বিদেশে উচ্চশিক্ষা এবং স্কলারশিপ

  • ড. মো. আ. ওয়াহাব
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বিভিন্ন দেশের ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ ও একাডেমিক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। গত ১০ বছর অস্ট্রেলিয়ার তিনটি ইউনিভার্সিটিতে লোকাল শিক্ষার্থী (ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখা করে​ ​ও বসবাস করে)​ ​এবং ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল।

সেই কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষার্থীরা কীভাবে ইউনিভার্সিটি স্কলারশিপ পেয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করার সুযোগ পেয়ে থাকে, সেই সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করব। ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীরা কীভাবে আসে তা ফোকাস থাকবে।

বিজ্ঞাপন

সিভি ও কভার লেটার, করেসপন্ডেন্স/কমিউনিকেশন, ইন্টারভিউ এবং অ্যাপ্লিকেশন, রেকমেন্ডেশন/রেফারেন্স লেটার এবং ইংলিশ টেস্ট স্কোরের মতো বিষয়গুলো থাকবে। মোটামুটি যদি এ ফ্যাক্টসগুলো আলোচনা করি, তাহলে ভর্তি ও উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা হবে।

সিভি ও কভার লেটার

বিজ্ঞাপন

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, আমরা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা অনেকে সুইটেবল সিভি এবং কভার লেটার তৈরিতে সময় এবং মনোযোগ কম দেই। বলা যায়, অনেকটা নন-প্রফেশনাল। একজন স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে আসবে এমন শিক্ষার্থীর সিভি ভালোভাবে ফোকাসড করতে হয়, এক কথায়, খুবই ইনফরমেটিভ হতে হয়| যেমন, যখন কেউ কোনো ল্যাবের গ্রুপ লিডার/প্রফেসরের কাছে অ্যাপ্লিকেশন করবে, তার অবশ্যই সেই ল্যাবের গ্রুপ লিডার/প্রফেসর রিসার্চ এরিয়ার সঙ্গে মিল রেখে সিভি তৈরি করতে হয়। মনে রাখতে হবে যে এক ল্যাবের অধীনে বেশ কিছু অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, প্রভাষকসহ অনেকে রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করে। অনেকজন একই ল্যাব শেয়ার করে কাজ করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেকে কোন না কোনো প্রজেক্টের অধীনে কাজ করে, প্রজেক্ট লিড দেওয়ার জন্য একজন প্রজেক্ট লিডার থাকে। এক কথায় গুড টিম ওয়ার্ক লাগে। কোনো প্রজেক্টে যদি ফান্ড (টাকা) থাকে, যা দিয়ে স্টুডেন্টকে স্কলারশিপ দেওয়া হয় অথবা ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপ পাওয়া যায়, তবে এটা ফান্ডিং পরিস্থিতির (situation) ওপর নির্ভর করে। তবে যদি ভালো সিভি এবং ইংলিশে ভালো স্কোর থাকে, তাহলে ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপ পাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে আসে।

সিভিতে স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের রেজাল্ট উল্লেখ করতে হবে (সম্ভব হলে সিজিপিএ উল্লেখ করতে হবে)। সুন্দর হেডিং এবং অর্ডার থাকবে। রেজাল্ট সেকশন-এ পজিশনসহ (যেমন ফার্স্টক্লাস, ফার্স্ট/সেকেন্ড) পুরস্কার পেয়ে থাকলে সেটা কোন ধরনের (ডিপার্টমেন্ট, অ্যাডমিশন, প্রেসেন্টেশন, কনফারেন্স),লিস্ট অফ পাবলিকেশনের অবশ্যই সম্পূর্ণ ইনফরমেশন থাকবে (যেমন: লিস্ট অফ অথরস দিয়ে আপনাকে নামটা হাইলাইট করতে হবে, করেসপন্ডিং অথর হলে অবশ্যই উল্লেখ করতে ভুলবেন না,​ ​পাব্লিকেশনে টাইটেল, সাল (২০২০), ভলিউম​ ​(২০), পেজ নম্বর (১১১-১২৩), (ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর, সাইটেশন, জার্নাল টাইপ (যদি পারেন q১/q২ উল্লেখ করা ভালো)। আলাদা শিরোনামে লিস্ট অফ কনফারেন্স থাকবে, যেখানে কোনো কনফারেন্সে অংশ নিয়েছেন কিনা এবং কোন ধরনের, ওরাল অথবা পোস্টার প্রেজেন্টেশন কিনা তা পরিষ্কার করে সিভিতে লেখা ভালো। এখন গুগলস্কলার এবং স্কোপাস/গুগলস্কলার সাইটেশন (scopus/google citations)(উদ্ধৃ​​তি-কেউ আপনার পাবলিকেশন ব্যবহার করেছে কিনা সেটা) উল্লেখ থাকলে আরও ভালো। এখন h-ইনডেক্স (h-index) দ্বারা রিসার্চ ইমপ্যাক্ট এবং কোয়ালিটি বোঝা যায়। এখন গুগল সার্চ ইঞ্জিনে এইসব ইনফরমেশন সহজলভ্য (available)।

সিভির পাশাপাশি কভার লেটার আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ ফ্যাক্টর। যা প্রফেসরের প্রথম নজরে পড়বে। কভার লেটারের মধ্যে নিজের পরিচয় দেয়ার পর রিসার্চ নিয়ে তার কাজের সঙ্গে কতটুকু মিল আছে, থাকলেও কীভাবে আছে এবং আপনার পিএইচডি রিসার্চ ইন্টারেস্ট বিষয়টা সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে বিনয়ের সঙ্গে উপস্থাপন থাকতে হবে। যদি কোনো অভিজ্ঞতা মিলে যায় (আপনার ফিলড/ইন্টারেস্টে মিলে যায়) তা খুবই নম্রতার মাধ্যমে জানাতে হবে কভার লেটারে। প্রফেসর অনেক ব্যস্ত থাকেন, তাই সিভি যতটুকু ইনফরমেটিভ করা যায়, ততো ভালো। সিভি এবং কভার লেটারসহ পাঠানোর পর যদি কোনো প্রফেসরের কাছ থেকে রেসপন্স পান, তাহলে আরো কমিউনিকেশন হবে। এসব কমিউনিকেশন দ্বারা তারা আপনার স্কিলস সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করবে্‌ন। যদি প্রফেসর আপনার সিভি পছন্দ করেন, তাহলে আপনার সিভি শর্ট-লিস্ট করে রাখবেন। ইতোমধ্যে প্রফেসর হয়তো আরো সিভি পাবেন, সেগুলোও রাখবেন। এর মধ্যে সে গ্রুপ কতজন স্টুডেন্ট নেবে সে সেমিস্টারে তার একটা ইন্টারনাল পসিবল ডিসিশন হবে।

শর্ট-লিস্ট

আবেদনকারীদের একটি ইনিশিয়াল লিস্ট করে তারপর সে তালিকা থেকে সবচেয়ে সুইটেবল স্টুডেন্টদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা হবে। প্রত্যেক স্টুডেন্টের সিভি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, এক কথায় গ্রিল করা হয় (আপনার সিভি কোন দেশের এবং কোন ইউনিভার্সিটি, রাংকিং, ডিগ্রি সম-মূল্যায়ন ইত্যাদি)। শর্ট-লিস্টের আগে ট্রান্সক্রিপ্ট, রিকমেন্ডেশন লেটার এবং পাবলিশড পাবলিকেশন্স নিয়ে একটা ফাইল তৈরি করা হবে এবং তাতে আপনাকে ইন্টারভিউয়ের সময় প্রশ্ন করতে অথবা জানতে সুবিধা হয়। পিএইচডি ইন্টারভিউ মূলত আপনার সিভি, কভার লেটার, এই গ্রুপ রিসার্চ করতে আগ্রহ এবং এক্সপেরিয়েন্স সম্পর্কিত হয়ে থাকে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কোনো প্রজেক্ট/থিসিস করে থাকলে, সেই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। এই ইন্টারভিউয়ে মূলত পিএইচডি প্রার্থী/অ্যাপ্লিকেন্টের কনফিডেন্স এবং ল্যাব কাজ ও টিম ওয়ার্ক কেমন করতে পারেন, তা জানতে চায়। আগেই বলেছি, পিএইচডি অথবা রিসার্চ করতে অনেক টিম ওয়ার্ক লাগে। তারপর আপনার ইংলিশ স্কোর কত সেটা জানবে। ইংলিশ আইইএলটিএস স্কোর যত ভালো, তার সম্ভবনা ততো বেশি। সবকিছু মিলিয়ে যদি আপনি সিলেক্ট হন তাহলে তারা আপনার পূর্ণ অ্যাপ্লিকেশনটি জাস্টিফিকেশন দিয়ে গ্রাডুয়েশন অফিসে রেকমেন্ড করবেন। 

পাব্লিকেশনে অ্যান্ড কনফারেন্স ফ্যাক্টস

যদি কারো উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা থাকে, তাহলে স্নাতক শেষ পর্যায়েই কোনো প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ভালো। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে থিসিস গ্রুপ থাকতে হবে| প্রজেক্টে কাজ করার সময় কলাবোরেশন কাজ করার একটা ঝোঁক থাকতে হবে, যাতে করে তাদের ল্যাব ব্যবহার করা যায় এবং তারাসহ রচয়িতা (co-author) হবে। এভাবে কাজ করলে ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে পাব্লিকেশন করার স্কোপ বেড়ে যায় এবং পাব্লিকেশনের পরিমাণ বেড়ে যায়। কলাবোরেশন কাজ একটা টিম ওয়ার্ক এর বিরাট অংশ এবং সিলেকশনের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। এখন তো দেশের বাইরে কলাবোরেশন করার স্কোপ তৈরি হয়েছে এবং ভালো পাব্লিকেশনে করছে। আমার মনে হয়, ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে পাব্লিকেশনে এর স্কোপ অনেকটা বেড়ে গেছে। তাই সিভিতে যত ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে পাব্লিকেশন থাকবে, তার স্কলারশিপের স্কোপ বেড়ে যায়। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল এ পাব্লিকেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর পিএইচডি পাওয়ার জন্য। পরেও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এভাবে কাজ করলে শিক্ষার্থীর রিসার্চ কাজ সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি হবে এবং ভালো মানের জার্নালে পাব্লিকেশন কীভাবে করতে হয় তা সম্পর্কে ধারণা হবে। এমন কি রিভিউয়ের উত্তর কীভাবে করতে হয় সেইটা ভালোভাবে জানা যাবে। মনে রাখবেন যে পাব্লিকেশন করার জন্য ভালো ল্যাব লাগে এবং ভালো ইনস্ট্রুমেন্ট বেসড ফ্যাসিলিটিজ লাগে। তাই আরেকটি ভালো অল্টারনেটিভ অপশন আছে, সেটা হচ্ছে আপনি দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, হংকং, তাইওয়ান, মালয়েশিয়াতে মাস্টার্স প্রোগ্রামে যেতে পারেন। এক কথায় ভালো ল্যাব দেখে মাস্টার করলে সেখান থেকে ভালো পাব্লিকেশন করার সুযোগ পাবেন। তারপরে অস্ট্রেলিয়ার যে কোনো ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডির জন্য স্কলারশিপের আবেদন করতে পারেন এবং পাওয়ার সম্ভবনাও অনেক বেশি|

ইংলিশ স্কোর

আইইএলটিএস ফর অস্ট্রেলিয়া ইংলিশ স্পিকিং কান্ট্রিতে আপনাকে অবশ্যই ইংলিশ স্কোর দিতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হলো আবেদনকারীর আইইএলটিএস স্কোর ৬.৫ এর বেশি হওয়া ভালো এবং অনেক ইউনিভার্সিটিতে ৬.০ থেকে আবেদন শুরু। ইংলিশ স্কোর ভালো মানে সেই আবেদনকারী বেশি গুরুত্ব বহন করে| ইংলিশ স্কোর ভালো মানে সে আবেদনকারী স্পিকিংসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সিগনিফিকেন্ট ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। ইংলিশ স্কোর ভালো হলে ভবিষ্যতে সাইন্টিফিক পেপার লিখতে এবং কনফারেন্স এ প্রেজেন্টেশন দিতে অনেক সুবিধা হবে। ইংলিশ ভালো জানলে নিজের ভালো লাগবে এবং ভালো কমিউনিকেশনের জন্য কনফিডেন্স বেড়ে যাবে।

রেকমেন্ডেশন/রেফারেন্স লেটার চেকিং

পিএইচডি অথবা চাকরির ক্ষেত্রে রেকমেন্ডেশন/রেফারেন্স লেটার যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। যেমন আবেদনকারীর কাছ থেকে তিনটি রেকমেন্ডেশন/রেফারেন্স লেটার চাওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে রেকমেন্ডেশন/রেফারেন্স লেটার যেন একটা অন্যটার অনুরূপ না হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু অংশ কপি অ্যান্ড পেস্ট করা, এটা খুবই অসাবধানে লেখা এবং শেষ পর্যন্ত খেসারত দিতে হতে পারে, মানে স্কলারশিপ হাতছাড়া হতে পারে। রেফারেন্স লেটার যেহেতু ভর্তিতে খুবই গুরুত্ব বহন করে, তাই অবশ্যই যথাযথভাবে লেখা ও উপস্থাপন করা উচিত। তাই রেফারেন্স লেটারে শুদ্ধ ইংলিশে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, ছাত্রকে কীভাবে চেনে এবং জানে, তার শক্তি (strength) এবং দক্ষতা উল্লেখ থাকা ভালো। শিক্ষার্থী যে বিষয়ে (প্রস্তাবিত প্রজেক্ট) পিএইচডি করতে যাচ্ছে, সেই বিষয়েই কিছু ইন্টারঅ্যাকশন (interaction) দেয়া ভালো। এ ইন্টারঅ্যাকশনের মাধ্যমে প্রস্তাবিত প্রজেক্টের সাথে ছাত্রের এক্সপেরিয়েন্স কতুটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা পরিষ্কার করে দেয়া।

কমিউনিকেশন/করেসপন্ডেন্স

 এখন তো ডিজিটাল প্লাটফর্ম, তাই অনেকভাবে আবেদনকারীর সাথে কমিউনিকেশন করা যায়, যেমন জুম, স্কাইপি, গুগল মেসেঞ্জার, আরো অনেক পদ্ধতি হতে পারে। তবে মনে রাখার বিষয় হচ্ছে, কমিউনিকেশনের সময় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যে প্রফেসর লক্ষ্য করবেন, আপনি কতটুকু সময়নিষ্ঠ (punctual) এবং কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে লিখছেন। যেমন, ইমেইল কমিউনিকেশনের সময় অবশ্যই যথাযথভাবে উত্তর দিতে হবে এবং শুদ্ধ ইংলিশ লিখতে হবে।

ড. মো. আ. ওয়াহাব: গবেষক, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী