মুক্তিযোদ্ধাদের তার ‘যুদ্ধ জীবনের তথ্য’ নতুন প্রজন্মকে শোনাতে হবে
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের হিরন্ময় ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা লাভ করেছি স্বাধীন দেশ, নিজস্ব পতাকা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলার ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণ বর্বর হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তারই পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে খোদিত হয় একটা নাম- ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর গোটা বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর দখলে এলেও বিজয় দিবসের পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর খুলনা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। মূলত ১৭ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী থেকে খুলনা মুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুলনা বিভাগের অবদান কম নয়। খুলনা বিভাগের মুক্তিযুদ্ধ সার্বিক মুক্তিযুদ্ধের সাথে বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপারও নয়। তবু সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গ্রথিত হলেও এ এলাকার লড়াইয়ের নিজস্ব একটা স্বকীয়তা রয়েছে। ভৌগলিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে শত্রুপক্ষের হামলা ও তার প্রতিরোধ প্রচেষ্টার মধ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য থাকাই স্বাভাবিক। খুলনা জেলার বড় অংশ ছিল নবম সেক্টরভুক্ত। খুলনায় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস অনবরত যুদ্ধ চলে। এখানে যেমন গেরিলা যুদ্ধ তেমনি হয় সম্মুখ সমর।
প্রলয়ংকরী ট্যাংক যুদ্ধও হয় এখানে। এ যুদ্ধে এখানে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যা সহজেই চোখে পড়ার মতো। খুলনার সাতক্ষীরা থেকে ব্যাংক অপারেশনের মাধ্যমে উদ্ধারকৃত এক কোটি পঁচাত্তর লক্ষ টাকা নিয়েই নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের যাত্রা শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও খুলনায় তা ঘটে একদিন পর, ১৭ ডিসেম্বর। এখানে শিরোমনি নামক স্থানে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ট্যাংক যুদ্ধ যা ছিল একটা অনন্য সাধারণ ঘটনা। এমন ট্যাংক যুদ্ধ দেশের অন্যত্র খুব কমই ঘটেছে। খুলনা দেশের এমন একটা এলাকা যেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় ভুল বোঝা-বুঝির কারণে ভারতীয় বিমানের আঘাতে ধ্বংস হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধ জাহাজ পদ্মা ও পলাশ।
স্বাধীনতা যুদ্ধে খুলনা ছিলো ৯নং সেক্টরের আওতাধীন। যুদ্ধকালীন সময়ে স ম বাবর আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার। স্কুল থেকে তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৭১ সালে খুলনা জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। একই সময় বি এল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন খুলনা-৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৪ সালে যুবলীগ খুলনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছিয়াত্তরে ২১ মাস এবং আটাশিতে পাঁচ মাস কারাভোগ করেন। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত মেয়াদে পাইকগাছা উপজেলার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স ম বাবর আলী বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রশাসন থেকে বারবার ফরম ফিলাপ করার কথা বলা হলেও আমি কিছুই করিনি। যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, কোনো সার্টিফিকেট বা আইডি কার্ড পাবার জন্য নয়।
ভারতের দেরাদুনে জেনারেল ওভানের নেতৃত্বে সামরিক প্রশিক্ষণ, বিশেষ করে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছেন স ম বাবর আলী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও খুলনা শত্রুমুক্ত হয়েছিল এর এক দিন পর ১৭ ডিসেম্বর। পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর শহীদ হাদিস পার্কে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন স ম বাবর আলী।
স্মৃতিচারণ করে স ম বাবর আলী বলেন, একাত্তরে মুজিব বাহিনী অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বার্থের বিরুদ্ধে কখনও কোনো কাজ করেননি। বঙ্গবন্ধুর নামে এ বাহিনী হওয়ায় দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে দ্রুত সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্মরণীয় রাখতে এবং সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে তার যুদ্ধ জীবনের তথ্য আজকের প্রজন্মের হাতে দেয়ার জন্য তিনি যুদ্ধ জয়ীদের প্রতি আহ্বান জানান।
মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলী নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বই উপহার দিয়েছেন। বইটির নাম ‘স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান’। স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান পশ্চিমা ধাঁচের কোন রোমাঞ্চকর নাটক, নভেল বা কল্পকাহিনী নয়, এটা বৃহত্তর খুলনার মুক্তিযুদ্ধের কথাচিত্র। বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯১ সালের বিজয় দিবসে।