পূজাকে কেন্দ্র করে যেন রাজনীতির খেলা না হয়: দোয়েল
মেধাবী অভিনেত্রী দিলরুবা হোসেন দোয়েল। মডেল হিসেবেও তার চাহিদা রয়েছে। বরাবরই বেছে বেছে ভালো মানের কাজ করেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয়। ধর্ম নিরপেক্ষ এই তারকা আসছে দুর্গা পূজা উপলক্ষ্যে বার্তা২৪.কমের ক্যামেরায় ধরা দিয়েছেন সাদা শাড়ি লাল পাড়ে। সমসাময়িক বিষয়ে কথা বলেছেন মন খুলে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসিদ রণ
মাসিদ রণ: কদিন পরেই দুর্গাপূজা? এবারের পরিকল্পনা কেমন?
দিলরুবা দোয়েল: হ্যাঁ, পূজার সময়টা আমার খুব পছন্দের। শরতের কাশফুল, না গরম না শীত আবহাওয়া আর বাতাসে পুজোর গন্ধ- সব মিলিয়ে আমি খুব এনজয় করি। কারণ আমি মুসলিম হলেও মনে করি, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। আমার অনেক বন্ধু বান্ধব রয়েছে হিন্দু ধর্মের। তাদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটাই পূজার সময়। তাছাড়া শিল্পী হিসেবেও পূজা উপলক্ষ্যে নানা ধরনের কাজ করি। এবারও একটি জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউজের পূজার কালেকশনের মডেল হয়েছি। আজ আপনাদের সঙ্গে যে ফটোশুটটা করলাম, সেখানেও লাল সাদা শাড়িই বেছে নিয়েছি যাতে পূজার আমেজটা থাকে।
তবে এবারের পূজা নিয়ে একটা কথা বলতে চাই। আসলে উৎসব তো মনের ভেতরের আনন্দ থেকেই রঙিন হয়। কিন্তু ক’দিন আগেই আমাদের দেশে যে রক্ত-শ্রোত দেখেছি, যে অস্থির অবস্থা আর উৎকণ্ঠা গেছে, তা কিন্তু এখনো আমরা কেউ ভুলতে পারিনি। জীবন জীবনের নিয়মে চলছে ঠিকই। তবে মনের মধ্যে সেই ক্ষত কিন্তু রয়েই গেছে। রাষ্ট্র এখন সংস্কারের কাজ নিয়েই ব্যস্ত, এরমধ্যে পূজার মতো বড় একটি উৎসব আসতে চলেছে। আশা করব, সবাই যেন সুন্দরভাবে এই উৎসব পালন করে। এই উৎসবকে ঘিরে যেন কোন মহল রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের খেলায় মেতে না ওঠে।
মাসিদ রণ: ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। একটু অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই...
দিলরুবা দোয়েল: প্রথমেই বলে নিতে চাই, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। কিন্তু আমরা কখনোই কোটায় পড়াশুনা, চাকরী কিংবা অন্য সুবিধা নেইনি। কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা তার সন্তানরা এই সুবিধার নেবার কথা ভাবে বলেও মনে হয় না। তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে একটা গর্ব ছিলো যে, এই স্বাধীন দেশ পাওয়ার পেছনে আমার বাবারও অবদান রয়েছে। কিন্তু সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা আন্দোলনের নামে যেভাবে অপমানিত করা হলো তাতে এখন আর নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলতে ইচ্ছে করে না।
আমি ক্ষূদ্র একজন মানুষ। অনেক সময় অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমার সামর্থ্য তো সীমিত। ফলে অনেক সময় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক কিছু করতে পারি না।
এই আন্দোলনের সময়ে যেভাবে ছাত্ররা পথে নামলো আর নিজেদের দাবির প্রতি অটল থাকলো শত বাধা বিপত্তির পরেও, আমি ভেতর থেকে একটা আশ্চর্য মায়া অনুভব করলাম ওদের প্রতি। বিষয়টা ওই পর্যন্তই ছিলো। কিন্তু যখন ওদের উপরে গুলি চালাতে শুরু করলো পুলিশ, একের পর এক মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করলো- তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি সম্পন্ন কোন মানুষই ঘরে থাকতে পারেননি। সবাই পথে নেমেছেন। সেই কারণেই আন্দোলনটাও এত দ্রুত বড় হয়ে উঠেছে ও সাফল্যের দিকে এগিয়েছে।
একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতেই হয়, অনেকেই জানেন এই আন্দোলনে তাহির জামান প্রিয় নামে একজন সাংবাদিক পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। যার ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। প্রিয় আমার খুব কাছের বন্ধুতূল্য ছোট ভাই। এই মৃত্যুর বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মেনে নেবেন? আমি ঠিক স্বাভাবিক ছিলাম না ওই সময়ে। এরকম বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্নজনকে নাড়া দিয়েছে, ক্ষুব্ধ করেছে। আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি, ক্ষমতার পালাবদলের পরেও যখন নিউ মার্কেট থানায় প্রিয়’র মা গেছেন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে, পুলিশের পক্ষ থেকে তিনি কোন সহযোগিতাই পাননি। এমনকি তারা মামলা পর্যন্ত নিতে চাননি। খবর পেয়ে আমরা অনেকে যাই থানায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থানায় বসে থাকার পরে অবশেষে মামলা নেয় পুলিশ। এসব ঘটনায় খুব মন খারাপ হয় আসলে। এতজনের প্রাণের বিনিময়ে একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের পথে যে এগুচ্ছি আমরা, সেটাও আসলে এরকম নানা অন্যায় চোখের সামনে ঘটতে দেখে অনেক সময় দুঃস্বপ্ন মনে হয়। যাই হোক, আমি আশাবাদী মানুষ। আগামীর বাংলাদেশ সুন্দর হবে, ন্যায়ের ও সাম্যের হবে সেটাই প্রত্যাশা।
মাসিদ রণ: রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে দেশের যে পরিবর্তন, বর্তমান যে সামগ্রিক অবস্থা- সেটাকে কিভাবে দেখছেন?
দিলরুবা দোয়েল: আমি একজন ক্ষূদ্র শিল্পী, কোন বোদ্ধা নই। ফলে রাষ্ট্রের সকল বিষয় যে আমি খুব বুঝি ব্যাপারটা তেমন নয়। তবে এটুকু বলতে পারি, যে কোন বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত দিতে গেলে কিছুটা সময় লাগে। একটি ক্ষমতা আমাদের দেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে ছিলো। তাদের দেশ পরিচালনা করার এক ধরনের পন্থা ছিলো। সেটা থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে হাল ধরতে সত্যিই সময়ের প্রয়োজন। রাষ্ট্র তো অনেক বড় ব্যাপার, একটি ঘর চালাতে গেলেও তো সময় লাগে। সেখানে কেবল তো দেড় মাস হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। তাদের প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। কারণ জনগণ আগের চেয়ে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। তারা এখন রাস্তাঘাটে কোন অন্যায় দেখলে আগের মতো এড়িয়ে না গিয়ে প্রতিবাদ করছে। এই যে জনগণ নিজেদের অধিকার বুঝে পেতে চাইছে এটাই কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা।
মাসিদ রণ: দেশের একদল প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলো। তাদের নিয়ে আপনার কি বলার আছে?
দিলরুবা দোয়েল: তাদের টিভিতে দেখেই তো বড় হয়েছি, তাই খুব সম্মান করতাম, ভালোবাসতাম। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনে তাদের কর্মকাণ্ড দেখে তাদের প্রতি আমার আর কোন সম্মানবোধ নেই। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু এই এবারের জুলাই বিপ্লব দেখলাম। তাতে তাদের অবস্থান দেখে সম্মান থাকার দরকারও নেই, তাতে যদি তাদের কেউ আমাকে অভিনয়ে না নেন তাতেও কিচ্ছু যায় আসে না। তারা এতো বছর অভিনয় করার পরও, এতো বড় বড় পদ পদবী পাওয়ার পরও যদি দেশের প্রতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে না পারেন তাহলে তাদের সম্মান দেখানোর কোন মানে হয় না।
মাসিদ রণ: সেন্সর বোর্ড থেকে সার্টিফিকেশন বোর্ড হয়েছে। এ নিয়ে আমার অভিমত কি?
দিলরুবা দোয়েল: আমি খুশি হয়েছি। এটা সময়ের দাবী ছিলো। সেটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বুঝেছেন এবং যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এজন্য তাদের সাধুবাদ জানাই।