অভিনয়শিল্পীদের দ্বন্দ্ব নিয়ে যা বললেন অগ্রজরা

  • বিনোদন ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীদের কর্মসূচী

সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীদের কর্মসূচী

অধিকার আদায়, বৈষম্যমূলক আচরণের জবাবদিহিতা এবং বিভাজন দূরীকরণসহ টিভি নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন ‘অভিনয় শিল্পী সংঘ’ সংস্কারের দাবি নিয়ে সরগরম দেশের সংস্কারকামী একদল অভিনয়শিল্পী। এসব দাবি আমলে নিয়ে তা সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন দেশের বর্ষীয়ান শিল্পীরা।

সারা যাকের, তারিক আনাম খানের মত প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা মনে করছেন, একই ইন্ডাস্ট্রিতে যদি শিল্পীরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে যায়, তাহলে সেটি কারো জন্যই শুভ কিছু বয়ে আনবে না। যেসব জায়গায় পরিবর্তন যৌক্তিক বলে বিবেচতি হবে, সেখানে পরিবর্তন এনে সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত বলে মনে করেন অগ্রজরা।

বিজ্ঞাপন

এই অবস্থা নিরসনে শিল্পীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন গুণী অভিনেতা তারিক আনাম খান। তিনি বলেন, ‘আমি দুই গ্রুপের সঙ্গেই কথা বলেছি। শিল্পী সংঘের বর্তমান যে কমিটি আছে তাদের কাছে সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীরা সংস্কার চাইছে সেগুলো মেনে নেওয়া হোক। আমি উভয়কেই বলেছি এই বিবাদ-বিভাজন, ভাঙা-ভাঙি ঠিক নয়। আলোচনা মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত।’

তারিক আনাম খান

আলোচনা না হওয়ায় সমস্যা তৈরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মাধ্যমে যারা কাজ করে, টেলিভিশন নাটক করে, তারা কিছু সংস্কার চেয়েছে। কিন্তু সংগঠন বলেছে, সদস্য না যারা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। শিল্পীদের মধ্যে সদস্য-অসদস্য বলে কিছু নেই। আর এ কারণেই এটা এখন জটিল জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তো পরিবর্তনের সময় আমি মনে করি সবসময় আলোচনা করা যায়, আলোচনা না করাটাই সমস্যা। এখন একে অপরের দাবিটা স্বাভাবিকভাবে নিয়ে যেভাবে সুরহা হয় সেই পথে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমার চাওয়া, এটার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ সমাধান হোক। এখানে কেউ কারো শত্রু নয়, সবাই এক। তরুণদেরও জায়গা তৈরি হোক।’

সারা যাকের বলেন, ‘অভিনয়শিল্পীদের এই বিভাজন কখনই কাম্য নয়, নতুন যারা যা দাবি করছে, ন্যায়সঙ্গত হলে সেটা মেনে নেওয়া উচিত। অভিনয়শিল্পী সংঘের দায়িত্বশীল যারা আছে, তাদেরও উচিত প্রশ্ন তোলার মত কাজ না করা। শিল্পীদের এই জায়গাটা তো সবথেকে বড় ঐক্যবদ্ধ ছিল। এখন বিভাজন তৈরি হলে দুপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

সমঝোতার মাধ্যমে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন সারা যাকের। সমস্যা বাড়তে দিলে একে অন্যের মধ্যে নানা ধরনের টানাপড়েন তৈরি হতে পারে বলেও শঙ্কা তার। তিনি বলেন, ‘অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে তো আসলে টেলিভিশন অভিনয়শিল্পী, সিনেমার অভিনয়শিল্পী, মঞ্চের আমরা যারা আছি এমন ভাগ ভাগ বলে কিছু নেই। শিল্পীর বন্ধন একটাই। বিভাজন তৈরি হওয়াটাই ক্ষতিকর। একসময় টানাপোড়নে পড়ে যাবে সবাই। তাই যারা দায়িত্বশীল আছে তারা তো তাদের দায়িত্বটা পালন করেই গেছে। এখন যদি নতুনরা সেখানে নতুন করে কিছু যুক্ত করতে চায়, সংস্কার চায় সেটা হতে দেওয়া উচিত।’

সারা যাকের

পরিবর্তন প্রয়োজন হলেও, দাবি আদায়ে সমসময় রাজপথকে বেছে নেওয়ার পক্ষে নন সারা যাকেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সব জায়গায় বিভাজন ভালো না। শিল্পীদের মধ্যে বিভাজন হলে সমাজ, দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এই বিভাজনকে এনকারেজ করা যাবে না। এখানে রাজনীতি না এনে সবাই একসাথে মিলিত হয়ে সুন্দর সমাধান এবং একত্রিত হওয়ার প্রয়াস দেওয়া উচিত।’

সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীদের এই অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে ‘অভিনয় শিল্পী সংঘ’র সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম বলেন, ‘কিছু কিছু দাবি আমাদের কাছে এসেছে। আমরা এটা খুব পজিটিভলি দেখছি এবং সমাধান করা যায় যেভাবে, সেই পথটা বের করার চেষ্টা করছি। আমাদের শিল্পীদের নিয়ে একটা মিটিং করেছি। সেই গ্রুপে (আলো আসবেই) সক্রিয় থাকা দুজন শিল্পীকে শোকজ করেছি। তাছাড়া আমরা ২৮ সেপ্টেম্বর একটা সাধারণ সভার ঘোষণা করেছি। সেখানে উভয় পক্ষের সবার মতামতের ভিত্তিতে একটা সমাধান দেওয়া হবে সেই আশা রাখছি।’

ঘটনার সূত্রপাত বৈষম্যবিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলনকে ঘিরে। ওই সময় শিল্পীদের মধ্যে ভাগ স্পষ্ট হয়েছে। আন্দোলনে ছাত্রদের পক্ষ হয়ে শিল্পীদের মধ্যে এক দল ফার্মগেট এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে আলোচনায় আসেন। একই সময়ে শিল্পীদের আরেকটি অংশ বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের সামনে সমাবেশ করে সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন।

‘অভিনয়শিল্পী সংঘ’র বর্তমান কমিটির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান

সম্প্রতি আওয়ামী লীগপন্থি শিল্পীদের ‘আলো আসবেই’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের কথোপকথনের বেশকিছু স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে আন্দোলনের সময় সরকারের নেওয়া ভূমিকার পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা গেছে ওই শিল্পীদের। আর এই গ্রুপের কয়েকজন শিল্পী ‘অভিনয়শিল্পী সংঘ’র নেতৃত্বে আছেন। যার ফলে শিক্ষার্থীদের পক্ষে রাজপথে থাকা শিল্পীরা সংগঠনটির প্রতি আস্থা হারিয়েছেন এবং তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

এরপর থেকে এই সংগঠনটি সংস্কারের দাবি তুলেছেন সংঘের অনেক শিল্পী। সংগঠনকে চিঠি দিয়ে আলোচনায় বসার জন্য বেশ কয়েকবার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন কয়েকজন সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পী। কিন্তু অভিনয়শিল্পী সংঘ থেকে জানানো হয়, সংগঠনের সদস্য ছাড়া অন্য কোনো অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে তারা আলোচনায় বসবেন না।

এরপর গত ৭ সেপ্টেম্বর অভিনয়শিল্পী সংঘের কাছে পাঁচটি দাবি জানিয়ে জরুরি কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংস্কারকামী শিল্পীরা। সেখানে অভিনয়শিল্পী সংঘের বর্তমান কমিটিকে দুঃখ প্রকাশ ও জুলাই বিপ্লবের বিপক্ষে অবস্থানকারীদের জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে।

রবীন্দ্র সরোবরে সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীদের একাংশ

কিন্তু সদুত্তর না মেলায় ১০ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে ‘কথা বলতে চাই, কথা শুনতে চাই’ শিরোনামের আলোচনার আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আজমেরী হক বাঁধন, শ্যামল মাওলা, নাজিয়া হক অর্ষা, সুষমা সরকার, সাবেরী আলম, সোহেল মণ্ডল, মনোজ প্রামাণিক, খায়রুল বাসার, শরীফ সিরাজ, আহমেদ সাব্বির, নীলা ইস্রাফিল, এলিনা শাম্মী, মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, আব্দুল্লাহ আল সেন্টুসহ ৫০ জন অভিনয়শিল্পী।

সেখানে অরাজনৈতিক সংগঠন হয়েও অভিনয়শিল্পী সংঘের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, যারা বিভিন্ন প্রপাগান্ডার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ, অভিনয়শিল্পীদের সমস্যায় সংগঠনের ভূমিকা, ‘আলো আসবেই’ গ্রুপে যুক্ত থাকা অভিনয়শিল্পীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, শিল্পীদের পাওনা আদায়ে সংগঠনের কঠোর ভূমিকা অনুপস্থিত থাকাসহ নানা প্রশ্ন রাখা হয়।

সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীদের কর্মসূচী

এছাড়াও বেশকিছু দাবিও উপস্থাপন করেন শিল্পীরা। দাবিগুলো হল- অভিনয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে পেশা হিসাবে স্বীকৃতি এবং অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যা যা পদক্ষেপ গ্রহণ, কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, নতুন করে রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম চালু, তিন ধরনের কোর্সের ভিত্তিতে ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করা, প্রফেশনাল কার্ডের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা, রিফর্মেশন অ্যাক্ট চালু, অভিনয়শিল্পীদের কাজের সুষ্ঠু, নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও সম্মানজনক পরিবেশ নিশ্চিত করা, শিফট সিস্টেম, ওভারটাইম চার্জ, ডেট ক্যান্সেলশন চার্জ চালু, নূন্যতম পারিশ্রমিক নির্ধারণ, প্রতিবছর স্ক্রিন এক্টরস অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি।