২০২০: যা কিছু চির স্মরণীয়-শিক্ষণীয়
ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকদের নজর এখন আমাদের ওপর। সব অর্থেই ২০২০ ছিল ভীতিকর আর দুর্দশার বছর। কোনো এক সময় আমাদের উত্তর প্রজন্ম হয়তো জানতে চাইবে, কেমন ছিল সেই প্রচণ্ড মানসিক আঘাত আর নাটকীয় বাঁকের দিনগুলি! ইতিহাস সাধারণ লিখিত হয় ক্ষমতাবান, সুবিধাপ্রাপ্ত ও কুখ্যাতদের ঘিরে। সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প খুব কমই আসে।
ধরা যাক, আজ হতে শতবর্ষ পরে, যদি ২০২০ সাল নিয়ে কথা ওঠে, তাহলে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো কোন বিষয়গুলো থাকবে? যেগুলো ২০২০ সালকে সব অর্থেই তুলে ধরে?
২০২০ শেষ হয়ে এলো। অনেকে এই বছরটি স্মৃতি থেকেই একদম মুছে ফেলতে চাইবেন। এরপরও, এইসব অভিজ্ঞতা ও যাপন তো রয়েই যাবে। সদ্য পার করে আসা অশান্ত বছরটি আমাদের কাজ-কর্ম, জীবন যাপন, চিন্তাধারা ও পরিবর্তনের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। দেখে নেওয়া যাক সেইসব বিষয়গুলো যা সত্যিকার অর্থেই মনোযোগ, স্মরণ ও শিক্ষণের যোগ্য দাবিদার!
ফেস মাস্ক ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা
বিষময় বিশ সালকে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটির মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় সেটি হলো ‘ফেস মাস্ক’। এটিকে ‘ফেস মাস্ক ইয়ার’ বললে অত্যুক্তি হবে না। এটি কেবল ২০২০ সালই নয়, আগামীতেও এর প্রয়োজনীয় প্রভাব বজায় থাকবে।
অণুজীব বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসের যে বাড়-বাড়ন্ত তাতে কোভিড-১৯ এর চেয়েও শক্তিশালী ভাইরাস সামনে হানা দেবে। সেক্ষেত্রে ফেস মাস্ক আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন-যাপনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে যাচ্ছে।
শুধু ফেস মাস্কই নয়, অন্যান্য যেসব শারীরিক সুরক্ষা সামগ্রী যেমন: স্যানিটাইজার, হ্যান্ড রাব, পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), গ্লাভস প্রভৃতি বছরজুড়েই মানুষের প্রয়োজনীয় তালিকার শীর্ষে ছিল এবং আগামীতেও পরিসরভেদে থাকবে। সাধারণ মানুষ শুরুতে পিপিই ও গ্লাভস পরলেও পরে শুধু মাস্কে এসে ঠেকে। কিন্তু চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও সেবাদানকারীদের তো এসব এড়ালে চলে না! তাদের জন্য এসব অত্যাবশ্যকীয়।
সম্প্রতি গবেষকরা করোনাভাইরাসের নতুন ‘স্ট্রেন’ (অণুজীবের জিনগত ভিন্ন প্রকার) খুঁজে পেয়েছেন যা আরও ৭০ গুণ সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন। ইতিমধ্যেই এই স্ট্রেন যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গণসংক্রমণ এড়াতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আকাশ যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে অন্যান্য অনেক দেশ। বাংলাদেশেও স্ট্রেনের খোঁজ মিলেছে। কাজেই ২০২০ সালে যেরকম মাস্ক-রাজ ছিল, নতুন বছরেও তা বাড়বে বৈ কমবে না। এছাড়া করোনা মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন হতে রীতিমতো বাধ্য করেছে। শুরুতে বাধ্যবাধকতা থেকে করলেও ধীরে ধীরে তা অভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যকর খাবার ও জীবন-যাপন ছাড়া যে আগামীতে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে জেতা সম্ভব নয়, সেই শিক্ষা আমরা চরম মূল্য দিয়েই অর্জন করেছি।
