কামাখ্যাগুড়ির ভাষা বৈচিত্র্য ও ২১শে ফেব্রুয়ারি



ড. রূপ কুমার বর্মণ
কামাখ্যাগুড়ির ভাষা বৈচিত্র্য ও ২১শে ফেব্রুয়ারি

কামাখ্যাগুড়ির ভাষা বৈচিত্র্য ও ২১শে ফেব্রুয়ারি

  • Font increase
  • Font Decrease

 

গত ২১শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রতিবছরের মতো এবারেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”। বাংলা ভাষার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় ২১শে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে সামাজিক মাধ্যমও। স্বাভাবিকভাবেই, বাংলাভাষা তথা মাতৃভাষার মাহাত্ম নিয়ে বাংলাদেশের মতো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যেও অনুষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অন্যদিকে, বাংলা তথা উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষার সংকট নিয়েও অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বস্তুত, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা-ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক স্তরে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ থাকায় বাংলা ভাষার অবস্থা অনেকটাই করুণ। ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসাবে বাংলাদেশে বাংলাভাষা সংকটের সম্মুখীন হয়নি ঠিকই, কিন্তু (অ-সরকারি সংস্থার পরিচালনায়) ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত বিস্তারও স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। বাজার-জনিত চাহিদা বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের প্রতি সামঞ্জস্য রেখে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্যের ফলে পশ্চিমবঙ্গে শহরাঞ্চলে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলা মাধ্যমের বেশকিছু সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। ছাত্রের অভাবে ধুঁকছে আরোও অনেক বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়। বাংলা ভাষার এই চিত্র আমাদের সবারই জানা। এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে প্রতি বছরেই ২১শে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে এক মহাসংকল্পের দিন।

পশ্চিমবঙ্গে ২১শে ফেব্রুয়ারি অবশ্য বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের মতো বহু ভাষাভাষি মানুষের রাজ্যে এই দিনটি আরোও অনেক ভাষাগোষ্ঠীর কাছে প্রেরনার উৎস। বিশেষত, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী (মূলত তপশিলি জনজাতির) কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই বিষয়টিকে উপলব্ধি করার জন্য আসুন আমরা একটু ডুয়ার্স অঞ্চলের দিকে একটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করি।


ভাষাগত দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলের জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলা বিশেষভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ। এই জেলাগুলিতে বসবাস করেন অসংখ্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। বস্তুত, আলিপুরদুয়ার জেলায় এমন সব ক্ষুদ্র জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন যা বৃহত্তর বঙ্গের অন্য কোথাও নেই। উপনিবেশ-পূর্ব যুগ থেকে বসবাস রত বিভিন্ন জনগোষ্ঠী (মেচ, রাভা, টোটো, ভুটিয়া, লেপচা, ডুকপা, রাই, লিম্বু, তামাং, নেপালি, কোচ, রাজবংশী, গারো, ইত্যাদি)  ছাড়াও ঔপনিবেশিক শাসনকালে চা-বাগিচার বিকাশের সূত্র ধরে এখানে আগমন ঘটেছে ঝাড়খণ্ড- বিহার অঞ্চলের বহু জনজাতির। বাগিচা- শ্রমিকের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আগত বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ (সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কুরুখ, চিকবরাইক, মাহালি, ইত্যাদি) আলিপুরদুয়ারের ভাষা বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করেছে। একইসঙ্গে, ইউরোপীয় মিশনারিদের আগমন, মিশনারি শিক্ষার বিস্তার, উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে হিন্দি-ভাষীদের আগমন (বিহারি, মৈথিলি, ভোজপুরি, পশ্চিমা, রাজস্থানি, গুজরাটি) এবং বৃহত্তর বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বাঙালিদের সৌজন্যে  আলিপুরদুয়ারের ভাষা সংস্কৃতির বিকাশের সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে। তবে এই জেলার ভাষা  বৈচিত্র্যে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে ১৯৪৭ এর বাংলা বিভাজন যার প্রভাব থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলিও মুক্ত নন। তবে, এই প্রভাব সবসময় নেতিবাচক হয়নি। বরং বৃহৎ ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের চাপে খানিকটা কোনঠাসা হয়ে পড়ায় কৌম গোষ্ঠীগুলি তাঁদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় উদ্দীপিত হয়েছে। ডুয়ার্সের যে কোন অঞ্চলে দিকে তাকালেই এই বৈশিষ্ট্যটি চোখে পড়বে। চোখে পড়বে কামাখ্যাগুড়ির মতো জনপদের ভাষাগোষ্টির ক্ষেত্রেও।

ভুটান হিমালয়ের পাদদেশে ডুয়ার্সের নদী-বেষ্টিত অঞ্চলে অবস্থিত কামাখ্যাগুড়ি একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ। এর উত্তর দিকের ৩১নং জাতীয় সড়ক (National Highway 31) ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল (Northeastern Frontier Railways) কামাখ্যাগুড়িকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের প্রবেশদ্বারে পরিণত করেছে। ১নং রায়ডাক ও ২নং রায়ডাক নদী, বৃহত্তর কামাখ্যাগুড়ি জনপদের যথাক্রমে পশ্চিম ও পূর্ব সীমানা দিয়ে কূলকূল করে বয়ে চলেছে। এছাড়াও কামাখ্যাগুড়ির প্রাণকেন্দ্রের মরা রায়ডাক ও ঘোড়ামারা নদী বর্ষার জলে শ্রোতশ্বিনী হয়ে ওঠে। কামাখ্যাগুড়ির দক্ষিণ প্রান্ত, আটিয়ামোচর-বোচামারির জঙ্গলের মধ্যদিয়ে স্পর্শ করেছেকোচবিহার জেলার সীমানা। ভারত-ভুটানের কুমারগ্রাম সীমানা ক্ষেত্র থেকে ৩০ কিমি দক্ষিণে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের কুড়িগ্রাম-কোচবিহারের সীমানা থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত কামাখ্যাগুড়ি ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলের ভাষা-বৈচিত্র্যও বিভিন্ন কারণে অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ।

কামাখ্যাগুড়ির উত্তর দিকের গ্রামগুলোতে (উত্তর কামাখ্যাগুড়ি, পশ্চিম নারারথলি, মধ্য নারারথলি, পূর্ব নারারথলি, পারোকাটা, উত্তর কামাখ্যাগুড়ি) আদিবাসী ও মেচ জনজাতির বসতি ছাড়াও রয়েছে রাজবংশী জনগোষ্ঠির বসবাস। উপনিবেশ-পূর্ব যুগে দক্ষিণ কামাখ্যাগুড়িতে গড়ে উঠেছিল রাভা ও স্থানীয় কোচদের(রাজবংশী) বসতি। কামাখ্যাগুড়ির পাশ্ববর্তী কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমাতেও রাভাদের বেশ কয়েকটি গ্রাম গড়ে উঠেছে। কামাখ্যাগুড়ি থেকে সোজা দক্ষিণ দিকে চলতে থাকলে রাভা গ্রামগুলি পাওয়া যাবে বোচামারি, তল্লিগুড়ি, হরিরহাট, বক্সিরহাট এমনকি বাংলাদেশ-সংলগ্ন মেঘালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম গাড়ো পাহাড় জেলার মহেন্দ্রগঞ্জেও।

দক্ষিণ কামাখ্যাগুড়ি (ও পার্শ্ববর্তী তুফানগঞ্জ মহকুমার) রাভা জনজাতির মধ্যে আধুনিকতার প্রভাবে তাদের জীবনধারা ও লোকবিশ্বাসে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। জনজাতীয়-সংস্কৃতি ও হিন্দু-সংস্কৃতির মিশ্রণে রাভা জনজাতির একটা বড় অংশ নিজেদের হিন্দু হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত: এখানকার রাভাদের মধ্যে সাম্প্রতিককালে খ্রিস্টানায়নের (Christianisation) ধারাও সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে রাভাদের কেউ কেউ নিজেদের ‘রাভা’ পদবিরও বদলে ‘দাস’ ও ‘রায়’ পদবি গ্রহণ করে স্থানীয় ‘রাজবংশী’ সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার চেষ্টা করে চলেছেন। অর্থাৎ হিন্দুয়ায়ন, খ্রিস্টানায়ন ও রাজবংশীয়ায়ন (Rajbanshiyization) একসঙ্গে চলমান। এই ধারাগুলোর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে দক্ষিণ কামাখ্যাগুড়ির রাভাদের মাতৃকুলানুসারী সমাজে (Matrilineal Society) পিতৃকুলানুসারী ধারার (Patrilineal traditions) জন্ম হচ্ছে। কিন্তু সাধারণভাবে কামাখ্যাগুড়ির রাভা সমাজ এখনও মাতৃকুলানুসারী যা তাঁদের প্রতিবেশী স্থানীয় জনগোষ্টিগুলি (রাজবংশী, মেচ) থেকে আলাদা।

আধুনিকতার সংস্পর্শে এসে কামাখ্যাগুড়ির মেচ জনজাতি মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন এলেও তাঁরা তাঁদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি ও ‘বস্ত্র উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে’ সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখানকার মেচ জনজাতির বিবর্তনের মধ্যে তিনটি সমান্তরাল ধারা বর্তমান—(১) জনজাতিয় সংস্কৃতি থেকে খ্রিস্টান সংস্কৃতিতে রূপান্তর, (২) জনজাতিয় ভাবধারা থেকে ব্রাহ্ম (হিন্দু) ধর্মে রূপান্তর, ও (৩) আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতশ্রেণির পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে বিবর্তন।

কামাখ্যাগুড়ি ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর বিবর্তনও আলোচনার দাবি রাখে। স্থানীয় রাজবংশী পরিবার ছাড়াও পূর্ববঙ্গের রংপুর অঞ্চল থেকে বহু রাজবংশী পরিবারের অভিবাসন ঘটেছে এখানে। এখানকার রাজবংশী সমাজ তার নিজস্ব ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, লোকচিকিৎসা, সামাজিক রীতিনীতি, নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র, কৃষিসরঞ্জাম ও লোকবিশ্বাসের বৈশিষ্ট্যগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

বৃহত্তর কামাখ্যাগুড়ির জনবৈচিত্র্যে বিপুল পরিবর্তন এসেছে দেশ-বিভাজনের (১৯৪৭) পর। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা (বিশেষত ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, ঢাকা, কুমিল্লা, পাবনা ও রংপুর) থেকে ব্যাপকহারে উদ্বাস্তু ও অভিবাসীদের আগমনের ফলে কামাখ্যাগুড়ি হয়ে উঠেছে বাঙালি অধ্যুষিত জনপদ। এই জনপদের বাঙালিরা বেশ কয়েকটি জাতি-বর্ণে বিভক্ত। কামাখ্যাগুড়ির বিভিন্ন ‘পাড়া’ বা রাস্তার নাম থেকে এখানকার জনবৈচিত্র্য  ও পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্রের আভাস পাওয়া যায়। ঘোষপাড়া, পালপাড়া, পাবনা কলোনি, ঢাকা কলোনি, চড়কতলা (নমঃপাড়া, মালোপাড়া), মোদকপাড়া, মাহিষ্যপাড়া, ইত্যাদি তার কয়েকটি উদাহরণ।

কামাখ্যাগুড়ির অভিবাসীদের মধ্যে রাজস্থানি (মাড়োয়ারি), বিহারি (বিহার থেকে আগত বিভিন্ন সম্প্রদায়) ও নেপালিদের সংখ্যা কম হলেও তাঁদেরকে বাদ দিয়ে এখানকার সমাজকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ডুয়ার্সের অন্যান্য বাজারের মতই কামাখ্যাগুড়ির (মাড়োয়ারি পট্টির) মাড়োয়ারিরা তাঁদের নিজস্ব ভাষা, খাদ্যভ্যাস, পোষাক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতিকে পরম যত্নের সঙ্গে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অন্যদিকে বিহারি অভিবাসীদের সংখ্যা মাড়োয়ারিদের তুলনায় অনেক বেশি। শ্রমিক ও ছোট ব্যবসায়ী ছাড়াও বিহারিরা চর্মকার ও ব্যান্ড পার্টির শিল্পি হিসেবে এখানে কাজ করে চলেছেন। বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে ও উৎসবে কামাখ্যাগুড়ির নতুন বাজারের ‘ব্যান্ডপার্টি’ বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। এখানকার বিহারি কর্মকার (লোহার), নাপিত ও মুচি সম্প্রদায়ও তাদের কর্ম দক্ষতার জন্য প্রসিদ্ধ।

কামাখ্যাগুড়ির উত্তর দিকে (ভুটানের সীমানা লাগোয়া অঞ্চলে) অবস্থিত কুমারগ্রাম- শামুকতলায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু চা-বাগান (কুমারগ্রাম, নিউল্যান্ডস, সংকোষ, তুরতুরি, রায়ডাক, চুনিয়াঝোড়া, কার্তিক, ধওলা, কোহিনূর, ইত্যাদি)। বাগিচা অঞ্চল ও কামাখ্যাগুড়ি-সন্নিহিত অঞ্চলে ‘সাদ্রি’ ভাষা (মিশ্র ভাষা) হয়ে উঠেছে বেশ জনপ্রিয়। তাছাড়া নেপালি ও হিন্দির সঙ্গে কুরুখ ও  সান্তালি ভাষারও বিকাশ ঘটেছে এখানে।

