জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভর হতে চাই না: প্রতিমন্ত্রী
জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল হতে চাই না, তবে সবপথ খোলা রাখতে চাই। এজন্য এলএনজি আমদানির পাশাপাশি দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জোর দেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি।
শনিবার (৫ আগস্ট ) এফবিসিসিআই ভবনে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার, বঙ্গবন্ধুর দর্শন শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি আশ্বাস দিতে পারি, গ্যাস সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারবো। তবে পরিকল্পিত জোনে শিল্প স্থাপন করতে হবে। সেখানে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হবে। ভোলায় উদ্বৃত্ত গ্যাস রয়েছে, পাইপলাইনের অভাবে আনা যাচ্ছে না। পাইপলাইন করতে ৯ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা লাগবে। পাইপে ৩০০ মিলিয়ন গ্যাস সরবরাহ থাকতে হবে। এখন কি সেই গ্যাস দেওয়া সম্ভব! ভোলায় শিল্প স্থাপন করা হলে এখনই গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে সাহস করে ৫টি গ্যাস ফিল্ড কিনে নেন। সেসব গ্যাস ফিল্ড থেকে ৩ লাখ হাজার কোটি টাকা অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ে, ২১ বছর লেগেছে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে। বঙ্গবন্ধু রিগ কিনেছেন, তার মেয়েও রিগ কিনেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের আবিস্কৃত গ্যাস আর মাত্র ৮ থেকে ৯ বছর চলবে, গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো ছোট ছোট। বাপেক্স বাইরে যাবে না, কাউকে ঢুকতে দিবে না, এখন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বাইরে থেকে রিগ ভাড়া করে কূপ খনন করা হবে। ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছি এতে সাড়ে ৬শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়বে, আবার একই সময়ে কিছু কূপের উৎপাদন কমে যাবে। সেটিও সাড়ে ৬শ এর মতো।
তিনি বলেন, আগে লক্ষ্য ছিল শতভাগ বিদ্যুতায়ন, আমরা সফল হয়েছি। এখন লক্ষ্য হচ্ছে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। এটা করতে হলে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পরিস্থিতি কিন্তু স্থির থাকে না, তাই সময়ে সময়ে মাস্টারপ্ল্যান রিভিউ করতে হয়েছে। অনেক কিছু করতে পেরেছি, অনেক কিছু হয় নি। করোনা পরিস্থিতি না হলে আরও কিছু করা সম্ভব হতো।
তিনি বলেন, এসপিএম করা হয়েছে, পানির নিচ দিয়ে ২৬০ কিলোমিটার লাইন করেছি। আগে গভীর সমুদ্রে থাকা জাহাজ থেকে তেল খালাস করতে ১২দিন লাগতো, এখন ৪৮ ঘণ্টায় তেল খালাস হবে। এতে বছরে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এটা করতে গিয়েও বাঁধার মুখে পড়তে হয়েছে। সিনিয়ররা প্রযুক্তি নিতে চায় না, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে, স্মার্ট থিংকিংয়ে যুক্ত হতে হবে।
তিনি বলেন, বিরাট সম্ভাবনা আমাদের কয়লায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগে স্থানীয় কৃষকের কথা ভাবতে হবে। তাদের পুর্নবাসন কিভাবে সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব ড. মোঃ খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আমার কাছে যে তদ্বির আসে তার বেশিরভাগ গ্যাস সংযোগের জন্য। আমরা দিতে পারছি না। ২০২৬ সালের পর থেকে শিল্পে গ্যাসের কোন সংকট থাকবে না। আমাদের আরও কূপ খনন করা দরকার। বাপেক্সের ৫টি রিগ রয়েছে আরেকটি রিগ কেনার অনুমোদন দিয়েছি। একটি রিগ দিয়ে বছরে সর্বোচ্চ ৩টি কূপ খনন করা যায়।
তিনি বলেন, পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। এতে অনেক খরচ কমে যাবে। জাহাজে করে তেল আনতে প্রিময়াম দিতে হয় ১১ ডলার, এখানে সাড়ে ৫ ডলার। এসপিএম অক্টোবর নাগাদ চালু করতে পারবো। এটি হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় ভালো অবস্থানে যাবে।
মডেল পিএসসি আপডেট করেছি। ১ মাসের মধ্যে সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে জানান জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সচিব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারী অধ্যাপক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড বদরূল ইমাম বলেন, বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র কিনে না নিতেন, পুরোপুরি বিদেশির ওপর নির্ভর করতে হতো। এখন যে গ্যাস পাচ্ছি তার সিংহভাগ আসে কিনে নেওয়া ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। বঙ্গবন্ধু একইসঙ্গে সমুদ্রে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলে আস্তে আস্তে অনুসন্ধান কমে যেতে থাকে। ত্রিপুরা তাদের ছোট্ট আয়তনে ১৬৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। আয়তনের দিক থেকে কয়েকগুণ বড় বাংলাদেশ মাত্র ১০০টি কূপ খনন করেছে। এতেই বুঝতে পারা যায়, বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে।
এখনকার সংকট দূর করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। সাগরে আমাদের দুই পাশ্বে ভারত ও মায়ানমার গ্যাস পেয়েছে। কিন্তু আমরা ওই অঞ্চলে গ্যাস পাই নি, প্রাকৃতিক কারনে নয়, অনুসন্ধান ঢিলেমির কারনে। ভূতত্ত্ববীদরা মনে করেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বড় রিজার্ভ পাওয়া যাবে মায়ানমার সংলগ্ন এলাকায়।
তিনি বলেন, বড়পুকুরিয়ার উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে। কারন সেখানে মাটির স্বল্প গভীরে কয়লার অবস্থান। বাংলাদেশে লোহার খনি আবিষ্কার করেছে জিএসবি। হাকিমপুর উপজেলায় অবস্থিত ক্ষেত্রটিতে বিশাল মজুদ রয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। ২০৪১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা, এটা নিশ্চিত করতে হলে বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এখন আমাদের জ্বালানি খাত অনেকটা আমদানি নির্ভর, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে ঝুঁকি থেকে যায়। অনেক দেশ রয়েছে যারা জ্বালানি রপ্তানি করে। আমাদের সে সুযোগ নেই, আমাদের একমাত্র রপ্তানি পণ্য হচ্ছে শিল্পপণ্য। শিল্পকে অব্যাহত রাখতে নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানি জরুরি। নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানি নিশ্চিত করতে হলে নিজস্ব কয়লা উত্তোলন করা জরুরি। এক সময় যে দেশগুলো কয়লার বিরুদ্ধে কথা বলতো, ইউক্রেন যুদ্ধের পর তারা আবার কয়লার দিকে ঝুকেছে।
সিনিয়র সাংবাদিক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু তিনটি কাজ করেছিলেন, মাটির নিচের সম্পদের উপর জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করেছিলেন আইনের মাধ্যমে। সেল প্রথম দিকে কথা বলতে রাজি হয় নি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের পেট্রোলিয়াম আইনের একটি ধারা ছিল অপারেশনে না থাকলে সেটি অধিগ্রহণ করতে পারবে। পরে বাধ্য হয় সেল।বঙ্গবন্ধু পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের মান উন্নয়ন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের মান অবনমন করা হয়। আমরা সাগরে সবার আগে কাজ শুরু করেছিলাম। এখন সবার পেছনে পড়ে গেছি।
তিনি বলেন বাপেক্স বোর্ডে একটি সিদ্ধান্ত হয়, সেটি যায় পেট্রোবাংলায়, তারা দেখে পাঠায় মন্ত্রণালয়ে, সেখানে একজন উপসচিবের মাধ্যমে ফাইলটির কাজ শুরু হয়। এভাবে বাপেক্সকে দিয়ে কাজ করা সম্ভব না। বিদ্যুৎ খাত যেভাবে এগিয়েছে সেভাবে জ্বালানি খাত এগিয়ে যেতে পারে নি। কমপক্ষে ২০টি করে কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শোয়েব বলেন, বাপেক্সকে দুর্বল করে অন্যান্য কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হচ্ছে, এই অভিযোগ তোলা হয় এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। বাপেক্স তার সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করে কাজ করছে। আমরা ২০২৪ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। এরমধ্যে ৯টি কূপ খনন করা হয়েছে। বগুড়া অঞ্চলে কূপ খননের পর উচ্চচাপের কারনে সরে এসেছি, মোবারকপুর গভীরে যাচ্ছি। সৌলকূপা ও জামালপুরে কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এফবিসিসিআই এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, উত্তরাঞ্চলের ৫টি কয়লা খনির বিষয়ে রাজনৈতিক ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। সেখানে যে সব বসতী রয়েছে তাদের জন্য স্যাটেলাইট টাউন স্থাপন করা যেতে পারে। জ্বালানির নিরাপত্তার জন্য কয়লা ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।