নির্বাচনী আয়োজন আছে, উৎসব নেই

  • কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নির্বাচনী আয়োজন আছে, উৎসব নেই

নির্বাচনী আয়োজন আছে, উৎসব নেই

গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের পথে পা রেখেছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের ভোটগ্রহণের কথা রয়েছে। তফসিল বলছে, আগামী ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। এরপর মনোনয়ন বাছাই, আপিল, প্রত্যাহার, প্রতীক বরাদ্দসহ সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা, চলবে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। এটা নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিলের সারসংক্ষেপ।

প্রতিবারের মতো এবারের নির্বাচনের পদ্ধতিও ব্যালট পেপার। তবে এই ব্যালট পেপারে নির্বাচনের পাশাপাশি অথবা বাইরে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে নানা সময়ে আগের নির্বাচন কমিশনের তৎপরতা আমরা দেখেছিলাম। ইভিএম নামের ওই পদ্ধতি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিপুল আগ্রহও ছিল, কিন্তু বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি। বেশিরভাগ দলের আপত্তি এবং মেশিনে ভোটগ্রহণ নিয়ে দেশের মধ্যকার নানামুখী আলোচনা ও অধিকাংশের অনীহাকে গুরুত্ব দিয়েছে। শুরুতেই বলে দিয়েছে, ভোটগ্রহণের একমাত্র পদ্ধতি ব্যালট পেপার। ইসির এই সিদ্ধান্ত তাদের প্রতি সকল রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনের একটা উদ্যোগ হলেও শুভ এই উদ্যোগ খুব বেশি আলোচিত হয়নি। বরং সকল আলোচনায় এখন নির্বাচনকালীন সরকার।

বিজ্ঞাপন

সংবিধানে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। ইউরোপ-আমেরিকার মতো বাংলাদেশেও দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে আগামী সংসদ নির্বাচন। দলীয় সরকার নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণ টানছি যদিও তবে ওই দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের নির্বাচনের সময়ে ইসি তেমন শক্তিশালী কিনা এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে তুলনার যোগ্য হয়ে ওঠতে পারেনি। তবে এখনই হয়নি বলে কোনোদিনও যে হবে না, এমন সংশয়বাদী হওয়ার মধ্যেও যুক্তি নেই। বরং সমূহ প্রতিকূলতা অতিক্রম শেষে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অনুকরণযোগ্য একটা পর্যায়ে যাবে বলেও প্রত্যাশা রাখা যেতে পারে।

নির্বাচন কমিশন যে তফসিল ঘোষণা করেছে সেটা তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের প্রধান ও একমাত্র দায়িত্ব নির্বাচন অনুষ্ঠানের। যতক্ষণ সংবিধান বলবত থাকবে, ততক্ষণ এই কাজের বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাদের নেই। যথাসময়ে নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হলে তারা সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করে ফেলত। ঘোষিত তফসিল তাদের সেই দায়িত্বেরই অংশ। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে চলমান বিরোধে তারা কোনো পক্ষ নয়। এখানে তারা যেমন কাউকে কিছুতে বাধ্য করতে পারে না, তেমনি পারে না কাউকে কিছু থেকে বিরত রাখতে। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো কিনা, নির্বাচনে সকল প্রার্থীদের জন্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হলো কিনা, দিনের ভোট রাতে দেওয়া হয়ে যাচ্ছে কিনা এসবসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল কিছুতে তারা ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু কাউকে নির্বাচনে নিয়ে আসা, কাউকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার মতো পরিস্থিতির জন্ম তাদের কাজ নয়। এগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা ইসির এখতিয়ারের বাইরে।

বিজ্ঞাপন

তফসিল ঘোষণার পর অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে দায় দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন। তাদের বেশিরভাগেরই দাবি (দাবি নয় অভিমান বলাই সংগত), বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন তফসিল ঘোষণা নির্বাচন কমিশনের উচিত হয়নি। এ দলে আছেন রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এমনকি কিছু সাংবাদিকও। অভিমানী মন্তব্যের সারসংক্ষেপ যদি তোলে আনি তবে দেখা যায়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যখন দেশে রাজনৈতিক বিরোধিতা রয়েছে তখন একতরফা এভাবে তফসিল ঘোষণা উচিত হয়নি! তাহলে কি করত নির্বাচন কমিশন? নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করে অনন্তকাল অপেক্ষা করে থাকত? তফসিল ও নির্বাচনের মধ্যকার যে সময়সীমা রেখেছে সেটাও বেশি কিছুদিনের। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই সময়ের মধ্যেও সমাধান সম্ভব।

নির্বাচন ও রাজনীতির ‘প্রাথমিক জ্ঞান’  থাকা সকলেরই জানা, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের বিধান রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব যথাসময়ে নির্বাচন। একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি। এই হিসেবে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গেছে এই নভেম্বরের এক তারিখ থেকেই। উক্ত ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে ভোটগ্রহণ করতেই হবে, এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ভোটগ্রহণ, কিন্তু তাদের দায়িত্ব সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নয়, নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নাকি দলীয় সরকারের অধীনে হবে এটা তাদের এখতিয়ারের বাইরে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে তারা কোন ভূমিকা রাখতে পারে না, এমনকি কোন মন্তব্যও করতে পারে না। তবু নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগে সকল দলের সঙ্গে আলোচনার জন্যে চিঠিও দিয়েছিল, কিন্তু বিএনপিসহ বেশ কিছু দল সে চিঠিতে সাড়া দেয়নি। যদিও এখানে প্রশ্ন আছে বিএনপি কি চাইলেই পারত ইসির চিঠিতে সাড়া দিয়ে সংলাপে যেতে? কারণ দলটি শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই কারাগারে, এবং দলটির উল্লেখের মতো জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ ছাড়া বাকি সকলেই গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে। রাজনৈতিক এই বিষয়টি ভিন্ন আলোচনা, তবে তফসিল নিয়ে ইসির দায় এখানে যারা দিচ্ছেন তারা ইসির কার্যবিধি-পরিধি না জেনে কিংবা জেনেও না জানার অভিনয়ে বিভ্রান্ত করতে দিচ্ছেন।

তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই ভোটগ্রহণের প্রস্তুতিতে আছে নির্বাচন কমিশন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ শুরু করে দিয়েছে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি। আওয়ামী লীগের জোটের দলগুলো এবং নতুন নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যেও আছে প্রস্তুতি। জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকলেও তারাও প্রায় নির্বাচনমুখী। এরবাইরে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বাকি যে দলগুলো বিশেষত ইসিতে নিবন্ধিত দলগুলো তাদের মধ্যে এখনো প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। দলের প্রতীক বরাদ্দ কার চিঠিতে হবে, এমন এক চিঠিও ইতোমধ্যে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগ ও এর সমমনা দল ও জোটগুলো এর উত্তর দিয়েছে। ইসির সংলাপের আগের চিঠির মতো এখানেও অনুপস্থিত বিএনপির উত্তর। বাস্তবতা বলছে, চিঠির উত্তর দেওয়ার মতো নেতা এই মুহূর্তে বিএনপিতে নেই। বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া দণ্ডিত হওয়ার পর রাজনীতি থেকে দূরে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগারে; ফলে বিএনপি অনেকটাই স্থবির রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, নিষ্ক্রিয় মাঠের কর্মসূচিতে।

নির্বাচন বাংলাদেশের একটা অন্যতম উৎসব ছিল। রাজনৈতিক বিরোধিতা, অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও মানুষ মুখিয়ে থাকত নির্বাচনের জন্যে। নির্বাচনের এই জাঁকজমকপূর্ণ রূপ হারিয়ে গেছে প্রায়। সবশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর। এরপর ক্রমে নির্বাচনের আমেজ হারিয়ে গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচন হয়নি, ২০১৮ সালের নির্বাচনে মানুষের অংশগ্রহণ নিয়েও প্রশ্ন আছে। এছাড়া বিগত উপনির্বাচনগুলোতে ভোটে যায়নি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ।

আগামী নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক ও সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হয় তবে ফের আশাহত হবে মানুষ। ফের মানুষ আগ্রহ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে না। ফলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের যে নির্বাচন সেখানে আয়োজন সম্পন্ন হবে হয়তো কিন্তু উৎসব থাকবে না। নির্বাচন হবে পড়বে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পন্নে ‘রাষ্ট্রীয় অপচয়ের আয়োজন’।