নির্বাহী আদেশে গ্যাসের বিতরণ চার্জ নয়!

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

গ্যাসের সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ নির্ধারণের দায়িত্ব বিইআরসিকে (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) দিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। নির্বাহী আদেশে সঞ্চালন চার্জ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে বলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্রটি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, গত ২ এপ্রিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব বিইআরসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার নাকি এমনও বলেছেন, আপনাদের (বিইআরসিতে) কাছে প্রস্তাব আসলে যাচাই-বাছাই করে যেটি সঠিক হবে তাই করবেন। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এখানে হস্তক্ষেপ করতে চায় না।

বিজ্ঞাপন

পেট্রোবাংলার একটি ‍সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) সঞ্চালন চার্জ বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব পেট্রোবাংলায় জমা হয়েছে। অন্যান্য কোম্পানির প্রস্তাব পেলেই একসঙ্গেই পেশ করা হবে।

তবে জিটিসিএল চার্জ কতো বাড়ানোর আবেদন করেছে সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি ওই কর্মকর্তা। জিটিসিএল গত বছরের মর্চে বিইআরসিতে দাখিলকৃত আবদনে সঞ্চালন চার্জ ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১.২২ টাকা (২০২২-২৩ অর্থ বছরের জন্য) করার আবেদন করেছিল। বিইআরসি যাচাই-বাছাই করে ৪৭ পয়সা অনুমোদন করেছে।

অন্যদিকে তিতাস গ্যাসও বিতরণ চার্জ বাড়ানোর আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। সবচেয়ে বড় ওই বিতরণ কোম্পানিটি বিদ্যমান বিতরণ চার্জ ১৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা করতে চায় বলে সূত্র জানিয়েছে। গত বছর অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে তিতাস গ্যাস প্রতি ঘন মিটারের বিতরণ চার্জ ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬৮ পয়সা করার আবেদন করেছিল। বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, তিতাস বিতরণ চার্জ ছাড়াই মুনাফায় থাকবে। শেষ পর্যন্ত অন্যান্য কোম্পানির মতো বিতরণ চার্জ ১৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।

গ্যাসের বিতরণ কোম্পানিগুলো অনেক বছর ধরেই মুনাফা করে চলছে। তাদের মুনাফার কিছুটা নজির পাওয়া যায় প্রফিট বোনাস প্রদানের হার থেকে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড তার ৩৮৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যেককে ১৮ লাখ টাকা করে প্রফিট বোনাস দিয়েছে। অতীতে জিটিসিএল, তিতাস গ্যাস, পিজিসিবি ও অন্যান্য কোম্পানিতে এই প্রফিট বোনাস প্রদানের প্রতিযোগিতা ছিল। অনেক সময় হিসেবে গোঁজামিল দিয়েও প্রফিট বোনাস দেওয়ার অনেক নজির রয়েছে। কোম্পানিগুলোর প্রফিট বোনাসে কিছুটা লাগাম টানার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

কেউ কেউ মনে করেন বিইআরসি ও কোম্পানির দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণও এটাই। যে কারণে আইন সংশোধন করে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোর বিকল্প চালু করা হয়েছে। অনেকের ধারণা মুনাফায় লাগাম দেওয়ায় চটে গেছেন বিতরণ কোম্পানিগুলোর লোকজন। আর কোম্পানি চটে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে মন্ত্রণালয় ক্ষেপে যাওয়ার নামান্তর। কারণ যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত প্রত্যেকেই কোন না কোন কোম্পানির বোর্ডে রয়েছেন। কেউ কেউ একইসঙ্গে একাধিক কোম্পানির বোর্ডে রয়েছেন। খোদ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব রযেছে সবচেয়ে বড় দু’টি কোম্পানির (তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) বোর্ড চেয়ারম্যান হিসেবে। বহু বছর ধরেই এমনটি চলে আসছে, সচিব পদে ব্যক্তির রদবদল হলেও সচিবের জন্য নির্ধারিত থেকেই যাচ্ছে বোর্ড চেয়ারম্যান পদটি। যিনি সচিব হবেন তিনিই বোর্ড চেয়ারম্যান হবেন এটাই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।

কোম্পানির কর্মকর্তারা যেহেতু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন, তাই সহজেই কান ভারি করার সুযোগ পান। এমনকি বোর্ড সভায় বসেও তারা তাদের মতো করে ব্যাখ্যা দাঁড় করান। কর্তাও হয়তো তা তলিয়ে দেখার সময় সুযোগ পান না। গত ১৪ ডিসেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্যপত্রে বিইআরসিকে নিয়ে চর্চার আলামত পাওয়া গেছে। ওই সভায় জিটিসিএল এমডি বলেন, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের সঞ্চালন চার্জ নির্ধারিত রয়েছে ৪৭ পয়সা। এর ফলে গত অর্থ বছরে ২১৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৫৫০ কোটি টাকা লোকসান হবে।

