‘তেল নিলে চাল বা লবণ একটা কিছু নিতেই হবে না হয় বেচুম না’ গৃহিণী রোমানা আক্তারকে কথাগুলো বলছিলেন এক দোকানদার। গলির ৪/৫ দোকান ঘুরে সয়াবিন তেল না পেয়ে তিনি ইব্রাহীমপুর কাঁচা বাজারে আসছেন তেল নিতে, তবে এখানে এসেও পড়েছেন বিপদে। প্রয়োজন না থাকলেও সয়াবিন তেল নিতে এখন কিনতে হচ্ছে অন্য আরেকটি বাড়তি পণ্য।
তেলের সঙ্গে লবণ বিক্রির বিষয়ে ওই বিক্রেতা বলেন, তেলে লাভ কম, এর ওপর কোম্পানি ঠিকমতো দেয় না। তেল দিলেও শর্ত থাকে চালের প্যাকেট অথবা লবণ কিছু একটা সাথে নিতেই হবে। এখন এইটা বিক্রি করে আমার কয় টাকা লাভ হবে? দুই লিটার তেলের গায়ের দাম ৩৫২ টাকা হলেও সবাই দেয় ৩৫০ টাকা। এইখানেও দুই টাকা নাই। এখন কেউ যদি অন্য কিছু কেনে তাহলেই শুধু তেল বিক্রি করি।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ও মহল্লার দোকান ঘুরেও পাওয়া গেছে একই চিত্র। এ সময় খুচরা বিক্রেতারা অভিযোগ করে বলেন, আমাদের তেল দিচ্ছে না ঠিকমতো। অর্ডার নিতে আসেও কম আবার নিয়ে গেলেও তেল দেয় না। আবার তেল দিলেও এর সঙ্গে রাখতে হচ্ছে অন্যান্য পণ্য।
দেশে তেলের চাহিদা ও উৎপাদন সক্ষমতা
দেশে প্রতিদিন ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন, প্রতি মাসে ১ লাখ ৭০ হাজার টন ও বছরে সর্বমোট ২৪ লাখ টনের মতো। তবে কিছুটা ব্যতিক্রম রমজান মাস। রমজান মাসে মানুষের খাদ্য তালিকা পরিবর্তন হওয়ায় চাহিদা বেড়ে দিগুণ হয়ে যায়। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে সরিষা ও রাইসব্রান থেকে উৎপাদন হয় প্রায় ৩ লাখ টন। চাহিদার বাকি অংশ বিশ্ব বাজার থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন, পাম ও সয়াবিন সিড আমদানি করে সরবরাহ করা হয়।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য মতে, দেশে সবচেয়ে বেশি ভোজ্যতেল উৎপাদন সক্ষমতা টিকে গ্রুপের। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন সাড়ে ৭ হাজার টন তেল পরিশোধন করতে পারে। এর পর রয়েছে সিটি গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠান দু’টির দৈনিক পরিশোধনের সক্ষমতা যথাক্রমে সাড়ে ৩ হাজার টন ও ২ হাজার ৪০০ টন। এভাবে ১২ প্রতিষ্ঠানের দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা সাড়ে ২৫ হাজার টন। বার্ষরিক হিসাবে যা দাঁড়ায় ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টনের মতো।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম
ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেলের সরবরাহ ঘাটতিতে দোষ চাপাচ্ছেন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ও ঠিক সময়ে তেল দেশে এসে না পৌঁছানোকে। তবে দেশে তেল আমদানির তথ্য ও আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের বর্তমান মূল্য বলছে ভিন্ন কথা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্যের পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলের দেয়া জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে জানুয়ারি মাসে প্রতি লিটার অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিলো ১২৫.৫৯ টাকা, যা ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে কিছুটা কমে হয়েছে ১২৫.৪৩ টাকা। অন্যদিকে পরিশোধিত পাম অয়েলের দাম গত মাসে ১৩০.৩০ টাকা থেকে কিছুটা বেড়েছে হয়েছে ১৩৩.৮৩ টাকা।
আবার এনবিআরের দেয়া তথ্য মতে গত বছরের তুলনায় এবছর বেড়েছে আমদানীও। সংস্থাটি জানায়, গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি- এই তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল দেশে ঢুকেছে ২ লাখ ৩২ হাজার টন। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৯ শতাংশ বেশি। বেড়েছে সয়াবিন বীজের আমদানিও। গত জানুয়ারিতে সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ টন। যা এক মাসে সয়াবিন বীজ আমদানিতে রেকর্ডও।
ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট দূর করে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে গত ৯ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি দুই দফা বৈঠক করেছে ট্যারিফ কমিশন। প্রথম বৈঠকে বাজারে ভোজ্যতেলের কোনো সংকট নেই বলে দাবি করেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা । বরং আগের চেয়ে এখন বাজারে সরবরাহ বেশি এমন দাবিও করেন তারা।
বৈঠকে টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতাহার তসলিম জানান, প্রতিষ্ঠানটি আগের বছরের চেয়ে বোতলজাত তেলের সরবরাহ ২৪ শতাংশ বাড়িয়েছে। গত জানুয়ারিতে ১১ হাজার ৮১০ টন তেল সরবরাহ দিয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৯ হাজার ৫০০ টন।
অন্যদিকে সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী জানান, সিটি গ্রুপ গত জানুয়ারিতে ৫০ হাজার ৭০০ টন তেল সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে ২২ হাজার ২৪২ টন বোতলজাত। গত বছরের একই সময় (জানুয়ারি ২০২৪) তারা ১৪ হাজার ২৬২ টন বোতলজাত তেল সরবরাহ করেছিল।
বাস্তবতা ভিন্ন
দেশের তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে বাড়তি তেল সরবরাহের কথা বললেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। দেশের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা কোম্পানিগুলোর কাছে চাহিদা মাফিক তেল পাচ্ছেন না। তেল সরবরাহে কোম্পানি প্রতিনিধিরা আসছেন না নিয়মিত, আসলেও অর্ডার নিয়ে গিয়ে সরবরাহ করছেন না ঠিক মত। আবার তেলের সাথে ধরিয়ে দিচ্ছেন অন্য পণ্য।
তেল সরবরাহে কতটা ভোগাচ্ছে তা জানিয়ে পূর্ব শেওরাপাড়া কাঁচা বাজারের বিক্রমপুর ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারি মাহবুব বার্তা২৪.কম কে বলেন, গত দুই মাস ধরেই তেল ঠিকমত পাই না। তিন কার্টুন অর্ডার করলে দিয়ে যায় একটা। আবার একটা তেল দিলে সাথে লবন, পোলাও চাল দিয়ে যায়। গতকাল আমার অর্ডার ছিলো ৫ লিটারের তেল ২ কার্টুন, ২ লিটার এক কার্টুন, আমাকে দুইটা এক কার্টুন করে দিয়ে সাথে হাফ কেজি ও এক কেজির দুই বস্তা লবণ ও ১২ টা চাল দিয়ে গেছে।
তবে বাজারের ব্যবসায়ীদের মত অতটা ভাগ্য প্রসন্ন না মহল্লার ভিতরের ব্যবসায়ীদের। তাদের কাছে এখন কোম্পানির লোকেরা আসেই না। এনিয়ে ইব্রাহীমপুরের মা জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা সাজিদ বার্তা২৪.কম কে বলেন, গত দুই মাস হইছে কোম্পানির লোকদের দেখি না। মেইন সড়ক দিয়ে আসে, বাজারে বাজারে দিয়ে ঐদিক দিয়েই চলে যায়। তাই ঝামেলা করে তেল রাখি না, বিক্রিও করতে পারি না।
একই চিত্র দেখা গেছে কাওরান বাজার ও ইস্কাটন এলাকার মুদির দোকানগুলোতেও। কাওরান বাজারে ম্যাজিস্ট্রেট এসে খুচরা ব্যবসায়ীদের তদারকি করায় কিছুটা বিরক্তও দেখা যায় তাদের। অনেকেই দোকানে তেল বিক্রিও রেখেছেন বন্ধ করে। ব্যবসায়ীরা জানান, আমরা কোম্পানি থেকে যেভাবে পাই, সেভাবে বিক্রি করি। সরকার কোম্পানিগুলোকে ধরুক। তাহলেই ত সব ঠিক হয়ে যায়। সেটা না করে ম্যাজিস্ট্রেট এসে আমাদের ধরে।
দুই সংস্থার পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে কৃত্রিম সংকটের কথা
তেলের দাম বেশি রাখা, সরবরাহে কারসাজির প্রমাণ পেয়েছে সরকারি দুই সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তাদের ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি পরিদর্শন দল পরিদর্শন শেষে এই তথ্য জানিয়েছে।
গত ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, নয়াবাজার, মৌলভীবাজার ও কারওয়ান বাজারে চারটি পরিদর্শন দল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এতে দেখা গেছে, জিনজিরা বাজারে জাকির জেনারেল স্টোর তীর ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটারের বোতলের দর ৮৫২ টাকা মুছে বিক্রি করছে ৯০০ টাকায়, দুই লিটার বোতলের দর ৩৫০ টাকা মুছে ৪০০ টাকায় বেচা হচ্ছে। খোলা তেলের লিটারও কেনাবেচা হচ্ছে বেশি দরে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। চারটি বাজারেই এমন চিত্র পেয়েছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসছে রমজানে বাজারে ভোজ্যতেলের বাড়তি চাহিদা ঘিরে পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহে সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
প্রায় একই ধরনের তথ্য মিলেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনেও। ভোজ্যতেলের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে করা একটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমে যাওয়া পুরোপুরি অস্বাভাবিক। কোথাও না কোথাও তেলের মজুতের ব্যাপারে তথ্যের ঘাটতি কিংবা অতি মুনাফার প্রবণতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের আন্তর্জাতিক দর এখন নিম্নমুখী। আমদানি ও এলসি খোলার চাহিদাও আগের চেয়ে বেশি। স্থানীয় উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার তিন গুণ। দাম ও সরবরাহ স্থিতিশীল করতে শুল্ক ও করে রেয়াত দেওয়া হয়েছে। নিত্যপণ্য হিসেবে কমানো হয়েছে এলসি মার্জিন। ফলে সরবরাহ কমে যাওয়ার পেছনে অসাধুতা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বার্তা২৪.কম কে বলেন, এখন যেটা চলতেছে এটা হচ্ছে দোষারোপের রাজনীতি। এর মধ্য দিয়ে রিফাইনার ও ডিস্ট্রিবিউটর দুজনেই লাভবান হবে। রিফাইনার বলতেছে সরবরাহ করতেছে, ডিস্ট্রিবিউটর বলতেছে পাচ্ছে না, এখন পাচ্ছে না যে বলছে, কেন পাচ্ছে না? এটা ত রিফাইনারগুলো দেখবে। তারা সেটা না দেখে একে অপরের বিরুদ্ধে দোষ দিয়ে সব সময়ের মতই লাভবান হবার চিন্তা করছে।
সরকার এখানে নিরব ভূমিকা পালন করতেছে মন্তব্য করে এস এম নাজের হোসাইন বলেন, সরকারেরও এটা দেখা উচিত, এখন সরকার আছে নিরব ভূমিকায়। ডিস্ট্রিবিউটর না পাইলে সরকার দেখবে না? এখন তারা বলছে ১-২ সপ্তাহ ঠিক হয়ে যাবে, এটা ত ঠিক হবেই। তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হলে ত ঠিক হবেই।