গাছ লাগানো দুর্লভ পাখি ‘কমলাপেট ফুলঝুরি’

  • বিভোর স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

দৃষ্টিনন্দন পাখি দুর্লভ পাখি কমলাপেট ফুলঝুরি। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

দৃষ্টিনন্দন পাখি দুর্লভ পাখি কমলাপেট ফুলঝুরি। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

গাছের উপরের গাছকে বলে পরগাছা। বছরের পর বছর ধরে বনের প্রকৃতিতে পরগাছারা বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। তবে কিছু কিছু পরগাছাদের জন্ম এবং বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে ফুলঝুরি (Flowerpeacker) পাখিদের ভূমিকা অনেক।

নিজেদের স্বার্থেই পরগাছাদের লাগায় ‘কমলা-পেট ফুলঝুরি’। সংরক্ষিত বনের বিশালাকৃতির কোনো কোনো গাছের উপর শূন্যে রয়েছে অসংখ্য পরগাছা। এই পরগাছাদের ফুল ও ফল থেকে ফুলঝরিরা যে মল ত্যাগ করে সেখান থেকে জন্ম হয় নতুন পরগাছাদের।

বিজ্ঞাপন

দুর্লভ পাখি ‘কমলাপেট ফুলঝুরি’। এর ইংরেজি নাম Orange-bellied Flowerpeacker এবং বৈজ্ঞানিক নাম Dicaeum trigonostigma। পাখিটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৯ সেন্টিমিটার। আমাদের চড়ুই পাখির মতো।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক বলেন, ফুলঝুরিরা বনের বিভিন্ন গাছের উপর ছোট ছোট যে সকল পরগাছা জন্মে সেগুলোর পাতা খায় এবং ফুলের মধুও খায়। সব ফুলঝরিদেরই কিন্তু মূল খাবার গাছের উপরের পরগাছার ছোট ছোট ফল। এ ফলগুলো ওরা খায় বলেই কমলা-পেট ফুলঝুরিরা ওই গাছগুলো লাগিয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে ফুলঝরি পাখিরা আছে সেখানেই গাছের উপরে পরগাছাগুলো আছে। কারণ ওরা ফল খেয়ে মলত্যাগ করলে ওই মল থেকেই নতুন গাছ জন্মে। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের পরগাছা, এটাকে ‘আমঘরোঞ্জ’ বলে অনেক জায়গায়। বনের ভেতর দেখবেন গাছের উপরে অনেক বড় বড় পাতা হয়; আর অনেক ফুল ফল হয়।

কমলাপেট ফুলঝুরি বনের পরগাছায় বসবাস করে। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

‘আমাদের দেশে যে সাত প্রজাতির ফুলঝুরি (Flowerpeacker) আছে তারা সবাই এমন পরিবেশেই বসবাস করে। ফুলের মধু খেয়ে এরা ফুলের পরাগায়নও করে আবার ফল বিস্তারের মাধ্যমে নিজের এলাকায় নতুন গাছ তৈরিতে প্রত্যক্ষ সাহায্য করে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের সংরক্ষিত বনগুলোতে হাঁটলে হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায় গাছের উপরে গাছ হয়ে আছে অনেক। এভাবে অনেক পরগাছা দেখলে বুঝবেন যে এখানে ফুলঝরি পাখিরা আছে’ বলে জানান ইনাম আল হক।

পাখিটির আয়ুষ্কাল সম্পর্কে ইনাম আল হক বলেন, আমাদের দেশের সাত ফুলঝুরিই কিন্তু একই কাজ। অর্থাৎ ওরা নিজের গাছ নিজেই লাগিয়ে নেয়। গাছের উপরে দারুণভাবে বাগান তৈরি করে থাকে তারা। বনের কোনো কোনো বড় গাছের মাথায় শূন্যে বাগান তৈরি হয়ে আছে। এখানেই ওরা বসবাস করে। নিজে ওরা কখনো নামেই না; খুবই কম নামে। যেমন- ‘কমলা-পেট ফুলঝুরি’ তো নিচে একেবারেই নামে না। ওখানেই বাসবাস করে, পাতার নিচে বড় বাসা করে; বাবুই পাখির বাসার মতো অনেকটা। ওখানেই ডিম পাড়ে, ছানা ফুটায় এবং ওখানেই কাটিয়ে দেয় পুরোটা জীবন।

পাখিটির বেঁচে থাকার কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গাছের উপরের পরগাছাগুলোর ফুলের মধু কিছু খায় আর পরগাছাগুলোর ফল খায় বেশিরভাগ সময়। ঝাকড়া হয়ে ঘন হয়ে পরগাছাগুলো যেখানে রয়েছে সেখানেই ফুলঝুরিদের সারাক্ষণ আনাগোনা। ঝোপের মধ্যে অথবা লম্বা একটা পল্লব পেলেই সে ওখানে লুকিয়ে যায়। ছোট পাখির তো অনেক শত্রু। তবু সে কৌশল করে সাবধানে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে প্রকৃতিতে। বিপদ টের পেলে পাতার ফাঁকে ফাঁকে নিজে আড়াল করে ফেলে সে। সেজন্য আমরাও তাদের সহজে খুঁজে পাই না। তাদের দেখতে হলে বেশ কষ্ট করতে হয়।

বনের গাছের উপরের থাকে বলে মানুষ চিনেই না ‘ফুলঝুরি’দের। বিশেষ করে ‘কমলা-পেট ফুলঝুরি’ পাখিটিকে খুব কম লোকই দেখেছেন। এরা পাহাড়ি বনের পাখি। সিলেট-চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বন এবং সুন্দরবনেই শুধুমাত্র তাদের দেখতে পাওয়া যায়। লাখ লাখ ‘কমলা-পেট ফুলঝুরি’ রয়েছে ওই তিনটি স্থানের বনাঞ্চলে কিন্তু কেউ দেখেনি। তার একটাই কারণ, তারা গাছের উপরের পরগাছাতে থাকে বলে জানান প্রখ্যাত পাখি গবেষক ও লেখক ইনাম আল হক।