পার্সি সম্প্রদায়: মৃত্যুর 'মৌন শিখর' যাদের শেষ আশ্রয়



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
পার্সি সম্প্রদায়: মৃত্যুর 'মৌন শিখর' যাদের শেষ আশ্রয়

পার্সি সম্প্রদায়: মৃত্যুর 'মৌন শিখর' যাদের শেষ আশ্রয়

  • Font increase
  • Font Decrease

করোনায় যে মৃত্যুর শীতল থাবা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে মুসলিম কবরগাহ, খ্রিস্টান গ্রেভিয়ার্ড, হিন্দুদের চিতা প্রতীকী আবহে চিত্রিত হচ্ছে। মানুষের শেষ বিশ্রামের প্রসঙ্গে আরেকটি ক্ষুদ্র অথচ সুপ্রাচীন ধর্মগোষ্ঠী পার্সিদের অদ্ভুত শেষকৃত্য স্থান 'টাওয়ার অব সাইলেন্স' বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য, যা মৃত্যুর 'মৌন শিখর' রূপে পরিচিত। অনেকে যাকে বলে 'আকাশের কবরস্থান'।

কলকাতার 'মৌন শিখর'

পার্সিরা মৃতদেহকে কবরে দেয় না, চিতায় পোড়ায় না। মৃত্যুর পর তাদের লোকালয়ের বাইরে একটি উঁচু মিনারের উপর রেখে আসে। সেখানে মাংসাশী পাখির দল আত্মসাৎ করে মৃত মানুষটির শরীর। এভাবেই প্রকৃতির মধ্যে সেই শরীর মিশে যায়। এই মিনারকেই তাদের ভাষায় বলা হয় 'দখমা' আর ইংরেজিতে 'টাওয়ার অব সাইলেন্স'।

ঔপনিবেশিক কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে জঙ্গলের মধ্যে 'দখমা' তৈরির কাজ শুরু হয় ১৮২২ সালে। খরচ পড়েছিল তখনকার দিনে ৩৫ হাজার টাকা। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন প্রবীণ পার্সি নেতা নওরোজি। সঙ্গে অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে এসেছিলেন। ১৮২৮ সালের ২৮ জানুয়ারি উদ্বোধন হয় টাওয়ার অফ সাইলেন্স। পূর্ব এশিয়ায় এটাই পার্সিদের প্রথম শেষকৃত্যভূমি। রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, মালয় থেকেও মৃতদেহ বয়ে আনা হত বহুদিন। এখন আর সেই প্রথা নেই বললেই চলে। পার্সিদের অনেকে বিকল্প সৎকারের ব্যবস্থা করছেন। তাছাড়া চিল-শকুনও আর নেই। মৃতদেহ সৎকারের জন্য এই 'দখমা'র চূড়াতেও বসানো হয়েছে সৌরচুল্লি। কিন্তু দুশো বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে 'মৌন শিখর'।

কলকাতার সমস্ত কোলাহলের সীমানা পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন টাওয়ার। চারপাশটা বদলে গিয়েছে অনেকটা। এখন আর আশেপাশে চিল-শকুনের দেখা মেলে না। কিন্তু একটা সময় তারাও এখানে অপেক্ষা করে থাকত। কখন একটি মৃতদেহ আসবে, পল-বিয়ারারের দল সেটিকে নীরবে তুলে দেবে মিনারের চূড়ায়। আর তারপর সেই মৃতদেহের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে এগিয়ে আসবে মাংসাশী পাখিরা। তখন ডানার ঝাপটে আর অবিরাম চিৎকারে সমস্ত নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। এখন আর চিল-শকুনেরা অপেক্ষা করে থাকে না। মৃতদেহও আসে না বললেই চলে।

আসবে কেমন করে? কলকাতায় আর পার্সি মানুষের সংখ্যাই বা কত! সব মিলিয়ে বড়জোর ৪০০ হবে। তবে উনিশ শতকে এই কলকাতা শহরেই এক লক্ষ পার্সি নাগরিক বাস করতেন।

শুরুটা হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাহাদুরের কৃপায়। কলকাতা তখন নতুন কসমোপলিটান। আইনি-বেআইনি নানাধরনের ব্যবসার কেন্দ্রে তখন কলকাতা। আর সেই ব্যবসার টানেই পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ এসে আস্তানা তৈরি করছেন এখানে। আর তার মধ্যে অগ্নি-উপাসক পার্সিরা ধনে-বিদ্যায়-ঐশ্বর্যে এগিয়ে ছিল সকলের থেকেই।

পার্সি ব্যবসায়ী দাদাভাই বেহরামজি বানাজি সুরাট থেকে কলকাতা এসেছিলেন ১৭৬৭ সালে। তবে ব্যাপকভাবে পার্সি বসতি গড়ে উঠতে থাকে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। মূলত প্রত্যেকেই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতায় তাঁদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল একাধিক এন্টারপ্রাইজ। তবে বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে মিলেমিশে যেতে তাঁদের বেশি সময় লাগেনি। অনেকের তো পদবীর শেষে 'বেঙ্গলি' শব্দটাও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল।

কলকাতায় তেমনই একটি পরিবার ছিল সোরাবজি পরিবার। কলকাতার পার্সিদের মধ্যে একজন অগ্রণী ব্যবসায়ী ছিলেন নওরোজি সোরাবজি বেঙ্গলি। এদেশের পার্সি জনজাতির মানুষদের একজোট করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। আর সেই সূত্রেই কলকাতায় তৈরি করেছিলেন একটি দখমা। ইংরেজিতে যাকে বলে 'টাওয়ার অফ সাইলেন্স'।

কলকাতার বুকে এমন কত ইতিহাস আজও রয়ে গিয়েছে। আমরা রাস্তায় ব্যস্ত চলাফেরার মধ্যে মাঝে মাঝে সেসবের সামনে থমকে দাঁড়ান অনেকেই। কিন্তু ইতিহাসের কতটুকুই বা খোঁজ রাখি আমরা? অনেক অনেক বছর আগে, যখন বেলেঘাটার খালটাও ছিল না, তখন কেমন ছিল এই এলাকা। সেই জঙ্গলের নিশ্ছিদ্র নীরবতার চেহারা কেমন ছিল? আজ আর কিছুই জানা যাবে না। টাওয়ার অফ সাইলেন্সের আশেপাশে তার খানিকটা আভাস হয়তো পেতে পারেন।

ভারতে পার্সি সম্প্রদায়

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন ইরানি জনগোষ্ঠী পার্সি নামে পরিচিত হলেও এরা মূলত 'জরোয়াস্ট্রিয়ানিজ্ম' বা 'জরাথ্রুস্টবাদ' নামক ধর্মীয় মতবাদের অনুসারী। রাজনীতিবিদ দাদাভাই নওরোজি, সিনেমা জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব দাদাসাহেব ফালকে, বিসনেস টাইকুন টাটা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির স্বামী ফিরোজ গান্ধি, অভিনেতা বোমান ইরানি প্রমুখ পার্সি সম্প্রদায়র মানুষ, যাদের প্রধান আবাস বোম্বে নগরে। ভারতের বিভিন্ন শহরে এবং পাকিস্তানেও কিছু পার্সি বসবাস করেন, বিশ্বে যাদের মিলিত সংখ্যা ১/২১০ লাখের বেশি নয়।

উল্লেখ্য, ভারতের ছয়টি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এসব সম্প্রদায় হচ্ছে মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পার্সি ও জৈন। ইহুদিসহ আরও কয়েকটি সম্প্রদায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। তাদের আবেদন বিবেচনাধীন।

প্রাচীন ইরান বা পারস্যদেশের সাম্রাজ্যগুলোর রাষ্ট্রধর্ম একদা ছিল জরাথুস্ট্রবাদ। এরা প্রধানত 'অগ্নি-উপাসক' নামে সংজ্ঞায়িত হলেও তারা একটি অতিপ্রাচীন ইরানীয় একেশ্বরবাদী ধর্ম বা ধর্মীয় মতবাদ। ভারতীয় উপমহাদেশে এটি পার্সি ধর্ম নামেও পরিচিত। জরথুস্ত্রীয় বা পারসিক ধর্মের প্রবর্তক জরথুস্ত্র। তার নাম অনুসারেই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় এই ধর্মের নাম হয়েছে "জরোয়াস্ট্রিয়ানিজ্ম" বা জরাথ্রুস্টবাদ। এ ধর্মে ঈশ্বরকে অহুর মজদা বা আহুরা মাজদা ("সর্বজ্ঞানস্বামী") নামে ডাকা হয়। এদের ধর্মগ্রন্থের নাম আবেস্তা বা জেন্দাবেস্তা । এই ধর্ম গ্রন্থের সঙ্গে প্রাচীন ঋগ্বেদ এর অনেক মিল আছে, তাই এদের উভয়ের উৎপত্তি একই উৎস থেকে বলে মনে করা হয়।

বর্তমানে পৃথিবীতে জরথুস্ত্রীয়দের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষের মধ্যে। ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ইরান, আর্মেনিয়া সহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশে এদের বাস। তবে ধর্মটির অনুসারী বা পারসীদের অর্ধেকই বর্তমানে ভারতে বসবাস করছে। ভারতে বসবাসকারী এসব পার্সিদের ৯০ শতাংশ থাকেন বোম্বে নগরে। বাকি ১০ শতাংশ ছড়িয়ে রয়েছেন সারা ভারতে। কলকাতায় পারসিক জনসংখ্যা প্রায় চারশো।

খ্রিস্টীয় ৯ম শতকে জরথুস্ত্রীয় ধর্মালম্বী পারসিকরা পারস্য তথা বর্তমান ইরান থেকে ভারতে গণঅভিবাসনের মাধ্যমে চলে আসেন। ভারতে এসে এরা প্রথম পা রাখে বর্তমান গুজরাতের উপকূলবর্তী সঞ্জান এলাকায়। এদের এই আগমন সম্পর্কে একটি চমৎকার ঘটনা প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে জানা যায়। পার্সিদের আগমনের পর সঞ্জানের শাসক একটি কানায় কানায় পূর্ণ দুধের পাত্র নবাগত পার্সিদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন তার রাজ্যে আর কাউকে ঠাঁই দেয়ার জায়গা নেই। পারসিরা ঐ পাত্রে চিনি ঢেলে দেখিয়ে দেন পাত্র উপচে পড়ছে না। অর্থাৎ বোঝানোর চেষ্টা করেন, চিনি যেমন দুধে মিশে যায় তেমনি তারাও ওই এলাকার মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকবেন। এরপর শাসক পার্সিদের আশ্রয় দেন।

যে পথে এসেছিল পার্সি জনগোষ্ঠী

ভারতে আগমনকালে পার্সি সম্প্রদায়ের জীবন ও অভিজ্ঞতা কেমন ছিল তা জানার একমাত্র সুত্র কিসসা এ সানজান নামক গ্রন্থটি । তৎকালীন সময়ে পার্সি জীবন বৃত্তান্তের অন্য কোনও উৎসের খোঁজ মেলে না। জরথ্রুষ্টদের ভারত আগমনের অন্তত ছয়শ বছর পরে রচিত কিসসা এ সানজান গ্রন্থটি ।

