মৃত ব্যক্তির ছাইয়ের অপেক্ষায় আত্তিক সাথান
চা ফ্রায়া নদীর উত্তর দিক পেরিয়ে আরও প্রায় ৪০ কিলোমিটার পেরোলে দেখা মেলে ভাসমান বাজার ক্ষলং লাট মায়োমের। খালের ওপর গড়ে উঠেছে এই বাজার। আর খাল ধরে এগোলেই দেখা মেলে ওয়াত সাপহানসহ আরও ৩ বা ৪টি প্যাগোডা। আর খালের দুপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি অর্কিডের বাগান।
একশ বাথে নৌকা ভাড়া করে আমরা রওনা দিলাম। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছালাম ওয়াত সাপহান প্যাগোডায়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্যাগোডা মানেই সেটা সোনালী রংয়ের হবে আর দূর থেকেই আলোর ঝলকানি বোঝা যাবে। এটাও হয়তো তার ব্যতিক্রম নয়।
নৌকা ভেড়ানোর জন্য ঘাট রয়েছে এখানে। নৌকা থেকে নেমে আমরা রওনা করলাম মন্দিরের ভেতরের দিকে। আমাদের সঙ্গে রয়েছে এখানকার সাংবাদিকতার গবেষক ম্যাক্স। ইতিহাসের ছাত্র হয়েও সাংবাদিকতার জন্য গবেষণা করতে ভালো লাগে তার।
এখানে প্যাগোডার ভেতরে রয়েছে তিন রংয়ের বৌদ্ধের মূর্তি। কাল পাথরের মূর্তি, সাদা এবং শ্যাম বর্ণের। একটির পাশে আরেকটি বসানো হয়েছে সারিবদ্ধভাবে।
প্যাগোডার মূল অংশটিকে ঘিরে রেখেছে একটি সাড়ে তিনফুট উচুঁ দেয়াল। দেয়ালে রয়েছে কিছু মানুষের ছবি। তার সামনে জ্বলছে মোমবাতি বা রাখা হয়েছে পূজার মতো প্রসাদ। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, এই প্যগোডায় অনুদান দেওয়া মানুষের ছবি এগুলো।
পরে ভুল ভাঙল। থাই ভাষায় এগুলোকে বলা হয় আত্তিক সাথান। আত্তিক মানে ছাই আর সাথান মানে স্থান। মানে মৃত ব্যক্তিদের ছাই রেখে এখানে ছোট বাক্সের মতো ঘরটির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার ওপরে ব্যক্তির ছবি এবং পরিচয় বসানো হয়। বিশ্বাস করা হয়, এর ফলে মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পাবে এবং পূর্ণজন্মে ভাল ফল পাবেন।
আবার কয়েকটি আত্তিক সাথান খালি রয়েছে। অপেক্ষা করছে নতুন কোন মৃত ব্যক্তির ছাইয়ের জন্য। তবে এখানে ছাই রাখা কিন্তু ফ্রি নয়। টাকা দিয়েই রাখতে হয় আত্মীয়দের।
ম্যাক্স জানালো এই প্যাগোডার বয়স একশত বছরের বেশি। এখানে দেখা গেলো বেশ কিছু মোরগের ভাস্কর্য। ধর্মের কল সবখানেই বাতাসে নড়ে। থাইল্যান্ডেও রয়েছে এমন। মোরগগুলোর কোন বিশেষত্ব নেই। হয়তো কেউ এখানে প্রথম এমন কোন মোরগের ভাস্কর্য বসিয়েছিল। পরে অনেকেই ভাবতে শুরু করেন, এই মোরগ সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারে। এবং মোরগের মূর্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এখানে প্যগোডাগুলো ঘিরে রয়েছে পর্যটকদের জন্য খাওয়ার দোকান, ছোট বাজার। বেশ বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এই ওয়াত সাপহান প্যাগোডা। আমরা ফেরার সময় দেখলাম আবার ছোট একটি টিলার মতো মন্দির। সেখানে ভেতরে গুহায় যেন বসে রয়েছেন বাবা লোকনাথ। এই হিন্দু মনিষী এখানে থাকার কারণ তেমন কেউ বলতে পারেনি। এমনকি যারা প্রার্থনা করছেন, তারাও অনেকে বলতে পারলেন না, তিনি কে এবং কেন এখানে রাখা হয়েছে!
প্যাগোডা থেকে বের হয়ে আমরা খাল ধরে এগোলাম অর্কিডের বাগান দেখতে। সরু খালের পাশে আরও প্যাগোডার দেখা মেলে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা অলস সময় পার করছেন, আবার অনেকে প্রার্থনায় মগ্ন।
এখানে অর্কিডের বাগানগুলো এখন হুমকির মুখে। একসময় শুধু দর্শনার্থীদের দেখার জন্য ছিল এই বাগান। এখন বিক্তির চেষ্টাও করছেন বাগানের মালিকেরা। আর নগরায়নের প্রবল স্রোত হয়তো সামনে এই অর্কিডের বাগানগুলোকেও হুমকির মুখে ফেলবে।