অপূর্ব সৌন্দর্যের পাখি স্কারলেট মিনিভেট
‘ঘুম ভাঙার পর থেকেই তোমার কথা মনে পড়ছিল খুবই। আজকে ঘুমও ভাঙলো বড় সুন্দর এক চমকে! এক জোড়া পাখির ডাকে ঘুম ভাঙলো। কম্বল ছেড়ে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি একজোড়া স্কারলেট মিনিভেট এসে বসেছে আম গাছের মাথায়। আমার ঘুম ভাঙানিয়া পাখিরা! আহাঃ রোজই যদি আসতো!’
প্রথিতযশা লেখক বুদ্ধদেব গুহ তার বিখ্যাত ‘মাধুকরী’ উপন্যাসে অপূর্ব বিন্যাসে পাখিটিকে অমর করে তুলছিলেন।
ছেলে ও মেয়ে দু’জনেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রঙের কারুকার্য। প্রকৃতিই তাদের সুসজ্জিত করে তুলেছে আলাদা আলাদা পোশাকে। ছেলে-মেয়ের দৃশ্যমান রঙের এই ভিন্নতা এবং লৈঙ্গিক পার্থক্য তাদের রক্ষা করে বিপন্নতার হাত থেকেও। ‘টিউই-টিউই-টিউই...’ স্বরে চমৎকারভাবে মাতিয়ে বেড়ায় বুনোপ্রকৃতি। ডালের উচ্চতায় বসে আপন মনে ডাকতে থাকে কেবল। বনের নির্জনতার মাঝে এমন সুমিষ্ট ডাক ভালো লাগার অবর্ণনীয় শিহরণ জাগায়।
এর ইংরেজি নাম স্কারলেট মিনিভেট (Scarlet Minivet) এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম পেরিক্রোকোটাস ফ্লেমিয়াস (Pericrocotus flammeus) বাংলায় একে সিঁদুরে সাহেলি ছাড়াও লাল সাতসাহেলি, লালপরি, সায়েলি নামেও ডাকা হয়। শহরে বসবাসকারী পাখিদের তালিকায় এরা পড়ে না।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্রে জানা যায়, পৃথিবীতে ১৩ প্রজাতির মধ্যে আমাদের দেশে ৬ প্রজাতির মিনিভেটের বিচরণ রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি আবাসিক এবং অবশিষ্ট চারটি পরিযায়ী পাখি।
ছেলে পাখিটি টুকটুকে লাল এবং মেয়েটি হালকা হলুদ এমন চমৎকার রঙের সংমিশ্রণ খুব কম পাখিদের মধ্যেই রয়েছে। এই প্রজাতির পাখিদের শুধুমাত্র পুরুষরা গাঢ় লাল হয়ে থাকে। স্ত্রীদের গায়ের রঙ হালকা হলুদ। পুরুষ পাখির মাথার রঙ কালো এবং পিঠের পালকে রয়েছে কালো রঙের ছোপ - যা তাকে দিয়েছে মোহনীয় রূপ। কিন্তু স্কারলেট মিনিভেট এর স্ত্রী-পুরুষ দু প্রজাতিই চমৎকার রঙের সৌন্দর্যে রাঙা।
এরা আবাসিক পাখি। অর্থাৎ আমাদের দেশেই বসবাস করে। সচরাচর জোড়ায় বা ঝাঁকে দেখা যায়। এরা ছোট আকারের পাখি। এদের দৈর্ঘ্য ২২ সেমি. এবং ওজন মাত্র ২৬ গ্রাম। প্রতি বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যে এরা ছানা তুলে। আমাদের দেশীয় গাছের গায়ে চরে বেড়ানো ছোট ছোট পোকামাকড় খায়। সিলেট, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, রংপুর, সুন্দরবন এইসব প্রাকৃতিক বন-জঙ্গলে এদের প্রায়ই দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, মায়ানমার এইসব দেশে রয়েছে এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি।
স্বনামধন্য পাখি পর্যবেক্ষক, গবেষক এবং প্রকৃতিবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা রোনাল্ড হালদার বলেন, ‘স্কারলেট মিনিভেটদের প্রাকৃতিক বন ছাড়া অন্য কোথায় পাওয়া যাবে না। এই মিনিভেট পাখিগুলোর বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক বনের প্রয়োজন। যেখানে আমাদের স্থানীয় নানান প্রজাতির গাছগুলো পরিপূর্ণতা রয়েছে। পাতাঝরা বন থেকে শুরু করে চিরহরিৎ বন, প্যারা বন, আবার চিরসবুজ বনেও এদের খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষের তৈরি করা বনে কিন্তু এদের কখনোই পাওয়া যাবে না।’
‘আমাদের অনেকেরই ধারণা যে, প্রাকৃতিক বন কেটে নিজেদের পছন্দ মতো গাছ লাগালেই তো বিভিন্ন পাখিদের আগমন ঘটবে। এমন ধারণা আসলে সম্পূর্ণ ভুল। বহু পাখি আছে যাদের সাথে প্রতিটি গাছের নিবিড় এক সম্পর্ক রয়েছে। কি ধরনের গাছ, কি ধরনের বন, বনের অবস্থা কেমন এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ওপর নির্ভর করে এ জাতীয় পাখিদের অস্তিত্ব ও বংশবিস্তার। কোনো বনের গাছগাছালি পরিবর্তন করলেই দেখা যাবে যে ওই পাখিটা আর নাই’ বলে জানান এ গবেষক।