চঞ্চল চৌধুরীকে কুর্নিশ জানালেন অপর্ণা সেন
দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা নির্মাতা মৃণাল সেনের বায়োপিকে অভিনয় করেছেন। ওপার বাংলার জনপ্রিয় নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত ‘পদাতিক’ নামের সেই ছবিটি মুক্তি পেয়েছে গত ১৫ আগস্ট। যা দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন বাঙালা সিনেমার জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী ও নির্মাতা অপর্ণা সেন।
ফেসবুকে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অপর্ণা সেন। যা ‘পদাতিক’ টিমের জন্য বড় প্রাপ্তি।
অপর্ণা লিখেছেন, ‘‘যদিও আরজি করের নৃশংস ঘটনায় মন ভারাক্রান্ত আমাদের সকলের, সৃজিতেরও। তবু এই ছবিটি দেখে মনটা ভরে গেলো ভালোবাসায়। এক নতুন সৃজিতকে খুঁজে পেলাম। সৃজিতের সিনেমাগুলোতে এর আগে নতুন নতুন চমক পেয়েছি। পেয়েছি চাকচিক্য, অভিনবত্ব, টেকনিকের খেলা। কিন্তু এতটা গভীরতা কোথায় ছিল এতদিন? আসলে ভালো সিনেমার প্রতি, পূর্বসূরিদের কাজের প্রতি, পরিচালকের একটা আন্তরিক ভালোবাসা জড়িয়ে রয়েছে এই ছবির পরতে পরতে। মৃণাল সেনের সিনেমা ও জীবন নিয়ে সৃজিত যে গভীরভাবে গবেষণা করেছেন এবং তার চেয়েও বড় কথা তার সারমর্ম অন্তরে উপলব্ধি করেছেন, ‘পদাতিক’ ছবিটি তার প্রমাণ। সেই উপলব্ধিই খুঁজে নিয়েছে এই সিনেমার ভাষা। ‘পদাতিক’ এখানে মৃণাল সেন, ‘পদাতিক’ এখানে সৃজিতও। তাই ‘পদাতিক’ ছবিটি সার্থকনামা।’’
অভিনেত্রী যেন নির্মাতার চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন ছবিটি। যা তার প্রতিক্রিয়াতে স্পষ্ট। অপর্ণা বলেন, ‘‘মৃণাল সেনের ছবির ভাষা চিরাচরিত গল্প বলার ভাষা ছিল না। সৃজিতের ‘পদাতিক’-এর ভাষাও তাই চিরাচরিত নয়। চমৎকার সম্পাদনায় বারবার মৃণাল সেনের জীবনালেখ্যর মধ্যে ফিরে ফিরে এসেছে তারই ছবির দৃশ্য। আমার বিশেষভাবে ভালো লেগেছে একটি সিকোয়েন্স, যাতে মৃণাল সেন এবং সত্যজিৎ রায়ের ছবির দৃশ্য ইন্টারকাট করে করে দেখানো হয়েছে সমসময়ের দুই মহীরুহ সমান্তরালভাবে কী ধরনের কাজ করছেন।’’
দর্শক-সমালোচকদেরও সচেতন করলেন অপর্ণা। বললেন, ‘তবে একটা কথা, মন দিয়ে দেখতে হবে ছবিটি। যারা মৃণাল সেনের বা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সঙ্গে সম্যক পরিচিত নন, তাদের হয়তো বা এদের ছবিগুলো আবার দেখে কিছুটা হোমওয়ার্ক করে নিতে হতে পারে। নয়ই বা কেন? আসলে আমরা আজকাল বড় অলস হয়ে পড়েছি দর্শক হিসেবে, ইনস্ট্যান্ট কফির মতো চটজলদি দর্শনেই ইনস্ট্যান্ট বিনোদন পেতে চাই। কিন্তু ভালো ছবি অনেক সময়ে তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দাবি করে। এই ছবিটি সেই জাতের।’
‘পদাতিক’-এর একটি বিশেষ দৃশ্যে বেদনাভরা মুগ্ধতায় ফিরেছেন অপর্ণা সেন। বলেছেন, ‘খুব ভালো লাগল মৃণাল সেন আর সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কের দিকটা—দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও দ্বন্দ্ব, বিতর্ক ও বন্ধুত্ব, ভারী সাবলীলভাবে ধরা পড়েছে। যে দৃশ্যে শোকাচ্ছন্ন দুজনেই হাসপাতালে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সদ্য-প্রয়াত ঋত্বিক ঘটকের মরদেহের পাশে, সেখানে তিন জন লেজেন্ডের একত্র উপস্থিতি, সিনেমাপ্রেমী আমার চোখে জল এনে দিয়েছিল। বারবার মনে হচ্ছিল কাদের হারিয়েছি আমরা!’
