যিনি আবেদনকারী তিনিই বিইআরসির বিচারকের আসনে!
প্রকৌশলী মো. ফজলে আলমকে গ্যাসের বিল বাড়ানোর আবেদন যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান করায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভোক্তারা। পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির ওই কর্মকর্তা ডেপুটেশনে বিইআরসির পরিচালকের (গ্যাস) দায়িত্ব পালন করছেন।
আর তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানিসহ অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির গ্যাসের বিল বৃদ্ধির আবেদন যাচাই করার জন্য। নীতিগতভাবে বিষয়টি কতটা যৌক্তিক এমন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেছেন, তাকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে এ কথা সত্য। তবে তিনি একা নন সেখানে আরও সদস্য রয়েছে। তার একার পক্ষে কমিটিকে প্রভাবিত করার সুযোগ নেই। তাছাড়া তার রিপোর্টেই চূড়ান্ত নয়, মূল্যায়ন করবে কমিশন। এখানে পক্ষপাত করার কোনো সুযোগ থাকছে না।
মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকদের নির্ধারিত পরিমাণ গ্যাসের বিল আদায় করা হয়। গ্যাসের বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের বিল বাড়ানোর আবেদন জমা দিয়েছে বিইআরসিতে। তাদের সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই কমিটি গঠন করে দিয়েছে। এতেই ন্যায় বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভোক্তারা। তারা বলেছেন, প্রকৌশলী ফজলে আলম পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তা। সে হিসেবে এক অর্থে তিনি আবেদনকারী, আবার তাকেই বিচারক করা হয়েছে এখানে ন্যায় বিচার আশা করা কঠিন।
মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের নির্ধারিত পরিমাণ গ্যাসের বিল আদায় করা হয়। দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার ও এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার গ্যাসের দাম আদায় করা হয়। গ্রাহক ব্যবহার করুক, না করুক অথবা বেশি ব্যবহার করলেও নির্ধারিত বিলেই তাকে দিতে হয়। বিদ্যমান এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৭৬.৬৫ ঘনমিটার (১৩৭৯.৭০ টাকা), দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৮৮.৪৪ ঘনমিটার (১৫৯১.৯২) করার আবেদন করেছে বিইআরসির কাছে। আবেদনটি চলতি বছরে মে মাসে জমা হয় বিইআরসিতে। ব্যাপক বিতর্কের পর বিষয়টি অনেকটা ধামাচাপা পড়ে যায়।
তবে সম্প্রতি বিইআরসির আবার তৎপর হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করে তৎপরতা প্রসঙ্গে বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেছেন, আগে শুধু তিতাস গ্যাসের প্রস্তাব এসেছিল। আরও কয়েকটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি রয়েছে। যে কারণে পেট্রোবাংলার মতামত চাওয়া হয়েছিল। এখন পেট্রোবাংলার মতামত পাওয়া গেছে।
বিইআরসি সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশ দেয় ২০২২ সালের ৫ জুন। বিইআরসি আদেশ দেওয়ার আগে মার্চে গণশুনানি গ্রহণ করে। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার ব্যবহার করছে। প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এক চুলা ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৭৭.৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়।
বিইআরসির তৎকালীন সদস্য (গ্যাস ২০২২) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমার তো মনে হয় ৫০ ঘনমিটারের নিচে করা উচিত ছিল। প্রথমবার জন্য ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছিল। তখন শর্ত দেওয়া হয়, প্রিপেইড মিটার বসানো এবং পরবর্তীতে কমিয়ে আনার।
আপনাদের সময়ে আদেশটি হয়েছে। কিসের ভিত্তিতে এক ও দুই চলা যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, তাদের যে সাড়ে ৩ লাখ প্রিপেইড মিটার ছিল সেখানে দেখা গেছে গড়ে ৪৫ ঘনমিটারের কম ব্যবহৃত হয়েছে। প্রিপেইড মিটারের বিলের তথ্য দেখলেই বুঝতে পারা যায়। বিষয়টির জন্য রকেট সায়েন্স জানা দরকার হয় না।
জুনের ওই আদেশে আবাসিকে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের তৎকালীন দর ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা করে দেয়। সে হিসেবে নন মিটার একচুলার ৯৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি হয়ে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে ১০৮০ টাকা করা হয়।
তিতাস দাবি করেছেন, নির্ধারিত পরিমাণের (৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার) চেয়ে মিটারবিহীন গ্রাহকরা বেশি গ্যাস ব্যবহার করে। ফলে সিস্টেম লস বৃদ্ধি পেয়েছে। এক চুলা ৭৬.৬৫ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার আবেদন করা হয়েছে। বিইআরসি আগে যে আদেশ দিয়েছে তা বাস্তব সম্মত ছিল না।
তবে তিতাস গ্যাসের ওই দাবির সঙ্গে একমত নন লালমাটিয়ার বাসিন্দা ডা. মনিরুল ইসলাম। তিনি প্রিপেইড মিটারে মাসে ৫০০ টাকার গ্যাসেই শেষ করতে পারেন না। মিটার ভাড়াসহ কোনো কোনো মাসে ৪০০ টাকাতেই চলে যায়।
গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা গেলে এই সংকট থাকে না। প্রথম দিকে গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে বেশ তোড়জোড় ছিল। এখন যতটা পারা যায় বিলম্বিত করার কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। প্রথম দিকে তারা বলেছিলেন আবাসিকে অনেক বেশি গ্যাস পুড়ছে, মিটার স্থাপন করলে তাদের রাজস্ব বেড়ে যাবে। কিন্তু লালমাটিয়া (২০১৬ সালে) এলাকায় প্রথম যখন মিটার বসানো হলো তার রেজাল্ট এলো উল্টো। দেখা গেল প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারীদের বিল আসছে দেড়’শ থেকে আড়াই’শ টাকা। যাদের মিটার নেই তাদের কাছ থেকে তখন বিল আদায় করা হচ্ছিল দুই চুলা সাড়ে ৪’শ টাকা।