রাজনীতির দুর্দিন



ফরিদুল আলম
ফরিদুল আলম / ছবিঃ বার্তা২৪

ফরিদুল আলম / ছবিঃ বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার ধারণা ছিল একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বিপর্যয়কে সামনে নিয়ে পরাজিত শক্তি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট তাদের সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমে তাদের ভাষায় নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে যাবে। শুরুতে তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের প্রতিবাদের ভাষা প্রকাশ করলেও এটা গিয়ে থেমেছে এদেশে অবস্থানরত কিছু বিদেশী কূটনীতিকদের দরজা পর্যন্ত। হতাশ হলাম।

আমাদের দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন বলতে আসলে আমরা হয়ত এখনও বুঝে থাকি হরতাল, অবরোধ কিংবা জ্বালাও পোড়াও ইত্যাদিকে। সম্ভবত সরকারবিরোধী পক্ষগুলোর, বিশেষত বিএনপি এধরণের আন্দোলন পরিচালনার সমস্ত রসদ ফুরিয়ে বিদেশীদের কাছে নালিশ করাকেই শ্রেয় মনে করছে। এতে বিদেশীরা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে অথবা তারা আদৌ এধরণের নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সরকারের ওপর কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ করার সামর্থ্য রাখে কি না সেটা ভেবে দেখা হচ্ছে না।

একথা ঠিক, একটা সময় ছিল যখন আমাদের সরকার পরিচালনায় বিদেশীদের ইচ্ছা অনিচ্ছা অনেক গুরুত্ব পেত। সেইসব দিন আমরা অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছি। এসব বোঝার জন্য আসলে খুব একটা বিদ্যার প্রয়োজন হয় না। তাহলে যা দাঁড়াল তা হচ্ছে আমাদের বর্তমান সরকারবিরোধী পক্ষগুলো আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তা তারা নিজেই জানে না। আর তাদের এই অজ্ঞানতা এবং অক্ষমতা আসলে সরকারের জন্য তাদের ইচ্ছামাফিক রাষ্ট্রপরিচালনার একটা ব্ল্যাংক চেক দেয়ার সামিল। আমার বিশ্বাস সরকার আগামী দিনগুলোতে বিরোধীদের দেয়া ব্ল্যাংক চেকের ওপর ভিত্তি করেই তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এটা আসলে আমাদের দেশের রাজনীতির এক ভয়াবহ দুর্দিনের প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বর্তমানে যেভাবে পরিচলিত হচ্ছে এবং ক্রমেই যেভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে উন্নয়নের প্রতিটি সূচকেই এগিয়ে যাচ্ছে এমনটা পরীবীক্ষণ করলে অনেকের কাছে মনে হতে পারে যে এখানে রাজনীতির মাতামাতি বা বাড়াবাড়ি উন্নয়নের ধারায় ছন্দপতন ঘটাতে পারে। মানুষ এখন ভাল আছে, সন্তুষ্ট আছে একথা যেমন সত্য, আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে আমরা অনেক দৈন্যদশার মধ্যে পতিত হয়ে যাচ্ছি।

রাজনৈতিক দলগুলোর বহুমাত্রিকতাতো উন্নয়নেরই আরেক প্রতিচ্ছবি। অনেকে হয়তো যুক্তি দিয়ে বলতে পারেন এশিয়ার জাপান এবং সিঙ্গাপুরের মত দেশে বিরোধী দলের অবস্থা যাচ্ছেতাই।

এইতো কয়েকবছর আগে জাপানের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জাপান (ডিপিজে) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মত রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হবার সুযোগ পেলেও তাদের সরকারের এক বছরের কম সময়ের মধ্যে পতন ঘটে এবং আবারও লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়।

আবার মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে, আমরা যদি পশ্চিমা গণতন্ত্রের উদাহরণ বাদও দিই তাহলে দেখতে পাব যে এশিয়ার অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই সরকারের বিপরীতে শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে। আমাদের দেশেওতো ছিল। আজকের যে দল সরকারে রয়েছে তারাওতো ৭৫ পরবর্তী ২১ বছর বিরোধী দল হিসেবে রাজনীতির অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে আজ রাষ্ট্রক্ষমতায়। অনেকে হয়তো এটা বলার চেষ্টা করবেন যে সরকার এদেশের বিরোধী দলগুলোকে মাঠে নামতে দেয় না, নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করে জেলে রেখেছে এবং অনেককে গায়েবী মামলার আসামী বানিয়েছে। যারা এমনটা বলেন তারা কি একটিবারের জন্য একটু পেছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করেন যে আজকের আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় কি নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছে? একটিবার যদি শুধু এটি ভাবেন যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে যে ১৭ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে তার প্রতিটিতেই তিনি রক্ষা পেয়েছেন ঐশ্বরিক কৃপায়। আজকের শেখ হাসিনা এমন একজন বলিষ্ট নেতৃত্বের অধিকারী হতে পেরেছেন কেবল বারবার নতুন জীবন পেয়ে।

৯৬ পরবর্তি সময়ে ১৫ বছর পার করে ১৬তম বর্ষে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বে এমন কোনো উদাহারণ দেয়া যাবে না যা থেকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাফাই গেয়ে কেউ বলতে পারেন যে বেগম জিয়া বা তার পরিবারকে এভাবে নিঃশেষ করার একটিবারের জন্যও চেষ্টা করা হয়েছে।

তাহলে অবস্থাদৃষ্টে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে একদা আমাদের দেশের মানুষ ৫ বছর অন্তর নতুন সরকার দেখার যে পণ করতেন সেখানে ব্যাত্যয় ঘটায় বিরোধী রাজনীতি আজ মরতে বসেছে।

আমি এখানে নিছক আওয়ামী লীগ বা বিএনপি রাজনীতির সমর্থক হিসেবে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। যে বিষয়টিকে একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে চাই তা হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্যতা। এখানে আমি সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে দেশের যে উন্নয়ন হচ্ছে সেটি খাট করে দেখতে চাই না। তবে কেবল নির্দ্বিধায় এটা বলতে চাই আজকের এই অর্জনের মূলে রয়েছে একজন শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, সততা এবং নিষ্ঠা। আর সেজন্য দেশে অপরাপর রাজনৈতিক চর্চার অনুপস্থিতি থাকবে সেটার কোনো মানে নেই, বরং উন্নয়নের যে মিছিলে আজ আমরা সামিল হয়েছি তা অব্যাহত রাখতে একটি সুস্থ রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির ভীষণ প্রয়োজন।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে আজকের আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি বলা হয়ে থাকে মহাথির মুহাম্মদকে। প্রথম দফায় তিনি প্রায় দুই দশক সরকার পরিচালনার পর পরবর্তি সরকারগুলো তারই উন্নয়নের দর্শনের আলোকে মালয়েশিয়ার শাসনকাজ অব্যাহত রেখেছিল। গত বছর আবার পাকাতান হারপান নামক রাজনৈতিক দলের ব্যানারে তিনি সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জনগণ আবার নতুন আশায় বুক বেধেছে। এখানে যে বিষয়টি বলা যেতে পারে তা হচ্ছে উন্নয়ন একটি চলমান পদক্ষেপ, আর সেটা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করতে হবে সকল রাজনৈতিক দলকে।

আমরা কোনভাবেই এটা প্রত্যাশা করতে পারি না যে একজন শেখ হাসিনাকেই সবসময় আমরা এভাবে ধরে রাখতে পারব, সেটা সম্ভব নয় এবং উচিৎ নয়, বরং তার সরকারের সকল ইতিবাচক কাজগুলোকে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। আর সেজন্য দরকার একটি সুস্থ ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

আমি চাই এবং আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আমরা সকলে চাই দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক ধারা চালু থাকুক। আর এই সুস্থ রাজনীতি বলতে আমি বুঝাতে চাইছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাজনীতি। মৌলবাদ, উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গীবাদের বিপরীতে দেশ গঠনের জন্য সত্যিকার অর্থে জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার রাজনীতি। সে সাথে আমি এটাও উল্লেখ করতে চাই আমাদের দেশের শান্তিকামী জনগণ আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এমন রাজনীতি দেখতে চান এবং এখানে চাওয়া পাওয়ার বিপরীতে ব্যাপক ফারাক থাকায় আজ বিরোধী রাজনীতি প্রতি পদে মার খাচ্ছে।

গেল নির্বাচনে আমরা দেখলাম এই একই ধরণের রাজনৈতিক ভুলের কারণে অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করার কারণে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলকে চরম মূল্য দিতে হল। যেখানে দলের বেশীরভাগ নেতা কর্মীর চাওয়া দলকে মৌলবাদী এবং যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকে মুক্ত করে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের আলোকে একটি প্রগতিশীল ধারায় পরিচালিত করতে সেখানে কেবল ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছার কারণে চরম এই রাজনৈতিক মূল্য দিতে দিতে দল আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আজ যদি বিএনপি এমন সিদ্ধান্তে আসে যে এখন থেকে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে কোনো আপোষ করবে না তবে তারা রাতারাতি ব্যাপক জনসমর্থন পাবে। তবে এটাও জানি তারা কোনভাবেই এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারবে না। এ এক রহস্য। আর এই রহস্য ভেদ করতে গেলে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তনের বিকল্প নেই। আজ দল যেভাবে ধ্বংসের কিনারে দাঁড়িয়ে তা থেকে উদ্ধারে সংস্কারের প্রয়োজনে দলের নেতৃত্বের একটা অংশ নিশ্চয়ই সামনে এগিয়ে আসবেন। তবে সেটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।

গেল নির্বাচনে দলের ৬ জন এবং গণফোরামের ২ জনসহ সর্বমোট ঐকফ্রন্টের ৮ জন সাংসদ শপথ নেবেন না বলে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটা তাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারে, কেননা গণফোরামের সাংসদরা শপথ নিতে আগ্রহী, তাছাড়া শপথ না নিয়ে তারা যদি এটাকে ফলপ্রসু কোনো ইস্যুতে পরিণত করতে না পারে তবে এটা হবে আরেক ভুল।

তাদের প্রতি পরামর্শ থাকবে, একটু জেগে উঠুন, দেশের রাজনীতিতে ভীষণ দুর্দিন চলছে। কেবল উন্নয়ন নয়, আমরা চাই একই সাথে সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

   

রাজনীতির বিভক্তি: মার্কিন সম্পর্ক মূল্যায়নে যে তাগিদ বিশ্লেষকদের



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

দু’দিনের সফরে মঙ্গলবার ঢাকা এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। গেল ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ফের ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী আইলিন লাউবাখেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সফরের পর ডোনাল্ড লু’র এই সফর দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। মি. লু’র এই সফরকে ঘিরে ইতিমধ্যেই পরস্পরবিরোধী বাক্যবাণ ছোঁড়াছুড়ি শুরু করেছেন দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র নেতারা।

তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে ডোনাল্ড লু’র এই সফরকে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশকে বিদ্যমান এই সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকেই জোর দেওয়া উচিত।

সাবেক পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ ও কুটনীতিক অ্যাম্বাসেডর ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ডোনাল্ড লু’র এই সফর নিয়ে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘নতুন সরকার আসার পর ডোনাল্ড লু’র এটি অফিসিয়াল লেভেল রুটিন ভিজিট। আমার মনে হয় নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার অংশই এই সফর। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কোন মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার এই সফরটা হচ্ছে।’

‘তিনি কি বলবেন এই সফরের পর হয়ত জানা যাবে, তাই পূর্বমূল্যায়ন না করেও দৃশ্যত যেটি বোঝা যাচ্ছে, মি. লু’র এই সফর বাংলাদেশকে নতুন করে স্টাডির অংশ। তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নেই কাজ করবে। আশা করব, দুই দেশই সম্পর্ক ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকে জোর দেবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে একে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না’-যোগ করেন সাবেক এই পেশাদার কুটনতিক।

বৈশ্বিক সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের আরও পরিণত চর্চার তাগিদ দিয়ে একুশে পদকজয়ী বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বলেন, ‘নানা বিষয়ে মতামত-মন্তব্য করাটাই রাজনীতিবিদদের কাজ। এখানে কেউ পরিপক্কভাবে দিতে পারে, কেউ পারেন না। আমেরিকা যেহেতু বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থারও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বাংলাদেশও সেইসব সংস্থার থেকে সাহায্য নিচ্ছে; তাই সচরাচর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চেয়েও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেক বর্ধিত, এটা স্বীকার করতেই হবে। রাজনীতিবিদদের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে তাদের রাজনৈতিক চর্চা করা উচিত।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘একধরণের দৃশ্যমান এজন্ডা তো তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) আছেই, যেমন-গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি। এসব বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করাটাও তাদের রীতি। আবার সম্পর্কটাকে চালিয়ে নেওয়াও তাদের বৈশিষ্ট্য। ডোনাল্ড লু এসেছেন হয়ত সেই চাপকে অব্যাহত রাখতেই। তার মানে এই নয় যে-বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের যে চলমান সম্পর্ক সেখানে তাত কোন প্রভাব পড়বে।’

আবুল মোমেন বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে যেটি দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে দুটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারত ও চীনের সঙ্গে একইসঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে রয়েছে। আমেরিকাও তৃতীয় আরেকটি শক্তি-সেই দিক থেকে এটা ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এক ধরণের সুবিধাও বটে।’

‘বাংলাদেশের তো এখন উপায় নেই-সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলতে হবে। বাংলাদেশ যদি মালদ্বীপের মত ক্ষুদ্র দেশ হতো তাহলে হয়ত চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ঢুকে গিয়ে চলার কথা ভাবতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বড় দেশ। রাজনৈতিক আকাঙ্খাও বহুমুখি। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে মালদ্বীপের মত স্ট্যান্ড নেওয়া সম্ভব নয়’-বলেন প্রভাবশালী এই কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

উল্লেখ্য, ডোনাল্ড লু সফরকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এ ছাড়া বৈঠক করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও। সফরকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময়ের কথা রয়েছে তাঁর।

;

ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কারণ ও প্রভাব



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণা ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব অর্জন করছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হলো, ব্যক্তির স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন এবং আত্মপ্রকাশের ওপর জোর দেওয়ার একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা।

এটি ব্যক্তিকে সমাজের নিয়ম ও রীতিনীতির চেয়ে নিজস্ব মূল্যবোধ ও বিশ্বাস অনুসরণ করার অধিকার প্রদান করে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বৃদ্ধির অনেকগুলি কারণ রয়েছে। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া ব্যক্তির জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যক্তির আরো স্বাধীন ও আত্মনির্ভর হতে সাহায্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইন্টারনেটের প্রসার ব্যক্তির তথ্য ও জ্ঞানের অভূতপূর্ব ‘অ্যাক্সেস’ প্রদান করেছে, যা তার নিজস্ব মতামত গঠন এবং তার নিজস্ব পছন্দ অনুসরণ করতে সাহায্য করে।

বিশ্বায়ন বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধারণার সংস্পর্শে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। এর ফলে ব্যক্তি তার নিজস্ব পরিচয় ও মূল্যবোধ সম্পর্কে আরো সচেতন হয়ে উঠেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যক্তি ঐতিহ্যবাহী নিয়মকানুন ও রীতিনীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন এবং তার নিজস্ব মূল্যবোধ অনুসারে জীবনযাপন করার জন্য আরো বেশি স্বাধীনতা চাইতে শুরু করেছেন।

আধুনিক সমাজে ব্যক্তিগত সম্পদ ও সাফল্যের ওপর জোর দেওয়া হয়। এর ফলে ব্যক্তি নিজস্ব লক্ষ্য ও স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে শেখেন। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা ও কর্মজীবনের ওপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি তার নিজস্ব জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তার নিজস্ব স্বপ্ন পূরণ করতে আরো বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

'নারীবাদ', 'হিজড়া' অধিকার আন্দোলন ইত্যাদির মতো সামাজিক আন্দোলনগুলি ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমতা ধারণার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই আন্দোলনগুলি ব্যক্তি তার নিজস্ব পরিচয় গ্রহণ করতে এবং তার নিজস্ব অধিকারের জন্য দাঁড়াতে উৎসাহিত করেছে।

ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ, যেমন পারিবারিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক রীতিনীতি, অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও আত্মপ্রকাশের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হতে পারে। এর ফলে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের প্রতি হতাশাবোধ করতে পারেন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন।

প্রযুক্তির অগ্রগতি ব্যক্তির তথ্য ও জ্ঞানের অভূতপূর্ব ‘অ্যাক্সেস’ প্রদান করেছে। এর ফলে ব্যক্তি বিভিন্ন ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়েছেন, যা তার নিজস্ব মূল্যবোধ ও বিশ্বাস গঠনে সাহায্য করেছে।

মানুষ স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা পছন্দ করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তির নিজস্ব জীবনযাপন এবং নিজস্ব পছন্দ অনুসরণ করার স্বাধীনতা প্রদান করে। এর ফলে অনেকেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। তবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকও রয়েছে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ ও বিশ্বাস অনুসরণ করার স্বাধীনতা প্রদান করে। এটি সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং ব্যক্তিগত বিকাশকে উৎসাহিত করে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিভিন্ন ধারণা ও জীবনধারার প্রতি সহনশীলতাকে উৎসাহিত করে। এটি একটি আরো বৈচিত্র্যময় এবং গ্রহণযোগ্য সমাজ তৈরিতে সাহায্য করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিকে নিজস্ব পছন্দ ও কর্মের জন্য দায়িত্বশীল করে তোলে। এটি ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং সামাজিক উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করতে পারে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তির নিজের ওপর জোর দেওয়ার ফলে সমাজের মধ্যে সংযোগ ও বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার ফলে সামাজিক অস্থিরতা ও সংঘাত বৃদ্ধি পেতে পারে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তির মধ্যে একাকী ও বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করতে পারে।

‘নারীবাদ’ আন্দোলন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল এবং এর ফলে নারীদের জন্য ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অতিরিক্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ পারিবারিক মূল্যবোধের দুর্বলতা এবং পারিবারিক বিচ্ছেদের দিকে পরিচালিত করতে পারে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আধুনিক সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনেরই প্রভাব রয়েছে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা এবং বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি এটি সামাজিক বন্ধন দুর্বল করতে পারে এবং ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি করতে পারে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সুবিধাগুলি কাজে লাগানো এবং এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবগুলি প্রশমিত করার জন্য ব্যক্তি, সমাজ, বেসরকারি সংস্থা এবং সরকারের পক্ষ থেকে সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;

আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ



ইরাজ নূর চৌধুরী
আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ

আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশকে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনে গ্রাউন্ড স্টাফ লেভেলে চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশকে এই কিস্তিতে আইএমএফ পূর্ব নির্ধারিত কিস্তির প্রায় দ্বিগুণ ১.২ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাংলাদেশকে প্রদান করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ইস্যুতে পিছিয়ে পড়া সামাজিক গোষ্ঠীর সুরক্ষা প্রদান, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটি জানায়। ৪২ মাসে সাতটি কিস্তির মাধ্যমে এই ঋণ বাংলাদেশকে দেওয়া হবে বলে জানায় সংস্থাটি। এই কিস্তি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে বলেও তখন জানানো হয়।

বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে এর আগে আরও দুই কিস্তিতে ঋণ পেয়েছে। এসময় সরকার আইএমএফের শর্তগুলো আংশিক পূরণ করতে পারলেও রিজার্ভ বাড়ানো, কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির মতো শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। গত জুনে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার জন্য শর্ত আলোচনার ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে আইএমএফের একটি দল ১৫ দিনের সফরে এসে সরকারের সাথে তাদের ঋণের শর্তগুলো পূরণ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছে।

আইএমএফের এই দল ঋণের কিস্তির অনুমোদনের জন্য সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ জানায়। এর মধ্যে ডলারের মান বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, সেবা, শিক্ষা ও কৃষিখাতে কর আরোপ, ৩ কোটি টাকার বেশি রেভিনিউ উৎপাদনকারী ব্যবসায় ১৫ শতাংশ কর আরোপ অন্যতম। এছাড়া আইএমএফ বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও মুদ্রাস্ফীতি রিজার্ভ বাড়াতে সরকারের কর্মপরিকল্পনা ও জ্বালানি বিল নিষ্পত্তিতে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে।

আইএমএফের এমন শর্তাবলির কারণে আসন্ন বাজেটে জনগণের উপর নতুন করে নানামুখী কর-এর খড়গ নেমে আসতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। আইএমএফের শর্তাবলির কারণে ইতোমধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, তেল ও গ্যাসের বৃদ্ধিসহ নানা কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে সিংহভাগ মানুষের। এরই মধ্যে সেবা, শিক্ষা, কৃষিতে ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হলে দ্রব্যমূল্যসহ সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ব্যাংকে আর্থিক অনিয়মের কারণে আমানতে যে মন্থরতা দেখা গিয়েছিল, ঠিক সেই ধরনের মন্থরতা দেখা যাবে বিনিয়োগে। ফলে সরকার নির্বাচনে কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই প্রতিশ্রুতি অনেকটাই বিঘ্নিত হবে।

২০২৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ বছরও এমন অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগ কম হবে বলে ধারনা করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভ অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় কম রয়েছে। সরকার আমদানি কমিয়ে রিজার্ভ রক্ষার যে চেষ্টা করেছিল সেটি তেমন কাজে আসছে না। ডলারের বিনিময় হার বেঁধে দেওয়া হলে সেই বিনিময় হার কম হওয়ায় ২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে বৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা কম এসেছে। হুন্ডি ও অবৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। সরকার রেমিট্যান্স প্রদানকারীদের যে প্রণোদনা দিয়েছিল সেটিও খুব বেশি কাজে দেয়নি। দেশে প্রথম দশ মাসে ১৯.১১ বিলিয়ন ডলার এসেছে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে বাংলাদেশ এই অর্থবছরেও ২৩ বিলিয়ন ডলার পাবে। যা রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। এমন মুহূর্তে আইএমএফ ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে এবং সরকার ডলারের দামও বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে দেশে হুন্ডি ও অবৈধ পথে টাকা পাঠানো বন্ধ হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। এছাড়াও চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ কম হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ ১৬ শতাংশ কমেছে। তা বাড়ার তেমন কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

এছাড়াও দেশে কর ছাড়ের প্রবণতার কারণে পোশাক শিল্প ছাড়া আর তেমন রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে উঠেনি। ফলে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যের অভাবেও দেশের রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এছাড়া আইএমএফ তার ঋণের কিস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ করা ও প্রয়োজনীয় রিজার্ভ ২০.১০ বিলিয়ন থেকে ১৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার করা ইঙ্গিত দেয় যে খুব সহসা এই বৈদেশিক মুদ্রার সংকট হবে। এই সমস্যা সমাধানে একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

আবার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়েছে একবছর আগে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তেতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বছরে চার বার আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে সেই দাম নির্ধারণ করার কথা বলেছে আইএমএফ। এছাড়াও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প উৎপাদন হুমকির মধ্যে পড়েছে। মফস্বল ও গ্রামে নিয়মিত লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এই সমস্যার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ জ্বালানি সংকটকে দায়ী করছে। রিজার্ভ সংকটের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। এই জ্বালানি তেলের সংকট সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকুর বিল পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ আরও কমবে। 

সরকার রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কর বৃদ্ধি ও কর আরোপের মত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার ফলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে বটে। তবে এতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ আর থাকছে না। দেশে বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে কর্মসংস্থান কম হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বেকারত্বের পরিমাণ ৩.৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের চলমান জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ আদায় নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও দেশের খেলাপি ঋণ আদায়ে তেমন কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দুই শতাংশ ডাউন-পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিল করার মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের যে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তাতে দেশের ব্যাংকিং খাত আরও বেশি বিপন্ন হবে বলে ধারনা করা যাচ্ছে। তথাপি ঋণ আদায় হলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। এতে করে আইএমএফের ঋণ শর্তাবলি পূরণ করাও যেমন সহজ হবে তেমনই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর চাপও প্রশমিত হবে।

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারকে আইএমএফের সকল শর্ত পূরণ করতে হবে। এই সকল শর্তের চাপ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষকে মুক্ত রাখতে সরকারকে উচ্চশ্রেণি ও ব্যবসায়ী মহলের প্রতি কঠোর হতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ করা, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ভবিষ্যতে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এছাড়াও মুদ্রা পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলে এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশ মুক্তি লাভ করতে পারবে।

লেখক: ইরাজ নূর চৌধুরী, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

;

এত ক্ষত প্রকৃতি সহ্য করবে কেন?



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার প্রখরতা বাড়ছে। এবছর বাংলাদেশজুড়ে দুঃসহ তাপপ্রবাহ বিরাজ করায় এর প্রভাব পড়েছে অনেক গুণ বেশি। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে প্রকৃতির এত বৈরী আচরণ আর কখনও চোখে পড়েনি বলে অনেক বয়স্ক ব্যক্তিরা অভিমত পোষণ করেছেন। গরমের কারণে এবছর প্রথম হিট এলার্ট জারি করার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোথাও সীমিত আকারে ক্লাস নেয়া ও ঢাবি, জাবি-তে অনলাইনে পাঠদানের আদেশ জারি করা হয়েছে। ছয়দিন পর দ্বিতীয়বার পুনরায় হিট এলার্ট জারি হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দেশের নানা স্থানে হিট স্ট্রোকে গৃহবধূ, কৃষক, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ট্রাফিক পুলিশ, বৃদ্ধসহ ষোল জনের প্রাণহানির খবর পওয়া গেছে।

এ অসহনীয় তাপমাত্রায় শিশুদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে ইউনিসেফ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ইউনিসেফ বলেছে, ‘বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে শিশুরা। অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে নবজাতক, সদ্যোজাত ও অল্পবয়সী শিশুদের জন্য। হিট স্ট্রোক ও পানি শূন্যজনিত ডায়রিয়ার মতো, উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে সৃষ্ট অসুস্থতায় এই বয়সী শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।’

শিশু ও বয়স্করা সূর্যের অতি তাপজনিত কারণে বেশি বেশি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভিড় করছে। বড় বড় শহরের অভিজাত এলাকায় বিদ্দ্যুৎ সরবরাহ অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও বস্তি ও গ্রামের মানুষ বিদ্দ্যুৎহীনতায় হাঁসফাস করছেন। অতি খরার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২৫-৩৮ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি জমিতে সেচের পাম্পে পনি উঠছে না। গৃহস্থলির কাজে নিত্য ব্যবহার্য্য হস্তচালিত নলকূপে পানি না উঠায় সেগুলো বন্ধ হয়ে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়ে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও বরেন্দ্র এলাকার অনেক জায়গায়। গড়াই, তিস্তা প্রভৃতি নদীতে প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহ না থাকায় ডালিয়া, জিকে ইত্যাদি সেচপ্রকল্পে বোরো ধানের জমিতে সেচ দেয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ঝিনাইদহে পাম্প ও প্রকল্পের ক্যানেলে পানি না থাকায় সেচকাজ বন্ধ রয়েছে। শহর এলাকার অগভীর নলকূপে পানি উঠানো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহুতল ভবনের ছাদের মধ্যে শখের ছাদবাগান বাঁচানো নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন অনেক সৌখিন ছাদবাগানী।

অনেক জেলায় বোরোধান, ভুট্টা, আখ, শাক-সবজির ক্ষেত মরে যাচ্ছে। বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রস না থাকায় কাউন ও পাটের চারা গজাচ্ছে না। সূর্যের মাত্রাতিরিক্ত তাপে নতুন বোরা ধানের শীষ বেরানোর পর চিটা হয়ে যাচ্ছে।

আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিদের এবার মাথায় হাত পড়েছে। ব্যাপক হারে আমের মুকুল বের হলেও ফেব্রুয়ারিতে একদিনের টানা বৃষ্টির পর প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ চরম ভ্যাপসা গরমে ৯০ ভাগ আম ও ৭০ ভাগ লিচুর মুকুল ঝরে গছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ক্যাম্পাস ও আশেপাশের এলাকার হাজার হাজার আমগাছের ৯৯ ভাগ আম ঝড়ে গেছে। সেগুলোতে তাকালে শুধু মুকুলের শুকনো খালি ডান্ডাটি চোখে পড়ছে! ক্যাম্পাসে বসবাসরত শিক্ষার্থীরা এবার টিফিনের সময় ঘটা করে আম পেড়ে খেতে পারবে না বলে হতাশা প্রকাশ করছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় এরপরও যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সেগুলো বৈশাখের অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ক্রমাগত ঝরে পড়ছে। তাই এ বছর ফলন বিপর্যয়ে আমচাষি ও আমবাগান লিজ নেয়া ব্যবসায়ীরা দিশেহারা, তাদের গভীর দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে।

আম ছাড়াও সব ধরনের কৃষি উৎপাদনে প্রায় সারা দেশে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এবারের গ্রীষ্মকালীন ফল-ফসলের ফলন বিপর্যয়ে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের আরো একধাপ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালকসহ সব খেটে খওয়া মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে বহুগুণ।

গরমে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পিচ গলে গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গা ও রাজধানীর রাজপথে কার্পেটিং গলে উঁচু-নিচু হয়ে গাড়ির চাকায় তরল বিটুমিন আটকানোর সংবাদ হয়েছে। কর্মচঞ্চল দিন কর্মস্থবির হয়েছে।

এমনকি দিনের বেলা সূর্যের খরতাপে হিটস্ট্রোকের ভয়ে মাঠের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক জায়গায় পাকা দান রক্ষার জন্য কৃষররা রাতের বেলা চাঁদের আলোয় ধান কাটার কাজ করছেন। যা অনেকটাই অস্বাভাবিক। গরমের কারণে রাতের বেলাতেও মানুষ রাস্তায় হাঁটতে বের হতে সাহস করছেন না।

এবছর প্রকৃতির এমন বৈরী আচরণকে কেউ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তবুও নিরুপায় হয়ে প্রকৃতির এই চরম সিদ্ধান্তকে মানতে মানুষ বাধ্য হচ্ছে।

এরপরও আবহাওয়া অফিস থেকে এখনও বৃষ্টি হবার কোন সুখবর নেই। এরই মাঝে দেশের বিভিন্ন জেলার খরাক্রান্ত মানুষ বৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে ইসতিসকার নামাজ আদায় করে বৃষ্টিভিক্ষা করে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। এটাতো গেল আমাদের দেশের বৃষ্টিহীন পরিস্থিতির কথা।

এর মাঝে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে হঠাৎ করে মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে অতিবৃষ্টিপাতের ফলে ফ্লাশ-ফ্লাড ঘটেছে। মরুভূমিতে অবস্থিত উভয় দেশে শতাধিক প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা জেনে কেমন জানি অদ্ভুত এক সময়ের কথা মনে হচ্ছে। প্রাচীনকালে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর অবাধ্য ও পাপিষ্ঠ জনবসতিতে অতিখরা ও অতিবৃষ্টি বা মহাপ্লাবনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শাস্তি নাজিল হবার ঘটনা আমরা জানি। দেশে দেশে কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ সে ব্যাপারে সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। এর পরেও কিছু মানুষ বিভিন্ন কারণে সেসব বাণী ভুলে গিয়ে চরম অবাধ্য ও বেপরোয়া জীবন যাপন করে। বিশেষ করে মানুষ আল্লাহ নির্দেশিত সীমা লঙ্ঘণ করে প্রকৃতির ওপর যখন অযাচিতভাবে নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ চালায় প্রকৃতিও তখন মানুষের উপর নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতে দেরি করে না।

তাই সৌদি আরব, ওমান বা মরুর দেশের বিলাসী শহর দুবাইয়ে বন্যা, হিমালয়ের পাদদেশে সিকিমে ফ্লাশফ্লাড, রাশিয়া, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, জাপান প্রভৃতিতে হঠাৎ বন্যা, সুনামী ইত্যাদি একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কথা হলো, দেশে দেশে এসব দুর্যোগ কেন এত ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে? বাংলাদেশে নাতিশীতষ্ণোমন্ডলে অবস্থিত হবার ফলে কেন এত বেশি তাপমাত্রাবৃদ্ধি সমস্যায় পড়ছে? কেন এমন দুর্যোগ হচ্ছে? জলবায়ুর অভিঘাত কেন এত ভয়ংকর রুপে আবির্ভূত হয়ে মানুষের জানমাল কেড়ে নিতে উদ্যত হচ্ছে?

এসব প্রশ্নে উত্তর মানুষের কাছে জানা। তদুপরি মানুষ আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে প্রকৃতি বিনাশে অতি তৎপর। বানাচ্ছে কংক্রীটের পাহাড়, বাড়ছে এসি, ফ্রীজের ব্যাপকতা। গাছ উজাড়, ঘাস নেই, জলাধার ভরাট, সূর্যের তাপে ধ্বংস হচ্ছে মাঠের ফসল, মাছ, পোল্ট্রি। নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা।

বাংলাদেশের প্রবল খরতাপে হিট এলার্ট জারিকৃত সময়ের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ন্যাম এক্সপো নামক জলবায়ু সম্মেলণ। চারদিনব্যাপী এই সম্মেলণে ১০৪টি দেশের গবেষক ও প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে প্রকৃতির খেয়ালী আচরণের প্রেক্ষিতে ধ্বংসলীলা সামলানোর জন্য নানা ইতিবাচক সুপারিশ প্রদান করে গেছেন। বাংলাদেশ দাবী করেছে যে, পৃথিবীতে কার্বণ নি:সরণের ১০০ ভাগের মধ্যে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৩৮ শতাংশ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে এই ক্ষুদ্র দেশটি। এর জন্য দায়ী কে বা কারা?

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে তোলার জন্য দায়ী দেশগুলো গাড়ি, এসি, ফ্রীজ, ভারী যন্ত্রাংশ, মারণাস্ত্র ও বিষাক্ত কেমিক্যাল তৈরী ও সেগুলোর জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব মানবতা বিধ্বংসী মারণাস্ত্র বিক্রির আয়ের উপর তাদের অর্থনীতি মজবুত হয়ে টিকে থাকার প্রয়াস পায়। মারণাস্ত্র বিক্রির আয় কমে গেলে তারা সেগুলোর বিক্রি বাড়ানোর জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে দেবার পায়ঁতারা করে। সেখানে তারা সাফল্য লাভ করে বীরদর্পে টিকে থাকে। তারাই আবার দরিদ্র বিশ্বকে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষা করার প্রেসক্রিপশন বাতলানোর জন্য সেমিনার ও কনফারেন্স আয়োজনের জন্য সহায়তা করে।

এসব ঘৃণ্য কৃতকর্ম ও নীতির বৈপরিত্যের মাঝে বিস্তর শুণ্যতা অবলোকন করে প্রকৃতি মুচকি মুচকি হাসছে। আর বার বার ঘটানো এসব জঘণ্য কার্যকলাপ সহ্য করতে না পেরে প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয়েছে।

কারণ, মানুষের এতসব অন্যায় প্রকৃতি আর কত সহ্য করবে? মুহর্মূহ: প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ, নির্বিচারে প্রকৃতির সাজানো অবয়ব ও কাঠামোর বিনাশ সাধন প্রকৃতি বার বার সহ্য করবে কেন?

মানুষের কারণে মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণহীন করে মানুষের জানমালের ক্ষতির ভয়ে লাল সংকেত স্বরূপ হিট এলার্ট জারি করছে। প্রাণভয়ে মানুষ প্রকৃতির স্মরণাপন্ন হয়ে আঁকুতি জানিয়ে হাজারো উন্মুক্ত মাঠে ইস্তিসকার নামাজ পড়ে কান্নাকাটি করে বুক ভাসাচ্ছে। কিন্তু তওবা করেও ফিবছর আবারো প্রকৃতি বিনাশে তৎপর হয়ে উঠছে কেন? আসলে মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে বড়ই অকৃতজ্ঞ। যেমন অকৃতজ্ঞ বিভিন্ন আর্থ-সামজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, মানসিক প্রতিজ্ঞার প্রতিপালনের বেলায়। এজন্য প্রকৃতি হঠাৎ করে বড় রুষ্ট হয়ে উঠে।

প্রতিদিন কত বাঁধ বা ড্যামে কত ট্রিলিয়ন কিউসেক পানি প্রকৃতির বুকে চেপে আটকানো হচ্ছে? মহাসাগরের বুকে কত কোটি টন ক্ষতিকর বর্জ্য ডাম্পিং করা হচ্ছে? ভূপৃষ্ঠের আকাশে বাতাসে কত লক্ষ লক্ষ টন বিষাক্ত বোমা ফাটানো হচ্ছে, কত শব্দ কত ঝলকানি দিয়ে নীরবতা ভেঙ্গে প্রৃকতির নিয়মের উপর বাহাদুরি করা হচ্ছে- অকৃতজ্ঞ মানুষ কি সেগুলোর হিসেব মাথায় রাখতে পেরেছে? প্রৃকতির উপর এত আঘাত, এত নিষ্ঠুর পরীক্ষা, এত ব্যবচ্ছেদ, এত ক্ষত নির্বাক প্রকৃতি সেটা বারংবার সহ্য করবে কেন? তাই হিট এলার্টের কবলে এবার আমাদের চিরসবুজ বদ্বীপ বাংলাদেশ!

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

;