পরিবারিক-সামাজিক নৈকট্য
বলাই বাহুল্য, করোনার প্রথম চার-পাঁচ মাস ছিল বিভীষিকাময়। সবাইকেই ঘরবন্দি থাকতে হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকদের মতে, বিশ্ব এর আগেও মহামারি দেখেছে। দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধ পার করেছে। কিন্তু এমন একযোগে বিশ্বব্যাপী বন্দিত্ব স্মরণকালে কেউ কখনও দেখেনি। এর ফলে অধিকাংশেরই পরিবারের সঙ্গে লম্বা সময় কাটানোর সুযোগ ঘটেছে। গ্রাম-মফস্বলে তাও পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে জানা-শোনার সুযোগ থাকে। কিন্তু মহানগরে সেটি ঠিক উল্টো। বরং এমন হয়, বছরের পর বছর পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকে কিন্তু কারও সঙ্গে কারও পরিচয় বা যোগাযোগ নেই। শহুরে ব্যস্ত জীবন তা হতেও দেয় না! কিন্তু এই লকডাউনে নিজের পরিবারের বাইরে সবচেয়ে আপনজন ছিল প্রতিবেশীরাই। সেটা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস হোক বা সহানুভূতি-সান্ত্বনা – আতঙ্কময় দিনগুলোতে তারাই পাশে ও কাছে ছিল।
এই প্রকৃতিপ্রদত্ত নৈকট্য অতি বিরল। করোনা কেটে গেলেও এমন মায়াময় বন্ধন কেউ হারাতে চাইবে না সেটা নিশ্চিত। শুরুর দিকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সংক্রমণ এড়াতে এর উল্টোটাও যে ঘটেনি তা নয়। কিন্তু মানুষ সামাজিক জীব। একা সে অতীতে যেমন বাঁচতে পারেনি, আগামীতেও পারবে না। বরং ধনতান্ত্রিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় রোজকার ইঁদুর দৌড় ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসার যে ফুসরত মিলেছে, এও বড় পাওয়া। মানুষের পাশে যে শেষ পর্যন্ত মানুষকেই দাঁড়াতে হয় তা আরও কার্যকরীভাবে প্রমাণ হলো গত বছরে।
দূষণমুক্ত নির্মল পরিবেশ
লকডাউনে কার্যত গোটা বিশ্ব থমকে ছিল। মানুষ ঘরবন্দি কাজেই বাস-ট্রেন-মোটরবাইক-উড়োজাহাজও চলেনি। অধিকাংশ কারখানাও ছিল বন্ধ। আকাশে-বাতাসে কালো ধোঁয়া নেই। যেখানে-সেখানে প্লাস্টিক ছড়ানো নেই। হোটেল-মোটেল খালি। প্রকৃতি যেনো হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। মা-প্রকৃতির এই বিশ্রামটুকু ভীষণ দরকারি ছিল। ওই সময় পরিবেশ দূষণ কী হারে কমেছিল তা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষণীয় শহর ঢাকার উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে। এমনিতে ঢাকার গড় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ১৯৪। হরহামেশা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। একিউআই অনুযায়ী, ২০০-৩০০ এর মধ্যে থাকলে তা ‘ভীষণ অস্বাস্থ্যকর’। লকডাউনে একিউআই নেমেছিল একশোর নিচে, যা ঢাকাবাসীদের আজন্ম স্বপ্ন ও চির কাম্য।
বিশ্বব্যাপী সীমাহীন পরিবেশ দূষণে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর নানামুখী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আমরা নানাভাবেই প্রত্যক্ষ করছি। এই নির্মল পরিবেশ সবসময়ের জন্য থাকে এটাই সবার কামনা। লকডাউন তথা ২০২০ সাল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলো পরিবেশ দূষণের কার্যকারণ এবং ফলাফল। এই শিক্ষা আমরা কেউই ভুলতে চাইবো না, ভোলা উচিতও হবে না!
সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন
গেলো বছর ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস মুভমেন্ট’ নতুন করে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। ঘটনার সূত্রপাত ২৫ মে ২০২০। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে গলায় হাঁটু চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে এক শেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা। লকডাউন ভেঙে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলনকারীরা পথে নামেন। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান। ভাস্কর্যের এই ব্যক্তিরা তাদের কাজ ও চিন্তার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বর্ণবিদ্বেষী ও মানবাধিকার হরণকারী ছিলেন।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এরকম শতাধিক বিতর্কিত ব্যক্তিদের ভাস্কর্য আন্দোলনকারীরা গুঁড়িয়ে দেন। বিভিন্ন শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এগুলো স্থাপিত ছিল। ভাস্কর্যগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামজিক ব্যক্তিত্ব। এছাড়াও, দিকে দিকে পরিবেশ ও মানবাধিকারসহ প্রয়োজনীয় নানা আন্দোলন দানা বাঁধে। একদিক দিয়ে এটা অনেকটা ইতিহাসের দায় শোধের মতো।
সম্পর্ক ও পারস্পরিক দেখভাল
এটা মিথ্যে নয়, করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে চরম আতঙ্কিত অবস্থায় স্বার্থপরতা ও মেরুকরণ প্রাধান্য পাচ্ছিল। সবারই ভয় ছিল, সাহায্য করতে গিয়ে আমি নিজে না সংক্রমিত হই! করোনা উপসর্গ দেখা দেওয়ায় নিজের পরিবারের লোকজনকেও বাগানে-রাস্তায় ফেলে এসেছে মানুষ। করোনায় কেউ মারা গেলে মৃতের স্বজনদের প্রতিবেশীরা পাড়ায় ঢুকতেও দেয়নি বলে খবর এসেছে।
তবে প্রথম পর্বের আতঙ্ক কেটে গেলে মানুষকে ফিরতে হয়েছে মানুষের সাহায্য-সহানুভূতির কাছেই। সেটি নিজ পরিবারের লোকজন হোক বা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশী। ফলে যেকোনো ধরনের সম্পর্কেরও পুনরাবিষ্কার হয়েছে বলা চলে। ২০২০ সালে নানাবিধ শীতলতা কাটিয়ে নতুনভাবে মানুষ মানুষের উপকারে এসেছে। মহামারিকালে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন পর্যায়ের যত্ন ও দেখভাল এই মহাবিপদ কাটাতে সবচেয়ে বেশি কাজে এসেছে।
ভবিষ্যতের উপহার
করোনা মানুষের অসহায়ত্বেরও একটি বড় পরীক্ষা নিয়েছে বলা চলে। চোখের সামনে লাখো মানুষ মরছে। প্রিয়জন ছেড়ে যাচ্ছে বিনা চিকিৎসা ও ওষুধে। ভ্যাকসিন নেই, কবে আবিষ্কার হবে এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। গোটা মানবজাতি একসঙ্গে দিশাহারা। এরকম সামষ্টিক-সামগ্রিক দুরাবস্থা নিকটকালীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও গেছে কিনা সন্দিহান।
এমন অনিশ্চয়তা, টালমাটাল আর স্নায়বিক চাপের সময়ে মানবতাই আমাদের শেষ আশা ও ভরসা যুগিয়েছে। মানবতার কথা সবসময়ই বলা হয়ে থাকে। জীবনের বিভিন্ন পরিসরে এর চর্চাও চলে কিন্তু ২০২০ ছিল সামষ্টিকভাবে মানবতার অগ্নিপরীক্ষার বছর। বলা চলে, সেই পরীক্ষার প্রথম ধাপ আমরা উতরেছি। পরবর্তী শত-সহস্র উত্তর প্রজন্মের কাছে ২০২০ সাল ‘মানবতা’ নামক এই মহার্ঘ্য উপহারটিই রেখে গেলো..