তুরাগ পাড়ের কান্না: মাছও নাই, পোকাও নাই
‘২০ বছর আগে একদিনে ৫০ হাজার টাকার মাছ ধরছি। সাত/আট জন এক লগে গাঙে নামতাম। জাল ভর্তি মাছ উঠতো। ক্ষুধা পাইলে নদীর মাছ নৌকায় বইসাই রাইন্ধা খাইছি। তৃষ্ণা পাইলে নদীর পানি খাইছি। এখন হাতও দেওয়া যায় না। মাছও নাই, পোকাও নাই।’
এক নিশ্বাসে কথা বলে উদাস দৃষ্টিতে তুরাগের দিকে তাকিয়ে থাকেন ইদ্রিস আলী। নদীর পানি পঁচে কালো। দুর্গন্ধে বাতাস ভারি। মাথার ওপর তাপ ছড়াচ্ছে বসন্তের সূর্য।
তুরাগের পশ্চিম পাড়ে রুস্তমপুর ঘাটে ভেড়ানো নৌকাটা অল্প অল্প দুলছে। ইদ্রিস আলীর পাশে বসে বাসুদেব রাজবংশী ও রামদাস রাজবংশীও মাথা দোলাচ্ছেন। একজনের কোলে শিশু। ইদ্রিস আলীদের একদিনে ৫০ হাজার টাকার মাছ ধরার গল্প নিশ্চয়ই তার কাছে রূপকথা হবে। সে তো বেড়ে উঠছে দূষিত তুরাগের অভিশাপ নিয়ে।
নদী তীরেই জেলে বসতি, বাড়ি। আগে বাড়ি থেকে বেরুলেই নদীর পানিতে লাফ দেওয়া যেতো। কিন্তু, এখন এই ঘাট থেকে রুস্তমপুর গ্রামটাকে অনেক দূরের মনে হয়। জেগে ওঠা চরায় শীতকালীন সবজি শেষের বিবর্ণতা, নদীর বুকে ধান চাষের আয়োজন। ট্রাকে করে এনে সুরকি-কাঁকর ফেলে ভরাট করা হচ্ছে তুরাগের বুক।
বিপরীতে গাবতলী থেকে আশুলিয়ামুখী যে বাঁধ রাস্তা, সেটার এপাশে গ্যাঁট হয়ে বসে গেছে মিক্সচার কারখানা, রেস্তোরাঁ। বাঁধের ওপাশটাও একসময় ছিলো নদী লাগোয়া বিল। এখনকার উত্তরা পর্যন্ত। নতুন হওয়া ইপাসপোর্ট অফিসটাকেও এখান থেকে দেখা যায়।
সেদিকে তাকিয়ে বাসুদেব বলেন, ‘আগে বাঁধের ওপারে মাছ মারছি। ওই যে দশ তলা বিল্ডিং, ওখানে জাল ফেলছি। এখন তো নদীতেও জাল ফেলার জায়গা নাই।’
রুস্তমপুর ঘাটের এখানটাকে বলা হয় তিন গাঙের মোহনা। উত্তর থেকে আসা তুরাগ থেকে বেরিয়ে একটা ধারা খানিক পশ্চিমে এগিয়ে ফের দক্ষিণ মুখি হয়ে এসে এখানটায় মিশেছে মূলধারার সঙ্গে। আর একটা ধারা পূর্ব পাড়ের দিকে বেরিয়ে খানিকটা উজানে ছুটে ফের পূর্বদিকে বাঁক নিয়ে এগিয়েছে টঙ্গীর পাশ দিয়ে তেরমুখের দিকে। সামনে ওটার নাম হয়েছে টঙ্গী খাল। মিশেছে বালু নদীর সঙ্গে।
এ তিন ধারার এই সঙ্গমস্থল মাছের জন্য বিখ্যাত ছিলো আগে। রুস্তমপুরের পল্লীতে তাই জন্মের পরই নদীর সঙ্গে বাঁধা পড়তো জীবন ও জীবিকা। ইদ্রিস, বাসুদেব, রামদাসরা তাই জন্ম থেকেই মাছ ধরছেন। হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে আছেন এক গ্রামে। এখনও তিনশ ঘর জেলে আছে তাদের গ্রামে।
তাদের বেড় জাল, ঝাঁকি জাল, বেহাল জালে একসময় মাছ উছলাতো। মন ভরে যেতো দেশি বাইলা, টেংরা, মলা, চাপিলা, চান্দা, ইচা, খইলশা, বাইনের চকচকে শরীর দেখে। কতো যে স্বাদ ছিলো মাছের। দূষিত পানি সেই স্বাদ কমিয়ে দিয়েছে অনেক। তবুও এখনও বর্ষার অপেক্ষায় বসে থাকেন তারা।
বর্ষার তোড়ে পানির বিষ যখন ধুয়ে যায়, মাছ বাড়তে থাকে তুরাগে। তিন গাঙের মোহনায় সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা পড়ে আষাঢ় থেকে কার্তিকে। জাল-নৌকার জন্য এক ভাগ রেখে অবশিষ্ট মাছ নিজেদের মধ্যে সমান ভাগ করে নেন দলবদ্ধভাবে মাছ শিকারীরা। কিন্তু দায়-ঋণের বোঝা কমে আসতে আসতে ফের খারাপ হতে শুরু করে পানি।
জেলেদের ভাষায় ‘পচা’ নামে কার্তিক মাসে। তখন বন্ধ হয়ে যায় মাছ ধরা। ফের বাড়তে থাকে ধার- দেনা, ঋণের বোঝা। মৎস্যজীবীদের জন্য দেওয়া জেলে কার্ড পায়নি সবাই। তাই বেকার জেলেরা বাজারে এসে বসে থাকেন কামলা হিসেবে ভাড়া খাটার আশায়।
হতাশ সুরে রামদাশ রাজবংশী বলেন, ‘কার্ড নাই। পাঁচ/ছয় মাস কামলা খাটি। ৩০০ টাকা রোজ। কাম না পাইলে খেত কোপাই। তবুও তো তিন বেলা প্যাট ভরানো কঠিন হয়।
ইদ্রিস আলীর বয়স এখন ৬৫। রামদাস আর বাসুদেব রাজবংশীর ৬০ এর ঘরে। লেখাপড়া না জানলেও তিনজনই নাম লিখতে পারেন। নিজের তিন সন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে চান ইদ্রিস। তিন সন্তান নিয়ে রামদাস ও চার সন্তান নিয়ে বাসুদেবের ইচ্ছাও তাই। কিন্তু জীবিকার অনিশ্চয়তা তাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। তুরাগ তো এখন তাদের বেঁচে থাকার রসদ যোগাতেই হিমশিম খায়।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও ফেলো, রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)