শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

জলবায়ু পরিবর্তন শ্রমিক শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিবেশবান্ধব শিল্প ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শ্রমিকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের এই নতুন সুযোগ গ্রহণে সহায়তা করা উচিত।

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও কর্পোরেট লোভ শ্রমিক শ্রেণির জন্য একটি বড় হুমকি। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও কর্পোরেট লোভের বিরুদ্ধে লড়াই করে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব।

১৩৮তম মে দিবস শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, অধিকার ও উন্নয়নের প্রতীক। এই দিনটি শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের স্মরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় এবং জীবন-যাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।

মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও সংগ্রামের দিন। এই দিন আমরা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তাদের অবদানকে স্মরণ করি। শ্রমিকদের ন্যায্য কর্মপরিবেশ, মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যেতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করে আমরা একটি আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

এই মে দিবসকে সামনে রেখে আসুন, আমরা শ্রমিকদের ঐক্য ও সংগ্রামের মন্ত্র ধারণ করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি!

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

;