রাতের খাবার খেয়ে একটু হাঁটতে বের হয়েছি। হেমন্তের হিমেল বাতাসে শীতের আগমনী জানান দিচ্ছে। আর আকাশে উঠেছে তখন রাস পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের স্বচ্ছ মায়াবী আলোয় বিশ্বচরাচর সিক্ত হয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের কবি-লেখকেরা যুগে যুগে এই চাঁদের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে সৃষ্টি করেছেন কত-শত অপূর্ব সাহিত্যকর্ম; তার কোনো হিসেব আমরা জানি না!
এই মায়াবী চাঁদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই কখনো বিশ্বকবি রবিঠাকুর বলে গেছেন, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা তোমার, গন্ধসুধা ঢালো।’ আবার কখনো রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বলে গেছেন, ‘বেবিলন কোথা হারায়ে গিয়েছে-মিশর-অসুর কুয়াশাকালো; চাঁদ জেগে আছে আজও অপলক, মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!’
আর কখনো সকল রোমান্টিকতাকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়ে কঠিন বাস্তবতার নিরিখে কবি সুকান্ত বলেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়, পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’
চাঁদের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিলাম। তখনই মনে পড়লো, আমার বাড়ির থেকে ৫/৭ মিনিটের হাঁটা-পথের দূরত্বেই রাস-উৎসব হচ্ছে। ভাবলাম হাঁটিহাঁটি পা-পা করে একটু দেখেই আসি। চলে গেলাম মধুপুরের ‘মদন গোপাল আঙিনায়’। টাংগাইলের মধুপুর উপজেলায় ‘শ্রী শ্রী মদন গোপাল বিগ্রহ মন্দির’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২৯৮ বঙ্গাব্দে। প্রায় ১৩০ বছর পুরানো এই মন্দির। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজশাহী জেলার পুঠিয়া নিবাসী মহারাণী শ্রীমতী হেমন্ত কুমারী দেবী।
প্রতি বছরই এই মন্দিরে রাস-উৎসব পালিত হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালি বৈষ্ণব মতাদর্শীদের প্রাণের উৎসব এই রাসপূর্ণিমা। এছাড়া মণিপুরীদের প্রধান উৎসব এই রাসপূর্ণিমা। মন্দিরে গিয়ে দেখি লীলা-কীর্তন হচ্ছে। একদল কীর্তনীয়া লীলা-কীর্তন গাইছে আর ভক্তেরা শ্রীকৃষ্ণের সেই লীলা'র মহিমা ভক্তিভাবে গানে গানে সুরে সুরে শুনছে।
কীর্তন শেষে অনুষ্ঠিত হলো রাধাকৃষ্ণের পূজা। পূজা শেষে দেখলাম, ভক্তরা রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে চক্রাকারে ঘোরাচ্ছে। বিগ্রহটা মূলত রাধাকৃষ্ণ এবং গোপিনীদের মাটির মূর্তি দিয়ে তৈরি। রাধাকৃষ্ণের মূর্তিকে কেন্দ্রে রেখে বৃত্তাকারে গোপিনীদের মূর্তি। আর এই পুরো বিগ্রহটি একটা চাকাযুক্ত চক্রাকার কাঠামোতে উপবিষ্ট করা। যাকে সহজেই চক্রাকারে ঘোরানো যায়।
রাসপূর্ণিমা'র মাহাত্ম্য: পদ্মপুরাণে শারদরাস এবং বাসন্তীরাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বাসন্তীরাসের উল্লেখ থাকলেও শারদরাসের উল্লেখ নেই। শারদরাসের কথা বলা আছে শ্রীমদ্ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণে। শারদরাস মূলত কার্তিক মাসের শেষ পূর্ণিমাতে পালন করা হয়। বস্ত্রহরণের দিন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর গোপিনীদের কথা দিয়েছিলেন, পরবর্তী পূর্ণিমা-তিথিতে তিনি গোপিনীদের সাথে রাস-উৎসব করবেন।
কৃষ্ণের বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে গোপিনীরা সংসারের কর্তব্যজ্ঞান ভুলে বৃন্দাবনে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের পায়ে নিজেদেরকে নিবেদন করেছিল। কৃষ্ণ তাদেরকে বারবার স্ব-গৃহে ফিরে যেতে বললেও, গোপিনীবৃন্দ সেই অনুরোধ মানে নাই।
গোপিনীদের একমাত্র কামনা ছিল শ্রীকৃষ্ণকে একান্তে নিভৃতে পাওয়া। তাদের বিশেষ ভক্তি আর অনুরোধে কৃষ্ণ তাদের নিকটে এলেই তারা ভাবছিল, কানাই শুধু তার একার। যখনই এরকম ভাবছিল তখনই কৃষ্ণ তাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। আর গোপিনীরা গভীর বিরহে কাতর হচ্ছিল। ভগবান কারো একার সম্পত্তি নয়। ঈশ্বর সকলের। এই সারকথা বোঝানোর জন্যই কৃষ্ণ এই রাসলীলা করেছিলেন।
গোপিনীরা ভক্তিভাবে আচ্ছন্ন হয়ে যখন শ্রীকৃষ্ণের এই সারকথা অনুধাবন করতে পারলো, তখন তিনি 'যতজন গোপিনী ততজন কৃষ্ণ' রূপে সকলের সাথে রাসনৃত্য করলেন। রাস-উৎসব মূলত জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের কথা। এটি দৈনন্দিন জীবনের সুখানুভূতিকে আধ্যাত্মিকতায় রূপায়িত করার উৎসব। মানুষের কামপ্রবৃত্তিগুলোকে প্রেমসূচক করে তোলার উৎসব এই রাসপূর্ণিমা।
কীভাবে শুরু হলো এই উৎসব?: জনশ্রুতি আছে, বৈষ্ণব মতাদর্শের প্রবক্তা শ্রীচৈতন্যদেবের হাত ধরেই এই উৎসব প্রথম শুরু হয়। সেই দিক থেকে দেখলে ১৬ শতকের দিকে এই উৎসব নবদ্বীপে পালিত হওয়া শুরু হয়। যদিও চৈতন্যদেবের পরবর্তী সময়ে নবদ্বীপে বৈষ্ণবীয় ধারার চক্র-রাস উৎসব পালন একটু ফিঁকে হয়ে যায়। এবং চক্ররাসের পরিবর্তে শাক্ত-রাস উৎসবের সূচনা ঘটে। শাক্ত-রাস মূলত মদ-মাংস এবং আড়ম্বরপূর্ণ জৌলুস সমৃদ্ধ উৎসব।
প্রধানত যেসব জায়গায় রাস-উৎসব পালিত হয়: ভারতের মথুরা, বৃন্দাবন, নবদ্বীপ, নদীয়ার শান্তিপুরে এই উৎসব খুব ধুমধামের সাথে পালন করে ভক্তরা। এটাকে মূলত শান্তিপুরের ভঙ্গারাস বলা হয়ে থাকে। এছাড়া ওড়িশা, আসাম এবং মনিপুরে এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসবের অংশ হিসেবে অঞ্চলভেদে কথ্থক, ভারতনাট্যম, ওড়িশি, মণিপুরি প্রভৃতি শাস্ত্রীয় ও লোকায়ত নৃত্যসুষমার ব্যবহার দেখা যায়।
নবদ্বীপে শাক্তরাস খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়ে থাকে। এখানে রাধাকৃষ্ণ ছাড়াও সকল দেবদেবীরই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এটি নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ উৎসব। এখানে এই উৎসবকে ঘিরে নির্মিত হয় চমৎকার সব মূর্তি। অপরূপ কারুকার্যময় নির্মাণশৈলী এবং বিচিত্র রূপকল্পে নানান শক্তিরূপের নির্মিত মূর্তিকে পূজা করার মধ্য দিয়েই এই উৎসব নবদ্বীপে পালিত। এছাড়া নবদ্বীপের কোথাও কোথাও অনাড়ম্বরভাবে চক্র-রাসও পালিত হয়।
আগেই বলেছি, এটি মণিপুরিদের সবচেয়ে বড় উৎসব। কথিত আছে, আঠারো শতকের দিকে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র বাংলাদেশে এই উৎসবের প্রথম প্রচলন করেন। সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামন্ডপে প্রতি বছর এই উৎসব বিরাট কলেবরে পালিত হয়। লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম ঘটে এই উৎসবে।
এইদিন কৃষ্ণের বিগ্রহকে ঘিরে কুমারী মেয়েরা নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। ১৭৭৯ খ্রীস্টাব্দের দিকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নৃত্যগীতের সমন্বয়ে এই উৎসবের প্রচলন ঘটান মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র। ভাগ্যচন্দ্রের মৃত্যুর পর মহারাজ চন্দ্রকীর্তির শাসনামলে রাসনৃত্যকে আচৌকা, বৃন্দাবন, খুড়ুম্বা, গোস্ট, গোস্ট বৃন্দাবন ইত্যাদি ভঙ্গিমায় মণিপুরিদের মাঝে রাসনৃত্য ছড়িয়ে দেন।
রাসলীলা উৎসব শুরু হয় মূলত গোষ্ঠলীলা থেকে। গোষ্ঠলীলায় ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা গোপালের মতন রাখাল সেজে গোষ্ঠনৃত্য করে এবং গরু চড়াতে যায়। পাশাপাশি চলতে থাকে মণিপুরিদের নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসব। মণিপুরি সমাজে রাসনৃত্য ছয় ভাগে বিভক্ত। এগুলো হলো মহারাস, নিত্যরাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, গোপীরাস ও উদুখলরাস।
এবং সুন্দরবনের দুবলার চরে রাস উপলক্ষে ভক্তদের জন্য তীর্থ-স্নানের আয়োজন হয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশ এবং ভারতের বাঙালি অধ্যুসিত বিভিন্ন অঞ্চলে এই রাস-উৎসব পালন করা হয়।
রাধাকৃষ্ণ হচ্ছে সেই নাম যাঁদের সাথে অমর প্রেমকাহিনী জড়িয়ে আছে। তখনও রোমিও-জুলিয়েটের প্রেমকাহিনী মানুষের কাছে পৌঁছায় নাই। আর সেই মধ্যযুগ থেকেই এই প্রেমকাহিনী বাঙলার মানুষের হৃদয়ের গল্প হয়ে আছে। আমাদের বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের কবিগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে তাদের শৈল্পিক ভাষা আর ছন্দে করে তুলেছেন অমর।
ভক্তিবাদীরা আর বৈষ্ণব মতাদর্শের মানুষেরা রাধাকৃষ্ণকে ঈশ্বরের সিংহাসন থেকে নামিয়ে নিজেদের ঘরের আসনে রক্তমাংসের মানুষের মতন প্রেমের-প্রতীক হিসাবে স্থান দিয়েছে। আমাদের বাংলাসাহিত্যের অন্যতম সোনালী যুগ হচ্ছে বৈষ্ণব-পদাবলীর যুগ। বৈষ্ণব-পদাবলীর মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি মহাকালের মহান মহান কবিদের। যাঁরা ভক্তিভাবে প্রেমের কথা বলে গেছেন যুগের পর যুগ ধরে।
কবি বৃন্দাবন দাস'র একটি পদের কথা এইখানে বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি লিখেছিলেন; কৃষ্ণ রাধাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘শুন রাধে এই রস আমি যে তোমার বশ, তোমা বিনে নাহি লয় মনে। জপিতে তোমার নাম ধৈরয না ধরে প্রাণ, তুয়া রূপ করিয়ে ধেয়ানে।’ গল্প বলতে শুরু করেছিলাম পূর্ণিমার চাঁদকে নিয়ে, কথা বলতে বলতে নিতাই-চাঁদের গল্পে এসে থামলাম।
চাঁদের গল্প বলতে গেলে তো প্রেম আসবেই। যুগে যুগে রোমান্টিকতার কথায় যখনই চাঁদ এসেছে তখনই তো প্রেমের কথাও উঠেছে। ভবা পাগলার সেই গানের কথা মনে পড়ছে। মনসুর ফকির সুন্দর করে গেয়েছিলেন-‘আমার নিতাই চাঁদের বাজারে, গৌর চাঁদের দরবারে, একমন যার সেই যেতে পারে। ও ভাই সেই যেতে পারে।’
প্রেম তো তাই, যা একমনে একপ্রাণে করতে হয়। কায়মনোবাক্যে নিষ্কামভাবে প্রেমই তো মানুষকে শান্তি দেয়। জীবনের দিকে হাঁটতে আস্বস্ত করে।
প্রাচীন বোহেমিয়া রাজ্য বা আজকের চেক প্রজাতন্ত্রে ভ্রমণ ট্রিপে ইউরোপের পশ্চিম থেকে পূর্বে ভিয়েনা, ব্রুনো হয়ে স্বর্গীয় শহর প্রাগে প্রবেশের রোমাঞ্চকর অনুভূতির তুলনা হয় না। তারপর "নাইট ওয়াক ইন দ্যা সিটি অফ প্রাগ" মানেই লাইফটাইম মেমোরি। তবে, প্রাগে নামেই রাত, বাস্তবে খুঁজতে হবে "কোথায় রাত ?" রাতের যেন পড়ন্ত বিকেল। আকাশে তখনো কটকটে রোদ। বাতাসে বসন্তের রেশ।
পশ্চিম ইউরোপ যেমন জার্মানিক, পূর্ব ইউরোপের প্রাগ শহরে তেমনই প্রধানত স্লাভিক ট্রাইবদের বাস। চেক ভাষায় প্রাগের নাম প্রাহা। যার অর্থ হল ‘ford’ বা ‘rapid’। আক্ষরিক অর্থে ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে পেরোতে হয় এই অঞ্চল যেখানে নদীর গভীরতা অত্যন্ত কম। মানুষ আর ঘোড়াও সেই তিরতির করে বয়ে চলা অগভীর নদীর মধ্যে দিয়ে অনায়াসে এককালে পেরিয়ে চলত। এখন সেখানে ছোট্ট ব্রিজ হয়েছে। এই হলো প্রাহা নামটির উৎসমূল।
দেশ হিসেবে চেক প্রজাতন্ত্র কিংবদন্তির ভাণ্ডার। বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী স্লেভিক রাজকন্যা লিবিউসে অসাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী করতেন । পাহাড়ের মাথায় তিনি আর তার স্বামী রাজপুত্র প্রেমিস্ল শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্য শাসন করতেন। একদিন পাহাড়ের মাথায় উঠে, ভ্লাতাভা নদীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে তিনি বললেন, অদূর ভবিষ্যতে এই শহর হয়ে উঠবে পূর্ব ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শহর। খ্যাতির শিখরে পৌঁছবে তার শিল্প-কলা-কৃষ্টির উৎকর্ষতায়। শাসন বানালেন একটি বিশাল দুর্গ বানিয়ে চলেছিল। রাণীও বললেন, ওইখানেই সেই চরম শহরায়ণের সব লক্ষণ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ভাবীকালে ফলেও গেল তাদের কথা। পূর্ব ইউরোপের হৃৎপিণ্ড স্বরূপ গোড়াপত্তন হলো চেক রিপাব্লিকের। রাজধানী হলো প্রাহা, বিশ্ববাসী যাকে ডাকে প্রাগ।
চেক দেশের সুরম্য রাজধানী প্রাগ দর্শন করতে হয় বাসে চড়ে। প্রথমে নামতে হয় পাহাড়ের মাথায় স্ট্রাহভ মনাষ্ট্রি দেখতে। মনাষ্ট্রিতে রয়েছে বিয়ার ব্রুয়ারি। সেখান থেকে দুর্গ শহর প্রাগের অতি সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়। এই ভিউপয়েন্টে গিয়ে চেকের বিশিষ্ট সন্ত সেন্ট নরবার্টিনের বৃত্তান্ত সচিত্র জানা যায়।
স্ট্রাহভ মনাস্ট্রিতে সেন্ট নর্বার্টিনের রেলিক্স রাখা রয়েছে। আছে প্রকান্ড লাইব্রেরি, বিশাল বইয়ের সম্ভার, ব্যাসিলিকায় ফ্রেসকো ভার্জিন মেরীর মোটিফ। ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সবকিছুই সযত্নে সংরক্ষিত। পাশেই রাখা রয়েছে প্রকাণ্ড এক অর্গ্যান, যা বাজিয়ে বিশ্বসেরা সুরসম্রাট মোৎজার্ট বলেছিলেন, এমন বড় ও সুন্দর অর্গ্যান তিনি আর কোনোদিনো বাজাননি।
বাসের পাশাপাশি প্রাগ দেখতে হয় পায়ে হেঁটে। প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারে ঘোরার মজাই আলাদা। প্রাগ কিন্তু শিল্প, সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত ছুঁয়ে আগন্তুক পর্যটকদের নিয়ে যায় ফিজিক্স বইয়ের পাতায়। কারণ, জোহান কেপলার ও টাইকো ব্রাহের জ্যোতির্বিদ্যার অনেক কিছু আবিষ্কার ঘটেছিল এই প্রাগ শহরে। পথের ধারে দুই বিজ্ঞানির স্ট্যচু প্রমাণস্বরূপ আজো দৃশ্যমান।
কথিত আছে, দুই দিকপাল জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে আর জোহানেস কেপলার ভাগ্যের টানে আসেন প্রাগে। টাইকো ব্রাহে ছিলেন উৎকৃষ্ট পর্যবেক্ষক আর কেপলার ছিলেন গণিতজ্ঞ। এই প্রাগেই টাইকো ব্রাহে কেপলারকে তার সহকর্মী করলেন। আকাশে হঠাৎ টাইকো দেখতে পেলেন অদ্ভুত সুপারনোভা। কেপলার তা থেকে অঙ্ক কষে সূত্র তৈরি করলেন। বিজ্ঞানের সাধনায় একে অপরের পরিপূরক ছিলেন তারা।
প্রাগের হটস্পট সেন্ট নিকোলাস চার্চ। কোবলস্টোনের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নির্বিঘ্নে পৌঁছা যায়। কেননা, প্রাগের সবকিছু সংরক্ষণই অতি সুন্দর। অথচ এরা দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরেও নিজেদের অনেক ভেঙেচুরে আবারো অনেক সুন্দর করে গড়ে তুলেছে। সবকিছু রেখেছে চমৎকার, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি।
ট্রাম প্রাগের মনোরম বাহন। রাস্তা আর ট্রামলাইনের চলেছে পাশাপাশি। কি অপূর্ব এই স্ট্রীটকারের মায়াবী নেটওয়ার্ক। সারা শহরের অলিগলি রাজপথ থেকে ক্রিসক্রস ভাবে রঙীন সুন্দর সুন্দর ট্রাম চলে যাচ্ছে অনবরত। আর এরা কত সুন্দরভাবে এই যানটিকে ব্যাবহার করে সেটাই দেখবার বিষয়। প্রাগের ট্রামের নেটওয়ার্ক চেক রিপাবলিকের মধ্যে সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে বৃহৎ।
প্রাগের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা যায় নিরাপদে ও অবলীলায়। জেব্রাক্রসিংয়ে পা দিয়ে ট্র্যাফিক লাইট মেনেই চলাচল করে সবাই। যান বা মানুষ, কারোই তাড়া নেই। নিয়ম ভাঙার কথা তো অকল্পনীয়। নিজস্ব ছন্দময় গতিতে সবাই চলছে নিজস্ব পথে। পশ্চিম ইউরোপের মতো রুদ্ধশ্বাস দৌঁড়ে চলার ছিটেফোঁটাও নেই পূর্ব ইউরোপের প্রাগে।
প্রাগে চোখে পড়বে অসাধারণ রেনেসাঁ স্থাপত্য। সমগ্র ইউরোপই নবজাগরণের মূলভূমি। চারিদিক স্থাপত্যকলা, ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। প্রাগের লেসার টাউন হলো নান্দনিকতার চূড়ান্ত প্রকাশস্থল। লেসার টাউন স্কোয়ারের ল্যান্ডমার্ক হল রাজকীয় সেন্ট নিকোলাস চার্চ। ওল্ড টাউন স্কোয়ারের কেন্দ্রবিন্দুতে এই চার্চ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চেক আর্মির ঘাঁটি ছিল এই নিকোলাস চার্চ। চার্চটির সংরক্ষণে সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রম আর নামীদামী স্থপতিদের পরিশ্রমে শিল্পকলায় ভরে উঠে চার্চের অন্দর ও বাইরের মহল। সেন্ট নিকোলাস চার্চটি একাধারে গীর্জা অন্যধারে ক্লাসিকাল কনসার্টের অন্যতম প্রেক্ষাগৃহ বা মঞ্চ।
চার্চের বাইরে থিকথিক করছে রেস্তোঁরা, পাব, দোকানপাট, ব্যুটিক আর প্রাগের বিখ্যাত মানুষ, ধনী লোকজনের ব্যারক স্টাইলের ঘরবাড়ি। ইন্টারন্যাশানাল এমব্যাসিগুলোও এখানে। এই ব্যারক স্টাইল হল অত্যন্ত সুন্দর স্থাপত্যে নির্মিত বাড়ি। জানলার নীচে খোদাই করা মানুষের মুখ, বাড়ির ছাদের প্যারাপেটে পরী কিম্বা প্রবেশ পথে জীবজন্তুর অসামান্য আর্কিটেকচার। পুরণো শহরের অনুপাতে অনেকটাই ছোট বলে এর নাম লেসার টাউন।
চলতে চলতে প্রাগে পাওয়া যাবে অনেকগুলো ট্যানেল। মনে হবে একফালি অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে আবারো বড় রাস্তায় আসা হয়েছে। ডাকলেই পাওয়া যাবে প্রাইভেট ট্রামের একটি কামরাকে। ম্যাজিকের মত ট্রাম এসে দাঁড়াবে সামনে। উঠে পড়তে হবে টুক করে। তারপর সুন্দর অনুভূতিতে স্বপ্নের মত সন্ধ্যেয় প্রাগের ট্রামে চড়া আর একটা গলির মুখে অবতরণ করে পাথরের রাস্তা দিয়ে এক বিয়ার ব্রুয়ারীর মধ্যে প্রবেশ করা। বোহেমিয়ান বিয়ার বিশ্ববিখ্যাত। কোনও এক 'বিয়ার পাবে' সান্ধ্য আড্ডার অভিজ্ঞান শিহরণ জাগানিয়া। বিশাল সুদৃশ্য কাটগ্লাসের মাগে বিয়ার হাজির হবে। এককোণায় প্রৌঢ় বাজিয়ে চলেবেন একর্ডিয়ানে চেনাঅচেনা গানের সুর। আলো আঁধারিতে মায়াময় পরিবেশ তৈরি হবে।
রহস্যে মোড়ানো ঘন্টাখানেক পর পাব থেকে বেরিয়ে এলে আলোকমালায় সজ্জিত রোমান্টিক প্রাগের রাজপথে উঁকি দেবে সামনে। দূরে দেখা যাবে বিখ্যাত ইউনিভাসিটি অফ প্রাগ, যেখানে এলবার্ট আইনস্টাইন থিওরিটিকাল ফিজিক্সে অধ্যাপনা করেছিলেন। পাশেই রয়েছে চারজন মিউজিশিয়ানের অনবদ্য স্ট্যাচু, যা প্রাগের বিখ্যাত স্থাপত্যগুলোর একটি। চারজনের হাতে চারটি বাদ্যযন্ত্র। স্থপতির কল্পনায় বিশ্বের বৃহত্তম চারটি নদী আমাজন, মিসিসিপি, গঙ্গা এবং দানিয়ুব-এর এক অনবদ্য কলতান এই চার বাদ্যশিল্পী চোখ বন্ধ করে বাজিয়ে চলেছে । চার নৃত্যরত শিল্পীর চোখ বাঁধা। তাদের হাতে ম্যান্ডোলিন, ভায়োলিন, বাঁশী ও ট্রামপেট।
ভ্লাতাভা নদীর ওপরে প্রাগের ঐতিহাসিক চার্লস ব্রিজ। ব্রিজে বিশাল চওড়া হাঁটার পথ। ব্রিজের ডাইনে বাঁয়ে সব পিলারের মাথায় দন্ডায়মান সারেসারে স্থাপত্য। রাজ পুরোহিত সেন্ট জন নেপোমুকের স্ট্যচুটি সর্বপ্রধান, যে স্ট্যাচুর মাথার চারিপাশ দিয়ে একটি ধাতব রিংয়ে পাঁচটি সোনালী স্টার খচিত। ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ঠিক ওই স্থানটি থেকে তাঁকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন রাজা। কারণ পুরোহিতের কাছে রাজা তাঁর রাণীর স্বীকারোক্তির কথা জানতে চেয়েছিলেন এবং পুরোহিত তা জানাতে চান নি। অতি জাগ্রত এই স্ট্যাচুটি ছুঁলে নাকি মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। স্থানীয় মানুষ ব্রিজের গায়ে ছোট ছোট তালা লাগিয়ে দেয়, অনেকটা মাজারে গিয়ে লাল সূতো বাঁধার মত। নদীর ওপরে পুরণো ব্রিজ, নতুন ব্রিজ রাতের রূপসী প্রাগ শহরকে উন্মোচিত করে বহুবর্ণা আলোকমালায়।
যদি সেই রাতে আকাশে কৃষ্ণা চতুর্থীর চাঁদ থাকে, কিংবা ঘুটঘুটে অন্ধকারে পায়ে হেঁটে রূপসী প্রাগের পথ চলার শেষে পাওয়া যাবে প্রাগৈতিহাসিক ভৌতিক অনুভূতি। ছমছম করে ওঠবে গা। চোখের পলক পড়বে না একবারও। কানে ভাসবে প্রাগের পৌরাণিক উপাখ্যান। মাথাকাটা এক সাধুর গল্প, যার অতৃপ্ত আত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায় মনাষ্ট্রির সিঁড়িতে। সেই সাধু অভাবের তাড়নায় নিজের মাথা কেটে দেন। হেডলেস মঙ্কের গল্প শুনে মনে হবে সামনে নিজের বাড়ি বা হোটেল নয়, অশরীরী আত্মায় ভরা তেপান্তরের দিগন্তব্যাপী মাঠ।
প্রাগের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য সেন্ট অ্যাগনেস মনাষ্ট্রি, যার সামনে রয়েছে 'পাউডার গেট'। প্রাগের গথিক শৈলীতে নির্মিত টাওয়ার সহ প্রবেশদ্বার যেন মুঘল সম্রাটের 'বুলন্দ দরওয়াজ' অথবা 'গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া' বা 'ইন্ডিয়া গেট'। এই প্রবেশদ্বার প্রাগের ওল্ডটাউনকে নিউটাউন থেকে পৃথক করেছে। সেখানেও রয়েছে নানা গল্প। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, সেন্ট এগনেস নামে এক রাজকন্যা আট বছর বয়সে বাগদত্তা হন আরেক দশ বছরের রাজপুত্রের। কিন্তু বিয়ের পর সংসারে বীতরাগ জন্মানো আর কৃচ্ছ্রসাধনে ব্রতী হয়ে ভক্তিমার্গে বিচরণের যান তারা। ওল্ড টাউন অঙ্গনের ওয়েসনেসডে স্কোয়ার'-এ এ গল্প মশহুর, বোহেমিয়ার প্যাট্রন সেন্ট-এর নামে এই স্কোয়ারের নাম।
