‘আবাসিকের গ্যাস বিল এখনই পুনঃনির্ধারণ নয়’

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকদের বিল পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত তিতাস গ্যাসের আবেদনের বিষয়ে এখনই কোন সিদ্ধান্ত নয়। অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে পেট্রোবাংলা সমন্বিত প্রস্তাব জমা দিলে তারপর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন।

মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকদের এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) এবং দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) বিল নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এক চুলা ৭৬.৬৫ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার জন্য বিইআরসির কাছে আবেদন দিয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।

বিজ্ঞাপন

বিইআরসি চেয়ারম্যান বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, তিতাসের প্রস্তাবের বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আলোচনা হয়েছে। যেহেতু বিষয়টি গ্যাসের অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। তাই পেট্রোবাংলা তার অধীনস্থ কোম্পানিগুলোর মতামত নিয়ে সমন্বিত প্রস্তাব প্রেরণ করবে। তারপর বিইআরসি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করবে।

অন্যদিকে বিইআরসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, গত ২৬ জুন তারিখে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়ে তিতাসের চিঠির বিষয়ে অবগত করা হয়েছে। ওই চিঠির অনুলিপি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং তিতাস গ্যাসকেও দেওয়া হয়েছে। আমরা তিতাসের পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত আবেদন পেয়েছি গত মে মাসে।

তিতাস গ্যাস ওই প্রস্তাব দেওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। বিষয়টি অনুমোদন হলে আবাসিক গ্রাহকদের বিল অনেক বেড়ে যাবে। তিতাস গ্যাসের ওই প্রস্তাবকে মনগড়া ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন ভোক্তারা। চুরি ঠেকাতে না পেরে সেই দায় আবাসিক গ্রাহকদের উপর চাপাতে চাইছে বলে অভিযোগ করা হয়।

বিইআরসির সাবেক সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪কমকে বলেছেন, আমারতো মনে হয় ৫০ ঘনমিটারের নিচে করা উচিত ছিল। প্রথমবার ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছিল। তখন শর্ত দেওয়া হয়, প্রিপেইড মিটার বসানো এবং পরবর্তীতে কমিয়ে আনার।

আপনাদের সময়ে আদেশটি হয়েছে। কিসের ভিত্তিতে এক ও দুই চলা যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, তাদের যে সাড়ে ৩ লাখ প্রিপেইড মিটার ছিল সেখানে দেখা গেছে গড়ে ৪৫ এর নিচে ব্যবহৃত হয়েছে।

তিতাসের প্রস্তাবের সমালোচনা শুরু হলে তিতাস গ্যাস একটি ব্যাখ্যাও দিতে বাধ্য হন। ১৬ মে তারিখে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণের বিষয়ে পুন:বিবেচনার জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে পত্র মারফত অনুরোধ করা হয়েছে। উক্ত পত্রে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত কোন বিষয় প্রস্তাব নেই।

এতে বলা হয়, তিতাস গ্যাস টিএণ্ডডি কোম্পানি লিমিটেড পেট্রোবাংলার ৬টি ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মধ্যে অন্যতম। অত্র কোম্পানি গ্যাস সরবরাহ করে প্রতি ইউনিটে শুধুমাত্র ১৩ পয়সা মার্জিন পেয়ে থাকে। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস করার ক্ষেত্রে তিতাস গ্যাস-এর কোন প্রকার ভূমিকা বা সম্পৃক্ততা নেই। ইতোপূর্বে বিইআরসি মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকের প্রতি মাসে গ্যাস ব্যবহার একমুখী চুলার এবং দ্বিমুখী চুলার ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৭৩.৪১ ঘনমিটার এবং ৭৭.৩৮ ঘনমিটার নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ৪ জুন এক আদেশে মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকের প্রতি মাসে গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে একমুখী চুলার এবং দ্বিমুখী চুলার ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৫৫ ঘনমিটার এবং ৬০ ঘনমিটার পুনঃনির্ধারণ করে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে নির্ধারিত পরিমাণ-এর চেয়ে মিটার বিহীন গ্রাহকগণ বেশি গ্যাস ব্যবহার করে। ফলে তিতাস গ্যাস টিএণ্ডডি কোম্পানির সিস্টেম লস বৃদ্ধি পায়।

তিতাস গ্যাসের এই বক্তব্যের একমত হতে পারছেন না গ্রাহকরাও। তারা দাবি করেছেন তিতাস গ্যাস অযৌক্তিকভাবে বিল বাড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের পরিসংখ্যান বের করলেই তিতাসের বক্তব্য অসার প্রমাণিত হবে।

রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আগে ১ হাজার টাকার গ্যাস রিচার্জ করলে প্রায় ৩ মাসের মতো চলে যায়। গত বছর দাম বাড়ানোর পর (১২.৬০ থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা) ১৫’শ টাকা রিচার্জ করলে আড়াই থেকে তিন মাস চলে যায়। অর্থাৎ প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী রফিকুল ইসলামের মাসে খরচ পড়ছে ৫ থেকে ৬’শ টাকা। লালমাটিয়ার বাসিন্দা আব্দুল হামিদ মিয়াও প্রায় একই রকম তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি বড় পরিবার হলেও ৮’শ টাকার বেশি গ্যাস লাগবে না। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭ জন ১ হাজার টাকার গ্যাস রিচার্জ করলে দুই মাসের মতো চলে যায়।

খোদ বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, ‘প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট খুব ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘন মিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে’। তার বক্তব্য অনুযায়ী প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীরা মাসে ৪৫ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করছেন।

এক সময় বলা হতো আবাসিকের গ্রাহকরা অনেক বেশি গ্যাস পুড়ছে তাই দাম বাড়ানো উচিত। ওই বিতর্কের মধ্যেই ২০১৬ সালে লালমাটিয়া এলাকায় প্রথম পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রি-পেইড মিটার বসানো হয়। এতে রেজাল্ট এলো পুরো উল্টো, দেখা গেলো প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারীদের বিল আসছে অর্ধেকের কম (দেড়’শ থেকে আড়াই’শ টাকা)। তখন মিটার বিহীন গ্রাহকের মাসিক ৭৭.৪১ ঘনমিটারের বিল ছিল ৬৫০ টাকা নেওয়া হতো।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য মতে দেশে বৈধ আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে সাড়ে ৩৪ লাখ গ্রাহকের পকেট কাটা হচ্ছে। মাসে ৫’শ টাকা হারে ধরলেও পকেট কাটা টাকার পরিমাণ বছরে ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই হিসেব বড় পরিবারের, কিন্তু অনেক ছোট পরিবার রয়েছে যাদের ১ হাজার টাকার গ্যাসে ৩ থেকে মাস চলে যায়। যুগ যুগ ধরে চলছে এই পকেট কাটার মহোৎসব।

গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে প্রথম দিকে বেশ তোড়জোড় ছিল। এখন যতটা পারা যায় বিলম্বিত করার কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিতরণ সংস্থাগুলো। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২০১৮ সালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের দ্রুত করার আদেশ দেন। কিন্তু কোম্পানিগুলোর ঢিলেমির কারণে গ্রাহক যাতে নিজেরা মার্কেট থেকে মিটার কিনে স্থাপন করতে পারে সেই সুবিধা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু নানা মারপ্যাচে আটকে রাখা হয়েছে সেই সুবিধা। বিইআরসির পক্ষ থেকে একাধিক দফায় চিঠি দিয়ে প্রিপেইড মিটার স্থাপনে তাগাদা দেওয়া হয়।