স্মৃতিময় বৃক্ষ ও সুগন্ধি শিহরণ

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সুগন্ধীযুক্ত ফুল কামিনী। ছবি: বার্তা২৪.কম

সুগন্ধীযুক্ত ফুল কামিনী। ছবি: বার্তা২৪.কম

গাছ আর মানুষ! প্রকৃতির পরম প্রতিবেশী। একই সাথে অনাদিকাল ধরে বসবাস তাদের। কিন্তু তারপরও গাছের প্রয়োজনীয়তা সেভাবে অনুভব করে তাকে রক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়েছে মানুষ। দা-কুঠার বসিয়ে নিজের লোভ আর স্বার্থের জন্য ধ্বংস করেছে মূল্যবান বৃক্ষরাশি ও অরণ্যভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ।

এ পর্যন্তও থেমে থাকেনি মানুষ! থেমে থাকেনি তার লোভ-লালসার পরিসীমা। গাছের অস্তিত্বটিকে শেকড় থেকে উপড়ে না ফেলে যেন কিছুতেই শান্তি নেই তার। আমাদের আগে প্রজন্মের মানুষগুলো বৃক্ষের প্রতি কত মমতাময়ী, কত আন্তরিকই না ছিলেন। এ কথা ভাবতে অবাক হতে হয়। লালসালু দিয়ে বিশালাকৃতির বট-অশ্বত্থ গাছের নিচের শরীর জুড়ে দেয়া হতো।

বিজ্ঞাপন

আধ্যাত্মিক সাধকরা এই বড় আকৃতির গাছটির ছায়াতলে অবস্থান নিয়ে স্থানীয়দের বুঝিয়ে দিতেন- একে তোমরা কখনোই কেটে ফেলো না। এর গায়ে কখনোই তোমরা কুড়াল বসিয়ো না। এই বৃক্ষ মানুষ এবং প্রকৃতির জন্য মহা-উপকারী। লালসালুর রক্তিম সতর্কতা আর সাধকদের বট-অশ্বত্থ বৃক্ষের পাদদেশে প্রতি দীর্ঘ অবস্থান এই দুটোর ফলেই প্রাণে বেঁচে যেতো সেই বৃক্ষগুলো। এই বৃক্ষগুলো বেঁচে যাবার ফলে প্রাকৃতিক সুরক্ষার দিকটিও শতভাগ নিশ্চিত হতো। এভাবে বট-অশ্বত্থ হাজার পাখির খাদ্যের জোগান দিতো।

আর আজ! বড় গাছ দেখলেই লোভাতুর হয়ে যায় কতিপয় মানুষদের মন-মানসিকতা।

বিজ্ঞাপন
বৃষ্টি পেলেই সদলবলে প্রকাশিত হয়। ছবি: বার্তা২৪.কম

বৃক্ষ বিশালাকৃতির হোক বা ক্ষুদ্রাকৃতির হোক- এটি কোনো কোনোক্ষেত্রে স্মৃতিময়ী। একাকীত্বে স্মৃতির স্বাক্ষর বহন করে চলে। কোনো এক সময়কে ধারণ করে কিংবা ব্যক্তি-গোষ্ঠীর জীবনযাপন-সংগ্রামকে কেন্দ্র করেই তার বেড়ে ওঠা। তাই বৃক্ষের গাছে এখনো দা-কুড়াল বসালে কারো কারো মন-মনন আজও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এমনই হওয়া উচিত ছিল। যাদের হৃদয় একটা ছোট গাছ কাটার এমন দৃশ্যে সংবেদনশীল হয়ে যান তারাই বৃক্ষ প্রতি অনুগত মমতাময়ী মানুষ।

এবার স্থানীয় ফুলের দোকানের লোক এসে কামিনী গাছের কিছু পাতা ছিঁড়ে নিতে যায়। তার এমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবটি এক বৃক্ষপ্রেমীর কাছে এক প্রকার বলে অপরাধ মনে হয়। চরম আপত্তি এবং সেই সাথে অন্য কারোর প্রতি এ ধরণের প্রস্তাব না রাখার জন্য তাকে বুঝিয়ে দেয়া হলো।

সেই বৃক্ষ প্রেমীর বাড়ির বহু পুরনো সঙ্গী প্রিয় ‘কামিনী’। সেই ১৯৮৭ সাল থেকে তার ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা। নাম এবং গন্ধ দুটোর মাঝেই দারুণ আকর্ষণ রয়েছে। স্মৃতিময় দিনগুলোর উজ্জ্বল সাক্ষী হয়ে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কামিনী। বছরের পর বছর ধরে তার মতো করে কত শত-সহস্র ফুল সে ফুটিয়েছে। গন্ধ বিলিয়েছে নীরবে-নিভৃতে।

দৃষ্টিতেও সৌন্দর্য ছড়ায়। ছবি: বার্তা২৪.কম

তখনও বৃষ্টি শেষ হয়নি। সেই সাথে চলছে অশান্ত বর্ষণধারা। বারান্দার কাছে দাঁড়াতেই চোখ গিয়ে ঠেকলো প্রিয় কামিনীর দিকে। দেখি, ফুল সমেত কামিনী বৃষ্টিতে ভিজে-সেজে একাকার। বৃষ্টি হলেই সে ফুটে। সবাইকে গন্ধ বিলিয়ে সে থোকা থোকা হয়ে প্রকাশি হয়।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও নিসর্গবিদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘কামিনী হলো রাতের কুমারী ফুল; কারণ সে কমনীয়। কামের আধার ও উদ্রেককারী। তার সুগন্ধ মত্ততা রাতে। তাই তার সৌরভে রাত্রি হয় উতলা। কাম্য বলেই সে কামিনী। তিনি আরও বলেন, গাছটির শরীর বা ডাল মোটেই মসৃণ-সুন্দর নয়। ফাটা ফাটা। কিন্তু মখমলের মতো প্রায় কমনীয়। পাতা আঙুলের মাথার মতো ছোট। কিন্তু ওষুধিগুণে ভরা তার পাতা, ছাল ও শেকড়।’

বহুদিন লক্ষ্য করেছি, সন্ধ্যা যখন গভীর হয়ে রাতের মিশে যেতে থাকে- তখন তার জেগে ওঠার প্রকৃত সময়। প্রতিটি ফুলের সুবাসকে সে বাতাসের ভেতর সুকৌশলে প্রবেশ করিয়ে দেয়। সুঘ্রাণ এসে হঠাৎ মনোযোগ কেড়ে নেয় নিমিষেই। আহা! কী মিষ্টি গন্ধ কামিনীর! কার্তিকের মৃদু শীতের মাঝেও বৃষ্টিতে ফোটা সেই কামিনী স্মৃতিপর্বে সুগন্ধ ছড়ায়।