ওই সভায় তিতাস গ্যাস এমডি হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, তাদের কোম্পানি লোকসান দিচ্ছে, বিতরণ চার্জ বাড়ানো দরকার। অথচ ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রেট বেজের উপর রিটার্ন বিবেচনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে তিতাস গ্যাসের নিট রাজস্ব চাহিদা মাইনাস ১০ পয়সা। তিতাসের প্রতি ঘনমিটারের বিদ্যমান বিতরণ চার্জ ২৫ পয়সা হারে (জুলাই ২০১৯ থেকে) বাতিল করা যেতে পারে।

অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী তিতাস গ্যাস ২০২০-২১ অর্থবছরে অন্যান্য পরিচালন আয় করেছে ২ হাজার ৬০৮ মিলিয়ন টাকা, অন্যান্য অপরিচালন আয় করেছে ১২৩ মিলিয়ন টাকা। একই বছরে ব্যাংকে জমা আমানতের সুদ থেকে আয় করেছে ২ হাজার ৫১১ মিলিয়ন টাকা। তিতাস ২০২০-২১ অর্থবছরে অন্যান্য খাত থেকে সর্বোমোট আয় করেছে ১০ হাজার ৩৭১ মিলিয়ন টাকা।

বিতরণ চার্জ বিলুপ্ত করার পক্ষে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি তার ব্যাখ্যাও দিয়েছে। কমিটি বলেছে, তিতাসের রাজস্ব চাহিদায় অবচয় হার, ঋণের সুদ, রিটার্ন অন ইক্যুইটি, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, সুদ আয় সিস্টেম লস বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ভবনের অবচয় ৩ থেকে ১০ শতাংশ, ফার্ণিচার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ, অফিস ইক্যুইপমেন্ট ১৫ শতাংশ অন্যান্য ইক্যুইপমেন্ট ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ, যানবাহন ২০ শতাংশ, অন্যান্য সম্পদ ১০ থেকে ২০ শতাংশ অবচয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৫ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এতে তাদের বিতরণ চার্জ বিলুপ্ত করলে কোম্পানি মুনাফায় থাকবে।

শুনানিতে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটির রিপোর্টে বলা হয় সবগুলো কোম্পানিই মুনাফায় রয়েছে। কোম্পানিগুলো পরিচালন বর্হিভূত আয় এতে বেশি, তাদের বিতরণ চার্জ আদায় না করলেও মুনাফায় থাকে। অর্থাৎ হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক আমানত, নানা রকম মাশুল দিয়েই মুনাফায় থাকে কোম্পানি। এ কারণে শুধু কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বিতরণ চার্জ ২৫ পয়সা থেকে কমিয়ে ৯ পয়সা করার সুপারিশ দেওয়া হয়। অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির বিতরণ চার্জ বিলুপ্ত করার সুপারিশ দেওয়া হয়। এই ছিল ২০২২ সালের অবস্থা। চলতি বছর নির্বাহী আদেশে অস্বাভাবিক হারে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ক্ষেত্র বিশেষে দ্বিগুণ করা হয়।

আর গ্যাসের দাম দ্বিগুণ মানে শিল্প গ্রাহকদের জামানত দ্বিগুণ। অর্থাৎ তাদের ব্যাংকে আমানত দ্বিগুণ হবে, বছর শেষে অপরিচালন আয় আরও বেড়ে যাবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কোম্পানিগুলোর ব্যাংকে ফেলে রাখা উদ্বৃত্ত অর্থ নিয়ে গেছে সরকার। অথচ এখন কোম্পানিগুলোর চার্জ বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।

বিইআরসির একজন বিদায়ী সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমরা যা দিয়েছি সেটিকে ট্যারিফ বলা হয়। ট্যারিফ নির্ধারণের কতগুলো ভিত্তি রয়েছে। ফ্রি অর্থনীতির মধ্যেও ট্যারিফের মাধ্যমে কিছুটা হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নির্বাহী আদেশে যেভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে, সেখানে কোম্পানিগুলোর মুনাফা ফুলে ফেপে উঠবে। পেট্রোবাংলার সুবিধা পাওয়ার কোন পথ উন্মুক্ত করা হয়নি। গেজেটে বলতে হতো, বাড়তি অর্থ পুরোটা পেট্রোবাংলা পাবে, তবেই প্রকৃত সফল পাওয়া যেতো। না হলে কর্ণফুলী ১৮ লাখ প্রফিট বোনাস দিয়েছে পরের বছর এক কোটি করে দেবে।