কামাখ্যাগুড়ি ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের (কুমারগ্রাম, বারোবিশা, তুফানগঞ্জ, বক্সিরহাট, শামুকতলা ও মহাকালগুড়ি) ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সাত দশক অতিক্রম করতে চলেছে। ‘১৯৬০-র দশকের আসামে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার দাবিতে আন্দোলন’ এখানকার ভাষা আন্দোলনকে উদ্দীপিত করেছিল। ১৯৬৯-এ স্থাপিত উত্তরাখণ্ড দল , রাজবংশী (কামতাপুরী) ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে যে আন্দোলন শুরু করেছিল কয়েক দশক পর তা বাস্তবায়িত হয়েছে (২০১৮ সালে)। কামতাপুরী ও রাজবংশী উভয়েই পেয়েছে পৃথক ভাষার স্বীকৃতি। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে স্থাপিত হয়েছে যথাক্রমে ‘কামতাপুরী ভাষা একাডেমী’ ও ‘রাজবংশী ভাষা একাডেমী’। এমনকি কামতাপুরী ও রাজবংশী মাধ্যমে পঠনপাঠনের প্রস্তুতিও চলছে জোরকদমে। শুরু হয়েছে সান্তালি ভাষাতেও পঠনপাঠন। অন্যদিকে দার্জিলিঙের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সূত্র ধরে নেপালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে ডুয়ার্সেও আন্দোলন হয়েছে কয়েক দশক ধরে। একইসঙ্গে, বড়োল্যান্ড আন্দোলন ও বড়ো (মেচ) ভাষার স্বীকৃতির দাবির সঙ্গে কামাখ্যাগুড়ি তথা তার পাশ্ববর্তী গ্রামগুলোর (মহাকালগুড়ি, খোঁয়াড়ডাঙ্গা, দলদলি,  দোবাশ্রী, হেমাগুড়ি, ইত্যাদি) গভীর সংযোগ ছিল। বড়ো  ও নেপালি উভয়েই সংবিধানের অষ্টম তালিকায় স্থান পাওয়ায় ভাষার অধিকার নিয়ে বড়ো-ভাষী বা নেপালি-ভাষীদের আর আন্দোলন করতে হচ্ছে না।

কিন্তু বাংলা ভাষার মতো নেপালি,  সান্তালি, বড়ো, রাজবংশী বা কামতাপুরীকেও সংগ্রাম করতে হচ্ছে ইংরেজি ও হিন্দির দাপটের সঙ্গে। কামাখ্যাগুড়ি বা ডুয়ার্সের অন্যান্য ক্ষুদ্র জনজাতি বা ভাষাগোষ্ঠীগুলির বাচার লড়াই আরোও কঠিন। তাঁদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে প্রভুত্ত্বকারী ভাষার (ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, নেপালি, রাজবংশী, সান্তালি, সাদ্রি, ইত্যাদি) সঙ্গে। একইসঙ্গে নিজেদের ভাষা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাঁদের  প্রতিনিয়ত ভাবতে হচ্ছে । আর এই সংগ্রামে, ২১শে ফেব্রুয়ারির উদ্দীপনার মাঝেই কামাখ্যাগুড়ির ভবেশ রাভা ও সহ শিল্পীরা দায়চাঁদ  রাঙাঙের লেখা “রাভা জাতীয় সংগীতে” সুর দিয়েছেন। গেয়ে উঠেছেন:

...... হাসঙাইঙি কোচা সামসিং স্বা...

দে সারায় কোচা নাঙ, সৌঙ হাইমৌন পতকনাঙ

...... হাসঙাইঙি কোচা সামসিং স্বা

তিস্তা, গঙ্গা, বলাঙ বুত্তুর,

রায়ডাক সংকোচ  তোর্ষা।

... হাসঙাইঙি কোচা সামসিং স্বা……

[ও বিশ্বের কোচ মানুষেরা, আর ঘুমিয়ে থেকোনা, হাতে হাত মিলিয়ে জেগে ওঠো। তিস্তা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, রায়ডাক, সংকোষ, তোর্ষা-তীরের ওগো কোচ জনগণ, গায়ে কামবাঙ ও কেমব্লেট জড়িয়ে তোমরা এগিয়ে চল, আর ঘুমিয়ে থেকোনা।]

২১শে ফেব্রুয়ারির আবহে গানের মাধ্যমে ঘুমন্ত স্বত্তাকে জাগিয়ে তোলার এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে  এক গুরুত্ত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আগামী দিনে মাতৃভাষা দিবসের আবহে অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীগুলিও তাঁদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতিতে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ নিয়ে হয়তো এভাবেই এগিয়ে আসবেন।

*. রূপ কুমার বর্মণ কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক। তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন খলেন্দ্র মোচারি, দেবাশিস ভট্টাচার্য, রাজু সাহা ভবেশ রাভা।

   

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;