মোরগ যখন বিজ্ঞাপনের প্রতীকী চিহ্ন!

  • জুবায়ের ইবনে কামাল, অতিথি লেখক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ধর্ষণ বিরোধী সচেতনতার বার্তা সমৃদ্ধ বিজ্ঞাপনটির একটি দৃশ্য

ধর্ষণ বিরোধী সচেতনতার বার্তা সমৃদ্ধ বিজ্ঞাপনটির একটি দৃশ্য

বিজ্ঞাপনের ভাষা নিয়ে কথা বলার আগে মোরগ নিয়ে দুটো গল্প বলা যাক।

একটি হলো বিবিসি জানালার বিজ্ঞাপন। একটি দেয়ালের উপর থেকে ভয়ংকর ভাবে ঝাঁপ দিলো লাল রঙা মোরগ। ঠিক তখনই দেয়ালের ওপাশ থেকে মাথা বের করতে দেখা গেলো মাথায় দুই বিনুনী করা এক কিশোরী মেয়েকে। এবার দেয়ালের উপর থেকে ঝাঁপ দিলো মেয়েটাও। তারপর শুরু হলো মোরগটাকে আটকানোর লড়াই।

বিজ্ঞাপন

কখনও বা মুরগীকে আটকে রাখার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি খাঁচা ছুড়ে দিচ্ছে লাল রঙা মোরগটির দিকে, আবার কখনও দেখা যাচ্ছে টিনের চাল থেকে কখন নিচে লাফ দেবে মোরগটি সেই সময়ের জন্য তক্কে তক্কে আছে মেয়েটি। রোদে শুকাতে দেয়া ধানের উপর ঝাঁপ দিয়েও শেষমেশ হাতে রাখতে পারে না মোরগকে। এ যেন কিশোরী-মোরগের অদম্য লড়াই। আর ঠিক এভাবেই এগিয়ে যায় বিবিসি জানালা ইংরেজি শেখার বিজ্ঞাপন। আমরা শেষে দেখতে পাই, পেছনে ভেসে আসছে একটি কণ্ঠ, যে বলে যাচ্ছে- ‘আপনি এত কঠিন কাজ করতে পারেন? আরেকটু চেষ্টা করলে ইংরেজিটাও পারবেন’।



অন্য বিজ্ঞাপনটি হলো পাওয়ার এনার্জি ড্রিংকের বিজ্ঞাপন। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনটা খানিকটা আলাদা। ওয়েব সিরিজ তাকদীরে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পাওয়া সোহেল মন্ডলকে দেখা যায় একটি লাল রঙা মোরগকে আদর করে ‘সোনা মিয়া’ বলে ডাকতে। তার ডাকার ভঙ্গিতে অশ্লীলতা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। সামনে বসে থাকা লোকটিকে তিনি আরও বোঝান, এই মোরগটি এখন আর কথা শোনে না। নিজে থেকেই নড়াচড়া করে। এই কথাগুলো বলার সময় ক্লোজ শট নেয়ার মাধ্যমে নির্মাতা বিষয়টিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দর্শকদের দেখান।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু তারপরই পাল্টে যায় দৃশ্য। সত্যি সত্যিই মোরগ লাফিয়ে উঠে। খানিক লাফিয়ে উঠে ছুটে যায় অন্য কোথাও। পেছনে তখন বেজে ওঠে খানিকটা রম্য ঘরানার আবহ সঙ্গীত- ‘থাকুক না যতই সাধ ভুল পথে ছুটে যাওয়ার/ রাখবে বেঁধে সাধের ঘোড়া মামা দেখাও পাওয়ার’। এবং ঘটতে থাকে মজাদার সব কান্ড। মোরগটি ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন মেয়ের গায়ে। মেয়েটির দিকে বড় বড় দৃষ্টিতে তাকায় সে। ঠিক তখনই মেয়েটির পক্ষ থেকে চড় খাওয়ার পর মোহ ভাঙ্গে তার, ছুটে যায় কথা না শোনা মোরগ ধরতে।

উপরে দুটো বিজ্ঞাপনেই মোরগকে প্রতীকী হিসেবে ভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু পাওয়ার এনার্জি ড্রিংকের বিজ্ঞাপনে খুব স্পষ্টভাবে একটি বার্তা দেয়, নারীদের প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে। তবে প্রচলিত বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বার্তাগুলো দেখানোর পন্থা ছিলো আবেগপূর্ণ।


এই প্রথম বাংলাদেশের কোন বিজ্ঞাপনে নারীদের উপর সহিংসতা ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে শক্ত বার্তা দেয়ার পন্থা হিসেবে বেছে নেয়া হলো হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমা। স্যাটায়ার ঘরানার এই বিজ্ঞাপনটি শেষ হয় একটি ইংরেজি বার্তা দিয়ে। যার বাংলা অর্থ খানিকটা এরকম, ‘প্রিয় ভাই, দয়া করে শিখে নাও নিজের মোরগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হয়। কারণ কেউই তোমার অযাচিত মোরগকে চায় না। ধন্যবাদ বিষয়টি বোঝার জন্য’। ইংরেজিতে অক্ষরে হ্যাশট্যাগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, ‘কক ইন কন্ট্রোল’। অর্থাৎ মোরগকে নিয়ন্ত্রন রাখুন।

স্যাটায়ারের আবরণে দেয়া এই শক্ত বার্তাটিই এই বিজ্ঞাপনের শক্তি। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, এখানে খানিকটা দুর্বলতাও আছে। সেটি হলো, এই বিজ্ঞাপনটি যেই নির্ধারিত মানুষদেরকে সামনে রেখে বানানো হয়েছে, তাদের জন্য ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষা ব্যবহার করাই ছিলো সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত। কিন্তু মোরগ শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ করলে ইংরেজিতে যেই শব্দটি পাওয়া যায়, তা আবার পুরুষাঙ্গকেও চিহ্নিত করে। এ যেন বিজ্ঞাপন নির্মাতার এক ঢিলে দুই পাখি মারার এক দারুণ সৃজনশীল প্রক্রিয়া।


বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের ভাষার অনেক উন্নতি হয়েছে। পাওয়ার এনার্জি ড্রিংকের এই বিজ্ঞাপনটি তৈরি করেছেন মাহাথির স্পন্দন। এবং ‘দ্য বিগ কন্টেন্ট লিমিটেড’ নামের বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে এটিকে নির্মান করা হয়েছে। তাদের আগের দুটো বিজ্ঞাপনেও ভিন্ন আঙ্গিকে বিজ্ঞাপনে বার্তা দেয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। যার একটি বিজ্ঞাপনে পবিত্র রমজান মাসে একটি অফিসে অমুসলিম অফিসারের লুকিয়ে খাবার খাওয়া এমনকি না খেয়ে থাকার দৃশ্য দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলো। প্রায় পাঁচ মিনিট দৈর্ঘ্যের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে ছিলো মুগ্ধতা।

তেমনি অন্য বিজ্ঞাপনে ধর্ষণের শিকার হওয়া একটি মেয়েকে বিয়ের জন্য দেখতে এসে অনাকাঙ্খিত ঘটনার শোনার পর ছেলেদের পরিবারের প্রতিক্রিয়াও দেখানো হয়েছিলো। এবং শক্তিশালী বার্তা ছিলো এই যে, কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা যেটি ঘটবার পেছনে ভুক্তভোগীর কোন হাত নেই, সেই ঘটনার দায় কখনই ভুক্তভোগীর উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না।

খুব স্পষ্টভাবেই নির্মাতা কোনো বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতে গেলে শুধু পণ্যটি বিক্রি করার বিষয়ই ভাবেন না; বরং বিজ্ঞাপন যে বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে পৌছবে তাদের কাছে তারা দিতে চান শক্ত কোন বার্তা- যা দিয়ে একসময় বদলে যাবে আমাদের চিন্তা ও চেতনা। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের ভাষার শক্তিশালী এই ব্যবহার আমাদেরকে সাহস যোগাচ্ছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।

বিজ্ঞাপন: পাওয়ার ড্রিংকস
বিজ্ঞাপন নির্মাতা: মাহাথির স্পন্দন
বিজ্ঞাপনের ব্যাবহৃত গানের শিল্পী: পারভেজ সাজ্জাদ
সুর: শেখ সাফি মাহমুদ
কম্পোজিশান: শেখ সামি মাহমুদ