গ্রন্থটির ভাষ্য মতে, জরথ্রুষ্ট ধর্মানুসারীদের যে গোষ্ঠীটি সর্ব প্রথম ভারতে এসেছিল তাঁদের আদি নিবাস স্থল ছিল মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম খোরাশান অঞ্চলে। ইতিহাস খ্যাত খোরাশান অঞ্চলটির ভৌগোলিক ব্যাপ্তি বিশাল । কয়েকটি রাষ্ট্র জুড়ে এর ব্যপ্তি। তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তানের অংশবিশেষ সহ এটি ইরান ও আধুনিক আফগানিস্তান রাষ্ট্রের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত । বর্তমান ইরানের অন্তর্গত অংশটি খোরাশান প্রদেশ নামেই পরিচিত ।

কিসসা এ সানজান গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী জাদি রানা নামক একজন ভারতীয় শাসক ভারতে আগত জরথ্রুষ্ট গোষ্ঠীটি কে নিজ রাজ্যে বসবাসের অনুমতি দেন। তবে তাঁর বিনিময়ে তাঁদেরকে ঐ রাজ্যের প্রচলিত ভাষা এবং পোষাক-পরিচ্ছেদ গ্রহণ করতে বলা হয় । প্রদত্ত শর্ত দুটি মেনে নিয়ে গোষ্ঠীটি ভারতে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করে। তাঁদের এই বসতিই পরবর্তীতে সানজান নামক জনপদে পরিণত হয়।

বলা হয় পারস্যে নিজেদের আদিনিবাসস্থল সানজান নগর এর নামানুসারে তাঁরা এই বসতির নামকরণ করেন। ইতিহাসের প্রাচীন সেই সানজান নগর বর্তমানে তুর্কমেনিস্তান রাষ্ট্রের মারভ নামক অঞ্চল এর সংলগ্ন। এরও প্রায় পাঁচ বছর পর ইরানের বৃহত্তর খোরাশান অঞ্চল থেকেই জরথ্রুষ্টদের আরও একটি গোষ্ঠী ভারতেবর্ষে আগমন করে। এই গোষ্ঠীটি নিজেদের সঙ্গে সাথে কিছু ধর্মীয় উপকরণ (আলাত) ও নিয়ে এসেছিল । এই দুই গোষ্ঠী কে অনেকসময় একত্রে খোরাস্তানি বা কোহিস্তানি বলে ডাকা হত, যার অর্থ পাহাড়ী। এঁদের পরেও ইরানের সারি অঞ্চল থেকে জরথ্রুষ্ট দের আরও একটি গোষ্ঠী ভারতে এসেছি বলে জানা যায়।

ধারণা করা হয়, সানজান জনপদ স্থাপনাকারী জরথ্রুষ্ট ঐ গোষ্ঠীটিই ভারতের প্রথম স্থায়ী জরথ্রুষ্ট অভিবাসী । তবে তাঁদের আগমনের সময়কাল নিয়ে মতভেদ আছে। কোনও নির্ভর যোগ্য তথ্য সুত্র না থাকায়, ঐতিহাসিকেরা কিসসা-এ-সানজান - গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলী থেকেই আগমনের সময়কাল নির্ণয় করার প্রয়াস করেন। কিসসা এ সানজান এ বর্ণিত অনেক ঘটনার সময়কাল অস্পষ্ট হওয়ায় এবং উল্লেখিত অনেক তারিখে অসঙ্গতি থাকায়, ঐতিহাসিকেরা কোনও তারিখকেই নির্ভুল দাবী করতে পারছেন না।

ঐতিহাসিকেরা ধারণা করছেন, সানজান অভিবাসীদের আগমনের তিনটি সম্ভাব্য তারিখ থাকতে পারে- যেগুলো হলঃ ৭১৬, ৭৬৫ এবং ৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ। তাঁরা এই তিনটির মধ্যে যে কোনো একটি তে এসে থাকবেন। আগমনের তারিখ নিয়ে এহেন মতভেদ পার্সি সমাজেও তুমুল বাক বিতন্ডা এমনকি লড়াই সৃষ্টি করেছে। তবে শেষ কথা হল এই যে ১৮ শতকের পূর্বে রচিত পার্সি কোনও লেখাতেই সাল তারিখ উল্লেখ নেই, তাই তারিখ নিয়ে কোনও দাবিই সন্দেহাতীত নয়। যে যাই দাবি করুক না কেন, সবগুলোই প্রকৃতপক্ষে অনুমান ভিত্তিক।

সুনিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, সানজান অধিবাসীদের আগেও বিভিন্ন সময়ে উপমহাদেশে জরথ্রুষ্টদের আগমন ঘটেছিল ও পদচারনা ছিল। ইরান বা পারস্যের সর্ব পূর্ব সীমান্তে আছে বালোচিস্তান প্রদেশ। আর বালোচিস্তান প্রদেশ ঘেঁষে অবস্থিত সিন্ধু উপ্যতাকা। এই সিন্ধু প্রদেশও কিছু কাল ইরান পারস্যের শাসকদের শাসনাধীন ছিল। সেই সময়টাই পারস্যে সাসানিদ সাম্রাজ্যের (২২৬-৬৫ খ্রিস্টাব্দ) অধীনে। ফলে সাসানিদ সাম্রাজ্যের বহু সামরিক প্রতিনিধি ও শিবির ছিল সিন্ধু প্রদেশে। সিন্ধু প্রদেশ হাতছাড়া হবার পরও ইরানীদের প্রতিপত্তি ও প্রভাব ফুরিয়ে যায় নি সিন্ধ প্রদেশে। ইরান ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় নি। নবম শতাব্দীর আরব ইতিহাসবিদ আল-মাসুদির গ্রন্থে জরথ্রুষ্ট সম্প্রদায়ের ভারতে বসবাসের অবস্থানের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ পাওয়া যায় । তিনি উল্লেখ করেন যে আল-হিন্দ ও আল-সিন্ধ এ এই ধর্মনুসারীদের অগ্নি মন্দির ছিল। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতেও জনা কয়েক পার্সি ব্যক্তিদের সিন্ধ প্রদেশে বসবাসের প্রমাণ মেলে। তবে বর্তমানে যে সম্প্রদায় টি সিন্ধ এ অঞ্চলে এ বাস করেন তাঁদের আগমন অনেক পরে, সম্ভবত ব্রিটিশদের আগমনের সময় থেকে। প্রাচীন ভারতবর্ষ ও পারস্যের মধ্যে বানিজ্য চলত, সমুদ্র পথ ও স্থল পথে। খ্রিষ্টের জন্মের অনেক পূর্ব থেকেই ইরান ও ভারত মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় যোগাযোগ ছিল। হিন্দু পুরাণ ও মহাভারতে সিন্ধু নদের পশ্চিমের অধিবাসীদের অভিহিত করা হয়েছে পারসিক নামে।

জাত-ব্যবাসায়ী ও শিক্ষিত পার্সি সম্প্রদায়

ভারতের পার্সিদের সম্পর্কে সতের শতকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চ্যাপলিন হেনরি লর্ড মত প্রকাশ করেন যে, পার্সিরা চেতনার বিকাশ ও উন্মুক্তির খোঁজে ভারতগামী হয়েছিল । কিন্ত একই সাথে তিনি এও মন্তব্য করেন যে, 'জাত ব্যাবসায়ী পার্সিরা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার সুত্রে ভারত অভিমুখী হয়েছিলেন।' মুঘল আমলেই তারা ব্যবসায় এগিয়ে আসেন। ব্রিটিশ আমলে তা প্রবলভাবে বৃদ্ধি লাভ করে।

নবাগত কোম্পানির জন্য নানা কাজে স্থানীয় লোকের দরকার ছিল। সমুদ্রতটের বন্দর এলাকায় ব্যবসার সহযোগী ও নির্মাণকাজে পার্সিরা তখন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। একই সূত্রে পার্সিরা গুজরাতের গ্রামাঞ্চল ছেড়ে ব্রিটিশ কোম্পানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাজ, বোম্বে ও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি শহরগুলোতে আসতে থাকে। ফলে ভারতের নগরায়নের ইতিহাসে সামনের কাতারে পার্সিদের দেখতে পাওয়া যায়।

আধুনিক  শিক্ষায়ও তখন দ্রুতবেগে এগিয়ে আসেন পার্সিরা। একসময় পার্সি সমাজে শিক্ষা গ্রহণ ও জ্ঞান চর্চা শুধুমাত্র পুরোহিত ও ধর্মযাজক শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটিশ পরিচালিত স্কুলগুলোতে প্রথমবারের মত পার্সিসমাজের সাধারণ তরুণরাও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পান। লিখতে ও পড়তে শেখার পাশাপাশি তাঁরা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পান। ব্রিটিশ সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথেও তাঁদের পরিচয় ঘটে। ফলে তাঁরা নিজেদের আধুনিক ও ‘ব্রিটিশ’ ঢঙে গড়ে তুলতে শুরু করেন। নিজেদেরকে তাঁরা “ব্রিটিশদের মতই একটি জাতি” হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করেন, এবং নিঃসন্দেহে ব্রিটিশদের অনুসরণ ও অনুকরনে তাঁরা “উপমহাদেশের অন্যান্য সকল জাতির চেয়ে বেশি সফল ছিলেন।“।

এর সুফলও তাঁরা পেয়েছিলেন। উপমহাদেশের অন্যান্য জাতিগুলোকে যেখানে ব্রিটিশরা অনেকটাই অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতেন ও তাঁদের সমন্ধে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন, সেখানে পার্সিদের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। বিট্রিশদের মতে সাধারণ ভারতীয়রা ছিলেন, “অলস, অজ্ঞ, অযৌক্তিক, ও নতমস্তক তবে অন্তরে স্পর্ধা পোষণকারী”। কিন্ত পারসিদের সাথে নিজদের সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন তাঁরা । তাঁদের ভেতরে এমন কিছু গুণাবলী খুঁজে পান যা নিজেদের ভেতরেও বিদ্যমান। জোহান অ্যালব্রেক্ট ডি ম্যান্ডেলস্লো পার্সিদের আখ্যায়িত করেন পরিশ্রমী “নিষ্ঠাবান”, বিবেকসম্পন্ন ও তুখোড় ব্যাবসায়ী” একটি জাতি হিসেবে যারা বাণিজ্যে অগ্রগতি করার ব্যাপারে সদা তৎপর। জেমস ম্যকিন্টশের পর্যবেক্ষণেও ফুটে উঠে একই সুর, “ভারতের পার্সি সম্প্রদায় পৃথিবীর একদা পরাক্রমশালী একটি জাতির বংশধর যারা হাজার বছর পূর্বে নিষ্পেষণ ও অত্যাচার থেকে পালিয়ে ভারতবর্ষে এসে বসতি গেড়েছিলেন । বহু শতাব্দী দারিদ্রতা আর অবহেলার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকার পর অবশেষে তাঁরা নিজেদের যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন পেয়েছেন বর্তমান শাসকদের দ্বারা। কাছে। এই শাসক দের অধীনে তাঁরা দ্রুত এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যবসায়ী শ্রেণীর একটি হয়ে উঠতে পেরেছেন।"

এমন সফল ব্যাবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন উদ্যমী এক এজেন্ট যার নাম রুস্তম মানেক। ১৭০২ সালে তিনি ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম ব্রোকার হিসেবে নিয়োগ পান। কোম্পানীর প্রথম ব্রোকার হিসেবে তাঁকে শেঠ উপাধি দেওয়া হয়। অবশ্য এই পদে যোগ দেওয়ার পূর্বেই, ওলন্দাজ ও পর্তুগিজ শাসনামলে মানেক নিজের অবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন এবং আর্থিকভাবে যথেষ্ট সম্পদ ও সাফল্য অর্জন করেন। অঢেল সম্পত্তির মালিক হন। বিস্তর টাকা-কড়ি ছিলেন। তিনি ও তার কিছু সহযোগীদের বদৌলতে পার্সি সমাজের বহু লোক ব্যাক্তি কর্ম সংস্থানের সুযোগ পান। ফলে বছর খানেকের ভেতরে পার্সি সমাজের পেশাগত উন্নতির দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

