‘পণ্যের জোগান বৃদ্ধি না পেলে মূল্যস্ফীতি কমবে না’

  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। এই মূল্যস্ফীতি কমাতে পণ্যের জোগান বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

খবরের কাগজ-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন তিনি। বার্তা২৪.কম এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বুকাংশ প্রকাশিত হলো:

বিজ্ঞাপন

দেশে অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাস ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। অর্থনৈতিক খাতে সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের কঠিন সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি এবং সর্বোপরি রিজার্ভের কথা চিন্তা করলে- সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের চেষ্টা চলছে। বলা বাহুল্য, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বর্তমানে যেসব সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে, সেগুলো নতুন করে তৈরি কোনো সমস্যা নয়। এগুলো অনেক দিন ধরেই বিদ্যমান ছিল এবং এখনো তা আছে। সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা না গেলে আগামীতে অবস্থা আরও জটিলতর হয়ে ওঠার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই অর্থনীতিতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য এখনই কার্যকর ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তাদের বিভিন্ন কমিশন আছে, টাস্কফোর্স আছে- আমি আশাবাদ পোষণ করি, তাদের সক্ষমতা ও দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনার ফলে অদূর ভবিষ্যতে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী বলে আপনি মনে করেন?

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বর্তমান অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত হলো, আমাদের বৈদেশিক বিনিময় হারের ক্রমাগত অবমূল্যায়ন হচ্ছে, সেটাকে স্থিতিশীল করা। এ জন্য আমাদের রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। অনেকেই আমদানি কমানোর কথা বলতে পারে। কিন্তু আমদানি কমালে আমাদের মতো দেশে, যেখানে আমদানি পণ্য বেশির ভাগই শিল্পের কাঁচামাল বা মধ্যবর্তী পণ্য- এগুলোয় আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হবে। তাহলে সরবরাহের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা হবে। কাজেই আমাদের রপ্তানি কীভাবে আমরা বাড়াতে পারি, সে জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আমাদের প্রবাসীরা যে অর্থ পাঠায় সেটা সম্প্রতি কিছুটা বেড়েছে। এই ধারা অবশ্যই যেন বজায় থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে গুরুত্ব বিবেচনা করে সঠিক সময়ে সঠিক কাজগুলো করতে সক্ষম হলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব?

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বর্তমান সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি একটি কঠিন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি স্থিতিশীল হওয়ার আগেই শুরু হয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফিড) পলিসি রেট বৃদ্ধি করাসহ নানা ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। একই সঙ্গে আরও নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও বেশ কয়েকবার মুদ্রানীতি পরিবর্তন করেছে। যদিও বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য মুদ্রানীতিও রাজস্ব নীতির সমন্বয় সাধন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মূল্য বৃদ্ধি করে পণ্যের চাহিদা হয়তো কমানো যাবে। কিন্তু পণ্যের জোগান যদি একই সঙ্গে বৃদ্ধি না পায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমবে না। ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পেলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যায়। বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন কমে যাবে। আর উৎপাদন কমে গেলে কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর সবার জন্য উপযুক্ততা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না গেলে দেশে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম কোনোভাবেই কাজে আসবে না।

নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এর পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: মূল্যস্ফীতি বাড়লে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো খুবই অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মজুরি বৃদ্ধির হার সেভাবে বাড়ছে না। মূল্যস্ফীতি আর মজুরি বৃদ্ধির এই পার্থক্যের কারণে সাধারণ মানুষ সংসারের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক পরিবার তাদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। কেউবা তুলনামূলক কম পুষ্টিসম্পন্ন খাবার গ্রহণ করছে। অধিকাংশ দরিদ্র মানুষই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। দেশের সাধারণ জনগণ প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে। উচ্চ মধ্যবিত্তের মানুষ হয়তো তাদের সঞ্চয় ভেঙে জীবনযাত্রার মানটা রক্ষা করতে পারে। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তো কোনো সঞ্চয় নেই। আমরা দেখছি, এই মানুষগুলোর জীবনমান ক্রমশই নিম্নমুখী হচ্ছে। এখানে আমাদের যা করতে হবে; সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় যেসব প্রকল্প আছে, তা যেন সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সিন্ডিকেট নিয়ে অনেক লেখালেখি হয় কিন্তু সিন্ডিকেট কোনোভাবেই ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারের করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: এখনো সিন্ডিকেট আছে এবং তা ব্যাপকভাবেই আছে। এ মন্তব্য নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। মাঝে মাঝে আমরা দেখি অপারেশন হয়। সেই অপারেশনে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেটা নিয়ে আলোচনার বিষয় থাকতে পারে। মোটামুটিভাবে সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য আমি মনে করি, বর্তমানে যে আইন আছে ‘প্রটেকশন অব কনজ্যুমার লাইফ’- সে আইনের যথাযোগ্য বাস্তবায়ন জরুরি। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে এর মাত্রা বাড়ানো যেতে পারে। সাধারণ প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপনের মান ফিরিয়ে আনতে এই শ্রেণির দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। এদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম সফল হতে হলে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে খুবই নাজুক অবস্থায় আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য জোর পদক্ষেপ চালাতে হবে। পণ্য পরিবহনকালে চাঁদাবাজি এখনো আগের মতোই চলছে। মার্কেটে মার্কেটে চাঁদাবাজি হচ্ছে। হয়তো চাঁদাবাজের বদল হয়েছে। কিন্তু চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতির জন্য রাস্তায় রাস্তায় পণ্য চলাচলকালে এসব চাঁদাবাজি অনেকটাই দায়ী। বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের এ ধরনের কারসাজি বন্ধে সরকারি বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি।

সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক খাতে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে আপনি করেন?

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বলতে আমি যা বুঝি, এখানে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আমাদের দেশে সম্প্রতি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বেশ কিছুটা কমে গেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ- প্রত্যেকেই বাংলাদেশের ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যে প্রবৃদ্ধির স্টেটমেন্ট দিয়েছে, সেটাও ৪ শতাংশের মতো। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি তো ১০ শতাংশের কাছে অনেক দিন ধরেই আছে। সম্প্রতি তা ১০ শতাংশের বেশি হয়েছে। এই বিষয়গুলো সামনে রেখে আমাদের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখন প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত অনেক কম। এক দশক ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু করণীয় আছে। প্রথমত; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো করতে হবে। দ্বিতীয়ত; অবকাঠামো, ট্রান্সপোর্টসহ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নানা রকমের সমস্যা আছে। তৃতীয়ত, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস যে সূচকে আছে, সেই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। এর মধ্যে বেশ কিছু সাব-ইন্ডিকেটরস আছে। সেগুলোর উন্নতি হওয়া দরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়।