পিএসসি চূড়ান্ত হলেও সাগরে দরপত্র আহ্বানে ঢিলেমি

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

পিএসসি-২০০৮ মাত্র ৩ মাসে চূড়ান্ত হলেও ঢিলেমির কারণে পৌনে ৩ বছর সময় গড়িয়ে গেছে পিএসসি-২০২৩ (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি) হালনাগাদে। অবশেষে বহুল প্রত্যাশিত পিএসসি চূড়ান্ত হলেও দরপত্র আহ্বানের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

পিএসসি অনুমোদনের পর একাধিক সভায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তৎকালীন সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেছিলেন, আমরা এক মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে চাই।

বিজ্ঞাপন

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, সাধারণ পিএসসি চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিড ডকুমেন্ট অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু পিএসসি অনুমোদিত হওয়ার দেড় মাস অতিবাহিত হলেও দরপত্রের ফাইল এখনো তোলা হয়নি। তবে খসড়া বিড ডকুমেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছে, ফাইল চাওয়া হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।

মডেল পিএসসি-২০০৮ চূড়ান্ত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন পেট্রোবাংলার তৎকালীন পরিচালক (মাইনিং) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী। সাবেক ওই পরিচালক বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে মধ্যে চূড়ান্ত করেছিলাম। এখন পৌনে ৩ বছর লাগবে কেনো। আমরা তখন খসড়া উন্মুক্ত রেখে পাবলিকের মতামত নিয়েছি, আমরা ৪টি পাবকিল কনসালটেশন করেছি। তখনও এতদিন লাগেনি। এবার তো এসবের কিছুই করা হয়নি। বিষয়টি হচ্ছে লক্ষ্যটা কি। তোমার যদি লক্ষ্য হয় গ্যাস আমদানি তাহলে দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান গুরুত্ব হারাবে এটাই স্বাভাবিক।

বিজ্ঞাপন

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলে কমপক্ষে ৩ মাস সময় দিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কোন পার্টি দরপত্র জমার জন্য বাড়তি সময় চেয়ে আবেদন করে। তখন তাকে সময় দেওয়া আন্তর্জাতিক রেওয়াজ। দরপত্র জমার পর মূল্যায়ন করতেও দুই-তিন মাস সময় লাগবে। অথচ অলস বসে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ৯টি ব্লক প্রস্তুত রয়েছে দরপত্রের জন্য। সবচেয়ে উদ্বেগে বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ যতবেশি বিলম্ব করছে ততবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের পাশের ব্লকগুলো থেকে দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস উত্তোলন করছে মিয়ানমার।

পেট্রোবাংলার ঢিলেমির কারণে বিশাল সমুদ্র জয়ের পর অধরা সম্ভাবনার সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। আন্তর্জাতিক আদালতে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সর্বমোট ১ লাখ ১৮ হাজার৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। এক দশক পেরিয়ে সেই সমুদ্র সীমার সফলতা কোনই কাজে আসেনি, বিশেষ করে খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে।

দেশের ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের স্বস্তিকর সমাধান এই বিশাল জলরাশির নিচে লুকায়িত বলে মনে করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কারণ বাংলাদেশের ব্লকের পাশেই মিয়ানমার বিশাল গ্যাসের মজুদ পেয়েছে। সাগরে দরপত্র আহ্বান করেও খুব একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। বাংলাদেশের পিএসসি-২০১৯ আকর্ষণীয় নয়, বহুজাতিক কোম্পানির এমন অভিযোগে হালনাগাদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে (আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়)।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ওই সিদ্ধান্ত জানুয়ারিতে (২০২১) প্রেরণ করা হয় পেট্রোবাংলায়। রহস্যজনক কারণে প্রায় ১০ মাস সেই ফাইল চাপা দিয়ে রাখেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) শাহীনুর ইসলাম। দশ মাস পড়ে থাকার পর কাজ শুরু হলেও পেট্রোবাংলার কাছে কখনই অগ্রাধিকার পায়নি বিষয়টি। কনসালটেন্ট চূড়ান্ত করতে সময় নেয় আরও ৮ মাস। ২০২২ সালের মে মাসে সিঙ্গাপুরের উড ম্যাকেঞ্জি এশিয়া প্যাসিফিককে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়। কোম্পানিটি ৪ মাস পর খসড়া জমা দিলে ফাইল চালাচালির পর গত ২৬ জুলাই চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ অনেক ছাড় দিয়ে মডেল পিএসসি-২০১৯ (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি) সংশোধিত করা হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগের পিএসসিগুলোতে গ্যাসের দর স্থির করে দেওয়া হলেও এবার গ্যাসের দর ব্রেন্ট ক্রডের আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে উঠানামা করবে গ্যাসের দর। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রডের ১০ শতাংশ দরের সমান। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রডের দাম ৮০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ৮ ডলার। যা বিদ্যমান পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল। ব্রেন্ট ক্রডের দামের ক্ষেত্রে সারা মাসের দর গড় করে সেই হিসাব ধরা হবে। দামের পাশাপাশি সরকারের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ের দুই বছরের মধ্যে কূপ খনন করে গ্যাস না পেলে কিংবা, বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য না হলে শর্তসাপেক্ষে যথাক্রমে ১ ও ২ শতাংশ হিস্যা বাড়ানোর সুযোগ থাকছে। গ্যাস বিক্রির ক্ষেত্রে প্রথম প্রস্তাব পেট্রোবাংলাকে দিতে হবে, পেট্রোবাংলা নিতে না চাইলে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির সুযোগ পাবে বিদেশি কোম্পানি।

অন্যদিকে বিশাল সমুদ্রসীমায় একটি পূর্ণাঙ্গ বহুমাত্রিক জরিপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে নাম দিয়ে ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। সেই প্রক্রিয়াও নির্ধারিত ছকে করতে ব্যর্থ হয়েছে পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। নরওয়ের কোম্পানি টিজিএস এবং ফ্রান্সের স্লামবার্জার কনসোর্টিয়াম তাদের রিপোর্টও গুছিয়ে এনেছেন বলে পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে। তারপরও আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে ঢিলেমি লক্ষ্যণীয়।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, মডেল পিএসসি আকর্ষণীয় করার কারণে অনেক বড় বড় বিদেশি কোম্পানি সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখাচ্ছে। মার্কিন কোম্পানি এক্সন মবিল খুবই আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা ইতিমধ্যে দুই দফায় প্রস্তাবনা দিয়েছে। আমরা একটি নন বাইন্ডিং এমওইউ করতে পারি।

২০০৮ সালের গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ নম্বর ব্লক ইজারা পেয়েছিল আমেরিকান কোম্পানি কনোকো ফিলিপস। কোম্পানিটি দুই বছর অনুসন্ধান করার পর চুক্তি সংশোধন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির দাবি জানায়। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় ব্লক দুটি ছেড়ে দিয়ে চলে যায় ২০১৪ সালে। অন্যদিকে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক দরপত্রে গভীর সমুদ্রের ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১ এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ফিলিপস ও স্টেট অয়েল। পরবর্তী সময়ে কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় ব্লকগুলো ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। একই সময়ে অগভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোর জন্য ভিন্ন একটি দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এই দর প্রক্রিয়া এসএস ১১ নম্বর ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং এসএস ৪ ও এসএস ৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুটি কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া (ওআইএল) ইজারা নিয়েছিল। সান্তোস এসএস-১১ ব্লকে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপ করার পর কূপ খনন না করেই বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। ওএনজিসি দুই ব্লকে থ্রি-ডি ও টু-ডি সাইসমিক জরিপ চালানোর পর ৪ নম্বর ব্লকে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করে, কিন্তু গ্যাস মেলেনি। তারা আরও দুটি কূপ খনন করবে বলে জানা গেছে।