নাড়ির বন্ধনে হৃদয় পড়েছে বাঁধা, কলকাতা!



মোস্তফা মহসীন  
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

একটা বিস্ময়সূচক উক্তি এবং মৃদু উত্তেজনাময় আলোড়ন নিয়ে সিপিএম জমানার গল্প জানতে আমি আগ্রহী হলে; টাকমাথার রাশভারী চেহারার প্রবীণ লোকটি কোনো উত্তর না দিয়ে চশমাটা ঠিক করে নিলেন। অতঃপর পাশে রাখা খবরের কাগজে মনোযোগী হয়ে ওঠলেন।পাত্তা না পাবার বাজে অভিজ্ঞতা থেকে বেরুতেই কিনা হ্যাংলার মতো জানতে চাইলাম-কলকাতা মানেই ‘মাছে ভাতে কলকাতা’ নাকি ‘দই-রসগোল্লার কলকাতা’? এবার মেঘভাঙা বৃষ্টির মতোই বাক্যহীন সংযম ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে আচমকা বিদ্রুপময় হাসির ঝলক দেখালেন! জানালেন উপমা দুটির একটিও তার নিকট জুতসই মনে হচ্ছে না। সুদীর্ঘ জীবনাচরণগত দৃষ্টিভঙ্গিতে তার নিকট কলকাতা মানে কিন্তু ধর্মতলার মোড়ে রেঁস্তোরা বা ‘কেবিন’-এ বসে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ সারতে সারতে বাবুদের মতো পা দুলিয়ে দুলিয়ে অন্তত ডাবল হাফ চায়ের চুমুকে পরিতৃপ্ত হওয়া।

অতঃপর  ভদ্রলোকের সাথে খাতির জমাতে ধর্মতলা মোড়েই যেতে হলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই, দীর্ঘশ্বাস চেপে মৃদুস্বরে শৈশবে শোনা গল্পগুলোরই যেন তর্জমা করলেন। বাপের দেশ ছিল মানিকগঞ্জ। বর্ষাকালে সেখানকার ঝিলের পানিতে বৃষ্টির তরঙ্গ। বৃষ্টির মিষ্টি পানির ছোঁয়া পেয়ে ফসল ফলতো মাঠে। তরতরিয়ে মাচান জুড়ে বেয়ে ওঠতো কচি লাউয়ের ডগা। ফাগুন হাওয়ায় আন্দোলিত হতো যুবতীদের রেশমিচুল। ছোটবেলার সেই স্কুল, মাটির ঘর, বাঁশের বেড়া… তারপর তো এই ইট-পাথরের জীবনে যুদ্ধ করতে করতে হাফিয়ে ওঠা। এবারে ভদ্রলোক বুকের অতল গভীর  ছেনে, ভিতরের জমানো হতাশাটা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখলেন। তারপর প্রচণ্ড খেদ নিয়ে বললেন; একই দেশ, একই রকম মানুষ, একই ভাষা, একই জাতিসত্তা, শুধু ধর্মের কারণে দেশটাকে ভেঙে মানুষগুলোকে আলাদা করে ফেলা হলো। দেশভাগ ষড়যন্ত্রে সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে সম্ভ্রমহারা অগণ্য মানুষ হয়ে গেলেন উদ্বাস্তু!

এই দেশভাগের সীমানা নির্ধারণকারী ব্যক্তিটি স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিপ। আমার মনে ভদ্রলোকের জন্য এখন একটু করুণাই হচ্ছে; আহা! কতো কতো মানুষের অভিশম্পাত যে তার জীবনে জুটেছে!

