অদক্ষ ক্যাপটিভে গিলে খাচ্ছে মূল্যবান গ্যাস, বেকার পড়ে থাকছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিয়ে ক্যাপটিভে কমবেশি ৪ মেগাওয়াট (৪ হাজার ইউনিট) বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, একই পরিমাণ গ্যাসে কম্পাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম।
অর্থাৎ একই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে দেড়গুণ বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। তবুও বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে ক্যাপটিভে (নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন) চলে যাচ্ছে চড়া দামে আমদানি করা গ্যাস। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে মোট ৯ হাজার ৭২৪ মিলিয়ন ঘনমিটার, আর একই সময়ে ক্যাপটিভে ৫ হাজার ৩১০ মিলিয়ন ঘনমিটার।
ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা এবং গ্যাসের চাহিদা নিয়ে বরাবরেই লুকোচুরি করা হয়। পেট্রোবাংলার গ্যাসের উৎপাদন বিবরণীতে বলা হয়েছে, ৭ নভেম্বর (২০২৪) বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৮৯১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে,আর ক্যাপটিভে মাত্র ১০২ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ নয় ভাগের একভাগ।
পেট্রোবাংলার উৎপাদন বিবরণী বরাবরে এমন রিপোর্ট দিলেও গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে থাকা ৬টি কোম্পানির বার্ষিক রিপোর্ট বলছে ভিন্ন কথা। সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাসের ২০২২-২৩ অর্থবছরের রিপোর্টে গ্যাস বিক্রির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ওই বছর কোম্পানিটি ৩ হাজার ২৮৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস দিয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। আর ক্যাপটিভে সরবরাহ দিয়েছে ৪ হাজার ৩৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানি কর্নফূলীর রিপোর্টও বলছে ক্যাপটিভে বেশি সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৭২ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস ক্যাপটিভে আর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দেওয়া হয়েছে ৫২২ মিলিয়ন। তবে জালালাবাদ ও বাখরাবাদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বেশি গ্যাস সরবরাহ দিয়েছে। ৬টি কোম্পানির দৈনিক গড় সাড়ে ২৬ মিলিয়ন (বিদ্যুৎ কেন্দ্র) ও সাড়ে ১৪ মিলিয়ন ঘনিমটার (ক্যাপটিভ)। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছে ক্যাপটিভে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সূত্র বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছে, জুন ২০২৪ পর্যন্ত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৬ হাজার ৮৫ মেগাওয়াট দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে গ্যাস ভিত্তিক রয়েছে ৩ হাজার ৪৬০ মেগাওয়াট। আর ডিজেল ভিত্তিক রয়েছে ২ হাজার ৬২৫ মেগাওয়াট। বিইআরসি বলছে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের হার ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৭টি, ২১-২২ অর্থবছরে ১২৫টি, ২২-২৩ অর্থবছরে ১৫৯টি সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩১০টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ৭ নভেম্বর ২০২৪ এর রিপোর্ট বলছে ওইদিন দেশের ৫৯টি গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৯টি পুরোমাত্রায় গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে। ৩৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ ছিল, আর বাকিগুলো কোনটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও কোনটি আংশিক উৎপাদন করেছে গ্যাস ঘাটতির কারণে।
পেট্রোবাংলার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৭ নভেম্বর ৮৯১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ওই দিন গ্যাসের চাহিদা ছিল ২ হাজার ৪৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের এই সংকট আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠার শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। প্রতি ঘনমিটার গ্যাস দেশীয় ফিল্ড থেকে পাওয়া যাচ্ছে ১ টাকা দরে। একই পরিমাণ গ্যাস আমদানি করতে ৭১ টাকার মতো ব্যয় হচ্ছে। দাম যখন চড়া তেমনি অবকাঠামো না থাকায় ২ বছরের মধ্যে আমদানি বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই।
গ্যাসের এই সংকট মোকাবিলায় ক্যাপটিভের (৩৪৬০ মেগাওয়াট) গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা গেলে প্রায় ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বেশি পাওয়া সুযোগ রয়েছে।
ক্যাপটিভ প্রশ্নে শিল্প মালিকদের বক্তব্য হচ্ছে তারা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না, তাই বাড়তি বিনিয়োগ করে ক্যাপটিভ বসাতে হচ্ছে। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য লোডশেডিং হলেও বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যায়। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেলে কেউই ক্যাপটিভে যাবে না। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বক্তব্য হচ্ছে ব্যবসায়ীরা আংশিক সত্য বলছেন। ২০১২ সালে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের গ্যারান্টি দিয়ে কিউ শ্রেণি চালু করা হয়েছিল। বিশেষ লাইন দিয়ে তাদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় একজন উদ্যোক্তাও আবেদন নিয়ে আসেননি।
বিইআরসিতে দাখিল করা পিডিবির এক চিঠিতে বলা হয়, ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে বিতরণ কোম্পানির অবহেলার শিকার হচ্ছে দক্ষ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অন্যদিকে কোম্পানিগুলো ক্যাপটিভে গ্যাস দিলে বেশি দাম পান, তাই সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবর্তে ক্যাপটিভে দিতে তাদের আগ্রহ বেশি।
গ্যাসের অভাবে যখন অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ, তখন দেদারছে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন বিস্ময় রয়ে গেছে। ১০ মেগাওয়াটের বেশি ক্যাপটিভ গ্যাস সংযোগ দিতে বিদ্যুৎ বিভাগের পুর্বানুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই বাধ্যবাধকতা এড়াতে ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়ায় অবস্থিত এনআর গ্রুপকে ভিন্ন তিনটি গ্রাহক সংকেত দিয়ে ২৪.৯২ মেগাওয়াট ক্যাপটিভ দেওয়া হয়েছে বিগত সরকারের সময়ে। এভাবে নিয়ম বর্হিভূত ভাবে অনেকেই সংযোগ পেয়েছেন।
ক্যাপটিভ সংযোগের ক্ষেত্রে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশনএন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (টিজিটিডিসিএল) ও কর্ণফূলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) ভূমিকা বেশি সমালোচিত। কঠোরভাবে বিধি নিষেধ আরোপ করা থাকলেও শত শত ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দিয়েছে কোম্পানি দু’টি। কখনও বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে, কখনও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই। দীর্ঘদিন ধরেই কোম্পানি দু’টির বোর্ড চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিবগণ। যে কারণে অন্যরামুখ খোলার সাহস দেখাননি।
ক্যাপটিভে গ্যাসের অপচয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকায় ঘাটতি বাড়ছে বিপিডিবির। বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলুক আর না চলুক মাসে প্রায় ১৮’শ কোটি টাকার মতো ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। উৎপাদন ক্ষমতা যত বৃদ্ধি পাবে ক্যাপাসিটি চার্জের অংক সমানতালে বড় হবে। এতে করে বিদ্যুৎ খাত সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিপিডিবি ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪০ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে এখন বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধির একটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে শিল্প। শিল্পায়ন হচ্ছেও, কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিদ্যুতের চাহিদায় তারতম্য দেখা যাচ্ছে না। শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার আশানুরূপ না হওয়ায় অনেকদিন ধরেই শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে গণহারে ক্যাপটিভ বসানো। একে রোধ করা না গেলে সমুহ বিপদের শঙ্কা দেখছেন অনেকেই।
ইন্সটিটিউট ফর এনার্জি ইকনোমিক ফাইন্যান্সিয়াল এনালাইসিস এর লিড এনালিস্ট শফিকুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ক্যাপটিভের চেয়ে কম্পাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এনার্জি সাশ্রয়ী। একই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। শুধু ক্যাপটিভ নয়, অনেক ক্ষেত্রে বয়লারে গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। এরচেয়ে বৈদ্যুতিক বয়লার অনেক এনার্জি সাশ্রয়ী। ধীরে ধীরে ক্যাপটিভ থেকে বের হয়ে আসার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত।