আমরাই বাংলাদেশে প্রথম মিউজিক্যাল ডুয়ো: রোমিও ব্রাদার্স

  • মাসিদ রণ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

‘রোমিও ব্রাদার্স' অরূপ ও নয়ন / ছবি: নূর এ আলম

‘রোমিও ব্রাদার্স' অরূপ ও নয়ন / ছবি: নূর এ আলম

বেশিরভাগ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াকে অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেও কারও কারও জীবন বদলে দেয় এই মাধ্যম। তেমনি দুজন অরূপ আর নয়ন। বাংলাদেশের নেটিজেনরা অবশ্য তাদের ‘রোমিও ব্রাদার্স’ নামে চেনে। ফেসবুকে গানের ভিডিও দিয়ে খুব অল্প সময়ে পেয়েছেন পরিচিতি। বার্তা২৪.কমের সঙ্গে সম্প্রতি আড্ডায় বসেছিলেন এই দুই তরুণ শিল্পী। সঞ্চালনা করেছেন মাসিদ রণ

‘রোমিও ব্রাদার্স' অরূপ ও নয়ন / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : অনেকটা হঠাৎ করেই পরিচিতি পেয়েছেন আপনারা। শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?

বিজ্ঞাপন

নয়ন : শুরুটাই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। আমি অরূপের কাছে গীটার শিখতাম। একদিন গীটারের সঙ্গে গান গেয়ে সেই ভিডিও পোস্ট করলাম ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে। মানুষ বেশ পছন্দ করলো। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই একের পর এক ভিডিও পোস্ট করতে লাগলাম। একটা সময় আমাদের পরিচিতি সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে চলে গেলো। ডাক পেতে থাকলাম দেশ-বিদেশের স্টেজ শোতে।

নয়ন / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : আপনারা দুজন তাহলে আপন ভাই নন?

বিজ্ঞাপন

অরূপ : না, আমরা আপন ভাই নই। তবে পারিবারিকসূত্রে আমাদের যোগাযোগ। সমবয়সী না হলেও আমরা আসলে বন্ধু। গানের জন্য সেই বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়ে এখন আমরা ভাইয়ের মতোই। তাই যখন গান প্রকাশের কথা চিন্তা করলাম, তখন ‘রোমিও ব্রাদার্স’ নামেই শুরু করি।

অরূপ / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : কোন চিন্তা থেকে প্রথম গানের ভিডিও আপলোড করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়?


অরূপ : এর পেছনে আমাদের একেবারেই কোন চিন্তা-ভাবনা কিংবা পরিকল্পনা ছিলো না। মূলত, আমার বন্ধুরা সবসময় বলতো, ‘তুই এতো ভালো গান করিস, সেগুলো ফেসবুকে কেন পোস্ট করিস না? বড় বড় শিল্পীরাও তো গান গেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে!’ তাদের কথাগুলোই এক সময় আমাকে উৎসাহী করে গানের ভিডিও বানাতে। কিন্তু একা সবটা সামলাতে পারবো বলে মনে হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে নয়ন ভাইয়াও আমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করবে বললেন। এরপর থেকেই একসঙ্গেই আমরা ভিডিও আডলোড করলাম।

‘রোমিও ব্রাদার্স'-এর সঙ্গে আড্ডায় মাসিদ রণ / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : কোন ভিডিওটি ‘রোডিও ব্রাদার্স’-এর টার্নিং পয়েন্ট?


অরূপ : মাদার্স ডে’তে একটা ভিডিও করেছিলাম। যে ভিডিওর মাধ্যমে আমরা মা আর সন্তানের সম্পর্কের ইমোশনকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। গানটি ছিলো জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও’। ভিডিওটিতে দেখা যায়, আমি মায়ের পায়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছি আর নয়ন ভাইয়া পাশে গীটার বাজাচ্ছেন। এই ভিডিওটি দর্শক দারুণ পছন্দ করে। এরপর থেকেই আমাদের প্রায় সব ভিডিওই দর্শকের ভালো সাড়া পায়।

‘রোমিও ব্রাদার্স' অরূপ ও নয়ন / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : সঙ্গীতাঙ্গনে আপনাদের যাত্রা একেবারেই অল্প দিন। দুজনই তরুণ, ভবিষ্যতেও কী গান নিয়েই থাকতে চান? নাকি অন্য কোন পেশায় ভালো সুযোগ পেলে গান ছেড়ে দেবেন?


নয়ন : না না, একদমই গান ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা নেই। অনেকে এটা ভাবতে পারেন যে সহজে আমরা পরিচিতি পেয়েছি, হয়তো টাইম পাস হিসেবে গানের ভিডিও করছি। একটা সময় হয়তো অন্য কাজ করবো।

বিষয়টি আসলে তেমন হয়। আমরা দর্শকের সামনে অল্পদিন হাজির হলেও আমাদের চর্চা কিন্তু ছোটবেলা থেকেই। যেমন, আমি সঙ্গীত পরিবারেই বেড়ে উঠেছি। আমার পরিবারের অনেকেই কাওয়ালি গানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। আমি সেগুলো শুনে শুনেই বড় হয়েছি। একটা সময় নিজেই গানগুলো নিজের মধ্যে আত্মস্থ করেছি। তেমনি অরূপও ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সেমি ক্ল্যাসিক্যাল গানের চর্চা করে আসছে। ফলে গানের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও ডেডিকেশন অন্য পর্যায়ে। আমরা যেখানে যেভাবেই থাকি না কেন গানটা আমাদের সঙ্গে রয়েই যাবে।

‘রোমিও ব্রাদার্স' অরূপ ও নয়ন / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : গান নিয়ে আপনারা কি স্বপ্ন দেখেন?


নয়ন : খেয়াল করলে দেখবেন, আমাদের উপমহাদেশে গানের অনেক জুটি রয়েছে। যেমন শংকর-জয়কিশান, নাদিম-শ্রাবন, লক্ষীকান্ত-পেয়ারেলাল, কল্যান জি-আনন্দ জি, আনন্দ-মিলিন্দ, শিব-হরি, যাতিন-লালিত, শংকর-এহসান-লয়, বিশাল-শেখর, সেলিম-সুলেমান, সাজিদ-ওয়াজিদ, মিট ব্রস, সচিন-জিগার, অজয়-অতুল, সচিত-পরম্পরা, নিজামি ব্রাদার্স, নুরানস সিস্টার্সসহ আরও অনেক জুটি। এসব জুটির কাজগুলো কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ফ্লেভারের হয় যা মানুষকে খুব কানেক্ট করে। আমরাও যেভাবে কাজ করতে চাই যাতে মানুষের মনে আমাদের গানের আলাদা জায়গা তৈরী হয়।

অরূপ : ইনফ্যাক্ট আমাদের পরিচিতি এভাবে হয়েছে যে, আমরাই বাংলাদেশে প্রথম মিউজিক্যাল ডুয়ো, ‘রোমিও ব্রাদার্স’।

নয়ন / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : ‘রোমিও ব্রাদার্স’ তো আপনাদের ব্যান্ডদলেরও নাম, তাই না?


নয়ন : হ্যাঁ। আসলে প্রথমে তো আমরা দুজনই গান করতাম। তাই স্টেজ শোতেও প্রথমে দুজনেই যেতাম। কিন্তু বড় স্টেজ শোতে দুজনে গান করে আর বাজিয়ে মাতানো সম্ভব না। তাই আমরা ‘রোমিও ব্রাদার্স’ নামে ব্যান্ড গড়ে তুলি। সব মিলিয়ে আমাদের ব্যান্ড মেম্বার ৬ জন।

অনেকে মনে করেন আমাদের একজন হয়তো ভোকাল, অন্যজন সাইড ভোকাল। কিন্তু বিষয়টা আসলে তা নয়। আমরা দুজনই মেইন ভোকাল, যে গানে যার গলা দরকার সে লিড করে। বাকী চারজন মেম্বার আসলে ফিক্সড না, কয়েকজনের মধ্যে যে যখন ফ্রি থাকেন তাকে তখন নেওয়া হয়।

অরূপ / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : বাংলায় একটা কথা রয়েছে, ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারি’। আপনারা দেখতে দারুণ সুদর্শন। এই বিষয়টি কি দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে?


অরূপ : রূপের মধ্যেই তো সবকিছু পাওয়া যায় না। হতে পারে প্রথমে হয়তো আমাদের বাইরের লুকটা কাউকে আকৃষ্ট করেছে, কিন্তু দিনশেষে গানের কোয়ালিটি না থাকলে কিন্তু কোন দর্শকই বেশিক্ষণ আমাদের গান শুনবে না। ফলে আমি মনে করি ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য মিলিয়েই আমরা। যেভাবে যাচ্ছে না যাক না! সমস্যা তো নেই (হাহাহা)।

নয়ন : আমারও তাই মনে হয়। সৌন্দর্য হয়তো জনপ্রিয়তা পাওয়ার রাস্তাকে খানিকটা সহজ করে, কিন্তু গুণ থাকাটা আবশ্যক। নয়তো সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সম্ভব না। একটা উদাহরণ দিই, আমরা সম্প্রতি কলকাতা ট্যুরে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের দারুণ কিছু শো হয়েছে। গান আর কবিতার মেলবন্ধনে আমরা দর্শকের কাছে প্রেজেন্ট করেছি। শুধু তাই নয়, সেখানে মিরচি মিউজিক অ্যাওয়ার্ডের মতো সম্মানজনক অনুষ্ঠানে আমরা অনেক গুণী শিল্পীর সান্নিধ্য পেয়েছি। তাদের কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। তারা কিন্তু এর আগে আমাদেরকে চিনতেন না। এখন তারা যদি দেখতেন যে এরা শুধু দেখতে সুন্দর, গানে তেমন জোর নেই তাহলে কিন্তু কখনোই একসঙ্গে কাজ করতে চাইতেন না।

‘রোমিও ব্রাদার্স' অরূপ ও নয়ন / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে শোনা যায়, আপনারা নাকি স্টেজ শোতে বেশ চড়া পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন?


অরূপ : আপনি খুব একটা ভুল শুনেছেন তা বলবো না। এটা সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ যে আমরা অল্প সময়ে নিজেদের একটা জায়গা করতে পেরেছি। ফলে আমরা যতোটুকু পারিশ্রমিক পেলে পরিশ্রম সার্থক হবে বলে মনে করি সেটা সবাই আমাদের দিচ্ছেন।

নয়ন : আসলে পারফরমেন্সের কোয়ালিটি আর দর্শকের চাহিদার ওপরেই তো পারিশ্রমিক হওয়া উচিত। আমরা অনেক কষ্ট করে সময় দিয়ে এক একটি পারফরমেন্স রেডি করি।

অরূপ : তাছাড়া আমাদের পারফরমেন্সগুলো কিন্তু ইউনিক। আমরা একই ধাচের গান করি না। দেখা গেল একমঞ্চে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান থেকে শুরু করে ফোক, সেমি ক্ল্যাসিক্যাল, সুফি, কাওয়ালি, গজল, ফ্রেন্স, ইংরেজি- সব ধরনের গান নিয়ে হাজির হই।

নয়ন : এতো ধরনের গান করতে কিন্তু আলাদা আলাদা ইন্সট্রুমেন্ট লাগে। তার জন্য দক্ষ যন্ত্রশিল্পী আমাদের সঙ্গে নিতে হয়। যেমন সরোদ, এটা আমাদের দেশে খুব একটা কেউ বাজায় না। যখন কোন শোতে একজন সরোদশিল্পী দরকার পড়ে তখন কিন্তু বাইরে থেকেও আনতে হয়। ফলে তাদের একটা ভালো পারিশ্রমিক দিতে হয়। সবমিলিয়ে আমরা পারিশ্রমিকটা ঠিক করি।

‘রোমিও ব্রাদার্স' অরূপ ও নয়ন / ছবি: নূর এ আলম

মাসিদ রণ : সোশ্যাল মিডিয়া আপনাদের ক্যারিয়ার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আবার এই প্ল্যাটফর্মে নিত্যদিন শিল্পীদের অনেক নেতিবাচক মন্তব্য কিংবা ট্রলের শিকার হতে হয়। আপনারা বিষয়টি কিভাবে দেখেন?


অরূপ ও নয়ন : সোশ্যাল মিডিয়া এখন পর্যন্ত আমাদের শুধু ভালোবাসাই দিয়েছে। কোন ট্রল কিংবা নেতিবাচক কিছুর মুখোমুখি হইনি। শুধু তাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে হয়তো আমরা নিজেদের জায়গা এতো দ্রুত করতে পারতাম না। এমনকি আমরা আমাদের চাহিদা বুঝে যেভাবে পারিশ্রমিক নিচ্ছি সেটাও হয়তো সম্ভব হতো না!