নারী দিবস, অক্সফোর্ড, ইতিবাচক চিন্তা
ঘটনাক্রমে লেখাটি বিশ্ব নারী দিবসে রচিত। এদিন আমার কেটেছে অক্সফোর্ডে। এই কথাটিই ভাবছিলাম যে, আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা আর আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যেই আছে, সম-অধিকার পাওয়ার সমাধান। তার জন্য নিতে হবে সমান দায়িত্বও। আর সকলের মধ্যে আনতে হবে ইতিবাচক প্রণোদনা।
যাই হোক, সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর ক্লান্তি দূর করতে আমার একটি প্রিয় কাজ হলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পুরোটা কয়েকবার গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে পুরো ক্যাম্পাস এবং তার আশেপাশের এলাকা গুলো এতোটাই মনোমুগ্ধকর এবং উৎকর্ষতার আবেশ ছড়ানো যে, এই ক্যাম্পাস দিয়ে হেটে গেলেও মনে হয় আমি কোনো একটা দারুণ ঐতিহাসিক বইয়ের পাতায় বাস্তবে ঢুকে পড়েছি।
যাই হোক, আজকেও সেরকম ভাবেই ক্যাম্পাসে গাড়ি নিয়ে একটা সিগনালে দাঁড়ালাম। সিগন্যাল গ্রিন হলো, সব পথচারী দাঁড়িয়ে গেলো, কারণ এখন গাড়িগুলো যাবে। ঠিক এই অবস্থায় ট্রাফিক রুল অমান্য করে দুই এশিয়ান ছাত্র দিলো দৌড়! আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, বাকি সব সাদা ছাত্ররা কিন্তু একদম নিয়ম মেনে দাঁড়ানো। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা এশিয়ানরা কেনো এরকম? এটা কি আমাদের জিন গত কোনো সমস্যা? নাকি আচরণগত বৈশিষ্ট্য?
এই দুরূহ প্রশ্নের উত্তর ভাবতে ভাবতেই মনে হলো, আমি গত ১৯ বছরের আমার এই বিদেশ জীবনে দেশের বহু কিছু মিস করেছি, সবচেয়ে বেশি মিস করেছি নিজের পরিবারের আপন আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবদের। তবে গত কয়েক বছরে দেশে গিয়ে আমি এটুকু অনুভব করেছি যে, দেশে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে ভয়াবহভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, তাতে এই দেশে কোনো সৎ ও নিয়মনিষ্ঠ মানুষের জীবন এখন খুবই দুর্বিষহ। মানুষের মধ্যে বিবেক এবং মূল্যবোধের এতোটাই দুর্ভিক্ষ যে ভালো মন্দ বিচারেও মানুষ ধীরে ধীরে অপারগ হয়ে যাচ্ছে। অন্যের সাথে প্রতারণা এবং অসততা এখন অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে যত বড়ো দুর্নীতিবাজ, সে ততো বড়ো পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থূল চিন্তার প্রতিফলন লক্ষ্যণীয়।
কেন জানি না, জীবন উপভোগের উম্মাদনায় মানুষ ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ করতেও অপারগ হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে! আর একারণেই ৯০% মুসলমানের দেশে নামাজ, রোজা, হজ্ব, জাকাতের সাথে সাথে দুর্নীতি, ঘুষখোর, ঋণখেলাপির সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলেছে।মূল্যবোধের চরম দৈন্যের কারণে ধর্মের সত্যিকারের প্রয়োগ থেকেও মানুষ সরে এসে ধর্মকে নিজের স্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। আত্মার উৎকর্ষের বদলে আরোপ করেছে এক যান্ত্রিক আনুষ্ঠানিকতা। কেউ কেউ তো নির্লজ্জের মতো নিজের কুকর্ম ঢাকার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে ধর্মের ধ্বজা ও রাজনীতির মুখোশ।
মানুষের মধ্যে এই চরম মূল্যবোধের অভাবের কিছু মৌলিক কারণের মধ্যে একটা অন্যতম কারণ আমার কাছে মনে হয় সুস্থ্য চিন্তার অভাব। একজন মানুষের চিন্তা-ভাবনা তার আশেপাশের পরিবেশ এবং মানুষের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। আমরা প্রত্যেকে বায়োলজিক্যাল মেশিন। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, আমরা প্রতিদিন আমাদের মস্তিষ্ককে যেরকম চিন্তা ভাবনার খোরাক দেব, মস্তিষ্কও ঠিক সেভাবেই চিন্তা করবে। অর্থ্যাৎ, বেশি বেশি পজিটিভ চিন্তাভাবনা দিলে মস্তিষ্কের নিউরনগুলো সেভাবে কানেক্টেড হয়ে আমাদের মন মানসিকতাকে পজিটিভ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। এবং এতে করে আমাদের কাজে-কর্মে সুস্থ্য চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটবে।
অপরদিকে, বেশি বেশি নেগেটিভ জিনিস দেখলে ও চিন্তা করলে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে নেগেটিভ বিষয়গুলোকেই আদর্শ হিসেবে মেনে সেভাবে চিন্তা-ভাবনা ও কাজ শুরু করে দেবে।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝতে সহজ হবে। ধরুন, ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের মানুষেরা কেনো এতোটা সফল পৃথিবীতে? কেনোইবা তারা এতোটাই তুখোড় বুদ্ধিমত্তার সাথে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করছে? এর অন্যতম একটা কারণ হলো তাদের চিন্তা ভাবনা প্রচন্ড ভাবে গোছানো এবং পজিটিভ। এরা যেকোনো পরিকল্পনা করে মিনিমাম আগামী ২০০ বছরের হিসেব কষে।এবং নিজেদের জীবনটাকেও তারা ঠিক একই ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আমি যখন অফিসে লাঞ্চ বা কফি টাইমে বসি, আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি জুনিয়র স্টাফ ছেলে মেয়েগুলোর প্রত্যেকের হাতে একটা করে বই। এরা ব্রেক টাইমে বই পড়ে। একে অপরের সাথে বই এর আদান প্রদান করে। বিশ্বের বড়ো বড়ো ইভেন্টগুলো নিয়ে আলোচনা করে। ওয়ার্ড পাজল খেলে। দেশ-বিদেশের ট্রাভেলিং নিয়ে গল্প করে।
আর আমাদের দেশের মানুষেরা নিজেদের ব্রেক টাইমে কোন নায়িকা কাকে বিয়ে করে ভাইরাল হলো, কোন ফুড ভ্লগারের ডিভোর্স কেনো হলো অথবা কোন অশিক্ষিত মহিলা বা পুরুষ একটা চ্যানেল খুলে কাপড় বা ক্রিম বা পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে সবাইকে জঘন্য ভাষায় কথা বলছে সেসব নিয়ে আলোচনায় অনেক বেশি উৎসাহ বোধ করে। মিডিয়াতেও নেতিবাচক খবরের ছড়াছড়ি। ব্যক্তিগত রগরগে খবরের প্রাধান্য, যা জনমত ও জনচিন্তাকে নেতিবাচক ধারায় ঠেলে দেয়।
দিনে দিনে এরকম চরম জঘন্য জিনিস গুলোও আমাদের সমাজে বিনোদন হিসেবে একসেপ্টেড হয়ে যাচ্ছে আর মানুষের চিন্তা-ভাবনায় এসব বিকৃতি অনেকটা জায়গা নিয়ে নিচ্ছে। এবং এর ফলস্বরূপ মানুষের মস্তিষ্ক আস্তে আস্তে এসব চরম নেগেটিভ বিষয় গুলোকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করছে এবং এর ভয়াবহ পরিণতিতে আমাদের সমাজ দিনে দিনে চরম অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষ হারিয়ে ফেলছে তার সূক্ষ্ণ ও গভীর চিন্তার ক্ষমতা এবং ইতিবাচক শক্তিগুলো।
নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে, সমাজে প্রচন্ড অনৈতিক এবং অগ্রহণযোগ্য কার্যকলাপও এখন অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে মানুষ জনের কাছে। মানুষ হিন্দি সিনেমার অনুকরণে পোশাক আশাক পড়ছে, ছেলে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে হিন্দি সিনেমার অন্ধ অনুকরণে। সরকারি অফিসে একটা কাজ করতে গেলে ঘুষ দিতে হবে, এটাই এখন নিয়ম। ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিলেও সেই ব্যক্তিই এখন সমাজে সম্মানিত। গুন্ডা মাস্তানরা অন্যের হাজার একর জমি দখল করে রাজত্ব বানিয়ে রোলস রয়েস চালাবে, আর পুরো দেশ তাদের পা চাটবে, এটাই স্বাভাবিক। ফেসবুক একঘন্টা বন্ধ থাকলে হাজার হাজার স্টেটাস দিয়ে মানুষ তার মূল্যবান সময়ের অপচয় করবে! এরকম হাজারো বিচিত্র সব অস্বাভাবিকতাই যেনো স্বাভাবিকতায় পরিণত হচ্ছে!
আসলে সমাজে একগাদা পাঠ্য বই কাঁধে নিয়ে ছাত্র ছাত্রীরা স্কুলে তো যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই বইয়ের মর্মার্থ আর তাদের কোমল মস্তিষ্কে ঢুকছে না! এর ফলে তাদের জন্যে ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন -হলে প্রয়োজন' - কথাটাই সর্বাংশে সত্যে পরিণত হচ্ছে। আর দিনে দিনে এক মস্তিষ্কহীন জাতিতে পরিণত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে তার উপলব্ধি করার মতো সূক্ষ্ণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাশীল মানুষেরও চরম সংকট দেখা দিয়েছে। তাই আজকাল ভাবতে ভয় হয় যে, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই রাহুগ্রাস সমাজকে কোথায় টেনে নামাবে!