চায়ের স্মৃতিবিজরিত টুকরো অংশের সংগ্রহশালা
স্মৃতি দুঃখজাগানিয়া। এই প্রেক্ষাপটে এসে অনেকেই বিগত দিনের স্মৃতিময় টুকরো টুকরো অংশ ফিরে যান। আর এই ভাবনা থেকেই ‘জাদুঘর’ প্রচলন। যেখানে বিগত দিনের পুরাতনী স্মৃতিনির্ভর বর্তমানের অব্যবহৃত উপাদানগুলোকে একে একে খুঁজে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে চা বাগানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু হয়। এরপর চা বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ১৮৫৭ সালে সিলেটে বাণিজ্যিকভাবে চা শিল্পের বিকাশ শুরু। সেই ইতিহাসের শাখা-প্রশাখা তৎকালীন প্রেক্ষাপটের উজ্জ্বলতাকেই ধারণ করে। যুগের সঙ্গে প্রযুক্তির সংমিশ্রণে চা শিল্পের বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমা এরই অনেক নমুনা-স্মৃতিচিহ্ন স্থান পেয়েছে শ্রীমঙ্গলের টি রিসোর্টে অবস্থিত দেশের একমাত্র চা জাদুঘরে বা টি মিউজিয়ামে। এটি চায়ের স্মৃতিবিজরিত টুকরো অংশের সংগ্রহশালা।
চা বাগানে সেসব দুর্লভ জিনিসের পাশাপাশি রয়েছে স্বাধীনতার আগে চা বোর্ডের দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিলও। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কমলগঞ্জের দিকে চলে গেছে যে সড়ক সেটি ধরে দুই কিলোমিটারের মতো এগোলেই বাংলাদেশ চা-বোর্ডের ‘টি রিসোর্ট অ্যান্ড মিউজিয়াম’। চা-বাগানে ঘেরা এ চায়ের জাদুঘরে বাংলাদেশের চা-শিল্পের প্রায় দেড়শ’ বছরের ইতিহাস ফুটে উঠেছে নানা সংগ্রহে-স্মারকে। সড়কের পাশ ঘেঁষা টিলার ওপর ছড়িয়ে থাকা টিনশেড ঘরগুলোর মধ্যে প্রথমটিতে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধুর আপাদমস্তক প্রতিকৃতি। খালি চেয়ার-টেবিলের পেছনে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন (১৯৫৭-৫৮)। তখন তিনি এসেছিলেন নন্দরানী চা বাগানে। সে সময় তিনি যে চেয়ারে বসে মিটিং করেছিলেন সেই চেয়ারই এটি। টেবিলের এক কোনায় ছোট তথ্যে এসব জানা গেছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের (পিডিইউ) ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. একে এম রফিকুল হক বলেন, প্রায় দেড়শ’ বছরের চা শিল্পের ইতিহাসের টুকরো টুকরো চিত্র যেন ফুটে উঠেছে চা জাদুঘরের সংগ্রহশালায়। চা বাগানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঐতিহ্যের নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ এবং নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এসবের পরিচয় করিয়ে দিতে বাংলাদেশ চা বোর্ড শ্রীমঙ্গলে ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর টি মিউজিয়ামের উদ্বোধন করা হয়। ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
দেশের বিভিন্ন চা বাগানে চা শিল্প-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পুরনো জিনিসপত্র ও নিদর্শন ফেলে না দিয়ে টি মিউজিয়ামে নিয়ে এলে আমরা ওগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দাতার নামসহ সংরক্ষণ করবেন বলে তিনি জানান।
টি মিউজিয়ামে স্থান পাওয়া দুর্লভ সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ আমলের টারবাইন পাম্প, কাঠ-পাথরে রূপান্তরিত জীবাশ্ম, সার্ভে চেইন, হস্তচালিত নলকূপ, লিফট পাম্প, লোহার লাঙলের অংশ, কেরোসিনচালিত ফ্রিজ, লোহার টেবিল, পানির ফিল্টার, সিরামিক জার, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাচীন বৈদ্যুতিক পাখা, পুরনো টেলিফোন সেট, টাইপ রাইটার, প্রাচীন পিএইচ মিটার, দেয়াল ঘড়ি, প্রুনিং দা, কাটা কোদাল, ড্রায়ারের অংশ, প্রাচীন মুদ্রা, প্লান্টিং হো, রুপার মুদ্রা, তামার ঘটি, বেতার যন্ত্র, রিং কোদাল, লোহার পাপস, কম্পাস, ফসিল, চয়নযন্ত্র, খুন্তি, বাথটাব, লেদ মেশিন, উড়োজাহাজের খণ্ডাংশ, ট্রলি ও রেললাইন, ড্রেসিং টেবিল, চা শ্রমিকদের পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃত কষ্টিপাথরের প্লেট, রুপার গয়না, মাদুলিসহ আরো অনেক রকমের নিদর্শন।
ন্যাশনাল টি কোম্পানির প্রাক্তন টি-প্লান্টার বি কে ভট্টাচার্য বলেন, এই টি মিউজিয়ামের গুরুত্ব আরো বিস্তৃত হতো যদি এর পাশে একটি টি লাইব্রেরি স্থাপন করা যেত। এতে চায়ের ওপর প্রকাশিত বিভিন্ন পুরনো প্রকাশনা, প্রতিবেদন কিংবা আমাদের মতো সাবেক টি প্লান্টারদের তালিকাসহ চায়ের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থাকলে নিঃসন্দেহে তা গবেষকদের অনেক উপকারে আসবে।