এবার অভিনেত্রী তথা সিনেমা বিশ্লেষক অপর্ণা সেন ফিরলেন চরিত্রে। আলাদা করে বললেন চঞ্চল চৌধুরীর কথা। তিনি জানালেন, ‘চমৎকার লাগলো গীতা এবং মৃণাল সেনের দাম্পত্য জীবনের ওঠাপড়া-ভালোবাসা-বন্ধুত্ব-অভিমানে তরঙ্গায়িত দুই কমরেডের পথচলা যেমন বাস্তব, তেমনই মধুর। অভিনয় এই ছবির মস্ত বড় সম্পদ। বিশেষ করে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয়ে মৃণাল সেন একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। পাশাপাশি মনামীও খুবই বিশ্বাসযোগ্য গীতা সেনের চরিত্রে। চঞ্চল চৌধুরীর কথা বিশেষভাবে বলছি শুধু তার চেহারায় মৃণাল সেনের একটা আদল খুঁজে পাওয়া যায় (যে আদলকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছেন পরিচালক) বলেই নয়; চঞ্চলবাবুর পর্দার উপস্থিতি এতটাই জোরালো যে প্রায় যেকোনও চরিত্রেই তিনি ভালো অভিনয় করবেন। মৃণাল সেনের কণ্ঠস্বর, তার বসার ভঙ্গি, দাঁতের ফাঁকে পাইপ ধরে তাকাবার ধরন, সব কিছু সম্পন্ন হয়েছে আপাত অনায়াস দক্ষতায়। কিন্তু আমরা সকলেই জানি প্রকৃতপক্ষে অন্য একজন মানুষকে আত্মস্থ করাটা ঠিক কতটা আয়াসসাধ্য। তাই পর্দায় বিশ্বাসযোগ্য মৃণাল সেন হয়ে ওঠার জন্যে চঞ্চলবাবুকে কুর্নিশ জানাই। আশা করবো উনি পশ্চিমবঙ্গে আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করে আমাদের সিনেমাকে সমৃদ্ধ করবেন।’
চঞ্চল মুগ্ধতা পেরিয়ে অপর্ণা চোখ রাখলেন সিনেমার অন্য বিভাগেও। বললেন, ‘‘পদাতিক’র প্রোডাকশন ডিজাইনার তথা শিল্পনির্দেশক তন্ময় চক্রবর্তীও বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন। মৃণাল সেনের বিভিন্ন সময়কার বাসস্থান, সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত বসার/পড়ার ঘর, কফি হাউজের পরিবেশ, সবটাই সযত্ন নির্মিত। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর আবহসংগীত এবং গানের সুর মনে অনুরণন তুলতে থাকে ছবি শেষ হয়ে যাবার অনেকক্ষণ পরেও। সোমনাথ কুণ্ডুর মেকআপ বরাবরের মতোই অতি উচ্চমানের। শুধু মৃণাল এবং গীতা সেনের বেশি বয়সের চেহারা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।’’
ফের ফিরেছেন নির্মাতা সৃজিতে। বলেছেন, ‘‘দু’ঘণ্টা ছ’মিনিট পরিসরে একটা গোটা জীবনকে তুলে ধরা বড় সহজ কাজ নয়। বিশেষ কিছু মুহূর্ত চয়ন করে দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল সেই জীবনের সারাংশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন সৃজিত। শুধু তো সেই জীবনের ইতিহাস নয়, তার উদ্ভাসও পেলাম আমরা এই ছবিতে। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে, রাস্তায় সেই পরিচিত ভঙ্গিতে বসা মৃণাল সেন যখন সেই পরিচিত ভঙ্গিতে ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, ‘কাট!’ তখন বাহবা দিয়ে বলতেই হয় যে এর চেয়ে মানানসই শেষ আর কিছু হতে পারতো না।’’
তাহলে কি ‘পদাতিক’ দেখে শুধুই মুগ্ধতায় ভেসেছেন বিচক্ষণ অপর্ণা? তা তো হবার কথা নয়। সেটিও বললেন অকপট, ‘অবশ্যই ছবিটিতে খুঁত ছিল। তবে সে কথা এখানে আলোচনা করতে চাই না, পরিচালককে জনান্তিকে বলবো। কারণ আমি চাই সবাই ছবিটা দেখুন। এটুকু বলতে পারি যে কিছু অংশ ভালো না লাগলেও, যা ভালো লেগেছে তার অভিঘাত অনেক বেশি ছিল।’
এদিকে ছবিটি মুক্তির পর থেকেই কলকাতা কার্যত অচল হয়ে আছে। চলছে আরজি কর কাণ্ডের টানা প্রতিবাদ। তার আগে ছাত্র বিপ্লবে ডুবে ছিল বাংলাদেশ। দুটো মিলিয়ে চঞ্চল চৌধুরীর সময়টা মোটেও পক্ষে নেই। ফলে ‘পদাতিক’ মুক্তি নিয়ে লম্বা পরিকল্পনার কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেননি চঞ্চল চৌধুরী। উচাটন মনে বসে আছেন নিজ শহরে।
নিজের ছবি নিয়ে অপর্ণা সেনের এই রিভিউ পড়ে এই অভিনেতা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ‘একদিকে দেশের পরিস্থিতি, অন্যদিকে উত্তাল কলকাতা। এর মধ্যেই প্রাণের ছবিটি (পদাতিক) মুক্তি পেলো। ঢাকায় বসেই যতটুকু খবর পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে ভালোই। যদিও এই ভালোটা শতগুণ হতো পশ্চিমবঙ্গ অস্থিতিশীল না হলে। সময়টা পক্ষে ছিল না আমার কিংবা আমাদের। তবু সান্ত্বনা পাই যখন কলকাতার রিভিউ আর রিঅ্যাকশনগুলো দেখি। যখন অপর্ণা সেনের মতো কিংবদন্তিরা আমাকে নিয়ে আলাদা করে দুটো কথা বলেন, তখন নিজেকে খুঁজে পাই।’
‘পদাতিক’-এ মৃণালের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মনামী ঘোষ। এছাড়াও ছবিটিতে আছেন জীতু কমল, কোরাক সামন্ত প্রমুখ। ছবির সংগীতের দিকটা সামলেছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত।