বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) শক্তিশালী করা গেলে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের অর্ধেকের বেশি সংস্কার হয়। তবে সেই বিইআরসিকে শক্তিশালীকরণের গতিতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না খাত সংশ্লিষ্টরা।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ ৩ মাস পার হলেও বিইআরসির মৌলিক বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি সামান্যই। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই (বিশেষ বিধান আইন স্থগিত ও নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ বাতিল) যে আশার আলো ছড়িয়ে ছিলেন, দিনে দিনে তা অনেকটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
প্রথমদিন মন্ত্রণালয়ে এসেই বির্তর্কিত বিশেষ আইনে (দায়মুক্তি আইন) আর কোন চুক্তি নয় বলে জানিয়ে দেন। সকল কাজ হবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে। উপদেষ্টা তার কথা রেখেছেন, অনেক প্রেশার গ্রুপের চাপও তাকে টলাতে পারেনি। বিশেষ আইনে চুক্তির অপেক্ষায় থাকা আমেরিকান কোম্পানি এক্সিলারেটের প্রস্তাবও নাকচ করে দৃঢ়তা দেখান।
প্রথমদিনে আরও একটি মাইলফলক ঘোষণা দেন বিইআরসি শক্তিশালী করার। ঘোষণা দেন, সরকার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করবে না, দাম নির্ধারণ করবে বিইআরসি। তার ওই উদ্যোগ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়, সাধুবাদ জানান ক্যাবসহ ভোক্তাদের সংগঠনগুলো। কয়েক দিনের মথায় ২৭ আগস্ট নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করার ধারা বিলুপ্ত করা হয়। অনেকে আশাবাদী হয়ে ওঠেন ন্যুজ্ব বিইআরসি গতিশীল ও শক্তিশালী হওয়ার। কিন্তু ৩ মাস অতিবাহিত হলেও বিইআরসি শক্তিশালী হওয়ার অন্তরায়গুলো এখনও রয়েই গেছে।
২০০৩ সালে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন পাশের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও আধাবিচারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠিত হয়। গ্যাস ও বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা এবং ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত বিইআরসি মূলত ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। এ পর্যন্ত ১৩টি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। তার ১২টি প্রবিধানমালাই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অনুমোদনের অপেক্ষায় ঝুলে রয়েছে।
আইনে সকল ধরণের জ্বালানির দাম নির্ধারণের এখতিয়ার থাকলেও প্রবিধানমালা ঝুলে থাকায় শুধুমাত্র গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে আসছিল বিইআরসি। ৩৪(৩) ধারায় বলা হয়েছে বিইআরসি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করবে। তবে শর্ত থাকে যে, প্রবিধানমালা প্রণয়ন না করা পর্যন্ত সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারণ করতে পারবে। পেট্রোলিয়ামের বিধিমালা অনুমোদন না হওয়ায় ধুয়া তুলে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারিত হয়ে আসছে। ২০২৩ সালে হঠাৎ করেই আইন সংশোধন করে নির্বাহী আদেশে দাম সমন্বয় (কম/বেশি) করার বিধান যুক্ত করা হয়। তারপর থেকে নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করায় কার্যত বেকার হয়ে পড়ে আধাবিচারিক প্রতিষ্ঠানটি।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে আশাবাদি হয়ে ওঠেন খাত সংশ্লিষ্টরা। অনেকেই ভেবেছিলেন এবার প্রবিধানমালাগুলো অনুমোদন হবে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে উদ্যোগও নেওয়া হয়। তবে ৩ মাস অতিবাহিত হলেও খুব একটা অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমি যোগদানের আগে থেকেই প্রবিধানমালা মন্ত্রণালয়ে জমা ছিল। আমি যোগদানের পর এগুলো অনুমোদনের বিষয়ে জোর দিচ্ছি। তবে জ্বালানি তেলের পৃথক তিনটি প্রবিধানমালা (বিতরণ, সঞ্চালন ও খুচরা বিক্রয়) না করে একত্রে করার বিষয়টি সামনে এসেছে। আমরা ৩টি একত্রে করে পাঠিয়ে দিয়েছি। আশা করছি শিগগিরই অনুমোদন পাওয়া যাবে।
প্রবিধানমালার পাশাপাশি জনবলের রয়েছে প্রকট সংকট। এজন্য নতুন জনবল কাঠামো তৈরি করা হয় ২০১৭ সালে। ২০১৪ সালে অনুমোদিত ৮১ পদের সঙ্গে আরও ২০০ পদসৃজন করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেটিকে কেটে ১১৮ নামিয়ে আনে। দুই বছর পর (২০১৯ সাল) দুই ধাপে নিয়োগের শর্তে অনুমোদন দেয় অর্থবিভাগ। এরপর আবার দুই বছর চলে যায়। ২০২১ সালের মার্চে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে রাজস্ব খাতে ৬৫টি পদ অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে পূর্বের ৮১ ও প্রস্তাবিত ৬৫ পদ মিলে ১৪৬ জনবলের কথা বলা হয়।
বিইআরসি ১৪৬ পদের দায়িত্ব বণ্টন প্রস্তুত করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রেড-৩ ও তদুর্ধ্ব পদ সৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন আবশ্যক। এরকম ৪টি পদ থাকায় ২০২১ সালের ৫এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রেরণ করে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন না দিয়ে যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা চেয়ে ফেরত পাঠান। আবার ঝুলে যায় জনবল কাঠামো। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ১৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে বিইআরসি। প্রায় ৩ মাস হতে চললেও আলোর মুখ দেখেনি। যে কারণে আবারও হতাশা বাড়ছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে চেয়ারম্যান নরুল আমিন ও কমিশনের সদস্যরা পদত্যাগ করেন। অন্তবর্তীকালীন সরকার শুধু চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে। কমিশনের ৪ সদস্যপদ শূন্য থাকায় স্থবিরতা বিরাজ করছে কমিশনে। ফুল কমিশন না থাকায় অনেক কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিইআরসির সাবেক সদস্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবু ফারুক বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বিইআরসিকে কার্যকর করা গেলে জ্বালানি খাতের অর্ধেক সংস্কার হয়ে যাবে। আইন অনুযায়ী পুর্ণাঙ্গ ক্ষমতা দেওয়া গেলে অনেক দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। ভারতসহ অনেক দেশে কোন চুক্তি করতে হলে রেগুলেটরি কমিশনের অনুমোদন নিতে হয়। আমাদের দেশেও যদি করা যায়, তাহলে তারা দেখবে সেটির আদৌ প্রয়োজন কি-না, আবার দর যৌক্তিক কি-না? দেশীয় স্বার্থ থাকলে তারা অনুমোদন দেবে। এতে ম্যাক্রো লেভেলে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
বিইআরসির সাবেক সদস্য মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বিইআরসিকে কার্যকর করলেই সবথেকে বড় সংস্কার হয়ে যাবে। বিইআরসি শক্তিশালী হলে অনেক দুর্নীতি অনিয়ম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। ৩ মাসেও কেনো প্রবিধানমালা অনুমোদন হলো না সেটা বড় অবাক করার।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা বিইআরসিকে ভবিষ্যতে শক্তিশালী ও কার্যকর দেখতে চাই। এখন পর্যন্ত বিইআরসি ইস্যুতে সরকারের অবস্থান আমাদের কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়। আগের সরকারের পথ ধরেই তারাও জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করছে। আগের সরকারের সুরেই কথা বলছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি, প্রয়োজন হলে যেভাবে এলপিজির দর ঘোষণার আদেশ আদায় করে নিয়েছি। জ্বালানি তেল প্রশ্নে সেই পথে হাটতে পিছপা হবে না ক্যাব।
এক সময় এলপিজির দর কোম্পানিগুলো নির্ধারণ করতো, ক্যাব কোর্টে গেলে বাধ্য হয় বিইআরসি।
ভোক্তারা বলেছেন, বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে মুনাফার অশুভ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। এমনও দেখা গেছে কোম্পানির স্টাফরা বছরে ১৮ লাখ পর্যন্ত প্রফিট বোনাস পেয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বিইআরসির গণশুনানিতে কিছুটা হলেও জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হতো। সেই জায়গাটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি ও অপচয় ঠেকাতে পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করতো গণশুনানি। তাদের অনিয়ম প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয় থাকতো। কিন্তু সেই বিইআরসিকে শক্তিশালী করতে সেভাবে মনযোগ দেখা যাচ্ছে না।