ভরসার প্রতীক



ড. আতিউর রহমান

  • Font increase
  • Font Decrease

আজকের দুনিয়া প্রযুক্তি-নির্ভর। ব্যবসা-বাণিজ্য-শিক্ষা সবই আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভর করেই এগুচ্ছে। কোনো কোনো দেশ প্রযুক্তি হস্তান্তরে খুবই দূরদর্শী ছিল বলেই আজ তারা উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। দক্ষিণ কোরিয়া তেমন এক দেশ। ঊনিশশো ষাটের দশকেও দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় আমাদের ওই সময়ের অবস্থার মতোই ছিল। সে সময় দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল (১৯৮০ সালের মূল্যে) মাত্র ৮৭ ডলার। আর আজ তা তিরিশ হাজার ডলারেরও বেশি। আমাদেরও তখন মাথাপিছু আয় এর ধারে কাছেই ছিল। ওরা এতটা এগিয়ে গিয়েছে প্রযুক্তি গ্রহণ করার সক্ষমতার জোরে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রযুক্তি নির্ভর করার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে সাহায্য করেছে সরকার। উদ্ভাবন ও উন্নয়ন খরচের ৮৫ শতাংশই আসে ব্যক্তিখাত থেকে। মোট জিডিপির প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ খরচ হয় এই খাতে। অথচ ১৯৮১ সালেও তা ছিল মাত্র .৮১ শতাংশ। বর্তমানে দশ হাজারেরও বেশি পিএইচডি ব্যক্তিখাতের নানা কোম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে কাজ করেন।

আমাদের বেলায় ঠিক তার উল্টো। বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আমদানি আমরা ঠিকই করছি। কিন্তু এই প্রযুক্তিকে ‘আনবান্ডল’ করে তাকে দেশোপযোগী করে উপযুক্ত উদ্ভাবন করার ক্ষেত্রে আমাদর জনশক্তি খুবই পেছনে। তাই আমাদের উৎপাদনশীলতাও সে হারে বাড়ছে না। তবে সম্প্রতি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবার যে সংকল্প গ্রহণ করেছে তার ফলে নয়া তরুণ উদ্যোক্তার বিকাশের বেশ কিছু ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আর ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যেই এই উদ্যোক্তাদের সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে। প্রযুক্তি বাইরে থেকে নিশ্চয় আনতে হবে। তবে তা আমাদের প্রয়োজনমতো গড়ে পিটে নেবার সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে। যেমন ধরুন, আমাদের মোবাইল আর্থিক সেবা উন্নত বিদেশি প্রযুক্তি নির্ভর একটি ডিজিটাল ব্যবসা। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা বিদেশি ‘আলীবাবা’র প্রযুক্তি গ্রহণের জন্যে অংশীদারত্ব ভাগ করে নিতে দ্বিধা করিনি। কিন্তু আমরা মালিকানার প্রধান অংশ আমাদের হাতেই রেখেছি। ‘কাজ করে করে শেখার নীতি’ গ্রহণ করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের উদ্যোক্তাদেরও অনুধাবন করতে হবে যে, উদ্ভাবন ও গবেষণায় তাদেরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারও সে জন্যে তাদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে দ্বিধা করবে না। যদিও আমাদের বাজেটে এ বিষয়ে খানিকটা ঘাটতি রয়েছে, তবুও বলব ধীরে ধীরে দিন বদলাচ্ছে। সরকার ও উদ্যোক্তারা মিলে মিশেই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি হচ্ছে আমাদের উদীয়মান উদ্যোক্তারাই। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই শক্তিকে আরো মজবুত করতে আমরা কী ধরনের নীতি-সমর্থন দিতে পারি। সেজন্যে আমাদের পরিসংখ্যান ও ইতিহাস—দুটো দিকেই নজর দিতে হবে। শুরুতেই আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলোর দিকে তাকাই। গত দশ বছরে আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি অনেকটাই পোক্ত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে। তবে বেসরকারি বিনিয়োগ আরো বাড়লে ভালো হতো। তাই আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি হতে যাচ্ছে ৭.৬ শতাংশ। উন্নয়নশীল বিশ্বের চেয়ে অন্তত সাড়ে তিন শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ উৎপাদন, ফ্লাইওভার মহাসড়কসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেগা অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার একনিষ্ঠ রয়েছে বলেই অর্থনীতির চাকা এমন সচল রয়েছে। গত দশ বছরে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন তিনগুণ বেড়ে এখন প্রায় আঠেরো হাজার মেগাওয়াট। তবে সবাইকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হলে আমাদের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। আমরা অবশ্য সে পথেই হাঁটছি। কৃষি খুব ভালো করছে। এবছর সারা দেশেই কৃষি উৎপাদন স্থিতিশীল। ধানচাল ছাড়াও মাছ, সবজি, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির উৎপাদনের ধারা বাড়ন্ত। অতিদারিদ্র্য কমে বারো শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। দশ বছর আগেও যা প্রায় ঊনিশ শতাংশ ছিল। আমাদের মাথাপিছু আয় এই দশ বছরে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ১৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের মানব উন্নয়ন সূচকগুলোর সমান তালে এগিয়েছে। জীবনের গড় আয়ু, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশু মৃত্যুর হার, নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন—সকল সূচকেই বাংলাদেশ তার পড়শি দেশসমূহের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হবার সবকটি সূচকেই বাংলাদেশ যোগ্যতা অর্জন করেছে। এখন আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের সংগ্রামে লিপ্ত। আশাকরছি ২০৩০ সালে এমডিজির মতোই এসডিজি অর্জনেও বাংলাদেশ তার সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে।

আমাদের আর্থ-সামাজিক এই সাফল্যের পেছনে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তাদের অসাধারণ অবদানের কথা না বললেই নয়। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের সামাজিক গতিময়তার জন্যেই। উদ্যোক্তা তৈরির একটা সহজাত সৃজনশীলতা এই সমাজে রয়েছে। এত ছোট দেশে এত মানুষের বাস। ‘ডেনসিটি ডিভিডেন্ড’ লাভের একটা স্বাভাবিক সুযোগ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই দেশে খুঁজে পাওয়া যায়। এর ফলে আমাদের ‘কানেকটিভিটি’ বা সংযোগের সম্ভাবনাও বেশি। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই আমরা এখন জোর কদমে এগিয়ে চলেছি। একই সঙ্গে আমাদের সমাজ খুবই লড়াকু। একাত্তরের প্রতিকূলতা জয় করে এই সমাজ তার ভেতরে এক অভাবনীয় লড়াই করার শক্তি সঞ্চয় করে রেখেছে। আর সেই কারণে অসংখ্য তরুণ উদ্যোক্তা ব্যবসা-বাণিজ্যের নানামুখী বাঁধা ডিঙিয়ে ঠিকই বের হয়ে আসছে। সংখ্যার বিচারেও আমাদের জনসংখ্যা খুবই তরুণ। পনের বছরের কমবয়েসী তরুণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩৮%। ১৫-২৪ বছর বয়েসী তরুণের সংখ্যার হার ১৯.৫%। চীনে এই হার ১৩%। ভিয়েতনামে ১৬.৯%। ভারতে ১৮.৪%। এই তরুণরাই আমাদের মূল জনশক্তি। এদের অংশগ্রহণেই আমাদের শ্রম বাজার গতিশীল ও সাশ্রয়ী। আমাদের উদ্যোক্তরাও বয়সে তরুণ। তাই এই বৈশ্বিক পরিবেশে প্রযুক্তির সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার করে তারা আমাদের শুধু রপ্তানি শিল্পেরই বিকাশ ঘটাচ্ছে তাই নয়, ই-কমার্স থেকে শুরু করে জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতি, সমাজ ও প্রশাসনকে গতিময় রাখতে তারা অসামান্য ভূমিকা পালন করছে। তবে যথেষ্ট গুণমানের শিক্ষা না পেয়ে তরুণদের বিরাট অংশের কর্মসংস্থান পর্যাপ্ত ঘটছে না। তাই তাদের মনে শঙ্কা ও অসন্তোষ রয়েছে। এর প্রমাণ আমরা হালের সরকারি চাকুরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় বেশ খানিকটা দেখতে পেয়েছি। তাই আরো কর্ম-সংস্থান সৃষ্টিই আমাদের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগও ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারাই বেশি করে করতে পারেন। উদ্যোক্তা তৈরির জন্যে তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা শতধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব স্নাতক বের করছি তারা আমাদের আধুনিক শিল্পায়ন ব্যবস্থাপনায় অপ্রসাঙ্গিকই থেকে যাচ্ছে। অথচ আমাদের গার্মেন্টস, তথ্য প্রযুক্তি ও চামড়া শিল্পের মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপক ও প্রকৌশলী শ্রীলঙ্কা, ভারত ও আশেপাশের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। সেজন্যে বছরে পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার গুনতে হচ্ছে। আবার দেখুন তেজগাঁওতে অবস্থিত আমাদের টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্নাতকই কিন্তু বেকার নেই। তার মানে আমরা আমাদের অর্থনীতির দক্ষতার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত কর্মী তৈরি করতে পারছি না।

প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের এক্ষুনি ব্যবসায় ও শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি ট্রেডকোর্স চালু করা, আরো বেশি করে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে নীতি-সমর্থন জরুরি হয়ে পড়েছে। হালে তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ ব্যবস্থাপক ও উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণে মনোযোগী হয়েছে। এই ধারা আরো জোরদার করতে হবে। আমরা জিডিপির মাত্র দশমিক এক পাঁচ শতাংশ আয় এন্ড ডি (গবেষণা ও উন্নয়ন) বাবদ ব্যয় করি। চীন এ বাবদ ব্যয় করে দেড় থেকে দুই শতাংশ। আমাদের ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপযুক্ত উদ্ভাবনী কেন্দ্র (‘ইনোভেশন ল্যাব’) রয়েছে? আমাদের ব্যক্তিখাতই বা এই খাতে কতটা খরচ করে? শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতেও আমাদের সরকারি খরচ উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড়পড়তা খরচের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। ব্যক্তিখাতও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে বরং ব্যবসাই বেশি করছে। উপযুক্ত জনশক্তি তৈরিতে নজর তেমনটা নেই। তা সত্ত্বেও আমাদের এতটা নিরাশ হবার কোনো কারণ নেই। আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। সারা বিশ্বেই বস্ত্রখাতের হাত ধরেই উন্নতির মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে। মনে রাখা চাই বাংলার উন্নত বস্ত্র শিল্পই সতের শতকে ভারত দখলের অভিপ্রায়ে ইউরোপীয়রা জাহাজ ভাসিয়েছিলেন। ভুল করে কলম্বাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও উত্তর আমেরিকা পৌঁছুনোর পর ভাস্কো দা গামা ভারতে আসেন। আরব ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই ভারতে আসতেন। তাদের মুখ থেকেই ইউরোপীয়রা ভারতের ধন সম্পদের কথা শোনেন। ১৭৬০ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই বাংলার লুণ্ঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেই লুটের অর্থ লন্ডনে যেতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালে রবার্ট ক্লাইভ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জানিয়েছিলেন বাংলা অফুরন্ত সম্পদের এক ভাণ্ডার। স্থানীয় বস্ত্রখাত ছিল তার মূলে। আর সেই আকর্ষণেই তারা বাংলা দখল করে। পরে পুরো ভারত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল বহুজাতিক কোম্পানি। তাদের মূল কাজই ছিল বাংলার সম্পদ আহরণ করে ইউরোপ নিয়ে যাওয়া। এই সময়টায় বাংলার স্থানীয় বস্ত্র শিল্প ধ্বংস করে ইংল্যান্ডে তার প্রসার ঘটানো হয়। এর মাধ্যমেই ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের উৎপত্তি। ম্যানচেস্টার ও ল্যাংকাশায়ারের শিল্পায়নের সাথে বাংলার শিল্পোয়নের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। এই শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ডে বসে থাকেনি। আরো লাভের আশায় ব্রিটিশ পুঁজি ঊনিশ শতকে মার্কিন শিল্পায়নে বিনিয়োগ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন পুঁজি আবার ইউরোপের পুনর্নির্মাণে ব্যবহৃত হয় মার্শাল পরিকল্পনার আওতায়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিংগাপুর, হংকংও এই পুঁজির ভাগ পায় এবং মূলত বস্ত্রখাতের শিল্পায়নের হাত ধরে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের সফল মডেল দেশে পরিণত হয়। একই ধারায় ভারত ও চীনও এখন এই বিশ্ব পুঁজির ভাগ পাচ্ছে এবং উন্নতি করছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দেশ গার্মেন্টেসের হাত ধরে পুঁজি আসতে শুরু করে আমাদের বস্ত্র শিল্পে। সেই বস্ত্র শিল্পের সুবাদেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্ততম বস্ত্র রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। আহরিত পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে এই শিল্পের আরো অনেকগুলো রপ্তানিমুখী শিল্পে। বর্তমানে পোশাক শিল্পের সহযোগী হিসেবে জুতো, ওষুধ, সিরামিক, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাইসাইকেল, জাহাজ নির্মাণসহ রপ্তানিমুখী শিল্পায়নে বড় ধরনের সাফল্য দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। আর মূলত এই দ্রুত অগ্রসরমান শিল্পায়নের ফলেই গত দশ বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে তিনগুণ। এসবই সম্ভব হয়েছে এক দল তরুণ উৎসাহী এবং ঝুঁকি গ্রহণে সাহসী উদ্যোক্তার জন্যে। বাংলাদেশ সরকারের উপযুক্ত নীতি প্রণোদনা, ব্যাংকিং খাতের প্রয়োজনীয় উদ্ভাবনীমূলক সমর্থন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দূরদর্শী রেগুলেশন এই শিল্পায়নের শক্ত পাটাতন তৈরি করতে সাহায্য করেছে। এই ধারার শিল্পায়নের পেছনে পুঁজি ও শ্রমের সম্মিলন ছাড়াও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অনেক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক গতিময়তা এবং সর্বোপরি উদ্যোক্তাদের সক্রিয়তা কাজ করছে। বিশেষ করে, আমাদের চলমান উন্নয়ন অভিযাত্রায় লক্ষ লক্ষ ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তার কঠোর পরিশ্রম ও এগিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা বিরাট ভূমিকা রেখেছে। এদের মধ্যে থেকেই পরবর্তী সময়ে বড় বড় উদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও বাংলাদেশের অনুকূলে কাজ করছে। অনেকেই মনে করেছিলেন রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পে ধস নামবে। কিন্তু আমাদের লড়াকু উদ্যোক্তারা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই সংকটককে সুযোগে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সংগ্রামে ক্রেতাদের সংগঠন অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড, উন্নয়ন সহযোগীদের (বিশেষ করে জাইকা ও বিশ্বব্যাংক) সমর্থন, বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ নীতি সমর্থন বড় ধরনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

আমার মনে আছে যেদিন রানা প্লাজা দুর্ঘটনাটি ঘটল ওই দিন সকালে হোটেল সোনারগাঁতে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। আমরা সেদিন বলেছিলাম এই দুর্যোগ বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠবে এবং পরবর্তীতে একে সুযোগে পরিণত করবে। পরের দিন জাপানী রাষ্ট্রদূত আমার বাসায় চলে এলেন। বললেন, এসএমই খাতে যে কমসুদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে জাইকা বিতরণ করছে তা থেকে একশো কোটি টাকা আলাদা করে ছোট ও মাঝারি গার্মেন্টস শিল্পের নিরাপত্তা বিধানে যেন দেওয়া হয়। আমরা দ্রুতই সরকারের সাথে আলাপ করে নয়া এক ঋণ কর্মসূচীর সূচনা করলাম। এই কর্মসূচী এখনো চলছে আরো বৃহত্তর পরিসরে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরপর বিশ্বব্যাংকের সাথে আলাপ আলোচনা করে আরো তিনশো মিলিয়ন ডলারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কমসুদের ঋণের ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি, আরো দুশো মিলিয়ন ডলার আমরা রিজার্ভ থেকে আলাদা করে শুধুমাত্র সবুজ বস্ত্র ও চামড়া কারখানার জন্যে নয়া ঋণ কর্মসূচি চালু করি। তাছাড়া, ইডিএফ বা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলটি দুশো মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে দুই বিলয়নেরও বেশি পর্যায়ে উন্নীত করেছিলাম। সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় বেশি পরিদর্শক নিয়োগ ছাড়াও নানামুখী তৎপরতা বস্ত্র শিল্পের সামাজিক ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সের ব্যাপক উন্নতি করতে নীতি সমর্থন প্রদান করে। এভাবেই বাংলাদেশের মূল রপ্তানি শিল্প একটি সংকট থেকে শুধু উঠে দাঁড়িয়েছে তাই নয় এখন তার প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ এক খবরে জানতে পারলাম যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি গত চার মাসে প্রায় তিন শতাংশ হারে বেড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি থেকে সরে আসার পর থেকে ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, চীনের কাছ থেকে যে হারে বস্ত্র কিনছে তার চেয়ে বেশি হারে বাংলাদেশ থেকে কিনছে। আর আগেই যেমনটি বলেছি, বর্তমানে মার্কিন খুচরো বিক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের বস্ত্রখাতের ভাবমূর্তি সামাজিক ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সের উন্নতির কারণে বেশ উজ্জ্বল। তাই ৫.৬২ শতাংশ ডিউটি দিয়েও বাংলাদেশের শক্তিশালী বস্ত্রখাত মার্কিন বাজারে দিন দিনই তার শক্তিমত্তা দেখিয়ে চলেছে। এ বছর ভারতেও আমাদের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আর এসবই সম্ভব হচ্ছে আমাদের পরিশ্রমী ও সাহসী উদ্যোক্তাদের অদম্য প্রচেষ্টার জন্য।

আমাদের তৃণমূলের অসংখ্য ক্ষুদে উদ্যোক্তারা কৃষি, মৎস্য, তাঁত ও কুটির শিল্পের ভীষণ তৎপর। তৃণমূলেও তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর অসংখ্য ডিজিটাল উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। ইউনিয়ন তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্র সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আউটসোর্সিং ব্যবসাও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন অর্থায়নের নীতি সমর্থন দিয়ে নারীসহ এসএমই উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাংকের সাথে সমঝোতা করে কৃষি ও এসএমই ঋণ দেবার জন্যে অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এসব ক্ষুদে উদ্যোক্তার পাশে থাকার অভিনব কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং চালু করা হয়েছে বাংলাদেশ। লক্ষ লক্ষ বর্গাচাষীরাও এই ঋণ সুবিধে পাচ্ছেন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র দুই শতাংশ হারে গৃহায়ণ প্রদান করে তাদের আবাসনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সবাই চেষ্টা করেছে বলেই পোশাক শিল্পখাত এমন করে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই খাতকে আরো সবুজ ও সক্ষম করার জন্যে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেসব উদ্ভাবনীমূলক নীতি সমর্থন দিতে শুরু করেছিলাম তা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে সেই প্রত্যাশাই করছি। একই সঙ্গে এই খাতের ওপর বাড়তি যে তিন শতাংশ করপোরেট করারোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে তা যেন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় সরকারের কাছে সেই অনুরোধ করছি। তাছাড়া, সবুজ কারখানার ওপর যে দুই শতাংশ বেশি করারোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে তারও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। উল্টো এক্ষেত্রে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করছি। রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের ঝুঁকিও অনেক। বিশেষ করে এরফলে নগরায়ন অপরিকল্পিত রূপ নিতে পারে, পরিবেশের অবনতি ঘটতে পারে, শ্রমিকদের জীবনমান চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তাই বড় বড় উদ্যোক্তারা যেন এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় নিজেরাও সক্রিয় হন এবং সরকারের সহায়তামূলক নীতিসমর্থন পান সেজন্যে সংগঠিত হন।

আমার ধারণা, আমাদের প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তরা এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় তাদের বুদ্ধিমত্তা ও সমর্থন স্বস্বার্থেই দেবেন। বিশ্বায়নের এই যুগে পরিবেশগত ও সামাজিক ঝুঁকি মোকাবেলা করেই যে তাদের এগুতে হবে সেটা তারা জানেন। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদেরও সঙ্গে নেবার মতো সক্ষমতা তাদের রয়েছে। কিন্তু ক্ষুদে মাঝারি উদ্যোক্তাদের সেই সক্ষমতা নেই। তাদের জন্যেও বড় উদ্যোক্তাদের চেম্বারকে উদ্যোগী হতে হবে। কারণ ছোট বড় মিলেই শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিবেশ বা ‘ইকো সিস্টেম’ গড়ে ওঠে। সেইজন্যেই এই নীতি সমর্থনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ অপরিহার্য।

বস্ত্রখাত ছাড়াও বাংলাদেশের আরো অনেক খাতে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল উদ্যোগের কথা আগেই বলেছি। ইলেকট্রিকাল যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক উৎপাদক, টায়ার উৎপাদক, আসবাবপত্র উৎপাদকদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিলে তারাও বস্ত্র উদ্যোক্তাদের মতো বিশ্ব বাজার দখল করতে সক্ষম হবেন। ভারত ও চীনে এখন বড় বড় গাড়ি উৎপাদকরা কারখানা খুলেছে। বছরে ২০ লক্ষ গাড়ি এই দুই দেশে তারা উৎপাদন ও বিক্রি করছে। এসব গাড়ির টায়ার, প্লাস্টিক পার্টস আমরা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করতে পারি। আমাদের পাটতন্তু দিয়ে গাড়ির বডির একাংশ তৈরি করা সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে চাই নীতি সক্রিয়তা। তাছাড়া, আমরা কৌশলগতভাবে এমন এক স্থানে অবস্থিত যে আমাদের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের হার হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ইউরোপের এয়ারলাইন্সগুলোকে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারাই এসব বিমানবন্দর গড়ে তুলবে। ভারত ও চীনের পর্যটন বাজারে প্রবেশের জন্যেও তারা তা করবে। সেজন্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করা নিয়মনীতি সহজ করা, নিরাপত্তা জোরদার করা, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সহজতর করার মতো নিয়মনীতি আরো ব্যবসা-বান্ধব করার প্রচুর সুযোগ আমাদের হাতে রয়েছে। পাশাপাশি অনেক কষ্টে গড়ে ওঠা আমাদের ম্যাক্রো অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে। একমাত্র স্থিতিশীল পরিবেশেই উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়। আগামী দিনের উন্নত বাংলাদেশকে নির্মাণের লক্ষ্য মাথায় রেখে এখন থেকে আমাদের আরো সম্মুখমুখী দূরদর্শী নীতিসংস্কার ও নীতি সমর্থন দিয়ে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় সদা সক্রিয় অংশীজন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আতিউর রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

   

সব নিষেধাজ্ঞা ভিসানীতির অধীন নয়



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অভিযোগ, সেটা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতির সহায়তা।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তিনি তার ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেছেন। অন্যায়ভাবে সামরিক খাতে চুক্তি বা ঠিকাদারি পাওয়া নিশ্চিত করতে তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। নিজের স্বার্থের জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে সোমবার (২০ মে) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয়।

দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে বলা হয়, উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে আজিজ আহমেদকে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। এর ফলে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য হবেন।

নিষেধাজ্ঞার পর প্রতিক্রিয়ায় সমস্ত অভিযোগকে অস্বীকার করে আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যদিও ব্যক্তিগত, তবে বর্তমান সরকারের সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই ঘটনাটি সরকারকেও কিছুটা হেয় করে।’

এদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন ভিসানীতির অধীন নয়, দেশটির অন্য আইনে। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা সেনাবাহিনীর বিষয়।’

এটা সত্যি যে, জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটা নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিসানীতির অধীন নয়। মার্কিন ভিসানীতি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের অধীন। কিন্তু জেনারেল আজিজকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের অধীন।

ম্যাথিউ মিলার তার বিবৃতিতে আইনের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। নির্বাচনকে প্রভাবিত কিংবা বাধা প্রদান বিষয়ে মার্কিনিরা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যে ভিসানীতি দিয়েছিল, এর অধীনে এখন পর্যন্ত কাউকে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। আজিজ আহমেদকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে।

নিষেধাজ্ঞা মানে ভিসানীতির নিষেধাজ্ঞা নয়। এটা দুর্নীতির অভিযোগে। এই ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ঘোষণা আছে বাংলাদেশের।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে যথার্থই বলেছেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দুর্নীতি দমন, সন্ত্রাস দমনসহ অন্যান্য বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করছি। আমরা দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রেও একসঙ্গে কাজ করবো। সরকার-দলের অনেকেই দুর্নীতিতে জেলে গেছেন, যাচ্ছেন সেটাও নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করেছেন হাছান মাহমুদ এবং এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অবগত করেছিল বলেও দাবি তার।

জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় তার ভাইকে শাস্তির থেকে পরিত্রাণের যে উল্লেখ সেটা দেশবাসীর অবিদিত নয়। এনিয়ে আগে প্রতিবেদন হয়েছে দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে। প্রতিবেদন হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায়।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের কর্মকাণ্ডের উল্লেখ ছিল।

যদিও সরকার এর প্রতিবাদ করেছিল। প্রতিবাদ করেছিল সেনা সদর দপ্তর। ওই প্রতিবেদনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন ডেভিড বার্গম্যান, তাসনিম খলিল, জুলকারনাইন সায়ের খান নামের ব্যক্তিরা।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) প্রতিবাদলিপিতে তাদের পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয় যথাক্রমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিত, অখ্যাত নেত্র নিউজ-এর প্রধান সম্পাদক ও মাদকাসক্তির অপরাধে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হতে বহিষ্কৃত একজন ক্যাডেট হিসেবে। অর্থাৎ সেনা সদর দপ্তরের ছিল কড়া প্রতিক্রিয়া।

জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ যে সব দায়িত্বে ছিলেন, সেগুলো ছিল রাষ্ট্রের অতি-গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তার সাবেক পদ-পদবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও রাষ্ট্রের সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। তাই, এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিজিবি-সেনাবাহিনী তাদের সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আনীত অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য দেবে নিশ্চয়ই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলছেন, ‘এটা সেনাবাহিনীর বিষয়’, তখন এই মুহূর্তে আমাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এছাড়া অভিযুক্ত ভাইকে বাঁচাতে সত্যি কি কোনো অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল, ওই ঘটনায় কি আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়েছিল, এনিয়েও ব্যাখ্যা আমরা আশা করি আইন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে।

অসত্য তথ্য দিয়ে ভাইদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটারও ব্যাখ্যা আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

সাবেক সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষিদ্ধ হয়েছেন—এই সংবাদের কয়েকটা দিক রয়েছে। প্রথমত অভিযোগগুলো সত্যি কিনা, সত্যি হলে রাষ্ট্রের করণীয় কী, অসত্যি হলে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে! অভিযোগগুলো যদি সত্যি হয়, তবে আইনি প্রতিবিধান করা উচিত রাষ্ট্রের। অসত্যি হলে উচিত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিবাদ জানানো।

যদিও এখানে ব্যক্তি আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের শাস্তির কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র তবুও বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই অপমান গিয়ে পড়ে রাষ্ট্রের ওপরও।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় দুর্নীতি দমনে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের একসঙ্গে কাজ করার যে প্রত্যয়, সেটা আমরা অনেকবারই শুনেছি, এবারও শুনলাম। তবে এই প্রত্যয় কেবল মুখের বুলি আর সাদা-কালো হরফের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাও উচিত নয় আমাদের।

বেঁচে থাকতে কাউকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেই হবে এমন না। পৃথিবীর সবার জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের গমন নয়, এটা আরো অন্য অনেক কিছুর মতো ছোট্ট এক ঘটনা।

তবে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মতো ফরমান জারি যে কারো জন্য অপমানের! হোক না সেটা ব্যক্তি পর্যায়ের। তবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এবং দেশে স্পর্শকাতর একাধিক বাহিনীর সাবেক প্রধান হিসেবে এটা রাষ্ট্রের জন্যও অপমাননাকর।

সত্যি যদি দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিষেধাজ্ঞাতেই শাস্তি সীমিত থাকা উচিত হবে না। প্রচলিত আইনে তাকে বিচারের আওতায় আনার সুযোগ থাকলে সেটা গ্রহণ করতে হবে।