এই ঐতিহাসিক স্থানটি হল প্রাগের হেরিটেজ সাইট। মধ্যযুগে এখানে ঘোড়ার বাজার ছিল। তারওর বোহেমিয়ান রাজা চতুর্থ চার্লসের নিউ টাউন স্কোয়ার বানানোয় তা পুরনো শহরে পরিণত হয়। এখন আলোয় ঝলমলে প্রাগের নিউটাউন। রাতের আলোয় ন্যাশানাল মিউজিয়াম, Wenceslas মনুমেন্ট এক অদ্ভূত রোমান্টিক স্থান। আর ওল্ড টাউন গা ছমছম রূপকথা জগতের মতো ধূসর ও রহস্যঘেরা।
"নাইটস অফ দ্যা ক্রস স্কোয়ার" হলো প্রাগের বিখ্যাত রাজপথ, টুরিস্টদের অন্যতম গন্তব্য। ডিজিটাল ক্লিকে, সেলফি স্টিকে রাজকীয় রাতপরী প্রাগের ছবি ক্যামেরায় ধরে সবাই এখানেই। এই পথ ও স্কোয়ার অন্যদিকে চার্লস ব্রিজকেও ছুঁয়েছে। স্কোয়ারের মধ্যখানে রাজা চতুর্থ চার্লসের বিশাল সেমি-গথিক স্ট্যাচু ।
শহরের আলোয় ঝলমলে অতিপ্রাচীন প্রাগ যেন যৌবনউদ্ভিন্না। চালর্স ইউনিভার্সিটির ৫০০ বছর পূর্তিতে রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে স্মারক নির্মিত হয়েছে। স্কোয়ারের আশপাশের গথিক স্টাইল অট্টালিকার প্যারাপেটে দাঁড়িয়ে সারে সারে ভাস্কর্য। অপূর্ব নন্দন দৃশ্য প্রাগের সর্বত্র উদ্ভাসিত করে রেখেছে।
পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের শহর প্রাগের নিজস্বতা অক্ষুণ্ণ হলেও সেখানে পশ্চিম ও দূরপূর্ব ইউরোপের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। প্রাগ যেন নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলন ও সঙ্গমস্থল। বিশেষত পাশের বলকানের প্রভাব প্রাগে অলঙ্ঘনীয় রূপে পরিব্যাপ্ত। বলকান অঞ্চল বলতে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চলকে বোঝায়। এর পূর্বে কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিমে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর। দানিউব, সাভা ও কুপা নদীগুলো অঞ্চলটির উত্তর সীমানা নির্ধারণ করেছে। বুলগেরিয়া থেকে পূর্ব সার্বিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বলকান পর্বতমালার নামে অঞ্চলটির নাম এসেছে।
বলকান অঞ্চলের সন্নিহিত চেক প্রজাতন্ত্র ঐতিহাসিকভাবে বোহেমিয়া নামেও পরিচিত মধ্য ইউরোপের একটি ভূবেষ্টিত রাষ্ট্র। দেশটির দক্ষিণে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে জার্মানি, উত্তর-পূর্বে পোল্যান্ড এবং দক্ষিণ-পূর্বে স্লোভাকিয়া অবস্থিত। চেক প্রজাতন্ত্র দেশটিতে রয়েছে পাহাড়ি ভূমি যা প্রায় ৭৮,৮৭১ বর্গকিলোমিটার (৩০,৪৫২ বর্গমাইল) অঞ্চলে বিস্তৃত এবং এর অধিকাংশেই নাতিশীতোষ্ণ মহাদেশীয় ও মহাসাগরীয় জলবায়ু বিদ্যমান। দেশের মধ্যভাগে অবস্থিত বৃহত্তম শহর ও রাজধানী প্রাগ। অন্যান্য শহরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বার্নো ও অস্ত্রাভা।
নবম শতাব্দীর শেষের দিকে মোরাভিয়ার অধীনে বোহেমিয়ার ডাচি প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে ১০০২ সালে রোমান সাম্রাজ্যের একটি ইম্পেরিয়াল রাজ্য হিসাবে এটি স্বীকৃত হয়েছিলো এবং ১১৯৮ সালে এটি একটি রাজ্যে পরিণত হয়। ১৫২৬ সালে মোহাচের যুদ্ধের পর, বোহেমিয়ার পুরো সাম্রাজ্যটি ধীরে ধীরে হাবসবার্গ রাজতন্ত্রের সাথে একীভূত হয়। এসময় প্রোটেস্ট্যান্ট বোহেমিয়ান বিদ্রোহ ত্রিশ বছরব্যাপী হোয়াইট মাউন্টেনের যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। যুদ্ধের পর হাবসবার্গরা তাদের শাসনকে সুসংহত করে। ১৮০৬ সালে রোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সাথে সাথে এসব ভূমি অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে, চেক ভূমি আরও শিল্পোন্নত হয়ে ওঠে এবং ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পতনের পরে এর বেশিরভাগ অংশ প্রথম চেকোস্লোভাক প্রজাতন্ত্রের অংশ হয়ে ওঠে। চেকোস্লোভাকিয়া মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের একমাত্র দেশ ছিল, যা আন্তঃযুদ্ধকালীন সময়কালে সংসদীয় গণতন্ত্র বজায় রেখেছিল। ১৯৩৮ সালের মিউনিখ চুক্তির পর নাৎসি জার্মানি পদ্ধতিগতভাবে চেক ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৯৪৫ সালে চেকোস্লোভাকিয়া পুনরুদ্ধার করা হয় এবং ১৯৪৮ সালে একটি অভ্যুত্থানের পরে এটি পূর্ব ব্লকের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সরকার ও অর্থনীতির উদারীকরণের প্রচেষ্টা ১৯৬৮ সালের প্রাগ বসন্তের সময় সোভিয়েত-নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের মাধ্যমে দমন করা হয়। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরের 'মখমল বিপ্লব' দেশে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটায়। ১ জানুয়ারি ১৯৯৩ তারিখে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে যায় এবং এর সাংবিধানিক রাজ্যগুলো চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
প্রাগ বা প্রাহা চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৩তম বৃহত্তম শহর। এছাড়াও বোহেমিয়ার ঐতিহাসিক রাজধানী। ভুলটাভা নদীর তীরে অবস্থিত এ শহরে ১.৩ মিলিয়ন মানুষের বাস, যখন তার নগর জোনগুলোতে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাস বলে অনুমান করা হয়। শহরে নাতিশীতোষ্ণ মহাসাগরীয় জলবায়ু বিদ্যমান। এখানে গ্রীষ্মকাল অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এবং শীতকাল অপেক্ষাকৃত শীতল।
প্রাগ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র, এক সমৃদ্ধ ইতিহাস যাকে পূর্ণতা দিয়েছে। রোমানেস্ক স্থাপত্য যুগে প্রাগ শহর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গথিক, রেনেসাঁ, বলকান ও বারোক স্থাপত্য যুগে এর বিকাশ ঘটে। প্রাগ বোহেমিয়া রাজ্যের রাজধানী এবং কয়েকজন পবিত্র রোমান সম্রাটের বাসস্থান ছিল। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা চতুর্থ চার্লস (শা. ১৩৪৬-১৩৭৮ খ্রি)। এটি হ্যাব্সবার্গ রাজ্যের এবং অস্ট্রো-হাংগেরীয় সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর কমিউনিস্ট আমলের মধ্যবর্তীকালে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী হিসাবে বোহেমীয় ও প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার, ত্রিশবর্ষীয় যুদ্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে এটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।
প্রাগ কিছুসংখ্যক বিখ্যাত সাংস্কৃতিক আকর্ষণের কেন্দ্র, যাদের অনেকগুলো বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের সহিংসতা ও ধ্বংসের পরেও টিকে রয়েছিল। এর প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে 'প্রাগ ক্যাসল' (প্রাগ দুর্গ), চার্লস ব্রিজ, (প্রাগ জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়িযুক্ত) ওল্ড টাউন স্কয়ার, ইহুদি কোয়ার্টার, পেট্রিন পাহাড় ও দুর্গ।
১৯৯২ সাল থেকে প্রাগের বিস্তীর্ণ ঐতিহাসিক কেন্দ্র ইউনেস্কোর 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট' তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শহরটিতে দশটির অধিক বড় বড় জাদুঘর, অসংখ্য নাট্যশালা, গ্যালারি, সিনেমা এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। একটি সম্প্রসারিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা শহরটিকে সংযুক্ত করেছে। এখানে বহু সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় আছে। প্রাগের 'চার্লস ইউনিভার্সিটি' মধ্য ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। গ্লোবাল এন্ড ওয়ার্ল্ড সিটিজ রিসার্চ নেটওয়ার্ক-এর গবেষণা অনুযায়ী প্রাগ 'আলফা-গ্লোবাল সিটি' হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ। ২০১৯ সালে মারসার কর্তৃক শহরটি পৃথিবীর ৬৯তম সর্বাধিক বাসযোগ্য শহরের মর্যাদা লাভ করে। একই বছর পিকসা ইন্ডেক্স প্রাগকে পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য ১৩তম শহরের স্থান দেয়। শহরটির সমৃদ্ধ ইতিহাস তাকে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করেছে। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী শহরটিতে প্রতি বছর ৮.৫ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক দর্শনার্থী ভ্রমণে আসে। ২০১৭ সালে প্রাগ লন্ডন, প্যারিস, রোম, ইস্তানবুলের পর সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী গ্রহণকারী ৫ম ইউরোপীয় শহর হিসাবে তালিকাবদ্ধ হয়।
প্রাগ ভ্রমণের উৎকৃষ্ট সময় মে থেকে আগস্ট মাস। চেক রিপাবলিকের ক্যাপিটাল প্রাগে যেতে যেকোনো ইউরোপিয়ান শহর থেকেই ফ্লাইট নেওয়া যায়। অথবা টুরগ্রুপের সাথে গেলে তারা বাস বা ট্রেন প্রোভাইড করে। হট টুরিস্টপ্লেস প্রাগে সবধরণের হোটেলের রমরমা। প্রত্যেক হোটেলেই বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট ইন্ক্লুডেড।
প্রাগ এমন এক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রোমান্টিক শহর, যাতে রয়েছে স্বর্গীয় ছোঁয়া, প্রাকৃতিক পরশ ও ঐতিহ্যের দ্যোতনা। প্রাগ শহরকে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের শেষে বিদায় জানিয়েও রেহাই পাওয়া যায় না। জীবনের বাঁকে বাঁকে স্বপ্নে এসে ধরা দেয় প্রাগসুন্দরী। মনে হয়, যে শহরে হাঁটতে আরও আরও পথ বাকী। অনায়াসে, অবলীলায়, জীবনভর যে শহরকে নিজের একান্ত শহরের মতো বুকে লুকিয়ে রাখা যায় এবং কখনোই বিদায় জানানো যায় না।
ইউরোপের আধুনিক কবি Mitchell Duran যা বিবৃত করেছেন কাব্যিক ব্যাঞ্জনায়:
"Goodbye Prague, to a city
I never thought I'd know.
