কয়লা উত্তোলনের পথে হাঁটছে সরকার

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কয়লা উত্তোলনের পথে হাটছে সরকার

কয়লা উত্তোলনের পথে হাটছে সরকার

জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কয়লা ‍উত্তোলনের তৎপরতা শুরু করেছে সরকার। প্রথমত বড়পুকুরিয়ার উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতি ব্যবহার ও ফুলবাড়ি কয়লা খনির উন্নয়নের বিষয়ে সক্রিয় বিবেচনা করা হচ্ছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, কয়লার ব্যবহার করতে চাই। তবে তার আগে বৈজ্ঞানিকভাবে সবকিছু সমাধান করতে হবে। আমাদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হচ্ছে পরিবেশ ও স্থানীয়দের বিষয়টি। আমরা জমির মালিককে ক্ষতিপূরণ দিলাম, কিন্তু ওই জমিতে যে কৃষক কাজ করতো তার কি হবে। কয়লার উপরে পানির স্তুরের সঠিক সমাধান থাকতে হবে। এক পক্ষের ক্ষতি করে আরেক পক্ষকে লাভবান করতে চাই না।

বিজ্ঞাপন

এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা কয়লা ক্ষেত্রগুলোর বিষয়ে হাত গুটিয়ে বসে ছিলাম না। ১০ বছর ধরে এসব বিষয়ে কাজ করছি। সমন্বিত বিদ্যুৎ জ্বালানি মাস্টার প্লানে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩০ শতাংশ করার ইঙ্গিত দেন তিনি।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গ্যাস সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে প্রত্যেক সভায় কয়লার বিষয়টি স্থান পাচ্ছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তরাংশে পরীক্ষামূলক উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। খনিটিতে আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং পদ্ধতি কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যনন্ত কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। আর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৮৫ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) সাইফুল ইসলাম সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা নর্থ-সাউথ পার্টে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের কথা চিন্তা করছি। বর্তমানে প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণের কাজ চলমান রয়েছে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দীঘিপাড়ার কয়লা উত্তোলনের বিষয়েও চিন্তা ভাবনা চলছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, বড়পুকুরিয়ার পাশাপাশি মাটির অল্প গভীরতায় থাকা ফুলবাড়ি কয়লা খনির বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে ফুলবাড়ি সেই ‘ঐতিহাসিক’ প্রতিবাদের কথা মাথায় রেখে সাবধানে পা ফেলতে চায় সরকার। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজটি করা যায় কিনা সেটাও বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

ফুলবাড়ির ঐতিহাসিক আন্দোলন দেশের কয়লা ক্ষেত্রগুলোকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট বিএনপি সরকারের আমলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রতিবাদে বিক্ষোভে নামে ফুলবাড়ীবাসী। ওই সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশ ও বিডিআর গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৩ জন। আহত হয় দুই শতাধিক। ফুলবাড়ির পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে ওই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ৬ দফা চুক্তি করে খনি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় তৎকালীন বিএনপি সরকার। ওই ৬ দফায় ছিল, আন্দোলনে নিহত ও আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান, দেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি না করা, বিতর্কিত এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) কোম্পানিকে চিরতরে দেশ থেকে বহিষ্কার, আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা, গুলিবর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার।

জ্বালানির সংকটকে পুঁজি করতে বিতর্কিত কোম্পানি এশিয়া এনার্জিও তৎপরতা শুরু করেছে বলে সূত্র জানিয়েছে। সরকারের উচ্চ মহলে এশিয়ার এনার্জির পক্ষ থেকে প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়েছে, এতে খনি উন্নয়নের উপকারিতা তুলে ধরা হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ৩০ বছরব্যাপী ৬৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। পাশাপাশি সৌর বিদ্যুৎ থেকে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। জ্বালানি আমদানির উপর চাপ কমবে, সরকার ট্যাক্স ও রয়ালিটি বাবদ আয় করবে ৭.৫ বিলিয়ন ডলার (টনপ্রতি ১৭.১৬ ডলার)। এতে নাকি পরিবেশ দুষণও ২২ থেকে ৩০ শতাংশ কমবে দাবি এশিয়া এনার্জির। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমানে যে মানের কয়লা আমদানি করা হচ্ছে তার চেয়ে উন্নত ফুলবাড়ির কয়লা। এতে দূষণকারি সালফারের উপস্থিতি অনেক কম। খনি উন্নয়ন করা হলে দক্ষিণাঞ্চলে থাকা পায়রা ও রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৯৭ ডলারে (প্রতি টন) কয়লা পৌঁছানো সম্ভব।

পেট্রোবাংলা সূত্রমতে বাংলাদেশে ৫ টি কয়লাক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে। ১৯৬২ সালে আবিস্কৃত জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ কয়লার মজুদ ধারণা করা হয়। ক্ষেত্রটিতে আনুমানিক কয়লার মজুদ রয়েছে প্রায় ৫৪৫০ মিলিয়ন টন। বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক অধিদফতর আবিষ্কার করেছে খালাশপীর, দীঘিপাড়া ও বড়পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্র। আর ফুলবাড়ি কয়লা ক্ষেত্র আবিষ্কার করে অষ্ট্রেলীয়ান কোম্পানি। খালাশপীর ও ফুলবাড়ি কয়লা খনির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির দেওয়া উন্নয়ন প্রস্তাব তৃতীয় পক্ষের দ্বারা মূল্যায়ন করার কথা বলা হলেও। সেই কাজটিও না করে হাত গুটিয়ে বসে ছিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ি, জয়পুরহাটের দীঘিপাড়া, রংপুরের খালাশপীর এবং বগুড়ার কুচমায়সহ পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব খনিতে প্রায় ৭ হাজার ৮২৩ মিলিয়ন টন উন্নতমানের কয়লা মজুদ রয়েছে। শুধুমাত্র বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলন চলমান। সম্প্রতি ১৩০৬ নম্বর ফেইজ থেকে দৈনিক ২৮০০ হতে ৩০০০ টন কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে।

ফুলবাড়ি কয়লাখনির কাজ পেতে চায় এশিয়া এনার্জি। যে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এলাকাবাসির রয়েছে চরম অসন্তোষ। কোন ভাবেই এশিয়া এনার্জিকে সহ্য করতে চায় না তারা। দিঘীপাড়া কয়লা খনির কাজ নিয়ে বসে রয়েছে পেট্রোবাংলা। খালাশপীর কয়লা খনি থেকে আন্ডারগ্রাইন্ড মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে চায় সমীক্ষাকারি কোম্পানি হোসাফ কনসোটিয়াম লি।

২০০৩ সালে হোসাফ কনসোর্টিয়াম ও চায়নার সেন উইন মাইনিং গ্রুপকে খালাশপীর কয়লা খনি সমীক্ষার জন্য লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ট্রপোগ্রাফিক্যাল সার্ভে এবং দ্বি-মাত্রিক ও ত্রি-মাত্রিক সিসমিক সার্ভে করে। হোসাফ ২০০৬ সালে খনি উন্নয়নের আবেদন করলেও সেই প্রস্তাব এখনও ঝুলে রয়েছে।

অন্যদিকে ২০০৪ সালে কয়লা নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়। ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন চূড়ান্ত হয়নি কয়লা নীতি। ২০০৪ সালে আইআইএফসি নামের দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে খসড়া কয়লা নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আইআইএফসি প্রণীত খসড়া অনুমোদন না দিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে রিভিউ (সংশোধন সংযোজন) করার দায়িত্ব দেয় বিএনপি। এরপর থেকে দফায় দফায় রিভিউয়ের পর রিভিউ কমিটি হলেও চূড়ান্ত হয়নি কয়লা নীতি।

বাংলাদেশ জ্বালানি তেল বলা চলে পুরোটাই আমদানি নির্ভর। গ্যাসের উপজাত হিসেবে পেট্রোল এবং চাহিদার ৪০ শতাংশ অকটেন উৎপাদন হয়। বাকি সবটাই আমদানি করে মেটানো হয়। জ্বালানির আমদানি নির্ভরতা কমাতে গ্যাস ভালো ভূমিকা রেখেছে এতোদিন। অনুসন্ধ্যানে স্থবিরতাসহ নানা কারণে নিজস্ব গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। অন্যদিকে শিল্পায়ন ও শতভাগ বিদ্যুতের কারণে বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা। গ্যাস সংকট আমদানি করে সামাল দিতে গিয়ে অনেকটা বেসামাল অর্থনীতি। বাধ্য হয়ে স্পর্ট মার্কেটের এলএনজি আমদানি বন্ধ। গ্যাস রেশনিং করা হচ্ছে, বিদ্যুতেও লোডশেডিংযে যেতে বাধ্য হয়েছে সরকার। অনেকদিন ধরেই জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, নিজস্ব সম্পদের ব্যবহার ছাড়া আমদানি নির্ভর অর্থনীতি খুবই ঝুঁকিপুর্ণ। প্রাথমিক জ্বালানি সবটুকু আমদানি করে সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই বাংলাদেশ। যেহেতু গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে তাই বাংলাদেশের হাতে কয়লার বিকল্প নেই। পাশাপাশি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া উচিত।