প্রকৃতি থেকে নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে ডাহুক
নদীমাতৃক বাংলাদেশের আরেকটি বৈশিষ্ট্য বিল-হাওরময় জলাভূমি। এগুলোতেই পরিবেশের জন্য অত্যন্ত উপকারী প্রাণীদের বসবাস। যারা জলাভূমির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নীরবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ প্রাণীগুলোর একটি হলো ডাহুক।
প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংসের কারণেই প্রকৃতি থেকে মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে ডাহুক। গ্রামবাংলার জলাভূমিতে আগের মতো চোখে পড়ে না তারা। প্রকৃতিক জলাভূমি এদের প্রধান আশ্রয়স্থল। পুকুর, খাল, বিল, নদীর বাঁক প্রভৃতি জায়গাগুলো তাদের প্রিয়।
শাপলা-পদ্মর ফাঁকে ফাঁকে দিব্বি দাঁড়িয়ে থাকতে বা লুকতে পারে। কচুরিপানার উপর দৌঁড়ঝাপ দিতে পারে অনায়াশে। তবে বর্ষা মৌসুমে এদের তুলনামূলকভাবে ডাহুক বেশি দেখা যায়। এদের ইংরেজি নাম White-breasted Waterhen এবং বৈজ্ঞানিক নাম Amaurornis phoenicurus। পুরুষ এবং স্ত্রী পাখি দেখতে একই রকম। একেকটি ডাহুক প্রায় ১৮০ গ্রামের মতো ওজন হয়ে থাকে।
বন-বাদাড়ে বা জলাভূমিতে ঘুরে বেড়ানো গ্রামীণ এই পাখিটিকে নিয়ে লোকসাহিত্যে নানান রচনা রয়েছে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, রূপসীবাংলা’র কবি জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ কবিরা তাদের লেখনিতে ডাহুকের কথা উল্লেখ করেছেন।
এক সময় পোষা পুরুষ ডাহুক দিয়ে বুনো ডাহুক শিকার করা হতো। বেঁধে রাখা পোষা ডাহুকটি খোলা জায়গায় কোনো প্রাকৃতিক ডাহুককে দেখলে যখনি তেড়ে আসে তখনি শিকারীর ফাঁদে আটকা পড়ে যায়।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো- অন্য পাখিদের মতো ডাহুকের বাচ্চাদের মা বা বাবা মুখে খাবার নিয়ে খাইয়ে দেয় না। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মেই বাচ্চাগুলো ১৫/২০ ফুট উঁচু থেকে লাফ দিয়ে নামে মাটিতে।শরীরটা পাতলা বলে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়লেও তাদের কিছুই হয় না। মাটিতে নেমেই বাচ্চাগুলো মা-বাবার পিছনে পিছনে হেঁটে হেঁটে খুঁটে খুঁটে খাবার খায়। ডাহুকের ছানাগুলো পুরো শরীরটা তুলতুলে নরম আর কালো রঙের। ওরা প্রকৃতিগতভাবে আত্মগোপনে পরদর্শী হয়ে থাকে।
প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ও লেখক শরীফ খান বলেন, ডাহুক কমে যাওয়া মূল কারণ তাদের আবাসস্থল অর্থাৎ তারা যেখানে বসবাস করে সেটা ধ্বংস হওয়া। আমাদের চারপাশ থেকে থেকে তো প্রাকৃতিক জলাভূমিসহ ঝোপঝাড় ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। তাই এগুলো উপর আশ্রয় করে থাকা পাখিগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে।
তাছাড়াও আরো একটি বিশেষ কারণ হলো - গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত-কুশিক্ষিত কবিরাজ-ওঝারা এই ডাহুকের মাংশ, তেল প্রভৃতি শারীরিক অংশ মানুষের নানা চিকিৎসায় ব্যবহার করে থাকে। ফলে ডাহুকের প্রয়োজন পড়ায় ফাঁদ দিয়ে জলাভূমিতে ডাহুক ধরা হয়। নানাভাবে শিকার করা হয়। যেজন্য এই পাখিটি মরাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখিন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি আরো বলেন, এককালে গ্রামবাংলায় পোষা ডাহুক যেমন তেমনি বুনো ডাহুকও ছিল। ওরা বাসা বেঁধে ডিম পাড়ার পর বেশি ডাকতো। রাতভর একটানা ডাকতে শুনা যায়। এ ডাক শুনলে মনে হয় ওরা যেন ব্যথা বা কষ্ট থেকে ডাকছে। আসলে তা নয়; এ ডাক মনের আনন্দের বর্হিপ্রকাশ।
এর স্বভাব ও শারীরিক বর্ণনা সম্পর্কে শরীফ খান বলেন, ডাহুক চতুর ও সতর্ক প্রকৃতির পাখি। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ভীরুও বটে। প্রচন্ড জোরে ছুটতে পারে বলে তাদের তুখোড় দৌঁড়বিদ বলা হয়। এদের দৈর্ঘ্য ৩২ সেন্টিমিটার। মাথা থেকে গলা পর্যন্ত সামনের দিকে সাদা রঙ এবং পেছনের দিকে কালো রঙের দৃশ্যমান ছাপ রয়েছে। হলদে ঠোঁটের গোড়ায় লাল রঙের সৌন্দর্য রয়েছে।
জলজউদ্ভিদের ডগা, ধান, নানান ধরণের শস্যবীজ, জলজ পোকা-মাকড়, শ্যাওলাও এদের খাদ্য বলে জানান পাখি বিশেষজ্ঞ শরীফ খান।