‘চিনি আর চিনি নাই, বিষ হয়ে গেছে’
কদিন পরেই মুসলমানদের সংযমের মাস রমজান। সারাদিন রোজা পালন শেষে ইফতারে এক গ্লাস শরবতে রোজাদারদের প্রাণ জুড়ানোর কথা থাকলেও শরবত তৈরির মূল উপকরণ সেই চিনির দাম এখন ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। এতে বাজারে চিনি কিনতে আসা সাধারণ মানুষ বলছে "চিনি এখন আর চিনি নাই, বিষ হয়ে গেছে"।
গতকাল হঠাৎ করে চিনির দাম কেজি প্রতি ২০ টাকা বাড়ানোর খবরে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুহূর্তেই চিনির কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে রাতেই আবার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।
এতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের একটা অংশ বলছে, চিনির দাম হঠাৎ বৃদ্ধি করে আবার রাতেই দাম প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আসায় তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। মূলত দাম বৃদ্ধির খবরে ব্যবসায়ীরা মিলে বেশি দামে চিনির অর্ডার (ডিও) করে ফেলেছে। এখন দাম যেহেতু আবার কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে তাই অর্ডারকৃত চিনি কম দামে বিক্রি করতে হবে।
বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি ১৪০-১৪২ টাকায়, যা কিনা গত রমজানে ছিলো ১২৫ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনি ১৫০-১৫৫ টাকা।
শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) মিরপুরের কিছু খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায় প্রকারভেদে ১৩৬-১৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সাদা চিনি।
সুলতান ট্রেডার্স এর স্বত্বাধিকারী মো. আব্দুর রহমান জানান, সাদা চিনি ১৩৬-১৩৮ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন তিনি। তবে এতে তার লস হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, এক বস্তা চিনি ৬ হাজার ৬০০ টাকায় আগে কিনলেও গতকাল বিকেলে হঠাৎ বস্তাপ্রতি ৮০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে তাকে। তারপর রাতেই আবার সেই চিনির দাম কমে যায়। এছাড়া প্রতি বস্তায় লেবার খরচ এবং মাঝেমধ্যে বস্তায় চিনি কম থাকারও অভিযোগ তার।
সেলিম জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী সেলিম জানান, ৬ হাজার ৬০০ টাকায় কয়েকদিন আগেই তিনি চিনি কিনেছেন। এতে তার প্রতিকেজি চিনি পড়েছে ১৩২ টাকা করে। তবে দাম বৃদ্ধির খবরে চিনি না পেয়ে ৬ হাজার ৮৫০ টাকায় দুই বস্তা চিনি কিনেছেন; এতে তার প্রতি কেজি চিনি ১৩৭ টাকার মতো পড়েছে। এর সাথে আবার যুক্ত হবে দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন ইত্যাদি তাতে করে ১৪০ টাকার উপরে তার খরচ। এখন যদি বেশি দামে বিক্রি করতে না পারেন তাহলে লোকসান দেওয়া ছাড়া উপায় নাই। তার অভিযোগ রমজানের সকল ধরনের পণ্যের দাম ইতিমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোলা আগে ১০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ১০৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এই ছোলাও গতবছর ছিল ৮০ টাকা, আর চিনি ছিল ১২০ টাকা।
মিরপুরের পাইকারি চিনির আড়ৎগুলো ঘুরে জানা যায়, হঠাৎ চিনির দাম বৃদ্ধি হওয়ার খবরে মিল থেকে চিনি সরবরাহের ওপর একটু নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। কিন্তু রাতে আবারও মিলগুলো অর্ডার নিচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা পড়েছেন দোটানায়। তাই অনেক ব্যবসায়ী অপেক্ষা করছেন আর অল্প-অল্প করে চিনি ছাড়ছেন।
মোমিন বাণিজ্য বিতানের ম্যানেজার তাজুল ইসলাম জানান, গতকাল বিকাল ৬টা পর্যন্ত বেশি দামে চিনি বিক্রি হয়েছে। দাম বাড়ার খবরে চিনি আরও বেশি দামে বিক্রি শুরু হয়েছিল। তবে আজকে ৬ হাজার ৮০০ থেকে ৬ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি করছি।
এছাড়াও তন্ময় ট্রেডার্স, ফারুক ট্রেডার্স, মোমিন আজকে ৬ হাজার ৭৮০ টাকা বাড়তি রেটে অর্ডার করেনি।
এদিকে, গতকাল মৌলভীবাজারে চিনির দাম বেড়েছিলে বস্তায় অন্তত ৫০-১০০ টাকা। এছাড়া অর্ডার করেও চিনি পাচ্ছেন না অনেক ব্যবসায়ী। তারা বলেন, চিনি নিয়ে আসতে গাড়ি পাঠানো হলে গাড়ি দুই তিন দিন বসে থাকে মিল গেটে। প্রতিদিন দুই হাজার করে ডেমারেজ দিতে হচ্ছে। এইটা পরবর্তীতে চিনির দামের মধ্যে ঢুকে যায়। যদি সাথে সাথে মাল পাওয়া যেত তাহলে আরও কমে চিনি পাওয়া যেত।
সামনের শবে বরাত ও রমজানের বাজারের প্রস্তুতি নিতে বাজারে এসেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসিবুর রহমান। তিনি জানান, রমজানের আগেই চিনি দাম নিয়ে ইতিমধ্যে একধরনের খেলা শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দেশে কোন ওছিলা পেলেই ব্যবসায়ীদের একটা অংশ মানুষের কথা না ভেবে শুধুমাত্র অতিরিক্ত মুনাফার লোভে হুটহাট দাম বৃদ্ধি করে দেয়। যে চিনি গতবছর ১১৫-১২০ ছিল তা এখন ১৪০-১৫৫ টাকা। চিনি এখন আর চিনি মনে হয় না, বিষ মনে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন গলার কাঁটা হয়ে গেছে। তাই সরকারের একটু সুনজর দেওয়া উচিত বাজারে, যেন সাধারণ মানুষের রমজানে কষ্ট না হয়।