করোনা নতুন পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাবার সুযোগ তৈরি করেছে



ড. মুহাম্মদ ইউনূস
. মুহাম্মদ ইউনূস

. মুহাম্মদ ইউনূস

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি ব্রাজিলের এস্তাদো দে সাও পওলো পত্রিকাকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস করোনাভাইরাস মহামারী ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তার সাক্ষাৎকারটির হুবহু বাংলায় অনুবাদ দেওয়া হলো-

১. আপনি লিখেছেন যে, কোভিড-এর প্রাদুর্ভাবের আগে আমরা খাদের একেবারে কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। আপনার কেন এমনটা মনে হলো? আমরা কীভাবে এবং কেন এ জায়গায় পৌঁছালাম?

মহামারীর অব্যবহিত আগে পরিস্থিতি ঠিক কোন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল আমি সেটাই বোঝাতে চেয়েছি। এই মহামারী অর্থনীতির মেশিনটাকে থামিয়ে দিয়েছে। এর ফলে মহামারী-পূর্ব অবস্থা থেকে পৃথিবী অর্থনৈতিকভাবে অনেক পেছনে পড়ে গেছে। এখন সরকার ও ব্যবসাগুলো জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মহামারীর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে যাতে প্রবৃদ্ধির সেই গতিটা আবারো ফিরে পাওয়া যায়। আমি যেটা জোর দিয়ে বলতে চাইছি তা হলো, এখন আমাদের নীতি হওয়া উচিত মহামারী-পূর্ব সেই পৃথিবীতে আমরা “আর ফিরে যেতে চাই না” কেননা সেটা ছিল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অল্প কিছু লোকের হাতে সম্পদের চরম কেন্দ্রীকরণ এবং পৃথিবীর বুকে মানুষকে অপাংক্তেয় করে দিয়ে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আগ্রাসনের মাধ্যমে এই গ্রহে মানুষের অস্তিত্ব ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবার একটা প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা আমাদেরকে ক্রমাগত সতর্ক করে যাচ্ছিলেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীতে আমাদের সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সময় গণনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। মানবজাতি এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদাপন্ন প্রজাতিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। মহামারী-পূর্ব পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া হবে আত্মহত্যার শামিল। তাহলে ধ্বংস-অভিমুখী সেই আগের পথে আমরা কেন ফিরে যাবো?

এখন যেহেতু অর্থনীতি থেমে গেছে, আমরা এখন একে সম্পূর্ণ নতুন পথে চালিত করতে পারি। মহামারী আমাদেরকে আত্মহত্যার পথ ত্যাগ করে একটি নতুন পৃথিবীর পথে - একটি তিন শূন্য অর্থাৎ “শূন্য নীট কার্বন নিঃসরণ”, “শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ” ও “শূন্য বেকারত্ব”-র একটি নতুন পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা জানি কীভাবে সেখানে পৌঁছাতে হবে। যা দরকার তা হচ্ছে আগের পথ পরিত্যাগ করার সাহসী সিদ্ধান্তের।

২. আপনি বলছেন যে, বর্তমান কাঠামোর একটি পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন যা শুরু হবে সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতা দিয়ে। কোনো দেশ এমনটা ভাবছে এবং এ ধরনের কোনো পথ অবলম্বনের চেষ্টা করছে বলে আপনার মনে হচ্ছে কি?

কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। আমাদের পুরনো ব্যবস্থা আমাদেরকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা একটি জ্বলন্ত গৃহে বাস করছি। কিন্তু আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা আমাদেরকে এটা বুঝতে দিচ্ছে না। আমরা একটি জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে একটি বড় উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত। আমরা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও প্রযুক্তির চমক উদ্যাপন করছি, উন্নয়নের জয়গান করছি- অথচ একেবারেই দেখতে পাচ্ছি না যে, আমাদের এই উৎসবই বরং আমাদের গৃহে লাগা আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে।

পৃথিবীর সব দেশেই তরুণ সমাজ এটা বুঝতে পেরেছে, আর এ কারণে তারা রাজনৈতিক দল থেকে দূরে থাকতে চাইছে। কিশোর-কিশোরীরা “ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার” ব্যানারে একটি নতুন ভবিষ্যতের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। তারা তাদের অভিভাবকদেরকে তাদের ভবিষ্যৎ চুরি করে নেবার জন্য অভিযুক্ত করছে। সরকারগুলো নিট কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য ঘোষণা করে নিজেদের সচেতনতা আর দায়িত্ববোধ প্রমাণ করতে চাইছে। ব্যবসাগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের উপর চুক্তি স্বাক্ষর করছে। তবে আমরা জানিনা এর কতটুকু আসল আর কতটুকু মিডিয়াতে প্রচারের উদ্দেশ্যে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক বর্তমান অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বদলে ফেলতে আমাদেরকে অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ধরনের চিন্তাধারা এরই মধ্যে একটি বিপজ্জনক পৃথিবী গড়ে তুলেছে যেখানে পৃথিবীর প্রায় সব সম্পদ উত্তর গোলার্ধের একটি চূড়ায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে আর পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ঠাসাঠাসি করে জড়ো হয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধের এক চূড়ায়। দুনিয়ার সকল সমৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে উত্তর গোলার্ধে আর দক্ষিণ গোলোর্ধের মানুষদের বলা হচ্ছে এর সাফল্য উদ্যাপন করতে। বর্তমান ব্যবস্থা সম্পদ ও মানুষের মধ্যকার এই দূরত্ব সফলভাবেই বাড়িয়ে চলেছে।

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষকে কাজ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই মানুষ পৃথিবীর বুকে আবর্জনায় পরিণত হবে; তারা আর কোনো কাজে আসবে না।

সরকারগুলো বরাবরের মতোই তাদের “রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ পথ” অনুসরণ করছে। তারা পরিবেশগত লক্ষ্য ঘোষণা করছে। কিন্তু অধিকাংশ দেশেই কোনো আশু প্রয়োজনীয়তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কোনো দেশেই কোনো দুশ্চিন্তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

বর্তমান ব্যবস্থাটাকে আমুল বদলে ফেলে “তিন শূন্য”র একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে মানুষকে বিশেষ করে তরুণ সমাজকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে।

৩. আপনি আরো বলছেন যে, পৃথিবীর এই পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে মুনাফাবিহীন ব্যবসা সৃষ্টি করতে হবে। এটা কি পুঁজিবাদ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া নয়?

পুঁজিবাদ এই ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে, মানুষ সবসময় ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। আমি এই ধারণাকে প্রকৃত মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসতে একে পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে চাচ্ছি। আমার এই নতুন সংজ্ঞায় মানুষ কিছুটা ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা আর প্রধানত সমষ্টিগত স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যক্তিস্বার্থের উপর সম্পূর্ণ জোর দিয়ে অর্থনীতিবিদরা সে-ধরনের ব্যবসা সৃষ্টিতেই ভূমিকা রেখেছেন যেগুলো মুনাফা সর্বোচ্চ করবে।

সমষ্টিগত স্বার্থ মানুষের অন্যতম লক্ষ্য হলে আমাদেরকে এমন ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করতে হবে যা সমষ্টির বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে বিশেষভাবে উপযুক্ত। যে ব্যবসা সমষ্টির সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট সেখানে ব্যক্তিগত মুনাফার প্রয়োজন নেই। তার যা প্রয়োজন তা হলো আর্থিকভাবে টেকসই পন্থায় সমষ্টিগত সমস্যাগুলোর সমাধান। আর এ কারণে আমি বিশেষ ধরনের ব্যবসা তৈরি করেছি যাকে আমি বলছি “সামাজিক ব্যবসা” - যে ব্যবসা ব্যক্তিগত মুনাফার অনুসন্ধান না করে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করবে। এই ব্যবসার মুনাফা ব্যবসাতেই আবার ফিরে যাবে, ব্যক্তির কাছে নয়।

এটা কি পুঁজিবাদ? এই নতুন তত্ত্বে মুনাফা সর্বোচ্চকারী ব্যবসাগুলো শূন্য ব্যক্তিগত মুনাফার ব্যবসাগুলোর পাশাপাশি ব্যবসা করে যাবে। কে কোন ধরনের ব্যবসা করবে তা ব্যক্তির পছন্দের উপর ছেড়ে দেয়া হবে। এই নতুন তত্ত্বে উদ্যোক্তা তিনটি বিকল্প থেকে একটি বেছে নেবেন-তিনি মুনাফা সর্বোচ্চকারী ব্যবসায়ে নিয়োজিত হতে পারেন, কিংবা একটি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে পারেন, অথবা এই দুই ধরনের ব্যবসাই সৃষ্টি করতে পারেন। দুই ধরনের ব্যবসাই একই নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে, একই বাজারে কাজ করতে পারে।

৪. মুনাফাই যদি না থাকলো তাহলো এই পুনর্বিন্যস্ত দুনিয়ায় মানুষ বিনিয়োগ করবে কেন?

আপনি যদি মনে করেন যে, লাভের প্রত্যাশা ছাড়া মানুষ কোথাও অর্থ ব্যবহার করে না তাহলে আপনি ভুল করছেন। মানুষ বিভিন্ন কারণে অর্থ ব্যয় করে। এর একটি হচ্ছে সেবামূলক কাজে দান, যেখানে দাতা লাভের আশা করেন না।

আপনি যদি ‘বিনিয়োগ’কে ব্যক্তিগত মুনাফা সর্বোচ্চ করার উপায় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন তাহলে আমি এ বিষয়ে একমত হতে পারি যে, কোনো সামাজিক ব্যবসার শেয়ার ক্রয়ে ব্যবহৃত টাকা ‘বিনিয়োগ’ হবে না। আপনি যদি বিনিয়োগের এই সংজ্ঞা মেনে নেন যে, কোনো কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ে ব্যবহৃত টাকা হচ্ছে বিনিয়োগ- তাহলে কোনো সামাজিক ব্যবসার শেয়ার ক্রয়ে ব্যবহৃত টাকা বিনিয়োগ হিসেবেই বিবেচিত হবে।

আপরি প্রশ্ন করতে পারেন, মুনাফা সর্বোচ্চ করাই যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে কেউ সামাজিক ব্যবসার শেয়ার কেন কিনতে যাবে?

আমি বিষয়টাকে এভাবে দেখতে চাই- মানুষ সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবে কেননা টাকা রোজগার করা  তার কাছে হয়তোবা সুখের হতে পারে, কিন্তু অন্যদের সুখী করাটা হবে তার কাছে পরম সুখের। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে মানুষতো সামাজিক ব্যবসাতেই বিনিয়োগ করতে চাইবে। প্রকৃতপক্ষে, এই সবকিছুরই মূল আমাদের মনের মধ্যে, যেখানে জন্ম হয় সুখের অনুভূতি- মন যেটাকে সুখ হিসেবে দেখে।

আমি আমার টাকা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে পারি। আমি এটা ভাল কাজে দান করতে পারি, বিছানার নিচে রেখে দিতে পারি, লটারির টিকেট কিনতে পারি, সামাজিক ব্যবসায়ে কিংবা মুনাফা সর্বোচ্চকারী কোনো ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারি, কিংবা আরো নানাভাবে এর ব্যবহার করতে পারি। আমাদের জীবনটা প্রকৃতপক্ষে সুখের সর্বোচ্চকরণ, মুনাফার সর্বোচ্চকরণ নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির তত্ত্বে আমাদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভ্রান্ত করেছে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপটা হচ্ছে এটা আমাদের মধ্যে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, সুখের পরিমাপ হয় টাকার পরিমাণ দিয়েছে।

৫. আপনি আরো বলছেন যে, নতুন পুনরুদ্ধার কর্মসূচিতে নাগরিক ও সরকারের মধ্যে যে শ্রম বিভাজন তা ভেঙে ফেলতে হবে, যেখানে সামাজিক সমাধানের লক্ষ্যে নাগরিকদেরকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। এখানে কি রাষ্ট্রের আকার ছোট করে ফেলার কথা বলা হচ্ছে?

পুঁজিবাদী তত্ত্বে ধরে নেয়া হয়েছে যে, নাগরিকরা তাদের মুনাফা সর্বোচ্চ করতে কাজ করে যাবে আর সরকারকে কর দেবে। সরকার রাজস্বের টাকা দিয়ে দেশের সাধারণ সমস্যাগুলোর সমাধান করবে।

সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকার কী মাত্রায় জড়িত হবে তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সরকার সবচেয়ে কম কর ধার্য করবে এবং সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা থেকে দূরে থাকবে। তাঁদের মতে সামাজিক ইস্যুগুলোর সমাধান বাজারের শক্তির হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। অন্যরা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে এবং সরকার কর ধার্য করে এজন্য অর্থের সংস্থান করবে।

আমার যুক্তি হচ্ছে, কোন পরিস্থিতিতেই সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে নাগরিকরা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারেনা। বিভিন্ন সামজিক সমস্যার সমাধানে নাগরিকদেরকে অবশ্যই তাদের সকল সৃজনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের সমস্যাগুলোর সমাধানে নাগরিকরা সক্রিয় হয়ে উঠলে এর ফল পেতে মোটেই বিলম্ব হবে না। যে কোনো বুদ্ধিমান সরকারকেই সমাজের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দেশের নাগরিকদেরকে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। সরকারের কাজ হবে নাগরিকদের উৎসাহিত করা, তাদের কাজের স্বীকৃতি দেয়া, তাদের অর্জনের প্রশংসা করা এবং নাগরিকদের বিভিন্ন উদ্যোগে সহায়তা দিতে উপযুক্ত আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে দেয়া। এছাড়াও সরকার সামাজিক ব্যবসা ফান্ড ও সামাজিক ব্যবসা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড গঠন করতে পারে এবং সামাজিক ব্যবসা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা উৎসাহিত করতে আইনী কাঠামো তৈরী করে দিতে পারে।

আমি সরকারের গুরুত্ব ছোট করে দেখাতে চাইছি না, আমি বরং প্রতিটি নাগরিককে সমাজের সমস্যাগুলোর সমাধানে যুক্ত হতে উৎসাহিত করার জন্য সরকারের সাংগঠনিক ভূমিকাকে আরো কার্যকরি করার কথা বলছি। সরকারের সক্ষমতাকে শুধু এর রাজস্ব আদায় দিয়ে বিচার করা ঠিক হবেনা। সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি তার জনগণ। জনগণকে সঠিকভাবে পরিচালিত ও উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে সরকার যা অর্জন করতে পারে শুধু রাজস্ব দিয়ে তার ভগ্নাংশও সম্ভব নয়।

আমি সরকারের একটি নতুন ভূমিকার প্রস্তাব করছি, যেখানে সরকার সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে উপযুক্ত আইনী কাঠামো, নীতি ও প্রণোদনার মাধ্যমে পুরো জাতিকে সংগঠিত করবে।

৬. এই পরিবর্তনে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে?

জনগণকে পরিচালিত করার ক্ষমতা সরকারের আছে। যে কোনো রূপান্তর প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুততর হয় যদি সরকার উপযুক্ত নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে আসে। আমরা নতুন গন্তব্যে পৌঁছাতে নতুন রাস্তা তৈরি নিয়ে কথা বলছি। সরকার যদি উৎসাহের সাথে এ কাজে যুক্ত হয় তাহলে নতুন রাস্তা তৈরির কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়ার একটি মূল উপাদান হচ্ছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। আমাদেরকে নতুন নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে যে, প্রতিটি তরুণ এখন থেকে এটা ভাববে যে, তাকে আর চাকরির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না- সে চাইলেই একজন উদ্যোক্তা হতে পারে। সরকার নাগরিকদেরকে সামাজিক ব্যবসা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড, বিনিয়োগ তহবিল ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী গড়ে তুলতে উৎসাহিত করতে পারে যাতে তরুণরা উদ্যোক্তা হবার সুযোগ পায়। সরকার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রথাগত ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে উৎসাহিত করতে পারে, প্রণোদনা দিতে পারে।

সরকার সামাজিক ব্যবসাগুলোকে দরিদ্র মানুষদের ও দূরবর্তী এলাকায় অবস্থিত মানুষদের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নিতে উৎসাহিত করতে পারে। একটি নিরবচ্ছিন্ন ও টেকসই রূপান্তরের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে সরকারের অনেক কিছুই করার আছে।

৭. আপনি সব সময়ই বলে আসছেন যে, ব্যবসায় উদ্যোগ বেকারত্বের সমাধান করতে পারে । ব্রাজিলে ব্যবসায় উদ্যোগ বলতে কখনো কখনো অনানুষ্ঠানিক কাজকে বোঝানো হয়। যেমন, একজন ব্যক্তি যে চাকরি হারিয়েছে সে একজন অনানুষ্ঠানিক বিক্রেতা হিসেবে কাজ করতে শুরু করলো। মানুষ বলছে সে একজন উদ্যোক্তা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে একটি অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছে। এ অবস্থায় প্রকৃত ব্যবসায় উদ্যোগ কি আনুষ্ঠানিক খাতে যত চাকরি ধ্বংস হয়েছে সেগুলো প্রতিস্থাপন করতে পারবে? কীভাবে?

আমি ঐ ব্যক্তিটির অনিশ্চিত অবস্থা বিষয়ে আপনার সাথে পুরোপুরি একমত। তাঁর অবস্থা অনিশ্চিত কেননা তিনি তাঁর ব্যবসাকে টেকসই করতে পারছেন না। তাঁর ঐ ব্যবসা অর্থায়নের জন্য কোনো যথাযথ ব্যবস্থা নেই। তাঁকে ব্যবসা চালাতে হচ্ছে মহাজনের নিকট থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে। ব্যবসার জন্য প্রয়োজন অর্থায়ন - যা হচ্ছে ব্যবসার জ্বালানি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আমাদের দরকার বিশেষায়িত ব্যাংক, যেমন সামাজিক ব্যবসা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংক। এ ধরনের ব্যাংক সব জায়গায় দরকার, বিশেষ করে দূরবর্তী ও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে। মানুষ বাস করে এমন সব জায়গায় এ ধরনের ব্যাংক থাকতে হবে। এগুলো মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে।

আপনার কাহিনীতে রাস্তার পাশে শার্ট বিক্রি শুরু করা যে লোকটির কথা বলছেন, সে হয়তো এখন দৈনিক পাঁচটি শার্ট বিক্রি করে, অথচ এর দশগুণ বেশি শার্ট  বিক্রি করার দক্ষতা তার আছে। নিজের ব্যবসাকে বড় করার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি তার নেই। সে ব্যবসা ছেড়ে দিলো। একটি চাকরি জোগাড় করে নিলো। কিন্তু ব্যবসার পুঁজি থাকলে তার কাছে বিভিন্ন বিকল্প থাকতো; সে চাকরি একেবারে ছেড়ে দিয়ে ব্যবসাকে পুরোপুরি লেগে পড়তে পারতো, অথবা চাকরির পাশাপাশি শার্ট বিক্রির ব্যবসাও চালিয়ে যেতে পারতো, অথবা ব্যবসার কথা পুরোপুরি ভুলে গিয়ে চাকরি করতে পারতো, অথবা ব্যবসায়ে আবারো ফিরে যেতে উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারতো।

আমি বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবে একজন উদ্যোক্তা। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষকে এটা পুরোপুরি ভুলিয়ে দেয় এবং বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে, চাকরিই আমাদের একমাত্র পরিণতি।

৮. আপনি সবসময় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কর্তৃক আমাদের কাজ কেড়ে নেবার বুঁকির কথা বলে আসছেন। এই মহামারীর সময়ে ডিজিটাল রূপান্তরের পরিমাণ বেশ বেড়ে গেছে। আপনি কি মনে করেন যে, প্রযুক্তি ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমাজের ক্ষতির করছে? এই সমস্যার সবচেয়ে ভাল সমাধান কি?

যে কোন প্রযুক্তিরই দু’ধরনের প্রয়োগ রয়েছে। এটা একটা আশীর্বাদ হতে পারে, আবার অভিশাপও হতে পারে। এটা নির্ভর করবে আমরা একে কোন দিকে পরিচালিত করছি তার উপর। এটা একই সাথে আশীর্বাদ ও অভিশাপ দু’টোই হতে পারে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানব জাতির জন্য বিপুল কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আমি এর কল্যাণমূলক ব্যবহার সমর্থন করি। কিন্তু আমি তখনই এর বিরোধিতা করি যখন এটা ব্যাপকভাবে মানুষের কাজ কেড়ে নেয়।

যখন কোনো নতুন প্রযুক্তি সৃষ্টি করা হয় তখন আমাদেরকে অবশ্যই ঠিক করতে হবে এটা কোথায় ব্যবহার করা হবে, কোথায় এর প্রয়োগ সীমিত করতে হবে। ওষুধের উদ্ভব হয়েছে মানুষকে সুস্থ করতে, কিন্তু সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এমন রাসায়নিক তৈরী করা যায় যা দিয়ে মানুষ হত্যা করা যায়।

আমার যুক্তি হচ্ছে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে ভুল পথে পরিচালিত করা হচ্ছে। খুব বেশী দেরী হয়ে যাবার আগেই এটা বন্ধ করতে হবে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স অন্য সব প্রযুক্তির মতো নয়; এটা যে কেবল নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম তাই নয়, এই প্রক্রিয়ায় এটা প্রতিবারই নিজের উন্নততর সংস্করণ তৈরী করতে পারে। এর কোনো সীমা নেই।

৯. উদ্যোক্তা সৃষ্টি ছাড়াও পৃথিবীর পুনর্বিন্যাসের জন্য আর কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আপনি মনে করেন?

শুরুতেই আমাদেরকে তিন শূন্য’র একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে - শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য দারিদ্রের লক্ষ্য অর্জনে শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ, আর শূন্য বেকারত্বের একটি পৃথিবী।

আমাদেরকে অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, এর জায়গায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে হবে, গোমাংস জাতীয় খাবার ত্যাগ করতে হবে, প্লাস্টিকের সামগ্রী বন্ধ করতে হবে, বৃক্ষরোপণ করতে এবং বনাঞ্চল সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করতে হবে, ব্যাংক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করতে হবে যাতে গৃহহীণরাও এর সুবিধা পেতে পারে, অল্প কিছু লোকে হাতে সকল সম্পদ পুঞ্জীভূত হবার সকল পথ বন্ধ করতে হবে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কর্তৃক মানুষকে পৃথিবীর বুকে আবর্জনায় পরিণত করা থেকে রক্ষা করতে হবে, এবং এই সকল সমস্যার সমাধানকল্পে সামাজিক ব্যবসার পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।

১০. আমরা পৃথিবীর এই পুনর্বিন্যাসে ব্যর্থ হলে এই গ্রহের ভবিষ্যত কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

এরই মধ্যে মানবজাতি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন প্রজাতিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। আমরা যদি আমাদের এতদিনের অনুসৃত পথেই চলতে থাকি তাহলে পৃথিবীর বুক থেকে আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাবো। এটা শীঘ্রই ঘটতে পারে, তবে তা নির্ভর করছে টিকে থাকার জন্য আমরা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছি তার উপর।

১১. আপনি যুক্তি দেখিয়ে আসছেন যে, ক্ষুদ্রঋণ অসমতা হ্রাস করতে সহায়তা করে। একে কীভাবে আরো জোরদার করা যায়? সরকারের কি একাজ করা উচিত?

সরকারের উচিত হবে না কোনো ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করা, কেননা সরকার একাজ করতে গেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই কর্মসূচির রাজনীতিকরণ হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। এর ফলে এই কর্মসূচি একটি দাতব্য কর্মসূচিতে পরিণত হবে। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দূর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।

সরকারের উচিত হবে উপযুক্ত আইনি কাঠামো সৃষ্টি করে মানুষকে “সামাজিক ব্যবসা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংক” সৃষ্টির লাইসেন্স প্রদান করা যে ব্যাংকগুলোর সঞ্চয় সন্নিবেশ করার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। এই লাইসেন্স অবশ্যই ব্যক্তিগত মুনাফা-সন্ধানী ব্যাংক তৈরির জন্য দেয়া হবে না; এটা করা হলে এই ব্যাংকগুলো শীঘ্রই মহাজনী ব্যাংকে পরিণত হবে।

   

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;