ব্রোচ (বর্তমানে ভরুচ) অঞ্চলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কালেক্টর পদে নিযুক্ত জেমস ফোরবস তাঁর রচিত অরিয়েন্টাল মেমোয়ার্স (১৭৭০) গ্রন্থে লেখেন, বোম্বে ও সুরাট অঞ্চলের মুখ্য বিশিষ্ট প্রথম সারীর ব্যাবসায়ী ও জাহাজ মালিকদের তালিকায় অনেকেই পার্সি। শক্ত সমর্থ, কর্মতৎপর, সৎ এবং অধ্যাবসায়ী এই জাতিটি নিঃসন্দেহে কোম্পানির গর্ব ও জন্য বড় সম্পদ। হিন্দুস্তানের পশ্চিম তটের বহু জাতির মধ্যে তাঁরা অনন্য। তাঁরা কোম্পানির গর্ব এবং আপন নিজ সমাজেও যথেষ্ট সমাদৃত।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে চীন এবং ভারতের মধ্যে জলপথে বাণিজ্য শুরু হলে জাহাজ নির্মাণে পারদর্শিতা ও তীক্ষ্ণ ব্যবসায়িক বুদ্ধিকে পুঁজি করে পার্সিরা এই বাণিজ্যে দ্রুত সাফল্যের মুখ দেখেন। মূলত কাঠ, সিল্ক, তুলা ও আফিমের জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। ব্যবসা বানিজ্য চলত বেশি। আফিম ও তুলার সওদাগরি জামশেদজি জেজিভয় নামক এক পার্সি ব্যাবসায়ী বণিককে দ্রুত সাফল্য এনে দেয়।  যার ধারাবাহিকতায় সোরাবজি, মোদী, কামা, ওড়িয়া, জিজিভোয়, রেডমনি, দাদিসেথ, পেটিট, প্যাটেল, মেহতা, অলিব্লাস, টাটা  প্রমুখ পরিবারগুলো বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে।

বোম্বে শহরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পার্সি সমাজের যে ধরনের অবকাঠামোর প্রয়োজন ছিল তার অনেকটাই তাঁরা দিয়ে তৈরি করেন। ১৭২০ এর দশকে পার্সি সমাজের জীবন ও জীবিকার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে জায়গা করে নেয় বোম্বে শহর। যেখানে ১৭০০ সালে “শহরের বণিকে ও ব্যাবসায়ীদের নাম তালিকায় মুষ্টিমেয় কিছু পার্সি ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়, সেখানেই, মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে, পার্সি ব্যবসায়ীরা শহরে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান অংশ হয়ে দাঁড়ান।“

সামরিক বাহিনীতে পার্সি সম্প্রদায়

ব্রিটিশ আমল থেকেই সামরিক বাহিনীতে পার্সি সম্প্রদায় রেখেছেন উজ্জলতার স্বাক্ষর। সামরিক বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে পার্সি সম্প্রদায় ভারতকে উপহার দিয়েছে বিভিন্ন বিশিষ্ট সামরিক কর্মকর্তা । ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম ফিল্ড মার্শাল একজন পার্সি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ভারত মিত্র বাহিনীর জয়ের মূল পরিকল্পনাকারী ও কারিগর এবং প্রধান নায়ক একজন পার্সি, নাম স্যাম হরমাসজি ফ্রেমজি জামশেদজি ম্যানকেশ। তিনি ব্রিটিশ সামরিক সম্মাননা মিলিটারি ক্রস প্রাপ্ত।

নৌবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা প্রথম পার্সি সামরিক ব্যাক্তিত্ব অ্যাডমিরাল জল কুরসেটজি। ভারতীয় বিমানবাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান এয়ার মার্শাল অ্যাস্পি ইঞ্জিনিয়ার ও একজন পার্সি। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তীতে ভারতে চীফ অফ এয়ার স্টাফ পদে দায়িত্ব পালন করেন ও পরবর্তীতে এয়ার চিফ মার্শাল হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর এই একই পদে নিযুক্ত হওয়া ১৮তম ব্যাক্তিটিও আর এক জন পার্সি, নাম ফালি হোমি মেজর। 

ভারতীয় কোস্ট গার্ড বাহিনী প্রধান প্রধানের পদে দায়িত্ব পালন করা ১৭তম ব্যাক্তিও পার্সি, নাম আর. এফ. কনট্রাক্টর। এছাড়া আছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরদেশির বুর্জোরজি । তিনি ১৯৬৫ সনে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে শত্রুর হাতে নিহত হন, যার স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে “পরম বীর চক্র” পদকে ভূষিত করা হয় (মরণোত্তর)। এটি ভারতের সর্বোচ্চ সামরিক পুরষ্কার/পদক । লেফটেন্যান্ট জেনারেল এফএন বিলিমোরিয়া ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সিনিয়র অফিসার এবং কোবরা বিয়ার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা লর্ড করণ বিলিমোরিয়ার পিতা।

প্রাচীন পারস্যে ঋষি জরথ্রুষ্ট  ধর্মীয় মত প্রচার করেন যে জগতে শুভ এবং অশুভ দুই শক্তির বিচরণ রয়েছে। এই দুই শক্তি ক্ষমতা ও বলে একে অপরের সমকক্ষ । কিন্তু এরা একে অপরের প্রতিদ্বন্দী এবং সর্বদা লড়াই এ লিপ্ত। প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব শুভ শক্তির বা আলোর পথে আসা এবং অশুভ শক্তির কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা । জীবদ্দশায় মানুষ যে পথ অনুসরণ করবে মৃত্যুর পর সেই অনুযায়ী তাঁর গন্তব্য নির্ধারিত হবে। ফলে পার্সিরা একটি কর্মমুখী সম্প্রদায়। জন্মভূমি থেকে শত শত বছর পূর্বে চলে এসেও তাঁরা ভিন্ন সমাজ ও মানুষের মধ্যে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। শিক্ষায় ও আর্থিক দিক থেকে ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের শতভাগ মানুষ সফল। তদুপরি, স্বদেশের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ না থাকার পরেও চমৎকারভাবে তাঁরা ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ ও সংরক্ষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

   

বৃষ্টি নাকি ধান, কী প্রার্থনায় দেশ?



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
বৃষ্টি নাকি ধান, কী প্রার্থনায় দেশ?

বৃষ্টি নাকি ধান, কী প্রার্থনায় দেশ?

  • Font increase
  • Font Decrease

‘পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সঙ্কেত/ সবুজে হদুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত/ ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে/ ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলে শুয়েছে মাঠের পরে/ কৃষাণ কনের বিয়ে হবে, তার হলদি কোটার শাড়ী/ হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কটি রোদ রেখা নাড়ি/ কলমী লতার গহনা তাহার গড়ার প্রতীক্ষায়/ ভিনদেশী বর আসা যাওয়া করে প্রভাত সাঁঝের নায়।’ পল্লীকবি জসীম উদদীনের ‘ধান ক্ষেত’ কবিতার অপূর্ব চিত্রায়ন কৃষকের শ্রম-ঘাম আর প্রকৃতির তরফে। কাব্যে-পঙক্তির বিমূর্ত চিত্র মূর্ত হয়েছে বিস্তীর্ণ মাঠে। কিষান-কিষানির বুক ভরা আশার সার্থক রূপায়ন হতে চলেছে এ-মৌসুমে।

এখন ভরা বৈশাখ। এ-সময়টা বোরো ধানের। বোরো ধান দেশের খাদ্যচাহিদার অন্তত ৫৫ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। দেশের হাওরভুক্ত ৭টি জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরে এই বোরোর চাষ বেশি হয়ে থাকে। এই ধান অতিবৃষ্টি, বন্যা ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে দেশের খাদ্যচাহিদায় ঘাটতি পড়ে না। তাই এই ধান চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া, বিশেষ করে রোদের উপস্থিতি অতি জরুরি। বর্তমানে সে পরিস্থিতি চলছে।

সিলেট অঞ্চলের মানুষ বলে এই অঞ্চলের মানুষের চাওয়া-পাওয়া, হতাশা-উচ্চাশার সঙ্গে আমি পরিচিত। তাদেরকে উদাহরণ হিসেবে টানছি। তাদের সঙ্গে থেকে জেনেছি, বোরো মৌসুমে নির্বিঘ্নে ঘরে ফসল তোলা কতটা জরুরি। গবাদি পশুর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে জরুরি খড় সংরক্ষণও। তীব্র রোদ এখানে সমস্যার নয়, এটা বরং আনন্দের। কারণ এই রোদ গা পোড়ালেও বুক ভরা আশার সার্থক বাস্তবায়নের পথ দেখায়। দেশের যে খাদ্যচাহিদা, যে খাদ্যনিরাপত্তা সেটা এই বোরো ধানের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই চাষ থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে দরকার হয় প্রকৃতির সহায়তা। এবার এখন পর্যন্ত সে সহায়তা আছে, যদিও এ মাসের শুরুর দিকে একবার ঝড়বৃষ্টিসহ শঙ্কার কালমেঘ হাতছানি দিয়েছিল। সেটা আপাতত দূরে সরেছে।

কিষান-কিষানির দরকার এখন তীব্র রোদ। তারা এটা পাচ্ছে। দেশে তীব্র তাপদাহ। এখানেও এর ব্যতিক্রম নয়। তবু তারা এই রোদের প্রার্থনায় রয়েছে। বৃষ্টি এখন তাদের কাছে দুর্যোগ-সম। কারণ এই বৃষ্টি এবং অতি-বৃষ্টিসৃষ্ট বন্যা তাদের স্বপ্নসাধ গুঁড়িয়ে ভাসিয়ে নিতে পারে সব। ২০১৭ সালের দুঃসহ স্মৃতি এখনও বিস্মৃত হয়নি সুনামগঞ্জের কৃষকেরা। সে বছর সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৩৭ হাওরের ফসল বন্যায় এবার ভেসে গিয়েছিল। গতবার কৃষক নির্বিঘ্নে ফসল ঘরে তুলেছেন। এরআগের বছর অন্তত ২০টি হাওরের ফসলহানি হয়েছিল বন্যায়।

প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ক্ষেতের ফসল, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা। এখানে প্রচণ্ড তাপদাহ তাই প্রভাব ফেলে সামান্যই। রোদে পুড়ে, প্রয়োজনে ছাতা মাথায় দিয়ে কিষান-কিষানিরা স্বপ্ন তোলেন ঘরে। তারা বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা না করে বরং রোদ আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখার প্রার্থনায় বসেন। কৃষকেরা পরিমিত বৃষ্টি চায় চৈত্র মাসে, বৈশাখে চায় খাঁ খাঁ রোদ্দুর, কারণ এই রোদে সোনালী ধান ঘরে ওঠে। লোককথার প্রচলিত, ধান তোলার মৌসুমে ঝড়বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য হাওরবাসীরা তন্ত্রসাধক বা ‘হিরাল’ ও ‘হিরালি’-দের আমন্ত্রণ জানাতেন। তারা এসে মন্ত্রপাঠ করে ঝড়বৃষ্টি থামানোর জন্য চেষ্টা করতেন। লোকায়ত বিশ্বাস থেকে আগেকার মানুষজন এমন আচার পালন করতেন। এসবে সত্যি কাজ হতো কিনা সেটা বিতর্ক এবং ব্যক্তি-বিশ্বাসসাপেক্ষ, তবে এই হিরাল-হিরালিদের আমন্ত্রণ বলে বৈশাখে একদম বৃষ্টি চায় না হাওরের কৃষক।

হাওরপারের মানুষেরা যখন রোদ অব্যাহত থাকার প্রার্থনায়, তখন দেশজুড়ে তীব্র তাপদাহে পুড়তে থাকা মানুষেরা আছেন বৃষ্টিপ্রার্থনায়। দেশের জায়গায়-জায়গায় বৃষ্টি প্রার্থনায় ইস্তিস্কার নামাজ পড়া হচ্ছে, গণমাধ্যমে সচিত্র সংবাদ আসছে এর। কোথাও প্রবল বিশ্বাসে কেউ কেউ ‘ব্যাঙের বিয়ে’ দিচ্ছেন, এটাও বৃষ্টি প্রার্থনায়। সামাজিক মাধ্যমে গরমের তীব্রতার আঁচ মিলছে, বৃষ্টি নাকি ধান—কোনটা জরুরি এই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের প্রচণ্ড তাপদাহ নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রচণ্ড গরমে দেশের মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে প্রতিবেদন করেছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, এএফপি ও টাইমস অব ইন্ডিয়া। গণমাধ্যমগুলো বলছে, প্রচণ্ড গরমের কারণে টানা দ্বিতীয় বছর বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের ঘোষণাও এসেছে। বৃষ্টি-প্রার্থনায় নামাজের আয়োজনের কথাও এসেছে বিশ্বমিডিয়ায়।

একদিকে প্রচণ্ড তাপদাহ, অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তার প্রধান উপকরণ ধান ঘরে তোলার অনিশ্চয়তা—তবু অনেকের কাছে সাময়িক স্বস্তিই যেন মুখ্য। অথচ আর দিন দশেক বেরো আবাদ-এলাকায় বৃষ্টি না নামলে ধানগুলো ঘরে ওঠত কৃষকের। নিশ্চিত হতো খাদ্যনিরাপত্তার।

প্রকৃতির ওপর আমাদের হাত নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই; তবু মনে করি আমাদের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশে কৃষকদের গুরুত্ব থাকা উচিত। আমাদের চাওয়ায় হয়তো প্রকৃতির রীতি বদলাবে না, তুমুল রোদ্দুরের দেশে হঠাৎ বৃষ্টি নামবে না, তবে ধান ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত রোদ্দুর কামনায় কৃষক স্বস্তি পাবে; ভাবতে পারবে এই দেশ আছে তাদের সঙ্গে।

কৃষকের জয় হোক। অন্তত বোরো-এলাকায় প্রকৃতি কৃষকের সঙ্গে থাকুক।

;

৫০ বছর আগে মহাকাশ থেকে তোলা পৃথিবীর ছবি আজও শ্রেষ্ঠ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সালটা ১৯৬৮। বিশ্বব্যাপী মানুষ মেতে উঠেছিল বড়দিনের আনন্দে। তখনো জানতো না, বড়দিন উপলক্ষে তারা একটি বিশেষ উপহার পেতে চলেছে। পৃথিবী থেকে আমরা হরহামেশাই চাঁদ দেখি। অমাবস্যা-পূর্ণিমা, এমনকি পক্ষের মাঝামাঝি সময়ের বদৌলতে নানা দৃষ্টিকোণে নানা আকারের চাঁদ দেখতে পাই। তবে চাঁদ থেকে পৃথিবী দেখতে কেমন? এরকমটা হয়তো অনেকেই ভাবেন।

নাসার মহাকাশচারীরা অ্যাপোলো ৪ এ করে তখন চাঁদের চারপাশে টহল দিচ্ছে। সেখান থেকে তারা চাঁদের বাসকারীদের দৃষ্টিতে পৃথিবী কেমন হবে তার এক নমুনা জোগাড় করেন। ক্রিসমাসের কিছুদিন আগে ক্রুরা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করার সময় ব্যারেন লুনার হরিজোন থেকে একটি ছবি তোলে। সেখানে সুদূর মহাকাশ থেকে পৃথিবীর একটি সুন্দর দৃশ্য ধারণ করা হয়। চমৎকার সেই রঙিন ছবিটি সবকিছু পরিবর্তন করতে চলেছিল।

ছবিটি তুলেছিলেন মার্কিন নভোচারী বিল অ্যান্ডার্স এবং জিম লাভেল। ছবিটি ধারণ করার পর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে যান। অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরও এটিকে প্রকৃতির সবচেয়ে আইকনিক ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, এটিই মহাকাশ থেকে তোলা প্রথম রঙিন এবং উচ্চ রেজুলেশনের ছবি।

১৯৭০ সালে পরিবেশ সচেতনতা এবং এই ব্যাপারে সক্রিয়তা বাড়ানোর উদ্দেশে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে পৃথিবী দিবস প্রচারিত হওয়ার কারণে ছবিটিকে বিশেষ কৃতিত্ব দেওয়া হয়।

যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মাইকেল প্রিচার্ড ছবিটিকে নিখুঁত দাবি করেন। তিনি বলেন, এই ছবিটি পৃথিবীর এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছিল, যা আগে কোনো ছবি করতে পারেনি। প্রকাণ্ড মহাবিশ্বে পৃথিবীর অস্তিত্ব কতটা ক্ষুদ্র গ্রহ, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ছবিটি।

১৯৬০ সালের পরই পৃথিবী নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। ষাটের দশকের শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মানুষ অনুধাবন করে পৃথিবীকে আজীবন একইভাবে ব্যবহার করা যাবে না। গ্রহের প্রতি আমাদের আরও অনুরাগী হতে হবে। সেই উদ্দেশে ১৯৬৯, ‘৭০ ও ‘৭১ সালে ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ’, মার্কিন প্রতিষ্ঠান ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’ এবং ‘গ্রিনপিস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ছবিটি প্রকাশের ১৮ মাস পর ২০ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক পৃথিবী রক্ষার আন্দোলনে রাস্তায় নামে।

পৃথিবী রক্ষা করার জন্য মানুষদের উৎসাহিত করার বেলায় ছবিটি অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। এখনো অবদি মহাকাশ থেকে পৃথিবীর পাঠানো ছবিগুলোর মধ্যে ১৯৬৮ সালে বড়দিনের আগে তোলা সেই ছবিটিকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়।

;

মাঝরাতে আইসক্রিম, পিৎজা খাওয়া নিষিদ্ধ করল মিলান!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: স্কাই নিউজ

ছবি: স্কাই নিউজ

  • Font increase
  • Font Decrease

আইসক্রিম, পিৎজা অনেকের কাছেই ভীষণ পছন্দের খাবার। তবে ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে মাঝরাতে এসব মুখরোচক খাবার ও পানীয় খাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ইতালিতে জেলাটিনের তৈরি আইসক্রিম খুব বিখ্যাত। এজন্য ইতালিতে 'জেলাটো সংস্কৃতি' নামে একটা কালচার গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি ইতালির মিলানের বাসিন্দাদের জন্য একটি নতুন আইন প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিবেদন- স্কাই নিউজ।

মিলানে বসবাসকারীদের অধিকাংশই মাঝরাতে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে আইসক্রিম, পিৎজা, ফাষ্টফুড জাতীয় খাবার ও পানীয় পান করে থাকে। এতে করে সেখানকার এলাকাবাসীদের রাতের ঘুম বিঘ্নিত হয়। নতুন প্রস্তাবিত আইনে শহরবাসীর রাতের ঘুম নির্বিঘ্ন করতে মধ্যরাতের পর পিৎজা ও পানীয়সহ সব ধরনের টেকওয়ে খাবার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

তবে মধ্যরাতের পর আইসক্রিম নিষিদ্ধ করার চেষ্টা এবারই প্রথম নয়। ২০১৩ সালে, তৎকালীন মেয়র গিউলিয়ানো পিসাপিয়া অনুরূপ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু 'অকুপাই জেলাটো' আন্দোলনসহ তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরে তিনি এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

এরপর আবারও মিলানে এ আইনটি প্রস্তাব করেছেন ডেপুটি মেয়র মার্কো গ্রানেল্লি। দেশটির ১২টি জেলা এই প্রস্তাবের আওতাভুক্ত হবে বলে জানিয়েছে মিলান কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে মিলানের মেয়র গ্রানেল্লি বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিকতা ও বিনোদন এবং বাসিন্দাদের শান্তি ও প্রশান্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা।

প্রস্তাবটি নিম্নলিখিত এলাকাগুলোতে প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছে মিলান কর্তৃপক্ষ: নোলো, লাজারেটো, মেলজো, ইসোলা, সারপি, ভায়া সিজারিয়ানো, আরকো ডেলা পেস, কোমো-গাইআউলেন্টি, পোর্টা গ্যারিবল্ডি, ব্রেরা, টিসিনিজ এবং দারসেনা-নাভিগলি।

জানা যায়, প্রস্তাবটি মে মাসের মাঝামাঝি থেকে কার্যকর থাকবে এবং নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। এটি প্রতিদিন রাত ১২.৩০ টায় এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং সরকারী ছুটির দিনে রাত ১.৩০ টা থেকে প্রয়োগ করা হবে। তবে এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে নাগরিকদের মে মাসের শুরু পর্যন্ত আপিল করার এবং আইন পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়ার সময় রয়েছে।

 

 

 

;

অস্ট্রেলিয়ায় নিখোঁজ কুকুর ফিরলো যুক্তরাজ্যের মালিকের কাছে



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরতে এসে নিখোঁজ হয় যুক্তরাজ্যের এক দম্পতির পালিত কুকুর। যুক্তরাজ্যে আসার ১৭ দিন পর মিলো নামের কুকুরটিকে ফিরে পেয়েছেন জেসন হোয়াটনাল নিক রোল্যান্ডস দম্পতি।

হোয়াটনাল এবং তার সঙ্গী নিক সম্প্রতি তাদের কুকুর মিলোকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া পরিদর্শনে যান। তারা যখন সোয়ানসিতে বাড়িতে যাচ্ছিলেন তখন মেলবোর্ন বিমানবন্দরে তার হ্যান্ডলার থেকে কুকুরটি পালিয়ে যায়।

সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী কুকুরটিকে অবশেষে মেলবোর্নের শহরতলিতে ১৭ দিন পর খুঁজে পাওয়া যায়।


হোয়াটনাল স্কাই নিউজকে বলেন, ‘মিলোকে ফিরে পাওয়াটা খুবই আশ্চর্যজনক ছিল আমার জন্য। যখন আমি আমার প্রিয় মিলোর (কুকুর) সাথে পুনরায় মিলিত হয়েছিলাম, তখন আমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। আমার কান্না দেখে অন্যরাও কেঁদেছিল। এটি সত্যিই আবেগপ্রবণ ছিল।

তিনি আরও বলেন, বিশ্বের অন্য প্রান্তে থেকে মিলোর কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। আমরা জানতাম না মিলো কোথায় আছে। এটি বেশ হতাশাজনক ছিল আমাদের জন্য, কিছুটা আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাকে ফিরে পাবো ভাবিনি।

মিলোকে পাওয়ার জন্য সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছিলাম, তখন স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে সাহায্য আসে, তারা মিলোর সন্ধান দেয়। মিলোকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের ধন্যবাদ।

;