ইতিহাসে আচড় দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখালেন এ আর রহমান!

  • আশরাফুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতারাম’ গানের বিকৃতি কিংবা আজাদ হিন্দ ফৌজের উদ্দীপনা জাগানো গান ‘জয় হো’ চয়ন করেও তাকে স্বীকার না করার অভিযোগ ছিল এ আর রহমানের বিরুদ্ধে। সুরারোপ আর গীত রচনা করে তিনি ‘অস্কার’জয় করতে পারেন বৈকি! কিন্তু ঐতিহাসিক সঙ্গীতের বিকৃতি ঘটিয়ে বার বার পার পেয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় এবার তিনি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানের সুর বিকৃতি ঘটিয়েছেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি ছবি ‘পিপ্পা’র সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের বিকৃত কর্মটি ইতিমধ্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বেরিয়েছে। বহু সঙ্গীতানুরাগীর মতো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি আমিও।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তো বটেই পরবর্তী সময়গুলোতে এই অঞ্চলের বহু স্বাধিকার আন্দোলনে, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে; এমনকি সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিষ্পেষণ-নিগ্রহের বিরুদ্ধেও জনমানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় কবির কালজয়ী এই সঙ্গীত। ফিউশনের নাম করে এ আর রহমানের এই ধৃষ্টতাপূর্ণ কর্মটির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই নিন্দার ঝড় উঠেছে স্যোশাল মিডিয়াসহ সর্বত্র। তাতে শামিল কবি পরিবারের সদস্যরাও। আমি বেদনাহত এই ভেবে যে ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া এই গানের সুর বিকৃতিতে এমন নিন্দার মাঝেও জনাব রহমান একটি পোস্ট করেছেন স্যোশাল মিডিয়ায় চলচ্চিত্রের প্রচারে কিন্তু ক্ষমা চেয়ে তার ‘কর্মটি’ প্রত্যাহার করেননি এখনও। 

বিজ্ঞাপন

তখন ঔপনিবেশিক যুগ। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কারারুদ্ধ। ‘বাঙালার কথা’ পত্রিকার জন্য নজরুলের কাছে জাগরণী কবিতা চেয়ে শ্রীকুমাররঞ্জন দাশকে পাঠালেন দেশবন্ধুর পত্নী বাসন্তী দেবী। নজরুল সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেললেন ‘কারার ঐ লৌহকপাট।’ পুরো দেশকে এক দুর্দমনীয় আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেল নজরুলের এই গান। ‘ভাঙার গান’ বাজেয়াপ্ত হল, জেলে গেলেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। তার কয়েক বছর পর ১৯২৮ সালে কলকাতায় পার্ক সার্কাস মাঠে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তুমুল জনপ্রিয় যুবনেতা শ্রী সুভাষচন্দ্র বসুর ঐকান্তিক আগ্রহে নজরুল নিজে পরিবেশন করেন, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’।

এমন হাজারও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে এই গানটিকে ঘিরে। এই গান বহু যুগ ধরে এই অঞ্চলের জনগণকে উদ্দীপ্ত করে এসেছে এবং আজও করে। এমন গানের বিকৃত সুর নিয়েও নাকি কেউ কেউ মিন মিন করে পক্ষে সওয়ালের চেষ্টা করছেন। বাকস্বাধীনতার ধোঁয়া তুলে এমন অর্বাচীন উচ্চারণ কেউ করতেই পারেন, কিন্তু তা নেহায়েৎ মূর্খতা ছাড়া কিছুই হবে না।

বিজ্ঞাপন

মনে রাখা দরকার, সাহিত্য ও সঙ্গীত কিভাবে একটি পরাধীন জাতির জেগে উঠবার মন্ত্র হতে পারে তা একজন কাজী নজরুল ইসলামই আমাদের শিখিয়েছেন। তিন সহাস্রাধিক গানের বিপুল সম্ভারে যিনি বাংলা সঙ্গীতকে এক অত্যুজ্জ্বল উচ্চতায় আসীন করেছেন তার অনন্য সৃষ্টিকর্মের সুর বিকৃতি একজন ‘অস্কার জয়ীকে’ তার মূল্যবোধের চরম অধপতনের বার্তাই দেয়। উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতকে বাংলা সঙ্গীতে প্রোথিত করে কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জন্য গৌরব করার মতো চিরকালীন বৈচিত্র্যপূর্ণ সঙ্গীত সম্ভার রেখে গেছেন। সে কারণেই বোধহয় ২ জন মহান সুরসাধককে উপমহাদেশের বেস্ট কম্পোজার হিসেবে আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে মানা হয়, তারা হলেন-হযরত আমির খসরু ও কাজী নজরুল ইসলাম।

সঙ্গীতের এতো বড় রাজাধিরাজের গান নিয়ে নিরর্থক পরীক্ষা-নিরীক্ষা অজস্র অনুরাগীর মতো আমাকেও চরম আহত করেছে। অমার্জনীয় এই অপরাধের জন্য জনাব রহমান, আপনি অবিলম্বে নত শিরে অপকর্মটি প্রত্যাহারপূর্বক ক্ষমা প্রার্থনা করুন ।

লেখক: বার্তা২৪.কম এর পরিকল্পনা সম্পাদক ও ইতিহাস গবেষক