প্রতিদিনই কমছে গ্যাসের উৎপাদন, চিন্তায় পেট্রোবাংলা

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতিদিনই কমছে গ্যাসের উৎপাদন, চিন্তায় পেট্রোবাংলা, ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদিনই কমছে গ্যাসের উৎপাদন, চিন্তায় পেট্রোবাংলা, ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদিনই কমছে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন, জানুয়ারি মাসে উৎপাদন কমেছে ১৯ মিলিয়ন ঘনফুট। ১ জানুয়ারি মোট উৎপাদন ছিল ১৯২৯ মিলিয়ন ঘনফুট, ৩০ জানুয়ারিতে ১৯১১ মিলিয়নে নেমে গেছে। যা গত ১ নভেম্বর ছিল ১৯৬৮ মিলিয়নে।

২০২০ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি ৭০৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করেছিল, আর ২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারি কোম্পানিটির উৎপাদন নেমে এসেছে ৪৯৯ মিলিয়নে। একই সময়ে বহুজাতিক কোম্পানির অধীনে থাকা ৪ গ্যাস ফিল্ড থেকে সরবরাহ পাওয়া যায় ১৬৫৬ মিলিয়ন, যা ৩০ জানুয়ারি ১১৬১ মিলিয়নে নেমে এসেছে। অন্যদিকে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা। এতে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে থাকা বিশাল ব্যবধান আরও বেড়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

উৎপাদন হ্রাসের এই প্রবণতা পাশাপাশি বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় উৎস বিবিয়ানার মজুদ কমে আসায় যে কোনো দিন বড় ঘাটতির মুখে পড়তে পারে। কারণ বাঙ্গুরাসহ অনেক নজির রয়েছে মজুদ কমে আসায় হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যাওয়া। দৈনিক ১৯১১ মিলিয়ন উৎপাদনের দিনে বিবিয়ান গ্যাস ফিল্ড থেকে এসেছে ৯৭২ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০২৬ সাল নাগাদ গ্যাসক্ষেত্রটির মজুদ শেষ হয়ে যেতে পারে। শঙ্কা সত্যি হলে দেশীয় উৎসের গ্যাসের ১ হাজার মিলিয়ন কমে যাবে।

বিবিয়ানার মজুদ বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেই খোলাসা করে কোনো তথ্য দেওয়া হয় না। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২২-২৩) অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুলাইয়ে অবশিষ্ট মজুদ দেখানো হয় ১৩৪ বিসিএফ। এরপর বলা হয়েছিল বিবিয়ানার মজুদ ১ টিসিএফ বাড়তে পারে। এরপর ১৯ মাস (৫৭৭ দিন) কেটে গেছে। দৈনিক গড়ে ১ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করছে সে হিসেবে অবশিষ্ট মজুদ সাড়ে ৫’শ এর নিচে নেমে এসেছে। সরল অংকে সাড়ে ৫’শ দিন চলার কথা। কিন্তু গ্যাসের ক্ষেত্রে তা কখনই সম্ভব হয় না, হঠাৎ করে পানি ও বালি এসে বন্ধ হতে পারে উৎপাদন।

বিজ্ঞাপন

ঘাটতি পূরণে যে ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার তাতে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। পেট্রোবাংলার অপর্যাপ্ত প্রস্তুতির সঙ্গে ডিপিপি অনুমোদনে মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা বিভাগের দীর্ঘসূত্রিতা তড়িৎ পদক্ষেপে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করছে। এখন আর ডিপিপি প্রণয়ন করে কাজ করার মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে নেই। একটি কূপের ডিপিপি অনুমোদন করতে গেলে কমপক্ষে ২ বছর সময় প্রয়োজন। এখন পানি থুতনি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যে কোনো সময় নাক তলিয়ে যেতে পারে। এখন আর সেই সময় পাওয়া যাবে না।

বিকল্প হিসেবে কোম্পানিগুলোর বোর্ডে অনুমোদন দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে কিছু ছোট ছোট উদ্যোগের সুপারিশ করেছেন অনেকেই। তারা বলেছেন রশিদপুর-৭, কৈলাশটিলা-৭ এর মতো কিছু কূপ রয়েছে যেগুলোর সামান্য সংস্কারে (ওয়ার্কওভার) কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

রশিদপুর-৭ কূপের নিচের জোন থেকে মাত্র ৫ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। কূপটির মধ্যম স্তরে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুদ রয়েছে। কূপটি ওয়ার্কওভার করে মধ্যম স্তর (২৭০০ মিটার) থেকে দৈনিক ১৫ মিলিয়নের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। অন্যদিকে কৈলাশটিলা-৭ কূপ বন্ধ রয়েছে বছর খানেক সময় ধরে। ওই কূপটির নিচের স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে, মজুদ রয়েছে ওপরের স্তরে। ওপরের স্তর থেকে গ্যাস তুলতে গেলে ওয়ার্কওভার করতে হবে। কূপ দুটির ওয়ার্কওভারের জন্য ডিপিপি না করে নিজস্ব অর্থায়নে ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব। এ জন্য যে অর্থায়ন প্রয়োজন পড়বে সেটি সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি নিজেরাই করতে সক্ষম। এ জন্য তাদের বোর্ডে অনুমোদন সাপেক্ষে তড়িৎ পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন জ্বালানি বিশেজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এমন আরও অনেক পকেট রয়েছে। যেগুলোতে হাত দিলে উৎপাদন বাড়ানো যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্লামবার্জার। ২০১১ সালে দাখিলকৃত রিপোর্টে বলা হয় বিদ্যমান গ্যাস ফিল্ডগুলোর সংস্কার করে ৪০০ থেকে ৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এতে খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ ১২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। একযুগ পর সেই রিপোর্ট নিয়ে কিছু কাজ শুরু করে পেট্রোবাংলা। এই কাজগুলো করতে পারলে এখন এই ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা।

আজকের এই গ্যাস সংকটকে বিগত সরকারগুলোর অদূরদর্শিতার ফসল। দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে যথাযথ মনোযোগ না থাকায় আজকের এই পরিস্থিতি। শেখ মুজিবুর রহমান সরকার ছাড়া আর কোনো সরকারেই এই খাতে যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল ই এলাহী চৌধুরী।

খাদের কিনারে দেশের গ্যাস সেক্টর, সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, বিশেষ করে ২০২৬ সাল নাগাদ মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা দেখছেন অনেকেই। এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে সামাল দেওয়াকে বিপদজনক বিকল্প হিসেবে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। আকাশচুম্বি দাম যেমন বাধা, তেমনি চাইলেই ইচ্ছামতো আমদানির পরিমাণ বাড়ানো সুযোগ নেই। দুটি এফএসআরইউ দিয়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ৯০০ মিলিয়ন আমদানি করা সম্ভব। নতুন এফএসআরইউ করতে গেলে দরপত্র চূড়ান্ত করার পর কমপক্ষে ১৮ মাস লাগবে। অর্থাৎ ২০২৬ সাল পর্যন্ত এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোন পথ খোলা নেই, দামের ইস্যু বাদ দিলেও।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, দেশে উৎপাদিত গ্যাসের গড় দর পড়ছে ৬.০৭ টাকার মতো। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক-চতুর্থাংশ গ্যাস আমদানি করায় গড় মূল্য ২৪.৩৮ টাকায় পৌঁছে গেছে। যখন এক-তৃতীয়াংশ আমদানি করতে ত্রাহী অবস্থা, সেই সময়ে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর মজুদ ফুরিয়ে আসছে, এতে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে উৎপাদন।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড ইজাজ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমাদের দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর মজুদ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আমরা যদি বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট ধরে রাখতে চাই তাহলে বছরে কমপক্ষে ১০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে হবে। এলএনজি আমদানি সমর্থন করি, তবে এটা সীমিত রাখতে হবে। আমরা যদি নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জ্বালানি সরবরাহ দিতে চাই তাহলে এ খাতে আমদানি ব্যয় দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলারে। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই জটিল।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল ই এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, খুব দ্রুততার সঙ্গে নতুন কূপ খনন করা, পুরাতন কূপগুলো সংস্কার করে উৎপাদন বাড়ানো এবং বিবিয়ানা কূপ থেকে ৭০ মিলিয়ন পর্যন্ত উৎপাদন করছে, বেশি রিজার্ভ থাকার পর রশিদপুর ও তিতাস গ্যাস ফিল্ডের কূপ দিয়ে অনেক কম (১০ থেকে ২৫ মিলিয়ন) সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানেও মনোযোগ দেওয়া দরকার।

তিনি বলেন, দৈনিক ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে এরমধ্যে প্রায় ১০ শতাংশের মতো সিস্টেম লস হচ্ছে, অর্থাৎ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে। যদিও কিছু কারিগরি লোকসান থাকা স্বাভাবিক তবে ১০ শতাংশ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সিস্টেম লস বিবেচ্য হতে পারে।

ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বহুকাল থেকে বিবিয়ানার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ২০২৬ সালে গিয়ে এর উৎপাদনে ধস নামতে পারে। কিন্তু সেই সতর্কবার্তা আমলে নেওয়া হয়নি। জরুরি ভিত্তিতে কতগুলো কাজ করা দরকার ছিল সেগুলো করা হয় নি। ছাতকে ১ টিসিএফ গ্যাস রয়েছে সেখান থেকে গ্যাস আনা দরকার।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, সম্ভাবনাময় কূপ রশিদপুর-৭, কৈলাশটিলা-৭ এবং সিলেট-৯ এর কাজ শুরু করেছি। দীর্ঘসূত্রিতা এড়াতে ডিপিপি না করে কোম্পানির অর্থায়নে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে কৈলাশটিলা-৭ এর উদ্দেশে রিগ রওয়ানা করেছে। আমরা আশা করছি প্রত্যেকটি কূপ থেকে কমপক্ষে ১০ মিলিয়নের বেশি গ্যাস যোগ হবে।