পেছন থেকে দৌড়ে সবার সামনে বাঁশখালী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র
![ছবি: বার্তা২৪.কম](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2023/Aug/31/1693456743617.jpg)
ছবি: বার্তা২৪.কম
সফল পরিণতিতে দেশের প্রথম বৃহৎ বেসরকারি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাঁশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট। পরে চুক্তি করেও অন্যদের পেছনে ফেলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে দক্ষতা দেখিয়েছে দেশীয় কোম্পানিটি।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশে ইতিহাসে নানান দিক থেকে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বেসরকারি একক বিনিয়োগ হিসেবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ, আবার বেসরকারি প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগেও রেকর্ড করেছে এস আলম গ্রুপ। বেসরকারি খাতে বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নেও রেকর্ড ছুঁয়েছে, প্রায় ১.৭৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থায়ন এসেছে প্রকল্পটিতে। আর এস আলম গ্রুপ নিজস্ব উৎস থেকে অর্থায়ন করেছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ বেসরকারি খাতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রথম ৩টি চুক্তি করে ২০১২ সালের জুনে। প্রথম দফায় সম্পাদিত ওই চুক্তিগুলো হয় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে। অন্যদিকে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এস আলম গ্রুপ চুক্তিবদ্ধ করে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ওরিয়নের বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসা থাকলো দূরের কথা, কাজেই শুরু করতে পারেনি। আর ৪ বছর পর চুক্তি করে ইতোমধ্যেই সফল পরীক্ষামূলক উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে এস আলম গ্রুপ।
![](https://imaginary.barta24.com/resize?width=700&quality=75&path=uploads/news/2023/Aug/31/1693456670321.jpg)
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ২৭৫ মিটার উচ্চ রঙ্গিন চিমনী অনেক দূর থেকেও দৃশ্যমান। সাগর মোহনায় নির্মাণ করা হয়েছে বিশেষায়িত জেটি। যেখানে ঘণ্টায় ২ হাজার মে. টন কয়লা খালাস করা যাবে। কয়লা ইয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত দু’টি কনভেয়ার বেল্টের সক্ষমতা রয়েছে ৪ হাজার মে.টন। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে ঢাকনা যুক্ত কনভেয়ার বেল্ট বসানো হয়েছে। কয়লা ইয়ার্ডের চারপাশে দেওয়া হয়েছে উচু নেটের ঘেরা। দু’টি উন্নতমানের এফজিডি (ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন) নির্মাণ হয়েছে অনেক আগেই। অ্যাশ সংরক্ষণের জন্য ২টি সাইলে নির্মাণ করা হয়েছে যার প্রত্যেকটির ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ২ হাজার ৬’শ মে. টন। আর ৮০ একর জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে বিশাল অ্যাশপন্ড। সাইক্লোন কিংবা জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতি দে র্যোগ থেকে সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে হেভি ওয়েভ প্রাচীর।
সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গত ১৪ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হয়। আর প্রথম ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় ২৪ মে। পরীক্ষামূলক উৎপাদন কার্যক্রম শেষ, এখন বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে প্রথম ইউনিট। দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বাড়তি ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে সেপ্টেম্বরের শেষ অথবা অক্টোবরের শুরুতে। সবচেয়ে সুখকর খবর হচ্ছে অন্যদের তুলনায় সাশ্রয়ী দামে মিলব এখানকার বিদ্যুৎ। ভারতীয় কোম্পানি আদানী গ্রুপের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ এমনকি পায়রার তুলনায় দাম সাশ্রয়ী হবে এই বিদ্যুৎ।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সুত্র জানিয়েছে, ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় প্রায় অর্ধেকের কম দামে পাওয়া যাবে বিদ্যুৎ। আর ডিজেলের সঙ্গে তুলনা করলে খরচ এক-তৃতীয়াংশ। বর্তমানে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে (টন প্রতি ১২৫ ডলার) ইউনিট প্রতি জ্বালানি খরচ ৬.৫০ টাকা, ফার্নেস অয়েলে (লিটার ৮৫ টাকা) ১৯ টাকা এবং ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ২৮ টাকার মতো খরচ পড়ছে। ফার্নেস অয়েলের সঙ্গে তুলনা করলে ইউনিটে সাশ্রয় হবে ১২ টাকার মতো। বাঁশখালী পুরোপূরি উৎপাদনে থাকলে দৈনিক প্রায় সোয়া ৩ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।মাসে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৯৫ কোটি ইউনিটের মতো। ইউনিট প্রতি ১২ টাকা হারে সাশ্রয় ধরলেও সরকারের সাশ্রয় হবে ১১৪০ কোটি টাকার উপরে।
বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষে বাঁশখালীর (চট্টগ্রাম) গন্ডামারা এলাকায় বৃহৎ ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। মালিকানায় রয়েছে দেশীয় খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ, চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচ টিজি। দেশীয় কোম্পানি এস আলমের অংশীদারিত্বের পরিমাণ ৭০ শতাংশ, আর চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ও এইচ টিজির হাতে রয়েছে ৩০ শতাংশ।
এসএস পাওয়ার ওয়ান লিমিটেড এর সিএফও এবাদত হোসেন ভুঁইয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের প্রথম ইউনিটের টেস্টিং শেষ হয়েছে।বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য আমরা প্রস্তুত হয়েছি। আশা করছি শিগগিরই প্রথম ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পুরোমাত্রায় উৎপাদন করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে এক মাস পরে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হওয়ার আগে থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি থেকে ট্যাক্স, ভ্যাট ও অন্যান্য ফি বাবদ প্রায় ১৩’শ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। দেশের ভেতর থেকে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছে। শুধু তাই নয়, করোনার মতো মহাসংকটের সময় যখন কর্মসংস্থান সংকট তৈরি হচ্ছিল, সেই সময়সহ টানা ৪বছর ধরে ৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে। কেন্দ্রটি চালু হলে ১২’শ লোকের কর্মসংস্থান হবে। যে সব জায়গায় আমাদের দক্ষ লোকবলের সংকট রয়েছে তেমন জায়গায় মাত্র ৬৫ জন চীনা প্রকৌশলী কাজ করবে। চীনা প্রকৌশলীরা যেখানে কাজ করবেন প্রত্যেক জায়গায় দ্বিতীয় লাইনে থাকবে বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা। যারা দক্ষ হয়ে পরবর্তীতে নিজেরাই প্রকল্পের দায়িত্বভার গ্রহণ করবে। অর্থাৎ দক্ষজনবল তৈরিতেও বিশাল ভূমিকা পালন করবে। এই খাতে দক্ষ প্রকৌশলীদের দেশে বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিইআরসির সাবেক সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মাইলফলক। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভালো প্রচেষ্টা। একটা বড় বিনিয়োগ সফল হলে পেছনে অনেক বিনিয়োগকারী উৎসাহী হন। অর্থাৎ একটা বিনিয়োগ আরেকটি বিনিয়োগ ডেকে আনে। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
তিনি আরও বলেন, আমি যতদূর জানি অবস্থানগত দিক থেকেও অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। তাদের জেটিতে সরাসরি ৬০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারবে। জ্বালানি তেলের তুলনায় সাশ্রয়ী দরে বিদ্যুৎ পাবে বাংলাদেশ সেদিক থেকেও সুখকর। তবে খেয়াল রাখতে হবে এগুলো যেনো বসে না থাকে। বসে থাকলে বিদ্যুৎ খাতে চাপ তৈরি হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল এর মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত গ্যাসের পরেই কয়লাকে সাশ্রয়ী বিবেচনা করা হয়। সে কারণে এ ধরণের বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। কেন্দ্রটি উৎপাদনে এলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ কমে আসবে। কিছুদিন আগে তেলের দাম বেড়ে গেল যখন বিদ্যুতের কিছুটা সংকট হয়েছিল, তখন টেস্টরানে এসে এসএস পাওয়ার ভালো সাপোর্ট দিয়েছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসা খুবই আনন্দের খবর। পায়রা, রামপালের মতো বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে গেলে ছোট এবং ব্যয়বহুল তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে।তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎে কেন্দ্রগুলো চালানোর কারণে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ও সরবরাহের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়ে গেছে। কয়লা ভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদন গেলে পার্থক্য কমে আসবে। আমাদের প্রথম লক্ষ্যছিল সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। সেই লক্ষ্য ভালোভাবেই পুরণ করতে পেরেছি।এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সাশ্রয়ী দামে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা। সে দিক থেকে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দারুণ সহায়তা করবে।