Goodbye Prague, to a heaven
that is lined with shattered beer bottles and stamped out cigarettes
the junkies and the hobo's here still manage to get a few puffs out of."
ডালের শেষ মাথায় বসে আছে ফুলমাথা-টিয়া। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক
ফিচার
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশমুখে একঝাঁক টিয়ার ডাক। নির্জনতা ভেঙে ডেকে ওঠে একত্রে। কমে আসা আলোয় নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত ওরা। অন্যান্য সঙ্গীদের অনুসারি হতে চাচ্ছে তাদের কেউ কেউ। তাই তাদের এমন সম্মিলিত শব্দধ্বনি!
পাখিটির নাম ‘ফুলমাথা-টিয়া’। তবে আরও একটি বাংলা নাম হলো হীরামন পাখি। এর ইংরেজি নাম Blossom-headed Parakeet এবং বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula roseata। ছবিতে প্রকাশিত পাখিটি পুরুষ ফুলমাথা-টিয়া। একই প্রজাতির পাঁচ-দশটি পাখির ছোট দলে এদের দেখা যায়।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, ফুলমাথা-টিয়া চা বাগান সংলগ্ন বন আর পাহাড়ি পরিবেশের বিরল পাখি। একে আপনি অন্য কোথাও পাবেন না। এরা বৃক্ষবহুল এলাকার পাখি। শুধু সিলেট বিভাগের চিরসবুজ ও চা বাগানেই এদের পাওয়া যায়। কৃষ্ণচূঁড়া, শিমুল প্রভৃতির মোটা মোটা ফুলের রসালো পাপড়ি, বিভিন্ন ফল, কিছু পাতা, কুঁড়ি, ফুলের মিষ্টি রস, শস্যদানা এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে।
বিকেলের পড়ন্ত আলোয় রাঙা ফুলমাথা-টিয়া। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক
এদের দৈহিক বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাখিটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৬ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখিটির মাথা গোপালি; দেহের প্রায় পুরোটাই ঘাস-সবুজ। মাথার চাঁদির সামনের অংশ ঘাড় গোলাপি-লাল। ঠোঁটের উপরটা ফিকে-কমলা এবং ঠোঁটের নিচ বাদামী। চোখ হলদে। থুতনি ও গলায় কালো লাইন। আর স্ত্রী পাখিটি ফিকে-ধূসর নীল মাথা ও থুতনি ছাড়া পুরু দেহই সবুজ। তবে গলার পিছনটা হলদে-সবুজ ও ঠোঁট ফ্যাকাসে।
পূর্ব থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ফুলমাথা-টিয়ার বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে বলে জানান ইনাম আল হক।
পরিবেশ ধ্বংস সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের দেশে বনের সংখ্যা এমনিতেই কম। এক্কেবারে হাতে গোনা। তারপরও যেটুকু রয়েছে তাও নানাভাবে ক্রমশ উজার ও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাই এই ফুলমাথা-টিয়াসহ নানা জাতের পাখি ও বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করতে প্রাকৃতিক বনগুলো যে কোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
সৃজিত বাগান নয়; আমরা বারবার প্রাকৃতিক বনের কথা বলেছি এবং মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। অর্থাৎ বছরের পর বছর ধরে শতসহস্র ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ-লতাগুল্মের মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে যে প্রাকৃতিক বন। প্রাকৃতিক বন কখনই মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। মানুষ শুধু পারে এই প্রাকৃতিক বনগুলোকে রক্ষা ও সম্প্রসারণ করতে। মানুষের তৈরি বন হলো সৃজিত বাগান। এই প্রাকৃতিক বনই দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বন থাকলে এই ফুলমাথা-টিয়া পাখিগুলোও থেকে যাবে বলে জানান পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক।
আব্দুল্লাহ আল নোমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাভার (ঢাকা)
ছবি: বার্তা ২৪.কম
ফিচার
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের শুরুতে আকাশকে আবির রঙা করে ফোটে কৃষ্ণচূড়া, আর বাতাসে ভাসে তার পাপড়ি। ঢাকার অদূরে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস জুড়েই আগুন রঙা সেই কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য আলো ছড়াচ্ছে। গাছে গাছে নয়ানভিরাম রাঙা ফুলের মায়া। দূর থেকে দেখলে মনে হবে গাছগুলোতে আগুন লেগেছে, কাছে গেলে চোখ আটকে থাকে রক্তিম আভার ফুলের সমাহারে। গাছের নিচে অজস্র ঝড়াপাপড়ি যেন বিছিয়ে রাখে লাল গালিচা।
দূর থেকে দেখলে মনে হবে গাছগুলোতে আগুন লেগেছে
সবুজ জাবি চত্বরে গাঢ় লালের বিস্তার যেন বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তরে রক্তিম সূর্যের প্রতীক আর বাংলাদেশের জাতীয় পতাকারই প্রতিনিধিত্ব করছে। অনিন্দ্য সুন্দর বাংলাদেশের মধ্যে এ চত্বর যেন এক টুকরো বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। কৃষ্ণচূড়া যেন সূর্যের সবটুকু উত্তাপকে শুষে নিয়ে সৌন্দর্যের এক অভিনব উত্তাপ ছড়াচ্ছে পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে। সে উত্তাপেই পুড়ে যাচ্ছে সৌন্দর্য বিলাসীসহ সকল ক্যাম্পাসবাসী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবন থেকে শুরু করে বিশমাইল গেট পর্যন্ত রাস্তার অসংখ্য গাছ এ ফুলের রক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে। আঁকাবাঁকা পথে ঝাঁক বাঁধা লাল কৃষ্ণচূড়ার মিতালি দেখে মনে হয় যেন গাছের পাতাগুলোতে আগুন লেগেছে। গন্ধহীন এ ফুলে পাপড়ি থাকে পাঁচটি। নমনীয় কোমল, মাঝে লম্বা পরাগ। ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া ফুলের মনোরম দৃশ্য দেখে যে কেউ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেই!
ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার, বটতলা, পরিবহন চত্বর, মুন্নী সরণী, কয়েকটি অনুষদসহ বিভিন্ন হলের সামনের খোলা জায়গা, কোথায় নেই এই কৃষ্ণচূড়া! দেখে মনে হতেই পারে এ যেন কৃষ্ণচূড়ার ক্যাম্পাস। তবে রাধাচূড়া, সোনালু আর জারুল ফুলও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের শিক্ষার্থী তানজিনা আমান তানজুম বলেন, ক্যাম্পাসে যেদিকে তাকাই মনে হয় কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোতে আগুন লেগেছে। কিছুদূর পরপরই একেকটা গাছ আর তাতে উজ্জ্বল লাল টুকটুকে ফুল। মনে হয় প্রকৃতিতে আধিপত্য বিস্তার তারাই করছে। কৃষ্ণচূড়ার নজরকাড়া এসব ছবি ঘুরছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফেইসবুকের বিভিন্ন গ্রুপেও। ঈদের ছুটিতে অনেক শিক্ষার্থী এখন বাড়ি আছেন। তাদের মধ্যে একজন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ঐন্দ্রিলা মজুমদার অর্ণা।
আবির রঙা করে ফোটে কৃষ্ণচূড়া, আর বাতাসে ভাসে তার পাপড়ি।
অর্ণা বলেন, ঈদের ছুটিতে এখনও বাড়িতে আছি। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া ফুলের ছবি দেখে মন খুবই অস্থির হয়েছে। কবে ছুটি শেষ হবে, আর ক্যাম্পাসে যাব, এই অপেক্ষায় আছি। আগুনের মতো লাল দেখে হয়তো এই ফুলের নাম ইংরেজিতে 'ফ্লেম ট্রি' রাখা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুল কবীর হিমেল বলেন, কৃষ্ণচূড়ার আদি নিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার। ভিনদেশী এই ফুল আমাদের দেশে নতুন নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এর উচ্চতা খুব বেশি হয় না। সর্বোচ্চ ১১-১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। তবে এর শাখা-প্রশাখা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো থাকে। বছরের অন্য সময়ে এ ফুলের দেখা পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশে এপ্রিল-জুন মাসে দৃষ্টিনন্দন ফুলটির দেখা মেলে। সাধারণত বসন্তকালে এই ফুলটি ফুটলেও তা জুন-জুলাই পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
কৃষ্ণচূড়ার নজরকাড়া এসব ছবি ঘুরছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফেইসবুকের বিভিন্ন গ্রুপেও।
কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিখ রেজিয়া। এটি ফাবাসিয়ি পরিবারের অন্তর্গত যা গুলমোহর নামেও পরিচিত। কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো সাধারণত বড় চারটি পাপড়ি যুক্ত হয়। পাপড়িগুলো প্রায় ৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। শীতকালে পাতা ও ফুল ঝড়ে যায়, বসন্তে নতুন পাতা ও কুশিতে নতুন সাজে সেজে ওঠে গাছ।
একদিকে পাহাড়। আরেকদিকে ছোট্ট একটি দ্বীপ। মাঝে অগভীর জলাভূমি। আর সেই বিস্তীর্ণ জলাভূমির মাঝ বরাবর চলে গেছে একটি কাঠের সেতু।
অবশ্য এই সেতু আকারে-আকৃতিতে সাধারণভাবে পরিচিত ব্রিজের থেকে অনেকটাই আলাদা। তাকে কাঠের পথ (Wooden Walkway) বলাই শ্রেয়। কারণ, তার প্রস্থ মাত্র এক ফুট। একের পর এক কাঠের পাটাতন পেতেই তৈরি হয়েছে এই পথ। নেই কোনো হাতলও।
ইংল্যান্ডের সমারসেটের (Somerset) শ্যাপউইক হিথ ন্যাশনাল নেচার রিজার্ভে গেলেই দেখা মিলবে এই কাঠের তৈরি সেতুটির। যার বয়স প্রায় ৬ হাজার বছর! ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম এই সেতু।
তবে বয়সের কারণেই ক্রমশ সংকটময় হয়ে উঠেছিল এই সেতুর অস্তিত্ব। সেতুটির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ইংল্যান্ডের ‘হেরিটেজ অ্যাট রিস্ক রেজিস্টার’-এর খাতায়। এবার সেখান থেকেই দুরন্ত প্রত্যাবর্তন করল এই প্রাগৈতিহাসিক পথ। দীর্ঘ কয়েক বছরের চেষ্টায় সেতুটির সংরক্ষণ কাজ সফলভাবে শেষ করলেন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
কার্বন ডেটিং অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৩৮০৬ অব্দে তৈরি হয়েছিল এই কাঠের সেতু। নিওলিথিক যুগে। অর্থাৎ, কিংবদন্তি স্টোনহেঞ্জের থেকেও বয়স বেশি কাঠের নির্মিত এই সেতুর। কোনও প্রকৌশলী নন, সেসময় ইংল্যান্ডের কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষরা এই সেতু নির্মাণ করেন। সমারসেট জলাভূমির মধ্যে অবস্থিত দ্বীপের মাটি তুলনামূলকভাবে অনেকটাই উর্বর। সেই কারণেই পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে এই দ্বীপে কৃষিকাজ শুরু করেছিল তৎকালীন কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষরা। যদিও তাঁদের বাসস্থান ছিল পার্বত্য উপত্যকা। দৈনন্দিন যাতায়াতের সুবিধার জন্যই তাই কাঠ পেতে তৈরি করা হয়েছিল ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথ।
সাধারণত কাঠ পচনশীল হওয়ায়, কাঠের তৈরি যেকোনো স্থাপত্যই অত্যন্ত দ্রুত ক্ষয়ীভূত হয়। তবে সমারসেটের এই সেতুটির ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঠিক বিপরীত। ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে প্রথম আবিষ্কৃত হয় ‘সুইট ট্র্যাক’-খ্যাত এই সেতু। তবে তার অবস্থা দেখে তখনও পর্যন্ত আন্দাজ করা যায়নি যে সেটির বয়স ৬০০০ বছর। এর নেপথ্যে রয়েছে জলাভূমির জলে পিট মস এবং প্ল্যাংটনের উচ্চ উপস্থিতি। যার কারণে জলে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় অনেকটাই। ফলে হ্রাস পায় ক্ষয়ীভবনের হারও।
সেতুটি সংরক্ষণের পর, সংশ্লিষ্ট জলাভূমিতে এই ধরনের মসের পরিমাণ বৃদ্ধির চেষ্টা করা হবে বলেই জানাচ্ছেন সংরক্ষণ কার্যের পরিচালক তথা ‘ন্যাচরাল ইংল্যান্ড’-এর সিনিয়র রিজার্ভ ম্যানেজার জুলি মেরেট৷ পরবর্তীতে এই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রকেও সারিয়ে তুলবে বলে অভিমত তাঁর।