মুনাফা লুটতে গ্যাজপ্রমের গম ও পটাশ সারের টোপ

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

চড়াদরে কাজ পেতে গম ও পটাশ সারকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রম। অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রলুব্ধ করতে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন পটাশ সার, ৫০ হাজার টন গম সরবরাহ করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

গ্যাজপ্রমের লোকাল এজেন্ট (বাংলাদেশ) অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ওই কর্মকর্তা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ১ জাহাজ (৩০ হাজার টন) পটাশ এবং সরকার ৩০ হাজার টন গম চাইলেও আমাদের কোম্পানি ৫০ হাজার টন গম সরবরাহ করতে যাচ্ছে। এগুলো বন্যার্তদের সহায়তা হিসেবে দেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

গত ২৯ আগস্ট সচিবালয়ে কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি। ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশকে বিনামূল্যে ৩০ হাজার মেট্রিক টন পটাশ সার দেওয়ার কথা জানানো হয় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

রাশান কোম্পানি গ্যাজপ্রম অনুদানের মাধ্যমে ড. ইউনূস সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছেন। যাতে করে বাংলাদেশে চড়াদরে কূপ খননের কাজ অব্যাহত রাখা যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরল নজির গড়েছে গ্যাজপ্রম। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকায় যে কাজ করতে পারে, একই কূপ পৌনে ৩০০ কোটি টাকায় পেতে তদবির চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি।

বিজ্ঞাপন

গ্যাজপ্রমের বাংলাদেশি এজেন্টরা দিনে দিনে দানবে পরিণত হয়েছিল। তাদের চাপে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের প্রাণ যায়-যায় অবস্থা হয়েছে। বলা চলে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা রক্ষা পেয়েছে কোম্পানিটির। বাপেক্স যে কূপ ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকায় করতে পারে সেই কূপের জন্য পৌনে ৩০০ কোটি টাকার দর প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। দরপত্র ছাড়া বিশেষ আইনে দিতে তাড়াহুড়ো ছিল চোখের পড়ার মতো।

প্রস্তাবিত ১৫টি কূপে প্রতিটিতে ২৩ মিলিয়ন ডলার হারে (১২০ টাকা) প্রায় ৪২০০ কোটি টাকায় চুক্তি করতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। ওই কাজগুলো বাপেক্স দিয়ে সর্বোচ্চ ১২০০ কোটি টাকায় করা সম্ভব। যার ভুরিভুরি নজির দেশের মধ্যেই বিদ্যমান, তারপরও চোখ বন্ধ করে ধারাবাহিকভাবে চড়াদরে কাজ দেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমনও সব নজির রয়েছে যা একইসঙ্গে ভয়ানক বলা যায়। তবুও সেই ভয়াবহ কাজ করে গেছেন তৌফিক ই-ইলাহী চৌধুরী সিন্ডিকেট। ২০১৪ সালে বাপেক্সের ৩৫৪তম বোর্ড সভায় শ্রীকাইল-৪ কূপ খননের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ৫৫৬তম বোর্ডসভায় ৬৪টি কোটি টাকার ডিপিপি (প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব) অনুমোদন করা হয়। অনুমোদিত ডিপিপি পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করে। নিয়ম হচ্ছে পেট্রোবাংলা অনুমোদন সাপেক্ষে কাজ শুরু হবে। কিন্তু পেট্রোবাংলায় ৬৪ কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন না দিয়ে ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি প্রেরণ করতে বলে। বাধ্য হয়ে একই কাজের (একই গভীরতা) জন্য ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি করা হয়। আর সেই কাজটি দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। সর্বশেষ ভোলায় ৩টি কূপ (ইলিশা, টবগী ও ভোলা নর্থ-২) খনন করে গ্যাজপ্রম। ওই কূপগুলো খননের জন্য গ্যাজপ্রম যে প্রস্তাব দেয়, কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে তার চেয়েও বেশি দরে। চড়াদরের প্রস্তাব আলোচনার মাধ্যমে কমিয়ে আনার কথা, কিন্তু ঘটেছে উল্টো।

বিভিন্ন সময়ে এভাবে কয়েকগুণ বেশিদরে ১৭টি কূপের কাজ দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। আরও ১৫টি কূপ খনন প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বাপেক্সের ভোলা গ্যাসফিল্ডের ৫টি কূপ খনন প্রকল্প। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আরেকটি মিটিং হলেই চূড়ান্ত হতো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব নিয়েই বিশেষ আইনে প্রক্রিয়াধীন থাকা প্রকল্প স্থগিত করে দিয়েছেন। আর এতেই রক্ষা পেয়েছে বিশাল অংকের ঋণের বোঝা থেকে।