বৃটিশ আইনজীবী রেড ক্লিফ আর কখনো ভারতবর্ষে আসেন নি

আলাপে আলাপে রাশভারী লোকটি অধিকতর নিকটতম হয়ে ওঠলে; তখন আমি আর তার কাছে ব্রাত্যজন থাকি না। স্মৃতির ঝাপি মেলে ধরে জানান, তখন ৮৩ কি ৮৪ সাল। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট জমানা। জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন গুলোর দাপটে সব কারখানায় শুরু হয়েছে লকআউট। তিনি শ্রমিক থেকে হয়ে ওঠলেন ট্রেনের হকার। নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে সে এক টাফ টাইম ছিল বটে; একেবারে দিশেহারা অবস্থা। তাদের মধ্যে যারা একটু-আধটু চটুল গান আউড়াতে পারতেন, তাদের অনেকেই ট্রেনে গান-বাজনা করে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে দিন গুজরান করতে থাকলেন। শেষমেশ শ্রমিক থেকে ভিখিরিতে অধঃপতনের ইতিহাসে সংক্ষুব্ধ হয়ে তিনিও আরও অনেকের মতো প্রথমে কংগ্রেস, পরে মমতা ব্যানার্জির পাঁড় সমর্থক বনে গেলেন।

তিনি আজও মনে করেন, বামেদের ট্রেড ইউনিয়ন বাজিতে ১৯৭৭-৮৭ এর মধ্যে ৮০ ভাগ প্রোডাকশন ইউনিট বন্ধ হয়েছে, নইলে তালা ঝুলেছে। চুরুটে আগুন ধরিয়ে চারপাশটা আবার সন্দিগ্ধ চোখে আচম্বিতে পরখ করে নিলেন। অতঃপর বাজখাঁই গলায় বলে ওঠলেন,

-যতোই ব্যাটল অব স্তালিনগ্রাদ, বলশেভিক রেভ্যলুউশন, লং মার্চের গল্প শুনে শিহরিত হোন না কেন; কলকাতার বাম জমানা স্ক্রুটিনি করলে মশাই আপনাকে ভিন্ন সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে!

-কিন্তু ওটা তো ছিল কেন্দ্রের অধীনে রাজ্য শাসন। কেন্দ্রকে উপেক্ষা করে কোনো বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার ছিল না সিপিএম বা জ্যোতিবসু বা বুদ্ধদেব কারোই। কেন্দ্র চাইলে রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করার অধিকার পর্যন্ত ছিল। আর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে কিছু ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অস্বাভাবিক নয়।

ডাবল হাফ চা

শেষমেশ নিজের নিজের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে বিনয়ের সাথে প্রবীণ লোকটি স্বীকার করলেন, সিপিএমের অপারেশন বর্গা ও ভূমি সংস্কার কর্মসূচিতে নিম্নবর্গের মানুষ ব্যাপক উপকৃত হয়েছে। শুধু নিম্নবর্গের হিন্দুরাই নয়, মুসলমানেরাও উপকৃত হয়েছে।

ভদ্রলোকের সাথে করমর্দন শেষ করে পা হাঁটা দিতেই, ডলার রুপিতে কনভার্ট করতে সহসাই একটি মানি এক্সচেজ্ঞ দোকান চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে। প্রয়োজন মিটিয়ে বাইরে বেরুতেই দেখছি প্রায় যাত্রীপূর্ণ বাসটা ফুল স্পিডে গন্তব্যের পথ ধরেছে। তার পাশেই লাইনে দাঁড়িয়ে লোকজন গোগ্রাসে গিলছে স্ট্রিটফুড। কলকাতা স্ট্রিট ফুডের  ‘বেতাজ বাদশা’ কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্য। চট-জলদি বানানো যায়, তাড়াতাড়ি খেয়েও ফেলা যায়। এটা যদি স্ট্রিট ফুডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয় তবে ‘রোল’ এক্ষেত্রে প্রথম। বাংলাদেশে ‘শর্মা’বলে পরিচিত খাদ্যটির কিছুটা কাছাকাছি কলকাতার ‘রোল’। ফুচকা, আলুকাবাব, তেলেভাজাই শুধু নয় আলু টিক্কি, বেলপুরি, লিট্টি চোখা’র মতো সর্বভারতীয় খাবারের সন্ধানও রাস্তার পাশেই অনায়াসে পেয়ে যাবেন।

ছোটবেলা থেকেই শুনছি, প্রতিবেশি দেশ হলো ভারত আর পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের কলকাতা সেই দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। ইউরোপের অন্যান্য অভিজাত শহরের মতো কলকাতা এবং ঢাকার মধ্যে নেই কোনো ভিসামুক্তির চুক্তি। তবে এটা মানতেই হবে যে ভাষা, জীবনধারা এবং ভূখণ্ডীয় আবেগ মিলিয়ে পদ্মা ও গঙ্গাপাড়ের লোকেরা এখন আগের যে কোনো সময়ের চাইতে কাছাকাছি।  

জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। যারপরনাই মাদকতায় প্রিয় গানের সুরে আবিষ্ঠ হয়ে আগেরদিন পৌঁছেছিলাম বেনাপোল বর্ডারে। আমার সাথে ভোর নাগাদ ওখানে বাংলাদেশের কাস্টমস-ইমিগ্রেশন সেরে নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে ভারতীয় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা। আমার মতোই যারা প্রথমবার যাচ্ছিলেন; তাদের ভেতরেও কাজ করছিলো গমনজনিত শিহরণ-রোমাঞ্চ। কিন্তু নানা উদ্ভট প্রশ্নে জেরবার করে মধ্যবয়সী এক ভারতীয় ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা এসব বাংলাদেশিদের রোমাঞ্চ কি; সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ভ্রমণের ক্লান্তিটাই ভুলিয়ে দেন! অনুভূতির ভ্রম বা হ্যালোসিনেশন তৈরি হয়। মনে হলো; বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উদার না হওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের দুই-একজন অফিসারই যথেষ্ঠ। মনে পড়লো আই কে গুজরাল সাহেবকে, পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি যে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ অনুসরণ করেছিলেন, তার মূল কথাই ছিল বৃহৎ দেশ ‘বড় ভাই’ হিসেবে ভারতকে বৃহৎ হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে।

কলকাতার সেই বিখ্যাত ট্রাম রাস্তা

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ এখন যেন স্রেফ নীতিকথা। তিস্তার জলের মতোই অধরা। এপাড়ে যখন জলশূন্য জনগণের দীর্ঘশ্বাস এবং সেই দীর্ঘশ্বাসের মাঝে জিইয়ে রাখা ভারত বিরোধিতা নিয়ে নির্বাচন মৌসুমে চায়ের কাপে আমরা দেখি ঝড়। আর ক্ষুদ্র প্রতিবেশিকে বঞ্চিত করে সীমান্তের ওপারে তখন ভোটের মৌসুমে বিজেপির দাদাদের জাতীয়তাবাদী দাম্ভিকতার ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’।

সব বাধা-বিপত্তি দূরে ঠেলে অবশেষে যখন পদযুগল স্পর্শ করেছিল বিশ্বকবি, জীবনানন্দ, শীর্ষেন্দু, সুনীল ও সমরেশের প্রিয় শহরে। গুনগুনিয়ে দুলে ওঠা চিত্তে হৃদমাঝারে তখন কে যে সুর তুলেছে- ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে/ তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ’। দেখেছিলাম  আন্তরিক অভ্যর্থনার সাথে হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়ার আদর্শ উপকরণ ক্যাফেইন নিয়ে সেখানে কীরকম পথ আগলে ধরেছিলেন- হরিদাসপুরের মুদি দোকানিরা? চা খেয়ে পুনরায় কলকাতা অভিমুখী নয়া বাস ধরতে ধরতে ভাবছিলাম উত্তরে দার্জিলিঙের হিমালয়, দক্ষিণে সুন্দরবন, এ রকম বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোন শহরে আছে? বাসের ভেতরে জানালা ছুঁয়ে দেখেছি, ছায়ামাখা অঘ্রাণের মিঠে রোদ্দুর ছড়ানো ধানি জমি। মেঠোপথে দুরন্ত গতিতে বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুল যাচ্ছেন কিশোরীরা। সবুজ মাঠে গরু চড়াতে শশব্যস্ত কিছু রাখাল। গাঁয়ের চা দোকান থেকে ভেসে আসা হিন্দি ছবির মাদকতা, সেই সুরে বুঁদ হয়ে পায়ের উপর অন্য পা তুলে নাচাচ্ছেন কেউ কেউ। পাতার বিড়ি, সিগারেট আর চায়ের ধোঁয়া মিলমিশে একাকার! দেখেছি, আরও দূরে শান বাঁধানো পুকুরে… স্নান শেষের লাবণ্য; জগতের সব পার্থিব পুণ্য নিয়ে গৃহে ফিরছেন পশ্চিমবঙ্গের রমণীকুল!

ওখানে পৌঁছার পর পার্ক স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট, মারকুইস স্ট্রিট, নিউমার্কেট ঘুরে ঘুরে দেখি। পছন্দসই হোটেল খুঁজে পেতে গিয়ে পেয়ে গেলাম নয়নাভিরাম একটি গেস্টহাউজ। মুকুন্দপুর জায়গাটা মন্দ না। প্রতি রাত্রিবাসের খরচ সেখানে মাত্র পাঁচশ রুপি। এসময় মধ্যবয়সী এক লোক হাত নেড়ে ডাক দিলেন। কাছাকাছি যেতেই বললেন, ‘নমস্কার, দাদা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, নাকি?’ হ্যাঁ বলতে না বলতেই জিজ্ঞাসা, বাড়ি কোথায়? সিলেট। ও চমৎকার জায়গা, আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি তো ওখানেই! ৪৭-এ দেশভাগের পর আমার বাবা এখানটায় চলে আসেন। আসলে বাংলাদেশের মানুষ কি যে ভালো!

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল

একটু পরেই তার মতলব টের পাই। যখন বলেন, ‘দাদা ডলার ভাঙাবেন নাকি? আপনি যে হোটেলে, সেটা তো খুবই খারাপ। আরো কমে ভালো হোটেল আপনাকে দিতে পারবো। দাদা, আর কিছু লাগলেও অনায়াসে বলতে পারেন। কারণ আমি আপনার দেশের লোক। কলেজ-ভার্সিটির সুন্দরী মেয়েছেলে আছে, লাগবে নাকি? একদম খাসা মাল!’

এবার লোকটিকে ভালোমতো পরখ করলাম; খোঁচা খোঁচা আধপাকা দাড়ি, গালের চোয়াল ভেঙে গেছে, পরনে সাদা ফতুয়া। এরকম দালালে যে গিজগিজ করছে গোটা কলকাতা, তা আগে থেকেই জানতাম। ‘ধন্যবাদ’ বলে তাই পায়ের গতি দ্রুতই বাড়িয়ে দিলাম।

কলকাতার ল্যান্ডমার্ক কোনটি এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে বিদেশিরা হাওড়া ব্রিজের চাইতে সবসময়ই এগিয়ে রাখেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলকে। ১৯০১-এ রানির মৃত্যুর পর মূলত কার্জন সাহেবের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিলো এ স্মৃতিসৌধ তৈরির কাজ। স্থাপত্যের মধ্যভাগের একটি ডোম বা গম্বুজ এটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। এই ডোমটির ঠিক নীচের ঘরটিকে বলা হয় ‘কুইন‘স হল’। চোখ বারেবারে সাঁতার কাটে, এই ডোমটির মধ্যস্থলে বসে থাকা বিউগল হাতে ডানা মেলা ব্রোঞ্জের সেই পরীটি দেখে!

নীচে, ভেতরে এই ঘরটির পাশ দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে চলে যাওয়া যায় ওপরে। ডোমটির গোলাকৃতি ঘিরে রেলিং দেওয়া পথ বেশ সুন্দর। এর মাঝেই ছড়িয়ে রয়েছে ১২টি বেশ বড় মাপের ছবি। আঁকিয়ে একজন উন্নত রুচির শিল্পী। বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রতিকৃতি আঁকিয়ে শিল্পী ফ্রাঙ্ক। ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত রানি ভিক্টোরিয়ার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী এই চিত্রশৈলীতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাজমহল এখনো দেখিনি, তবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে আমার কাছে ছবিতে দেখা তাজমহলের কাছাকাছিই মনে হলো।

পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে ফোনে কথা হয় আনন্দবাজার গ্রুপে কর্মরত কবি শ্যামল কান্তি দাশ এবং ঈশিতা ভাদুড়ীর সঙ্গে। এর মধ্যে ঈশিতা ভাদুড়ী এসে পরদিন কলেজ স্ট্রিটে দেখা করেন। উত্তর কলকাতায় বেড়ে ওঠা এবং ওখানটাতে পড়াশোনা করা ঈশিতা জানান, কলকাতা ঘুরতে হলে চোখে মেখে রাখতে হয় একটু কলকেতে আমেজ। হাঁটতে হবে শহরের হলুদ ল্যাম্পপোস্টের রাস্তায়। কলকাতাকে ভালোবাসতে হবে প্রাণখুলে আর ভালোবাসা অবশ্যই বিলিয়ে দিতে হবে হরেক রকম রঙে রাঙানো দেয়ালগুলোকে! তার কাছেই জানা হলো, কলকাতার নিজস্ব আরোও একটা বৈচিত্র্য আছে। সেটা হলো, এই শহরের মেয়েদের সাজগোজে। আগে থেকেই নাকি ২৯টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের সাজসজ্জার একটা নিজস্বতা ছিল। যাকে বলে কেতা। এখন সকলেই যেন একই স্রোতে গা ভাসিয়েছে। সকলেরই স্ট্রেট চুলে রং করা। মুখে  হাল্কা মেক আপ। কাকে কী মানায়, সেটা না ভেবেই সকলে এখন হতে চায় আল্ট্রা-মডার্ন। ইদানীং পুজার সময়েও অনেকের পরনে থাকে টপস এবং জিন্স!

কলকাতা নিউ মার্কেট

সেই দুপুরে খাসির মাংস দিয়ে ভরপুর খাইয়ে তিনি আমাকে নিয়ে ছুটলেন মান্না দে ক্যাফেতে; যখন জানলেন হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে তার জন্য জমা আছে অনেক ভালোবাসা! শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাল জমানার কফি কর্নারের কাছে বেশ কোনঠাসা মান্না দে’র কফি হাউস। তবু মনে হলো এক কাপ কফি, কিছু স্ন্যাক্স, হালকা গান আর বই মিলিয়ে লিজেন্ডকে স্মরণ; মন্দ হয় না!

তখন শেষ বিকেল, আলোয় দিনান্তের রূপ। কফির উষ্ণতায় আর বাংলাদেশিদের প্রতি শ্রদ্ধামাখা মুগ্ধতার গল্পে মজে, কখন যে চলে এসেছি হাওড়া ব্রিজে টের পাইনি। হুগলি নদীর তীরে দুই যমজ শহর কলকাতা আর হাওড়ার এটি সংযোগ রক্ষাকারী ব্রিজ। এটির অভিনবত্ব হলো, একটিও নাট-বল্টু লাগাতে হয়নি। আবার ব্রিজটির দিকে ভালো করে তাকালে দেখবেন, কোন পিলার বা স্তম্ভ ছাড়াই ব্রিজটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদি পন্টুন ব্রিজ বা ভাসমান সেতুটিই পরবর্তী সময়ে নতুন নির্মাণে হাওড়া ব্রিজ। যার পোশাকি নাম ‘রবীন্দ্র সেতু’।

শহরে গরম অত্যাধিক। দূষণের সাথে ক্ষয় বেড়েছে। চোখ বুলিয়ে দেখলাম ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা আগের চাইতে ক্ষীণ হয়েছে; তার সঙ্গে দর্শনধারীদের শরীরের উপর মৃদু বাতাসে মশার ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে, কখনো কামড় বসাচ্ছে মুখের উপর, কখনো নেচে বেড়াচ্ছে জলের উপর দলবদ্ধভাবে। তবু নতুন ব্রিজটির বয়স ছিয়াত্তর হলেও শরীরে জরা থাবা বসায়নি। স্বাস্থ্য টাল খায়নি একটুও! মোহময়ী সন্ধ্যার সোডিয়াম আলোয় হাওড়া স্টেশনে এসে ট্রেন ফেল করা মানুষের মতোই আমিও অনেকটা অবাক বিস্ময়ে দেখছি লোহার নকশার জাল! শিল্পের কী অসাধারণ বুনট!

উল্টোদিকের রাস্তার পাশেই একটি গাছের বিস্তীর্ণ শাখা-প্রশাখার ভেতরেই ঝলমল করে ওঠলো চাঁদ। সে আলোয় কেমন যেন রুপোর মতোন ঝিকমিক করে ওঠলো পাতাগুলো। ফিরছি মুকুন্দপুরের ঢেরায়। এই মুহূর্তে বাসে তারা মাত্র জনাকয়েক যাত্রী। বাকিরা একে একে নেমে গিয়েছে নিজেদর গন্তব্যে। কন্ডাক্টর সারাদিনের ডিউটি সেরে এখন ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ঝিমোতে ব্যস্ত। সে অলস দৃষ্টিতে দেখে নিল চতুর্দিকটা। একদিকে এক বৃদ্ধ হাঁড়িমুখ করে বসে আছেন। আবার পাশাপাশি চারজন নারী-পুরুষ য়ৌথভাবে আসনে। কোনো নারী সিট ফাঁকা দেখেও অন্য আসনে যাচ্ছেন না। কোথাও নেই পুরুষালি অভব্যতা। তাঁর ঠিক দুটো সিট পরেই এক সুন্দরী যুবতীর পাশে আমি। পরিচয়ে জানা হল নাম মিত্রা দেবী। সাকিন নিউ আলিপুরের। 'ইটসি বিটসি' নামে জনপ্রিয় খাবার প্রতিষ্ঠানে খাবার সাপ্লাই করেন। বলেন, আমি প্রায় ৫ বছর ধরে হোম মেড খাবার তৈরি করে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছি। তবে সম্প্রতি আমি আমার স্কুলের জব ছেড়ে দিয়ে পুরোটা সময়ই পরিবারকে এবং আমার এ কাজে দিচ্ছি। প্রতিমাসে প্রায় ১৪০০ জনের খাবারের অর্ডার সরবরাহ করি আমি। ভারতীয় রীতিতে নমস্কার জানিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন তিনি। যাবার আগে প্রাণবন্ত হাসিতে যেন রেখে গেলেন নারীবাদের জয়োল্লাস!  

হাওড়া ব্রিজ

সতেরশো রুপি দিয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনের টিকিট কাটি। এবারের গন্তব্য রাজধানী দিল্লী। যেখানকার লাড্ডু খুবই বিখ্যাত! খেলে পস্তাতে হয় আবার না খেলেও! তবু পর্যটকের চোখে এঁকে রেখেছি কলকাতার প্রতিটি মুহূর্ত যেমন এর বনেদীয়ানার স্বাক্ষর বহন করা পুরনো অভিজাত দালান, আর তার মাঝখানের সরুগলির পুরনো কলকাতা। আর অন্যদিকে চকচকে আধুনিক স্থাপত্যের সল্টলেকের নিউ কলকাতা।

অন্যপৃষ্ঠায় থাকা ঘোড়ার গাড়ি, জীর্ণ ঘুপচি দালাল-বাড়ি। মধ্যবিত্তের পরিশ্রান্ত মুখাবয়ব। লোকাল বাস আর মেট্রোয় গাদাগাদি করে ঝুলে ঝুলে নারী-পুরুষের কর্মস্থলে যাওয়া-আসা। রাস্তাজুড়ে হকারদের চিৎকার, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে পুরো জাতির দুই ভাগ হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্রিকেটপ্রীতি, এই ম্যাটার অব সাবজেক্টে ঢুকে পড়লে- কলকাতা আর ঢাকা তখন আলাদা থাকে না। যেন অবিচ্ছিন্ন সংযোগ শহর। বাঙালির অস্তিত্ব থেকে একে পৃথক করে মুছে ফেলা যায় না বলেই কিনা মনের গোপন মেমোরি কার্ডে আজও সাজিয়ে রেখেছি প্রিয় কলকাতার জন্য কয়েকছত্র:

পথের পাথর থেকে জলস্রোত ঝরে না কখনো/আমাকে ডাকে তোমার জনস্রোতে লেপ্টে থাকা সেই চেনা দৃশ্য/ সল্টলেক, কলেজস্ট্রিট, র্ধমতলার মোড়.../ দুঃখের মহড়া পায়ে কলকাতা ছুটে ঘরছাড়া স্রোতের মানুষ!/ দু’পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে জ্ঞান ও বোধের সড়কে আমিও তোমাকে ছুঁই/ শুনি ভোরের স্বপ্ন ভেঙেচুরে র্প্রাথনায় বসা দু’পারের মানুষের মৌনবাণী/ ভাষার পবিত্র শক্তি একদিন বদলে দেবে সীমান্তের জ্যামিতি!

   

সাংবাদিকের ফেসবুকে পোস্ট: মিললো আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর, ইজিবাইক



রাকিবুল ইসলাম রাকিব, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) করেসপন্ডেন্ট
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৭৭ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের স্ট্রোক হয়েছে একাধিকবার। এই বয়সে যখন তার বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম করার কথা, তখন তাকে একটি রিকশার প্যাডেল মেরে অবিরাম ছুটে চলতে হয় ঢাকার রাস্তা-ঘাটে।

দিন শেষে যা আয় হয়, তার একটা অংশ নিজের জন্য রেখে, বাকিটা পাঠাতেন গ্রামে থাকা বৃদ্ধ স্ত্রীর কাছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবেই চলছিল তার দিনকাল।

হাবিবুরের ইচ্ছে ছিল, শেষ বয়সের সময়টা তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কাটাবেন। কিন্ত সেখানে থাকার মতো ঘর ও জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকায় বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতে হতো তাকে।

হাবিবুরের দুরবস্থার খবর জানার পর সে বিষয়ে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক জ. ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।

সে পোস্টটি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তার উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর উপহারের সুখবর পান হাবিবুর। পাশাপাশি হাবিবুরের কর্মসংস্থানের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী তাকে একটি ইজিবাইক উপহার দেন।

এতে করে গ্রামের ফেরার ইচ্ছা ও গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলেছে এই অসহায় বৃদ্ধের।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সহনাটি ইউনিয়নে সোনাকান্দি গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহারের ইজিবাইকের চাবি হাবিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি সোনাকান্দি গ্রামে এই বৃদ্ধের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর জীবিকার তাগিদে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন হাবিবুর রহমান। সংসারে তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের সবাই গরিব ঘরে বিয়ে হওয়ায় বাবাকে দেখার সামর্থ্য নেই তাদের। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে মাত্র আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই হাবিবুর রহমানের। সে কারণে বাধ্য হয়েই ঢাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় রাত্রিযাপন করতেন রাস্তায় রাস্তায়।

এদিকে, রিকশাচালক হাবিবুর রহমানের দুরবস্থা নিয়ে গত ২৫ এপ্রিল সাংবাদিক জ.ই. মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। পোস্টটি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের। এরপরই নির্দেশনা আসে হাবিবুরকে তার এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার।

ওপর থেকে নির্দেশনা আসার পর গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ সোনাকান্দি গ্রামে গিয়ে হাবিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শনে করে দেখেন, তার মাত্র আধা শতাংশ জমি রয়েছে। এটুকু জমিতে ঘর নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিপত্তি বাধে। এ সময় হাবিবুর রহমানের জমির পাশেই দুই শতাংশ জমি দানের ঘোষণা দেন সহনাটি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. দুলাল আহমেদ। ইতোমধ্যে, জমির দলিল সম্পাদন হয়ে গেছে। শিগগিরই ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

হাবিবুর রহমান বলেন, সারাজীবন কষ্ট করেছি। আধা শতাংশ ভিটে ছাড়া নিজের আর কিছুই ছিল না আমার। সাংবাদিক মামুন ভাইয়ের লেখালেখির কল্যাণে এখন বাড়ি ও একটি ইজিবাইক হয়েছে। এখন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আমার দিন ‘রাজার হালে’ কাটবে। আমি অনেক আনন্দিত ও খুশি। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাসহ যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ বলেন, বৃদ্ধ বয়সে হাবিবুর রহমানের রিকশা চালানো নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুনের একটি পোস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তার প্রেক্ষাপটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাবিবুরকে নিজ গ্রামে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ইজিবাইক উপহার দিয়েছেন। এছাড়াও হাবিবুর ও তার স্ত্রীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে।

 

;

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;