ব্যাংকে কর্মীদের বেতন কমবে, মুনাফা কম নিবেন না মালিকরা!
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেড় বছরের জন্য ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতনধারী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কমানোর সুপারিশ করেছে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)।
কর্মী ছাটাই না করে ব্যাংক সচল রাখার জন্য নেওয়া এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে চলতি বছরের ১ জুলাই হতে বহাল থাকবে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ে কোনো কর্মীকে পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট ও ইনসেন্টিভ বোনাস দেওয়া হবে না।
এবিষয়ে বিএবির সেক্রেটারি জেনারেল স্বাক্ষরিত এক চিঠি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়াম্যানদের কাছে পাঠানো হয়েছে ১৪ জুন। কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোর পাশাপাশি পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট, ইনসেন্টিভ বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হলেও মালিকরা এই পরিস্থিতিতে কি কি ছাড় দিবেন এই সময়ে তা নিদিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এই সময়ে তারা লভ্যাংশ কম নিবেন কি-না তা বলা হয়নি।
ফলে মালিকদের একমুখী সিদ্ধান্তের কারণে অধিকাংশ ব্যাংকারের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকাররা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে ব্যাংকের অনেক ক্ষতি হবে। ব্যাংকারদের দাবী সব ব্যাংক বেতন ভাতা কমানোর পক্ষে নয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলার সব দায় শুধু ব্যাংকারদের নাকি মালিকদেরও কোনো দায় আছে। কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানো হলে মালিকদেরও উচিত দুই বছর লভ্যাংশ না নেওয়া। এতে ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য মজবুত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ব্যাংকের মুনাফার জন্য শুধু কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানো হচ্ছে কেন। মালিকরা এই পরিস্থিতিতে কি কি ছাড় দিবেন। বছর শেষে লভ্যাংশ নিবেন কি-না সেটাও কর্মীদের জানানো উচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, বেতন ভাতা কমানোর ফলে কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হলে কাজে বিঘ্ন ঘটবে। গ্রাহক মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। বেতন-ভাতা কমানোর আগে পরিচালনা পর্ষদকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার আহবান জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোর পরামর্শ দেওয়া হলেও বিএবির চিঠিতে মালিকদের ছাড় দেওয়ার কোনো নির্দেশনা না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, এ পরিস্থিতিতে কী করা যায় তার একটা সম্ভাব্য উপায় খুঁজে বের করতে বেসসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা একসঙ্গে বসে ইনফর্মাল আলোচনা করেছি।
শুধু কর্মীদের বেতন কমানো হবে, মালিকরা লভ্যাংশ কম নিবেন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, প্রত্যেকটি ব্যাংক কিভাবে চলবে সেটা তাদের নিজস্ব নীতিমালায় রয়েছে। সব ব্যাংকের বেতন-ভাতা ও বিনিয়োগের ধরণও ভিন্ন। সুতরাং ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলবে। বিএবি কোন হস্তক্ষেপ করবে না।
বিএবির ওই চিঠিতে বলা হয়, চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব গ্রেডের যেসব কর্মকর্তা ও নির্বাহীর মাসিক গ্রস বেতন ৪০ হাজার টাকার বেশি তাদের সবার ১৫ শতাংশ কমাতে হবে। আগামী দেড় বছর পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট ও ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যাবে না। ব্যাংকের চলমান নিয়োগসহ সব নিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। নতুন শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং এখন থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা এবং টেলিভিশনে সব ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখতে হবে। সব ধরনের স্থায়ী সম্পদ কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে।
চিঠিতে আরও লেখা হয়, সব বিদেশি ট্যুর বন্ধ রাখতে হবে। সব ধরনের সিএসআর, ডোনেশন, চ্যারিটি বন্ধ রাখতে হবে। সব গ্রাহক 'গেট টু গেদার' বন্ধ রাখতে হবে। অফিসার ও এক্সিকিউটিভ 'গেট টু গেদার' ও ম্যানেজার কনফারেন্স বন্ধ থাকবে। প্রয়োজনে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে করতে হবে। বড় ধরনের ব্যয় যেমন আইটি রিলেটেড, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার কেনা আপাতত সীমিত পর্যায়ে রাখা। অন্য সব ব্যয় সীমিত পর্যায়ে রাখতে হবে। কর্মী ছাঁটাই না করে ব্যাংক সচল রাখার জন্য এসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে বিএবিএর ঘোষণার আগেই ১১ জুন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন ব্যাংকটির ৫৫ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ডেকে নিয়ে ১৬ শতাংশ বেতন কমানোর ঘোষণা দেন। ১৬ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ বেতন ও ৬ শতাংশ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা কমানো হবে। জুন থেকেই কার্যকর হবে। বহাল থাকবে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
১৪ জুন বিএবি চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংকের কর্মীদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন হয়েছে। বেতন ভাতা কমিয়েছে এবি ব্যাংকও।
এবিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিএবি এধরণের চিঠি দিতে পারে কি-না সেই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের খোঁজ নেওয়া উচিত। তবে শুধু কর্মীদের বেতন-ভাতা কমালে সমস্যার সমাধান হবে না। ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ-আদায় কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ করতে হবে। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের জবাবদিহিতা আরও নিশ্চিত করতে হবে।