একদিকে ৮০ কোটি টাকার কাজ পৌনে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়, আবার যে কূপটি আরও কয়েক বছর পরে করা উচিত, সেই কাজ এখন করায় শুধু ঋণের বোঝা বাড়ছে, কোন রিটার্ন পাচ্ছে না বাপেক্স। এভাবে অতীতেও বিপদগ্রস্ত করা হয়েছে বাপেক্সকে। আবারও তারই মহড়া চলছিল বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে।

এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন ন্যাশনাল গ্রুপের চেয়ার‌ম্যান রাশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি আব্দুস সাত্তার মিয়া (মিয়া সাত্তার)। এক সময় রাশিয়ার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আওয়ামী লীগের ওপর মহলে দহরম মহরম থাকায় যা খুশি তাই করেছেন। অনেক বিতর্ক হলেও তার অপকর্ম থেমে থাকেনি। এখন পটাশ সার ও গম দিয়ে নিজের লাইন ওপেন করতে চাইছেন। ১৫ কূপ থেকেই বাড়তি ৩ হাজার কোটি টাকা হাতাতে চান মিয়ার সাত্তার।

দ্বীপজেলা ভোলায় ৯টি কূপ রয়েছে, এগুলো থেকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। সেখানে গ্যাসের চাহিদা নেই, আবার মূল ভূখন্ডে আনার পাইপলাইন না থাকায় দৈনিক মাত্র ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।

টবগী (২০১৭ সাল), ভোলা নর্থ (২০১৮ সাল) এবং ইলিশাসহ (২০২২ সাল) ৫টি কূপ এখন বসে আছে। সেই ভোলায় দ্রুত সরবরাহ আইনে চড়াদরে ৫টি কূপ খনন প্রকল্প কার স্বার্থে গ্রহণ করছে এমন প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের স্বার্থ নয়, এই প্রকল্প রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। যখন গ্যাজপ্রমকে দিয়ে টবগী ও ভোলা নর্থ (বসে থাকা কূপ) খনন করার হয় তখনও আপত্তি উঠেছিল। তখন বলা হয়েছিল এসব কূপ এখন খনন করে কোনো লাভ নেই। তখন সংশ্লিষ্টদের এমন আপত্তি সত্ত্বেও কূপ দু’টি অস্বাভাবিক দরে খনন করা হয়। যা এখনও পড়ে রয়েছে।

খালি চোখে হয়তো অনেকে কূপ খনন করে রেডি রাখাকে সমর্থন করতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে এসব প্রকল্প থেকে কোন রিটার্ন পাচ্ছে না বাপেক্স। উল্টো অগ্রিম চড়াসুদে ঋণে বাপেক্সে বিনিয়োগ সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। ২০১৭ সালে কূপ খনন করে ৪’শ কোটি টাকার বোঝা চাপানো হয়েছে বাপেক্সের কাঁধে। বাপেক্স নিজে করলে সর্বোচ্চ ১২০ কোটি টাকায় করতে পারতো। সময় নিয়ে এখন এসে করলেও কোনো অসুবিধা হতো না।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ভোলার কূপ খননের বিষয়টি বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। নাইকোকে যেমন বিশেষ ব্যাক্তিদের লাভ-লস হিসেবে করে কাজ দেওয়া হয়েছিল, এখানে তেমনি হয়েছে। এখানে বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১০ টাকার কাজ একশ টাকায় দেওয়া হচ্ছে এমন অরাজকতার দৃষ্টান্ত বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

গ্যাজপ্রমের বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী সব সময় সাফাই গেয়ে এসেছেন। এক সভায় প্রকাশ্য বলেছেন, আন্তর্জাতিক দরের তুলনায় অনেক কম মূল্যে কাজ দেওয়া হয়েছে গ্যাজপ্রমকে।

এক সময় সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ঘনিষ্ঠ অনিরুদ্ধ রায় গ্যাজপ্রমের দেশীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। তারপর সামনে আসেন মিয়া সাত্তার। আর পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তেন আরও বেশি কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। যাদের চাপের কাছে অসহায় ছিল বাপেক্স, আবার কেউ কেউ কমিশনের লোভে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন।