দেশে অল্প সংখ্যায় রয়েছে ‘হলদে-চোখ ছাতারে’
‘পাখির দেশ- বাংলাদেশ’ হলেও কিছু পাখির সংখ্যা এখনো নগণ্য। বাড়ছে না তাদের প্রজনন। প্রাকৃতিক গাছপালা ও লতাগুল্ম ধ্বংস, কৃষিজমিতে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহারে পাখিদের খাদ্য পোকা-মাড়কের মারাত্মক অভাবসহ পরিবেশগত নানা বিপর্যয়ের কারণগুলো রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিঘ্ন পাখি গবেষকেরা।
নানামুখী প্রাকৃতিক দূষণের শিকার হয়ে অল্প সংখ্যাক পাখির তালিকায় রয়েছে মাত্র ১৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের ‘হলদে-চোখ ছাতারে’। এর ইংরেজি নাম Yellow-eyed Babbler এবং বৈজ্ঞানিক নাম Chrysomma sinense। এরা আমাদের দেশের বিরল আবাসিক পাখি।
এ পাখিটি দেখতে প্রায় আমাদের জাতীয় পাখি ‘দোয়েল’ এর মতো। লালচে বাদামি দেহ এবং লম্বা বাদামি লেজ। তবে ‘হলদে-চোখ’ বলা হলেও চোখ কিন্তু হলদে নয়। এই পাখিটিকে চেনার উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো এর চোখে রয়েছে কমলা রঙের গোলবৃত্ত বা রিং। ছোট সাদা ভ্রুরেখা কমলাকৃতির ঘিরে রয়েছে চোখটিকে।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বলেন, হলদে-চোখ ছাতারে পাখিটির খুব কমই দেখা মেলে। শুরু থেকেই এ পাখিটাকে আমরা বাংলাদেশে কম পাচ্ছি। কেন কম পাচ্ছি তার কঠিক কারণ আমাদের জানা নেই। তবে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রচুর সংখ্যা রয়েছে। এ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে।
এর প্রাপ্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, দু-তিন বছর ধরে আমি রংপুরের তেতুলিয়াতে এ প্রজাতির বেশ কিছু পাখি পেয়েছি। শুধু বন নয়, ধানক্ষেতে মধ্যেও সাধারণত বেশি পেয়েছি। জুন-নভেম্বরে প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখিটিকে উঁচু ঝোপের মাথায় ও লম্বা ঘাসের ডগায় বসে বেশ জোর গলায় গান গাইতে থাকে। ‘টুয়ি-টুয়ি-টুয়ি-টা-হুয়িট-চু’ এভাবে গান গেয়ে মেয়ে পাখিটিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে সিলেট বিভাগেও পাখিটি পাওয়া যায়।
পাখিটির স্বভাব সম্পর্কে ইনাম আল হক বলেন, হলদে-চোখ ছাতারে এক জায়গায় স্থির হয়ে বেশিক্ষণ বসে না ওরা। ঝোপঝাড়ের মধ্যে পোকা খুঁজে বেড়ায়। এ পাখি ভীরু স্বভাবের। হঠাৎ ভয় পেলে এ ঝোপ থেকে ও ঝোপে লাফ দিয়ে পালায় এবং দেখতে দেখতে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। ভয়ে পালানোর সময় কর্কশ স্বরে কিচিরমিচির করে ডাকে। তবে সচরাচর পরিস্কার গলায় ডাকে।
এর শরীরিক রঙের বিন্যাস সম্পর্কে এ পাখি গবেষক বলেন, হলদে চোখ ছাতারে লালচে-বাদামি পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ১৮ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় ২০ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির কান-ঢাকনিসহ পিঠ পুরোপুরি লালচে-বাদামি। ছোট সাদা ভ্রুরেখা হলুদ চোখ ঘিরে রাখে। চোখের বেড় কমলা-হলুদ, থুতনি, গলা ও বুক সাদা, বগল ও তলপেটে রয়েছে হালকা পীত রঙের আভা। ঠোঁট কালো, খাটো, মোটা ও শক্ত। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। কমলা ও বাদামি মুখ প্রজনন মৌসুমে কালোতে রূপ নেয়। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারা অভিন্ন।
ইনাম আল হক আরো বলেন, ঘাসের গোড়া কিংবা ভূমির খুব কাছে অন্য উদ্ভিদে ঘাস দিয়ে বাটির মতো বাসা তৈরি করে ৩ থেকে ৫টি সাদার রঙের ডিম পাড়ে। পুরুষ-নারী উভয়ে মিলে ১৫-১৬ দিন তা দিয়ে ছানা ফোটায়। শিকারির মন বাসা থেকে অন্য দিকে ফেরাতে কাছের গাছে ডানা ভেঙ্গে নিজের অক্ষমতার ভান করে।
হলদে চোখ ছাতারে পাখিটির রসালো ফল এবং ফুলের মধু খুবপ্রিয় হলেও অন্যান্য খাবার হিসেবে পোকামাকড়, শুয়োপোকা, ফড়িং, বুনো মাকড়সা ইত্যাদি জীবনধারণের জন্য খেয়ে থাকে বলে জানান পাখি গবেষক ইনাম আল হক।