ভ্রমণ বিলাসে নতুন নজির গড়তে যাচ্ছে ইআরএল-২
ভ্রমণ বিলাসে নতুন নজির গড়তে যাচ্ছে ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ (ইআরএল) প্রকল্প। দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি করা ওই প্রকল্পের বিদেশ ভ্রমণ খাতেই বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮ কোটি ৬০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
এসব ভ্রমণের বেশিরভাগই রাখা হয়েছে সমজাতীয় রিফাইনারি পরিদর্শন। প্রকল্পের আওতায় ১৮৪ জন কর্মকর্তার বিভিন্ন দেশ সফরের কথা বলা হয়েছে। কয়েকটি ভ্রমণ রাখা হয়েছে স্ট্যাডি ট্যুর ও সমজাতীয় রিফাইনারি পরিদর্শনের। চট্টগ্রামের পতেঙ্গাতে ১৯৬৮ সাল থেকে সমজাতীয় কারখানা সফলতার সঙ্গে পরিচালিত হয়ে আসছে। বিদ্যমান কারখানার আলোকে পাশেই সম্প্রসারিত হচ্ছে ইআরএল ইউনিট-২। ঘরের সঙ্গে কারখানা রেখে কেনো কাড়ি কাড়ি ডলার খরচ করে বিদেশ ভ্রমণে যেতে হবে তার কোন অর্থ দেখছেন না কেউ। কিছু কর্মকর্তার ভ্রমণ বিলাসের সুযোগ করে দিতেই এই উদ্যোগ বলে মনে করছেন তারা। আর যাতে কেউই বাগড়া না দেন সে কারণে প্রকল্প অনুমোদন সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, আইএমইডি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্তাদের বিদেশ সফরের কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব)। সমজাতীয় রিফাইনারি পরিদর্শনের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে ৬ জন, অর্থমন্ত্রণালয় থেকে ২ জন, পরিকল্পনা কমিশনের ২ জন, আইএমইডির ২ জন, বিপিসিরি ৪ জন এবং ইআরএল থেকে ৬ জন কর্মকর্তার কথা বলা হয়েছে।
শুধু সমজাতীয় রিফাইনারি পরিদর্শন নয়, অপরেশন প্রসেস ইউটিলিটিস ও অফসাইট প্রশিক্ষণের নামে ৫৪ জন কর্মকর্তার বিদেশ সফরের কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না কেউই। এই খাতে ৫৪ জন্য কর্মকর্তার জন্য ১৫ দিনের বিদেশ সফর রাখা হয়েছে। এতে ব্যয় হবে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ইন্সপেকশন ও মেইন্টেন্যান্স বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিতে ৩৫ জন কর্মকর্তাকে ১৫ দিনের বিদেশ সফরে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। তারা পৃথক ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিদেশ সফর করবেন। এ ছাড়া রয়েছে ইনফরমেশন টেকনোলজি বিষয়ক প্রশিক্ষণ, ল্যাবরেটরি বিষয়ক প্রশিক্ষণ, গুণগতমান এবং অপটিমাইজেশন পদ্ধতিসমুহ এবং রিফাইনারি সংক্রান্ত প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণে বিদেশ ট্যুর।
এসব বিষয়ে হাতে কলমে শেখার জন্য বিদেশ যাওয়ার কোন অর্থ দেখছেন না কেউই। তারা বলছেন, যে টাইপের মেশিন আনা হবে সেগুলো যদি দেশে না থাকত তাহলে যুক্তি ছিল। এগুলো যখন দেশে বিদ্যমান তাহলে সেই মেশিনারিজ দেখার নামে বিদেশ যাওয়া মানে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। বাংলাদেশের বিদেশ ট্যুরের বিলাসিতা নামে নানা রকম জনশ্রুতি রয়েছে। যথাযথ কর্মকর্তাকে ট্যুরে না পাঠিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ট্যুর বাগিয়ে নেন। প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ গেলেও তারা সময় কাটান ঘুরে আর শপিং করে। এমনকি বৈশ্বিক বিভিন্ন কনফারেন্সে গেলেও তারা সেখানে সময় না দিয়ে ঘুরে বেড়ান। কাড়ি কাড়ি ডলার খরচ করে নেওয়া প্যাভিলিয়ন বেশিরভাগ সময় পড়ে থাকে ফাঁকা।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিদেশ সফর নিয়ে একশ্রেণির লোকজনের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি এসেছে, এগুলো থেকে অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য বিদেশ সফরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
শুধু ভ্রমণ বিলাস নয়, প্রকল্পটির ইপিসি ঠিকাদার ও ভেন্ডরের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক বাবদ রাখা হয়েছে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এতে বিভিন্ন স্তরের ১৩৪ জন কর্মকর্তা অংশ নেওয়া কথা রয়েছে। এই বরাদ্দ নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন উঠেছে।
বহুল আলোচিত ইআরএল-২ প্রকল্পটি ২০০৮ সালে আলোচনায় আসে। আমলাতন্ত্রিক জটিলতায় কাজ শুরুর আগেই কেটে যায় এক যুগ। প্রথমে ১৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট ধরা হলেও ১০ বারের বেশি ব্যায় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধিত ডিপিপিতে ২৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তহবিল থেকে ৭ হাজার ১’শ কোটি টাকা এবং জিওবি তহবিল থেকে ১৬ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। নতুন ডিপিপি অনুযায়ী জুন ২০২৭ সালে সমাপ্তের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদিত হয়ে এখন পরিকল্পনা কমিশনে গেছে।
ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট বাস্তবায়নে পরামর্শকের ভূমিকায় আছে ভারতের ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়। ১১০ কোটি ৬০ লাখ টাকার বিনিময়ে এই প্রকল্পের পরামর্শক সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। বিপরীতে ইস্টার্ন রিফাইনারির মাত্র ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ২৪৫ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানির যোগান দেয়। বাকি প্রায় ৪৯ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয় বিপিসিকে। দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। পরিশোধিত তেল না এনে ক্রডওয়েল এনে পরিশোধন করা হলে প্রতি লিটার ডিজেলে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ টাকা করে সাশ্রয় হয় বলে বিপিসি সুত্র জানিয়েছে।
দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ১৯৬৮ সালে অপারেশন শুরু করে। ফরাসি প্রতিষ্ঠান টেকনিপের করা ওই ইউনিটের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (৩০বছর) শেষ হলেও এখনও পুরোদমে চলছে। ২০২১ উৎপাদনের রেকর্ড গড়ে পুরস্কৃত হয়েছে। ১৫ লাখ টন উৎপাদন সক্ষমতার এই তেল শোধনাগারটি ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে পুরনোটির আদলেই নতুন রিফাইনারি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে ইআরএল-২ নিয়ে হতাশার কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ইআরএল-২ সংক্রান্ত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রকল্পটি নিয়ে চিন্তা করছি। বিশ্বব্যাপী জ্বালানির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। জ্বালানির ধরণ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ক্রডঅয়েল সারাজীবন পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়। কুয়েত আগ্রহ দেখিয়েছে, তারা হলে ভালো কারণ তাদের নিজেদের ক্রডঅয়েল রয়েছে, ক্রড নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে না।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, যারা অযৌক্তিভাবে ব্যয় বাড়িয়ে দেয় তারা দেশ ও জাতির শত্রু। এভাবে অপচয় করে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে জনগণের কাঁধে বোঝা চাপানো হচ্ছে।
প্রকল্পটির ব্যয় নিয়েও রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। ১১ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু দেশ আগ্রহ দেখিয়েছিল। সেই কাজে ২৩ হাজার কোটি টাকার ডিপিপি কেনো এমন প্রশ্নের জবাবে ইআরএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আসলে প্রজেক্টটি ভীষণ কমপ্লেক্স। আমরা যদি ইইউ, আমেরিকা কিংবা জাপানি কোয়ালিটি নেই। একটি থেকে অন্যটির দরের তারতম্য হবে এটাই স্বাভাবিক।