সাবেক সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন। এর আগে পুলিশের সাবেক নয় কর্মকর্তা যারা র‍্যাবে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এসেছিল। এই তালিকাটা কেন দীর্ঘ হচ্ছে, এখানে কি অস্বীকার তত্ত্ব নেই! এই অস্বীকার তত্ত্ব-পদ্ধতি যখন কাজে আসেনি আগে, তখন এই পথে পা না বাড়ানোই উচিত হবে আমাদের। এখানে যেখানে থাকা দরকার বিভিন্ন বাহিনীর বিভাগীয় ভূমিকা, তেমনি দরকার রাষ্ট্রীয় ভূমিকাও। কারণ, ব্যক্তির নামে এসব নিষেধাজ্ঞা আসলেও নাগরিক হিসেবে তাদের সবাই বাংলাদেশের।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক বিবৃতির পর একশ্রেণির মানুষের মধ্যে আনন্দ লক্ষণীয়। এই আনন্দের কারণ রাজনৈতিক। অনেকেই ভাবছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক এই নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু সব নিষেধাজ্ঞা ভিসানীতির অধীন নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা দুর্নীতি সম্পৃক্ততায় বিচারিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত কিংবা প্রভাবিত এবং আর্থিকখাত সংশ্লিষ্ট। নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিসানীতির অধীন হোক আর দুর্নীতির কারণে হোক ব্যক্তির নামের হলেও এখানে আদতে অপমানিত বাংলাদেশই।

দেশের এই অপমানে রাজনৈতিক-বিভক্তির আনন্দ অপ্রত্যাশিত, একইসঙ্গে ব্যক্তিগত শাস্তি এবং ‘স্বীকার করলে ভাবমূর্তি-সংকট’—এমন আশঙ্কায় এড়িয়ে যাওয়াও হবে অনাকাঙ্ক্ষিত!

কবির য়াহমদ: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর,বার্তা২৪.কম

;

ইব্রাহিম রাইসি’র মৃত্যু-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসি আল সাদাতি (জন্ম ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬০) সাধারণ মানুষের কাছে ইব্রাহিম রাইসি নামেই পরিচিত একজন রাজনীতিবিদ, বিচারক।

নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৩ আগস্ট (২০২১) থেকে ১৯ মে (২০২৪) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইরানে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার মৃত্যু ‘নিছকই দুর্ঘটনা’ না কি ‘সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে তুমুল আলোচনা। কারণ, তিনি ছিলেন শক্ত মেজাজের নেতা। মধ্যপ্রাচ্যে তথা আরব বিশ্বে মার্কিন-ইসরায়েল আধিপত্যের বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার। পশ্চিমা আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও গ্রুপের সহযোগী।

মার্কিন-ইসরায়েল তাকে প্রধান শত্রু মনে করতো। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তার মৃত্যু শুধুই ‘এক্সিডেন্ট’ নাকি ‘পলিটিক্যাল কিলিং’!

মার্কিন যুক্তরাষ্টের কাছে রাইসি ছিলেন ‘বিতর্কিত ও কট্টর মৌলবাদী’। তার শাসনকালকে ‘নারী অধিকার ও মানবাধিকারের পরিপন্থী‘মনে করতো ওয়াশিংটন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিস তাকে নিষিদ্ধ করেছিল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদকেরা তাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) নিয়ে আলোচনা আটকে যায়।

তারপরেও রাইসিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি পশ্চিমা শক্তি। তার শাসনামলে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিদর্শনে বাধা দিয়েছে এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে সমর্থন দিয়েছে। ইরান গাজার সংঘাতে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় এবং হিজবুল্লাহ ও হুথি আন্দোলনের মতো গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে।

অতএব, কপ্টার দুর্ঘটনায় রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো সমবেদনার পথে না হেঁটে সরাসরিই বলেছে, ‘এই মানুষটির হাতে যে অনেক রক্ত লেগে রয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ কোনো নেই’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের প্রতিবাদে রাইসির সমর্থকেরা প্রশ্ন করেছেন, ‘গাজ়ার মানুষের রক্ত তা হলে কার হাতে লেগে আছে! ইসরায়েল, না তাদের অস্ত্র জোগানো অন্ধ সাপোর্টার যুক্তরাষ্ট্রের! রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, দু’জনেই রাইসির মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে তাকে ‘প্রকৃত বন্ধু’ বলেছেন।

প্রথাগত রাজনীতির পথে ইব্রাহিম রাইসি ইরানের ক্ষমতার শীর্ষে আসীন হননি। তিনি ছিলেন ইরানের বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উপপ্রধান বিচারপতি। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি ছিলেন।

১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে তিনি তেহরানের প্রসিকিউটর এবং উপ-প্রসিকিউটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি আস্থান কুদস রাযভী নামক একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক এবং চেয়ারম্যান ছিলেন। রাইসি ২০০৬ সালে দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশ থেকে প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মাশহাদের জুমা নামাজের ইমাম এবং ইমাম রেজা মাজারের প্রধান ইমাম আহমদ আলা মোলহোদার জামাতা।

রাইসি ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, কিন্তু মধ্যপন্থী রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন। তিনি ২০২১ সালে ফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ৬২.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে হাসান রুহানিকে পরাজিত করেন।

অনেকেই মনে করেন, এই নির্বাচন রাইসির পক্ষে প্রভাবিত করা হয়েছিল। কারণ, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ মিত্র। রাইসিকে খামেনির পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

সন্দেহ নেই, ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইরাসের ইতিহাসে রাইসির শাসনকাল ছিল অত্যন্ত সংকটময়। ভেতরের নানা আন্দোলন থামানোর পাশাপাশি ইরানকে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় সদা নিয়োজিত থাকতে হয়েছে তাকে।

অন্যান্য মুসলিম দেশ যেখানে মার্কিন-ইসরায়েল আধিপত্য ও গণহত্যা মেনে নিয়েছে, ইরান তা করেনি। ইরানি রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে, মার্কিন-ইসরায়েল আগ্রাসন মোকাবিলায়। সে কারণে ইরানি জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাইসিকেও হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কেননা, রাইসির কপ্টার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও সব জানানো হয়েছে।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন কার্বি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিচ্ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। গোটা অঞ্চলকে অস্থির করে রাখার অভিযোগ ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতেও তুলবে।’

রাইসির শাসনকালে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক কিছু ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘হামাস’কে সাহায্য করেছে। হিজ়বুল্লাহ গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করেছে। সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে বোমা ফেলায় ইসরায়েলকে নিশানা করে ইরান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। যদিও এরপর ইস্পাহানের কাছে ইরানের এয়ারবেসে বোমা ফেলে আসে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান।

হরমুজ় প্রণালীতে ইসরায়েলি মালিকের একটি জাহাজকে পণবন্দিও করে ইরানের বাহিনী। মোটের ওপর, মার্কিন-ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে যাচ্ছিল রাইসির ইরান। এমনকী, মার্কিন নিষেধাজ্ঞাতে পরোয়া না করে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে মৈত্রী গঠন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিকল্প পরিসর তৈরি করে নেয় রাইসির নেতৃত্বাধীন ইরান।

১৯ মে (২০২৪) রোববার ইব্রাহিম রাইসি পূর্ব আজারবাইজানের প্রদেশে জলপাই এলাকায় প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলীর সঙ্গে জলাধার প্রকল্প উদ্বোধন শেষে ফেরার পথে রাইসিকে বহনকারী একটি হেলিকপ্টার ইরানের উত্তর-পশ্চিমে ভারজাকান এলাকার একটি দুর্গম পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়।

ওই দুর্ঘটনায় ইব্রাহিম রাইসি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আব্দুল্লাহিয়ানসহ হেলিকপ্টারে থাকা সবাই অর্থাৎ ৯ জন নিহত হন। কপ্টার ভেঙে রাইসির মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা হলেও নানা ঘটনাপ্রবাহ সন্দেহের আঙুল তুলছে ইরানের প্রতিপক্ষের দিকে।

কৌশলী ইরান হয়ত গোটা পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কায় সমঝে চলছে। তার সামনে নেতৃত্বের শূন্যতা পূর্ণ করা এবং রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখাই আপাতত বড় চ্যালেঞ্জ।

রাইসির মৃত্যুশোক পালনের মধ্যেই ইরান আগামী ২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর অন্তর্বর্তীকালীনভাবে ওই ভূমিকায় থাকার কথা ভাইস প্রেসিডেন্টের। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মোখবর সাময়িকভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাবেন। তাকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে কাজ করতে হবে। ইরানের সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্টের আচমকা মৃত্যু হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট সাময়িকভাবে ওই দায়িত্ব সামলাবেন। তিনি সরকারের তিন সদস্যের কাউন্সিলের একজন সদস্য হিসেবেই ওই দায়িত্ব পাবেন। কাউন্সিলে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়াও রয়েছেন ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বিচার বিভাগের প্রধান।

প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ৫০ দিনের মধ্যে এই কাউন্সিল দেশে নতুন করে নির্বাচনের আয়োজন করবে। তার মাধ্যমেই স্থির হবে ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন।

২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নতুন প্রেসিডেন্ট যিনিই হবেন, তাকে রাইসির মৃত্যুতে পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে সৃষ্টি হওয়া একরাশ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবতে হবে। মার্কিন-ইসরায়েলি প্ররোচনায় যাতে পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা না বাড়ে এবং ইরানের স্বার্থ রক্ষিত হয়, সেসব বিষয় নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে নতুন নেতাকে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে কড়া দর-কষাকষিরই পক্ষপাতী ছিলেন রাইসি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’ যে পাকিস্তানের সঙ্গে গত জানুয়ারিতে ইরানের যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়েছিল, শেহবাজ় শরিফের সরকার গঠনের পরে তিনদিন ধরে সে দেশেই সস্ত্রীক সফর করে দ্বিপাক্ষিক, একাধিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার অঙ্গীকার করে এসেছিলেন রাইসি। স্পষ্টতই, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে শত্রুতা ভুলে বন্ধুতার প্রয়োজন বুঝেছিলেন বৈদেশিক রাজনীতিতে পটু ও কৌশলী রাইসি। নতুন ইরানি নেতা রাইসির পথে চলেন না কি নতুন রাস্তা বের করেন, সেটাই দেখার বিষয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য রাইসির পিছু ছাড়েনি। ইরানের সঙ্গে সখ্যতার ‘অপরাধে’ পাকিস্তানকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল। সেই হুঁশিয়ারির সুর আবার শোনা গিয়েছিল চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারতের সঙ্গে ইরানের চুক্তির পরে।

মনে করা হয়, ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গেও চুক্তির পথে হাঁটছিলেন রাইসি। মার্কিন অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও নানা প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে দেশের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কমিউনিস্ট রাশিয়া, চীন ও অপরাপর দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলেন রাইসি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের নীতি একা প্রেসিডেন্ট তৈরি করেন না। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেকগুলো সংস্থা ও ফোরাম মিলিতভাবে দেশের জন্য নানান রকমের নীতি প্রণয়ন করে। প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রীদের নিয়ে সেসব বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। ফলে, রাইসির মৃত্যুতেও ইরানের জাতীয় নীতির খুব একটা বদল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে, এটাও ঠিক যে, রাইসির মৃত্যুর প্রভাব পড়তে চলেছে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় ভূ-রাজনীতিতে ও আঞ্চলিক ক্ষমতার মেরুকরণে। সংঘাত, যুদ্ধ, আগ্রাসন, গণহত্যায় জর্জরিত ওই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান শক্তির লড়াইয়ে রাইসির ইরান যেভাবে নেতৃত্বের আসনে চলে এসেছিল এবং সমমনাদের নিয়ে বড় মাপের মেরুকরণ করে মার্কিন-ইসরায়েল জোটের বিরুদ্ধে লড়ে চলছিল, তার প্রভাব সহজে মুছে যাবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

গরীবি চেহারার গাড়িগুলোর গর্বিত মালিক কারা?



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবিঃ বার্তা২৪.কম

ছবিঃ বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের রাজধানী ও সারাদেশে একই রাস্তায় চলন্ত গাড়ির ধরণ বিভিন্ন তবে এদের মালিক মূলত: দুই শ্রেণির। ধনী আর গরিব মালিক। গরিব মালিকরা কখনো কখনো মাত্র একটি পুরনো গাড়ির মালিক। তাদের গড়িগুলো হতে পারে একটি বাস বা মাইক্রোবাস, একটি সিএনজি, একটি বা কয়েকটি অটোরিক্সা। তারা সেটাকে ভাড়ায় খাটান অথবা নিজেরাই সেটা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত বছর রাজপথ থেকে পুরনো গাড়ি সরানো হবে খবর প্রচারিত হলে তাদের অনেকেই ভেবেছেন উপার্জনের একমাত্র সম্বল একটিমাত্র গাড়ি। সেটাকে পথে চালাতে না দিলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মারা যাবেন।

এসব পুরনো গাড়ির ব্যক্তিমালিকরা কখনো কোন নীতিনির্ধারণী সভায় আমন্ত্রিত হন না, তাদের কোন প্রতিষ্ঠান নেই। অন্যদিকে পুরনো গাড়ির ধনী মালিকদের এককজনের বহু গাড়ি, নিজস্ব পরিবহন প্রতিষ্ঠান, লোকবল, সমিতি, নেটওয়ার্ক সবকিছুই আছে। তারা নতুন গাড়ি কিনে দূরপাল্লায় দেন ও অতিপুরনোগুলো ঢাকা-চট্টগ্রামে চালান। তারা সরকারের নীতিনির্ধারণী সভায় আমন্ত্রিত হন, মতামত প্রদান করেন।

এসব বাস মালিকদের উদ্দেশ্য করে এক সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘রাজধানী ঢাকায় অনেক উন্নয়ন হলেও লক্করঝক্কর বাস চলাচল বন্ধ হয়নি। এ জন্য ১২ বছর মন্ত্রী পদে থেকে কথা শুনতে হয়। আপনাদের কি লজ্জা করে না?... আমাকে জিজ্ঞেস করল, এত বছর মন্ত্রী আছেন, গাড়িগুলোর এই অবস্থা? এই গাড়িগুলো চলে চোখের সামনে। কেন এই বাস বন্ধ করা যায়নি? এটি সত্যিই লজ্জার বিষয়। আপনাদের কি লজ্জা করে না?’ প্রশ্ন হলো- গরীব গরীব চেহারা কি শুধু রাজপথে চলাচলকারী গাড়িগুলোর? জড় পদার্থ ছাড়া গরীব চেহারার জীবগুলোর কথা আগে ভাবা উচিত। জীবগুলোর গরীবি চেহারা দেখানো বন্ধ হলে তাদের বাহনগুলোর গরীবি চেহারা হয়তো আর দেখা যাবে না।

রাজপথে ক্ষুধার তাড়নায় রাজকীয় গাড়ির বন্ধ জানালায় টোকা দিয়ে এক টাকা দাবী করা ভিক্ষুক, ভবঘুরে, অভাবী মানুষ তাদের চেহারাও বেশ মলিণ ও গরীবি। তাদের মোট সংখ্যা কত? তারা নিশ্চয়ই মাফিয়াদের কালো কাঁচ লাগানো গোপন পরিবহন দ্বারা পরিবাহিত হন অথবা রিক্সাভ্যান, অথবা গরীবি চেহারার বাসে চলাচল করেন। এসব তথ্য নীতিনির্ধারকের কাছে মোটেও অজানা নয়।

তিলোত্তমা ঢাকার রাস্তায় হাল ফ্যাশনের গাড়ির পাশে রঙ চটা, কালো ধোঁয়া ছড়ানো, লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়ি, বাস চলাচল করা নিতান্ত বেমানান। এসব গাড়ির কোনটির বয়স তেতাল্লিশ বছর পার হয়েছে। এরে চেয়ে আরো কত বৃদ্ধ গাড়ি রাজপথে ও দেশের আনাচে কানাচে চলাচল করছে তার কোন পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এসব গাড়ির গর্বিত মালিক কারা?

গত বছর পুরনো গাড়ি ডাম্পিং করার কথা উঠলে এক শ্রেণির মালিকরা না খেয়ে মারা যাচ্ছেন বলে সংবাদ হয়েছিল। এখন তো অতি বৃদ্ধ গাড়ি ধরে ধরে স্ক্রাপিং করার কথা ভাবা হচ্ছে। তাহলে তাদের এবার কি হবে? অতি বৃদ্ধ গাড়ি স্ক্রাপিং করার পদ্ধতি সব উন্নত দেশে প্রচলিত। সেখানে অতি বৃদ্ধ গাড়ি ধরে ধরে আনতে হয় না। কোন
গাড়ি সরকার নির্দেশিত বয়সসীমা পার হয়ে গেলে তার লাইসেন্স নবায়ন করা হয় না। উন্নত দেশে লাইসেন্স নবায়ন করা হয় স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে। এতে কোন নতুন গাড়িও যদি ফেল করে তাহলে সেটা রাস্তায় চলাচলের অনুমতি পায় না। তিনি বাধ্য হন সেই গাড়িকে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে। মজার ব্যাপার হলো, উন্নত বিশ্বে ফিটনেস পেতে ব্যর্থ গাড়িকে ডাম্পিং ও স্ক্রাপিং করতে হলে নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে সরকারী ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে হয়। সেসব ভাগাড় ভর্তি হলে সরকারী লোকেরা নষ্ট গাড়িগুলোকে স্ক্রাপিং করে মন্ড বানিয়ে লৌহজাত দ্রব্য তৈরীর কারখানায় পাঠিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে ফিটনেস পেতে ব্যার্থ গাড়িকে রিসাইকেল করার নিয়ম নেই। পরিবেশ সচেতনতা আইনের কঠোরতা থাকায় তারা নিজেদের দেশে সেসব পুরনো গাড়ি চালাতে পারে না। জাপান ও কিছু দেশ পাঁচ বছরের পুরনো কিন্তু সচল গাড়িকে বিদেশে রপ্তানী করে থাকে।

আমাদের দেশে অবৈধভাবে আমদানী, বেনামী, ফিটনেসবিহীন, দুর্ঘটনা কবলিত ইত্যাদি গাড়িকে মামলা দিয়ে ধরে এনে থানার পাশে ডাম্পিং করা হয়। বহু থানায় জায়গা না থাকায় রাস্তায় সারিবদ্ধ করে ফেলে রাখা হয়। অনেক সময় ঘুষের ভয়ে মালিকরা গাড়ি ফেরত নিতে আসে না। সেখান থেকে বছরের পর বছর জং ধরে এসব গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে ধোলাই খালে বিক্রি হয়।

কারণ, এসব গাড়ির মালিক ও এর তদারকিতে অফিসে ও রাস্তায় দায়িত্বরত কোন কোন মানুষের মন খুব গরীব। তাদের জৌলুষ ও চেহারা কিন্তু গরীব নয়। তাই কে শোনে কার কথা? ফিটনেসবিহীন, দুর্ঘটনা কবলিত গাড়িগুলো স্ক্রাপ না হয়ে গোপনে পুনরায় রাজপথে ফিরে আসার অনুমতি পায়। রাজধানীর একই রাস্তায় রোলসরয়েস, মার্সিডিজ, পাগানি, বিএমডব্লিউ, টেসলা, টয়োটা, ফেরারী ইত্যাদি বিলাসবহুল কারের সাথে ৪৩ বছরের পুরনো লক্কর-ঝক্কর বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, মুড়ির টিন, রিক্সা, ভ্যান, ঘোড়ার গাড়ি চলতে দেখা যায়। দানব মোটর বাইক ফাঁক-ফোকর দিয়ে পিড় পিড় করে হর্ণ বাজিয়ে পথচারীর গা ঘেঁষে চলে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো
করে। এটাই তো আমাদের পথ চলাচলের চিরায়ত কৃষ্টি!

এর জন্য কোন মোটিভেশন আজ পর্যন্ত কাজে লাগানো যায়নি। দেশের গ্রামাঞ্চলে এমনকি হাইওয়েতে চলে নসিমন, করিমন, পঙ্খীরাজ নামক অটোরিক্সা, ভুটভুটি, চান্দের গাড়ি আরো কত কি ! নতুন রাস্তায় আধুনিক মোটর বাইক অন্যান্য গড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে চলার কৃষ্টি চালু করেছে সাড়ম্বরে। এসবের গতি নিবারণের জন্য সিসি ক্যামেরা বসালেও অদ্যাবধি দক্ষ ও সৎ জনবল তৈরী করা যায়নি। মুখের কথা ও দেশের বাস্তব অবস্থার মধ্যে এখানেও দুস্তর ব্যবধান তৈরী হয়ে আছে। গরীবি চেহারার এসব গাড়ি ছাড়াও একইসংগে অনেক বিলাসবহুল গাড়ির মালিক অনেক আমলা ও রাজনৈতিক নেতারাও। এজন্য নেপথ্যে থাকা মালিকদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।

এতদিন পরে ‘সাবওয়ে আমাদের করতেই হবে’ আমাদের যোগাযোগমন্ত্রীর এমন বোধদয় হওয়ায় তাঁকে অনেক ধন্যবাদ। তবে পুঙ্খানুভাবে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ না করে বন্যাপ্রবণ ঢাকায় সাবওয়ে মতো বড় কোন প্রকল্প তৈরীর আগাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সাবওয়ে থেকে তেমন কোন উপকার পাওয়া কঠিন। কল্পিত পাতাল পথের সাথে উপরের প্রচলিত পথের কানেক্টটিভিটির বিষয়টি বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত। এতে মানুষ নিকটস্থ জেলাশহরগুলো থেকে প্রতিদিন ৩০-৪০মিনিটে ঢাকায় এসে অফিস করে বাড়িতে ফিরতে পারবে। তাহলে জাপানের টোকিওর সাথে সাইতামা, চিবা, তোচিগি ইত্যাদি নিকটস্থ জেলার মতো আমাদের জনগণ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিপঞ্জ থেকে ডেইলী প্যাসেঞ্জারী করে ঢাকায় চাকুরী করতে পারলে ঢাকার উপর মানুষ ও বসতির চাপ কমবে এবং গরীবি চেহারার পুরনো যানবাহনগুলো এমনিতেই বিলীন হতে পারে।

*লেখকঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন

;

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও আরাকান আর্মি



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এ এ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাত চলমান রয়েছে। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তোরনের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। রাখাইনে প্রায় ছয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে এবং সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট চলছে। চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে ১২ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে। তারা সেখানে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জোরদারকরণে করণীয় সম্পর্কে এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় বলে জানায় রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কবে নাগাদ মিয়ানমার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সহায়তা নিশ্চিতে পাশাপাশি রাখাইনে তাদের ফিরে যাবার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় রয়েছে, তারা সেখানে হত্যা, মারামারি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কিছু এন জি ও’র সহায়তায় ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচারণার দায়ে দুটি এনজিওকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং এর পরপরই এনজিওগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত এনজিওগুলো যাতে প্রত্যাবাসন বিরোধী কার্যক্রমে জড়িত না থাকে তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আধিপত্য বিস্তার কোন্দলসহ খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা ও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতার সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে ধরার জন্য উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ে তাদের আস্তানায় অভিযান চালায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত ১৬ জন নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা জীবিকার তাগিদে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। যারা এই অবৈধ কাজে জড়িত এবং যারা রোহিঙ্গাদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তাদের সদস্য সংগ্রহ করছে এবং এর ফলে বাংলাদেশে সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি আশপাশের দেশেও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বিস্তারজনিত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দল ও উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং তারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত রয়েছে। আইওএম মহাপরিচালক কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে ৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরে। বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের নিরাপদ অবস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করেছে এবং ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সহায়তা কমেছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধিরা তাদের মত ব্যক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আরো মানবিক ও টেকসই সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ২০২৪ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্লানকে (জে আর পি) সমর্থন জানাতে হবে। এতে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মিলে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষের জন্য ৮৫২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চাহিদা উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭.৬ মিলিয়ন, জাপান ২.৬ মিলিয়ন ডলার এবং নরওয়েও ৬.৫ মিলিয়ন ক্রোনার দেয়ার প্রতিশ্রতি দিয়েছে। সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড জে আর পি’কে সমর্থন জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য তহবিল কমে যাওয়ার ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে উত্তোরন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য নতুন উৎস থেকে আরও তহবিল সংগ্রহের জন্য এবং ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে আইওএমকে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বর্তমানে রাখাইনের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও সংঘাতপূর্ণ। এ এ জাতিগত রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ এ রাখাইনের ১৯ টা টাউন শিপের মধ্যে ১৭ টাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। রাখাইনে এ এ ৬ মে বুথিডাং শহরের কাছে মিলিটারি অপারেশন কমান্ড ১৫ দখলের জন্য আক্রমণ চালালে প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর জান্তা সৈন্যরা এ এ’র কাছে আত্মসমর্পণ করে। রোহিঙ্গা ও রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ, কম্বোডিয়ার তথ্য সংগ্রহকারীদের সঙ্গে সম্প্রতিকালে ২০১৬ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনে অংশগ্রহণকারী অনেক রাখাইনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা জানায় যে, সে সময়ের ঘটনার জন্য তারা অনুতপ্ত এবং তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যপক প্রচারণার মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো কারনে তারা এই কাজ করেছিল এবং তা ঠিক করেনি বলে জানায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখনও আরাকানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাখাইনদের মধ্যে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। এর বিপরীতে কোনো মহলে তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায় না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালালেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামারদের অনেকে তা গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জাতিগত সংঘাত উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে, তবে এবার তাদের এই প্রচেষ্টা তেমন কার্যকরী হচ্ছে না। এ এ তাদের দখলকৃত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো বৈষম্য মূলক আচরণ করছে না বলে জানা যায়। তারা মিয়ানমার সেনা ক্যাম্প দখল করার পর সৈন্যদের পরিবারগুলোকে ও নিরাপদে হস্তান্তর করছে। এ ধরনের আচরণ তাদের সহনশীলতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেয়।

এ এ’কে তাদের সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক গবেষক এই সহস্রাব্দের সশস্ত্র দল হিসেবে আখ্যায়িত করে। এন এল ডি’র শাসনামলে এ একে সন্ত্রাসী দল হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০২১ সালে সেনাঅভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই সেনাসরকার সংগঠনটিকে কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাদের সঙ্গে একটি অঘোষিত যুদ্ধবিরতির আয়োজন করে। আরাকান আর্মি এই সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগায়। প্রায় দুই বছর তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সঙ্ঘাত এড়িয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে ও রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক গণসংযোগ চালায়। প্রতিটি এলাকায় তারা তাদের রাজনৈতিক এবং বিচারিক নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়। উত্তর এবং দক্ষিণ রাখাইনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে এনে ধীরে ধীরে তারা রাখাইনবাসীদের একমাত্র আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। এ এ’র সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে রাখাইনবাসীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। মিয়ানমারের সেনা-সরকার এবং এনএলডি রোহিঙ্গাদের প্রতি বরাবরই বিদ্বেষমূলক আচরণ দেখিয়ে আসলেও এ এ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় বলে জানিয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময় জান্তা সরকার অত্যন্ত কৌশলে রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে রেখেছিল। বর্তমানে এ এ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনদের এক ধরনের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়।

২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) এর সামরিক শাখা এএ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হিসেবে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। রাখাইনরা আরাকানে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিলেও রাখাইনে শান্তিতে বসবাস করতে হলে রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই হবে। তাই বাংলাদেশ থেকে আরাকানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমার সরকারের মতো আরাকানের রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মতও গুরুত্বপূর্ণ। এ এ’র কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল তোয়াং ম্রা নায়েঙ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে জানায় যে, এ এ বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটা তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।

এ এ জাতিগত রাখাইনদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে ও তাদের দূরদর্শী নেতৃত্ব মিয়ানমারের ফেডারেল কাঠামোর আওতায় একটা স্বশাসিত আরাকান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে এ এ’র সঙ্গে তাদের যোগাযোগ স্থাপন করেছে। সামনের দিনগুলোতে রাখাইনে তাদের প্রভাবের কারনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে তাদের সহযোগিতা দরকার হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জড়িত আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশকে এ এ’র সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ এ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আন্তরিক হলে তারা রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখাইন জনগণের মধ্যে প্রচার করতে পারে। রাখাইন সমাজের ওপর তাদের প্রভাব থাকায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে রাখাইন সমাজে জনসচেতনতা তৈরিতে এ এ’র প্রচারণাই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গেও নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে রোহিঙ্গাদেরকে পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ ফেরত নেয়ার বিষয়ে তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদেরকেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত বা বিভক্তি থাকতে পারবে না। নিজেদের ভিতরের বিভক্তি দূর করে তাদেকেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

;