করোনা ও মোনালিসা হাসি!

মোনালিসার হাসির মতোই দুর্বোধ্য করোনা। সংগৃহীত
মোটের উপর স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল সবকিছু। খুলে গিয়েছিল আকাশপথ, পর্যটন ক্ষেত্র, জাদুঘরের দরজা। মানুষ আবার অশেষ আনন্দে করোনাকালের ঘরবন্দি পরিস্থিতি পেরিয়ে বের হয়ে এসেছিল উন্মুক্ত চরাচরে।
মিউজিয়ামে আবদ্ধ বিশ্বসভ্যতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল নিদর্শনগুলোর সামনে আবার এসে দাঁড়িয়েছিল মানুষ। সেলফি তুলেছিল বিশ্বখ্যাত মোনালিসার চিরায়ত হাসিতে মাখা ছবির সামনে। ফিরে আসা সেই প্রায়-স্বাভাবিক পরিস্থিতি পুনরায় অপসারিত হওয়ার পথে আতঙ্ক ছড়ানো বৈশ্বিক মহামারি করোনার চতুর্থ আঘাতে। করোনায় আপাতত মুছে যাবে মোনালিসা হাসি। আবার বন্ধ হবে জনপদ, পর্যটনকেন্দ্র, জাদুঘর, প্রদর্শনকক্ষ।
সবারই জানা আছে যে, কোভিড-১৯-পরবর্তী পৃথিবীর সঙ্গে আগের পৃথিবীর মিল থাকবে না। স্বেচ্ছা-নিভৃতিতে ছটফট করতে করতে ‘আবার সব নর্মাল’-এর জন্য দিন গোনা আজকের মানুষের পক্ষে সেই সত্যটা হজম করা বেশ কঠিন যে, আবার ধেয়ে আসছে করোনা।
আবার আসছে দমবন্ধ করা শূন্যতার মধ্যে এলোমেলো কিছু বইপত্র ছড়ানো নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন, যেখানে বইয়ের কয়েকটি পৃষ্ঠা উড়ছে। মার্কাস অরেলিয়াস, এপিক্টেটাস, স্পিনোজা, পাসকাল মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন ইউরোপীয় জীবনের পরিসরে।
হয়তো বিশেষ করে মানুষকে বিদ্ধ করছে পাসকালের সেই অমোঘ প্রশ্ন: ‘তবে এখন আমি কী করব? কী করব আমি?’ প্রাচীন প্রজ্ঞার দিকেও ধাবিত হচ্ছে কোনও কোনও মানুষ। কিন্তু মন বসছে না মহামারি ও তাণ্ডবে। ইউরোপের উপান্তে লড়ছে রুশ-ইউক্রেন আর অকাতরে মরছে মানুষ। চারপাশে শক্তির কুৎসিত রণহুঙ্কার সঙ্কুল পরিস্থিতিকে করে তুলেছে আরও বিষময়।
প্রবল ভয়কে শমিত করতে চারপাশের বিরাট ও ভয়াল নৈঃশব্দ্যকে আঁকড়ে ধরেছে অসহায় মানুষ। অতলান্তিকের ধারে সুদূর ফরাসি শহর লা রশেল থেকে কিংবা ভার্সাই, মিউনিখ, প্রাগ, হেগ থেকে জানানো হচ্ছে, সেদেশের মৃত্যুর মিছিলের মধ্যে বসেও আশ্চর্য বই পড়ছে মানুষ, শিল্পের জন্য আকুতি জানাচ্ছে। এক জাদু-লণ্ঠন হয়ে শিল্প-নন্দনের অপরিসীম জগৎ ভুলিয়ে দিচ্ছে ভয়, আতঙ্ক, শূন্যতাবোধ ও একাকীত্ব।
জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে প্রকটিত হচ্ছে এই সত্য যে, করোনা যেন কোনওভাবেই আমাদের পিছু ছাড়তে চাইছে না। এই ভাইরাস কোনও না কোনওভাবে আমাদের পিছু নিয়েই রেখেছে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে এখন আমাদের কাছে নতুন বিপদের কারণ ওমিক্রন বিএ.৪ ও বিএ.৫। এই দুই ভাইরাস ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে ইউরোপ ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়াতেও। আর এই দুটি ভাইরাস যে অত্যন্ত সংক্রামক এই নিয়েও জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই প্রতিটি মানুষকে অবশ্যই এই বিষয়টি নিয়ে হয়ে যেতে হবে সতর্ক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রধান Tedros Adhanom Ghebreyesus-ও এই সাবভ্যারিয়েন্ট নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত। তাঁর কথায়, আমরা দেখতে পারছি না যে এই ভাইরাস কী ভাবে নিজের শাখা প্রশাখা বাড়াচ্ছে। মিউটেশনের বিষয়টিও অনেকসময়ই বোঝা যাচ্ছে না। তাই আগামীদিনে কী হবে বলা মুশকিল।
এই অবস্থায় প্রতিটি মানুষকে যে সতর্ক হয়ে যেতে হবে, এই বিষয়টি কিন্তু একেবারে নিশ্চিত। প্রফেসর টিম স্পেকটর, জোয়ে কোভিড অ্যাপের প্রধান এই প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের প্রতিটি মানুষকেই কোভিডের এই নতুন দুই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে সতর্ক হয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত অনেকের আবার গন্ধ চলে যাচ্ছে।
আসলে ডেল্টা ভ্যারিরিয়েন্টের সময় এই লক্ষণ বেশি দেখা গিয়েছিল। তবে এখন সময়টা বদলে গিয়েছে। এক্ষেত্রে ডেল্টার সময় দাঁড়িয়ে অন্যান্য সমস্যার তুলনায় বেশি দেখা দিয়েছিল এই লক্ষণ। কিন্তু এবার ফের দেখা মিলছে এই উপসর্গের। এর নাম অ্যানসোমনিয়া। এই জটিলতা থাকলে মানুষ কিছুটা সময় বা অনেকটা সময়ের জন্য গন্ধ পান না। তার থেকেই সমস্যা দেখা দেয়।
এদিকে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আগামী ৪ জুন (শনিবার) থেকে বৃহস্পতিবার (১০ জুন) পর্যন্ত বাংলাদেশব্যাপী টিকার বুস্টার ডোজ সপ্তাহ ঘোষণা করেছে সরকার। এই সময়ে ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব সবাই বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার চার মাস পর টিকার তৃতীয় ডোজ নেওয়া যাবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মঙ্গলবার (৩১ মে) প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় নতুন রোগি শনাক্ত হয়েছেন ২৬ জন। একই সময়ে করোনায় মৃত্যু শূন্য। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৯ হাজার ১৩১ জন। নতুন শনাক্ত নিয়ে সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত ১৯ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার শনাক্তের হার শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। আগের দিন এই হার ছিল শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৯ জন এবং এখন পর্যন্ত ১৯ লাখ ২ হাজার ৭৬০ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
পরিসংখ্যানের দিক থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আপাতত উদ্বেগজনক না হলেও বিশ্বপরিস্থিতির আলোকে সতর্কতা অবশ্যম্ভাবী। মোনালিসার হাসির মতোই দুর্বোধ্য করোনাও কখন আনন্দ, কখন বিষাদ, কখন বিদ্রূপমাখা তীর হানবে আচমকা, বলা অসম্ভব। বিশ্বব্যাপীই বিজ্ঞানিরা করোনার রূপ-রূপান্তরের পেছনে ছুটতে ছুটতে হয়রান। ফলে সুরক্ষার খাতিরে স্বাস্থ্যগত বিধিনিয়ম পালন, সামাজিক দূরত্ব বজায়, মাস্ক পরিধান, স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং অবশ্যই টিকাকরণ জারি রাখতেই হবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে।