থাইল্যান্ডে সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পর্যটন এলাকাগুলো ছাড়লে থাই জনগোষ্ঠীর ইংরেজি ভীতি উল্লেখযোগ্য। বরং কখনো ঔপনিবেশিক শাসনে না থাকায় ইংরেজিকে গ্রহণ করতে হয়নি বলে গর্বও করেন অনেকে। ফলে গত ১০ জুন যখন আমার স্ত্রী থাই পিবিএস টিভির সাংবাদিক কানালাওয়াই ওয়াক্লেহংকে ট্রাট হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, আমার মৌখিক যোগাযোগেরও প্রায় সব পথ বন্ধ হয়ে গেলো। কম্বোডিয়া সীমান্ত ঘেষা ট্রাট থাইল্যান্ডের একটি বিভাগীয় শহর। বাংলাদেশে আমার অভিজ্ঞতায় ৫ম শ্রেণি পড়ুয়া হলেই ইংরেজিতে মৌলিক শব্দ নাগরিকরা বলতে পারেন। অথচ এখানে বিরাট সব ডিগ্রিধারী চিকিৎসক বা আইনজীবীর পেট চেপে ধরলেও অন্য ভাষা বের হবে না। এদিকে আমার শ্বশুরবাড়িতেও স্ত্রী ছাড়া কারো পক্ষে ইংরেজিতে যোগাযোগ অসম্ভব। আর আমার থাই ভাষার জ্ঞানও হাটু ভাঙ্গা। তাই আধুনিক সময়ে গুগল ট্রান্সলেটেই ভরসা করতে হয়।

ট্রাট হাসপাতালে এর আগে ৩১ মে এবং ৭ জুন এসেছিলাম স্ত্রীকে গর্ভাবস্থার পরীক্ষা করাতে। আমার স্ত্রী যখন সন্তান সম্ভবা হয় তখন আমরা বাংলাদেশে। আমার দেখামতে থাইরা পরিচ্ছন্নতার ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়। তাই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা সর্ম্পকে একটা পরিষ্কার ধারনা দেওয়ার জন্য তাকে পরীক্ষা করাতে ইউনাইটেড এবং ডাক্তার দেখাতে পরবর্তীতে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। দুটো হাসপাতালেরই আঙ্গিনা দেখে স্ত্রী আমাকে বলেছিলো, ‘এতো নোংরা কেন তোমাদের হাসপাতালগুলো!’ এখানে মানুষ সুস্থ হয়ে আসলেও তো অসুস্থ হয়ে যাবে! আর ইউনাইটেডে ২ হাজার ১০০ টাকা ভিজিট দিয়ে যখন ৫ মিনিটের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিলাম, সেটা শুনে ও বললো, এমন জানলে থাইল্যান্ডের সব চিকিৎসকরাইতো বাংলাদেশে চলে আসবে!

ইউনাইটেড বা এভারকেয়ারকে নোংরা বলার কারণ খুঁজে পেলাম এখানে একটি বিভাগীয় হাসপাতালে এসে। সব মিলিয়ে মাত্র আড়াই লাখ মানুষের বাস ট্রাট বিভাগে। তবে প্রতিবেশী দেশের প্রতি দায়িত্ব হিসেবে এই সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে পারেন কম্বোডিয়ার সাধারণ জনগণও। যদিও এক্ষেত্রে তাদের স্থানীয়দের তুলনায় বাড়তি খরচ গুণতে হয়। তবে ট্রাট হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা দেখে আমি মনে মনে ভাবি, ভাগ্য ভাল স্ত্রীকে দেশের সরকারি হাসপাতালে নেইনি। নিলে হয়তো মূর্ছা যেতো!

২০০২ সালেই ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ গ্রহণ করে থাইল্যান্ড। এর ফলে স্থানীয়রা সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৩০ বাথ বা ৮০ টাকায় বাচ্চা জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সারের চিকিৎসা পর্যন্ত হয়। শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ খরচ নয়, এই খরচে ওষুধ, পরীক্ষা এবং ডায়াগোনসিসের খরচও বহন হয়।

আমার স্ত্রী চাকরি সূত্রে থাকেন ব্যাংককে। এর আগে গত ডিসেম্বরে সেখানে চুলাবরন ক্যান্সার হাসপাতালে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম গর্ভাবস্থার নিয়মিত চেক-আপে।

চুলাবরন হাসপাতালটি সরকারি হাসপাতাল নয়, বর্তমান রাজার বোন বা ভ্যালেড রাজকন্যার অনুদানে চলা একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। সেখানে ৮ মাস পর্যন্ত নিয়মিত চেকআপ করা হতো পে’র। সেখানে যে চিকিৎসক ছিলেন, ওয়টসিলা, প্রতিবার তার কাছে গেলে তিনি প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট গল্প করতেন। আমার অবস্থা, স্ত্রীর চাকরির অবস্থা, দেশের অবস্থা এসব নিয়ে। কারণ হচ্ছে একটাই, ডাক্তার হিসেবে রোগীকে আরও সহজ করা। চুলাবরনের চিকিৎসকই ৩২ সপ্তাহ হয়ে গেলে স্ত্রীর ফাইল ট্রাট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় ইমেইলে। আমরা যখন হাসপাতাল থেকে বের হই দেশে, আমাদের হাত ভর্তি যেমন অনেক ফাইল আর টেস্টের ফলাফল থাকে, এখানে আমার স্ত্রী বা সন্তানের এখন পর্যন্ত কোন চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজ চোখে পড়েনি। কারণ সবই আছে হাসপাতালের নির্দিষ্ট সার্ভারে।

ট্রাট থাইল্যান্ডের ধনী প্রদেশগুলোর মধ্যে একটি। এখানে মানুষের মাথাপিছু আয় থাইল্যান্ডের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় ভাল। তবে সেই অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক নেই। সরকারি হাসপাতালের বাইরে শুধু রয়েছে বেসরকারি ‘ব্যাংকক হাসপাতাল।’ যেহেতু পর্যটন স্থান হিসেবে ট্রাট পশ্চিমাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়, তাই তাদের জরুরি সেবা ও মেডিকেল ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করে এই বেসরকারি হাসপাতালটি। রয়েছে কয়েকটি ক্লিনিকও, সেখানে একজন বা দুজন করে চিকিৎসক রয়েছেন শুধু পরামর্শ দেওয়ার জন্য। তবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালের বাইরে একটিও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চোখে পড়েনি। আর প্রেসক্রাইবড ওষুধ নিতে হলেও শহরের ৫টি ফার্মেসির বাইরে নেওয়ার সুযোগ নেই।

ট্রাট হাসপাতালেও যখন স্ত্রী চেক আপে যেতো, এখানকার চিকিৎসক অনেকক্ষণ সময় দিতেন, গল্প করতেন। এতো সময় পেতেন কিভাবে চিকিৎসক? এখানে কি রোগীর চাপ কম? না, বরং এখানেও রোগীর চাপ রয়েছে। পাশের দেশের রোগীর চাপও অনেক। বিষয়টা হচ্ছে এই চিকিৎসকের হাতে সময় রয়েছে। দুপুর ২টা বা ৩টা বাজলেই নিজের চেম্বার বা বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়ার তাড়া নেই। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিকেও আলাদা করে সময় দিতে হচ্ছে না।

১০ তারিখ রাতে যখন স্ত্রীর গর্ভধারণের ব্যথা উঠলো সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। থাইল্যান্ডকে ইউনিফর্মের দেশও বলা যেতে পারে। যেখানে স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে, সরকারি কর্মকর্তা, বাস চালক, সবারই আলাদা আলাদা পোশাক রয়েছে। আর হাসপাতালেতো সেটি আরও কঠোরভাবে মানা হয়। চিকিৎসক, নার্স, আয়া, ট্রলিম্যান, কর্মচারী, কর্মকর্তা সবার আলাদা আলাদা পোশাক রয়েছে। তাই কে কোন কাজে নিয়োজিত সেটি বুঝতে সমস্যা হয় না।

দেশে অনেককে দেখেছিলাম, গর্ভধারণের রুমের সামনে বসে অপেক্ষা করতে। আমিও সেই প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। তবে আমাকে ফেরত পাঠালেন কর্তব্যরত নার্স, গুগল ট্রান্সলেটরের মাধ্যমে বললেন, ওকে লেবার রুমে নেওয়া হয়েছে। যখন বাচ্চা হবে, তোমাকে খবর দেওয়া হবে। এখানে বসে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। আমাকেও সহজভাবে মেনে বাসায় ফিরে আসতে হল।

১১ জুন স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে আমার ছেলে সন্তানের জন্ম হলো। মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ রয়েছেন। আমি আবার তাড়াহুড়ো করে ছুটে চললাম হাসপাতালের দিকে মা ও ছেলেকে বাসায় নিয়ে আসতে। কিন্তু যেয়ে আবারও হতাশ হতে হলো। ছেলে ও মা’কে দেখলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য। বাধ্যগতভাবেই অবস্টেট্রিক ওয়ার্ডে থাকতে হবে দুই দিন।

দেশ থেকে যারা ফোন দিচ্ছিলেন, তারা অনেকেই জানতে চাচ্ছিল, কেন দুই দিন থাকতে হবে? আসলে কি সাধারণ নিয়মে প্রসব হয়েছে সন্তান? নাকি সার্জারি প্রয়োজন হয়েছিল? আবার অনেকেই বললেন, দেখো দুই দিন কি বেশি টাকার জন্য রাখছে নাকি হাসপাতাল? আসলে বাংলাদেশের প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই ধরনের প্রশ্ন আসে আমাদের। আমারও এসেছিল। অবস্টেট্রিক ওয়ার্ডে শুধু মা ও সন্তানরা থাকে এখানে। আর কোন এটেনডেন্টকে থাকতে দেওয়া হয়নি। কেন? উত্তরে জানা যায়, এতে মা ও সন্তানের বাঁধনটা শক্ত হয়। আর বেশি মানুষ আসলে রোগ জীবাণু প্রবেশের সম্ভাবনাও বাড়ে। আর করোনার মধ্যেতো সেটা আরও বেশি কঠোরভাবে মানা হয়। তাই অগত্যা আরও দুইদিন অপেক্ষা করতে হলো মা ও ছেলেকে দেখতে।

তবে মা ও সন্তানকে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ার সময় দেখলাম এই দুইদিন বাধ্যতামূলক থাকার কারণে আমাকে কোন বাড়তি খরচ বহন করতে হয়নি। প্রসবের জন্য যে ৮০ টাকা খরচ করেছিলাম, সেটি সর্বসাকুল্যে খরচ। আর মা ও সন্তানকে বিভিন্ন হাইজিন সামগ্রী উপহার দেওয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে। এরও তিন দিন পরে যখন আবার আমরা সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে গেলাম এবার সন্তানের মাকে দেওয়া হলো ৩৪৫ বাথ, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার টাকার সমান। এটা সরকারি হাসপাতালে জন্ম নেওয়া সকল সন্তানদের দেওয়া হয় প্রাথমিক খরচ হিসেবে।

এছাড়াও যেসব মা ও বাবার আয় বছরে ১ লাখ বাথ বা প্রায় ৩ লাখ টাকার নিচে তাদেরকে প্রতি মাসে দেওয়া হয় ১ হাজার ৮০০ বাথ বা প্রায় ৫ হাজার ৪০০ টাকা। এই ক্যাটাগরিতে আমার স্ত্রী না পড়ায় সে এই অর্থ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

১৭ জুন সকাল থেকে স্ত্রী বলছিলেন, তার মনে হচ্ছে ছেলের চেহারা হলুদ হয়ে রয়েছে। আমরা আবারও দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, সেখানে তার বিলুরুবিন পরীক্ষা করা হলো এবং চিকিৎসক জানালেন ভয়ের কারণ নেই। সন্তান সুস্থ আছে। এবং এবার আমি জানতে পারলাম, এই শহরে আগামী ৬ মাস সন্তানকে চিকিৎসা করাতে এবং কোন পরীক্ষা নিরীক্ষাতে আমাদের আর কোন খরচ বহন করতে হবে না।

ট্রাট ছোট শহর। সবাই প্রায় সবাইকে চেনেন। এখানে ডাক্তার যাযারিকপাতি সিনথু’র অধীনে আমার সন্তান জন্ম নিয়েছে, তার সঙ্গে এক বিকেলে দেখা হলো পার্কে। দৌড়াতে গিয়েছিলেন তিনিও। বললাম, আপনারা রোগীদের অনেক সময় দেন। এই পেশাটাকে আসলেই মহৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন আপনারা। উত্তরে তিনি বললেন, আমি যখন এই পেশায় আসি, তখন আমি সেবা করার জন্য এসেছি। এখানে আলাদা কোন মহত্ব নেই। শিক্ষক, সাংবাদিকের মতো পেশাই এই চিকিৎসা। তবে অতি অর্থের পেছনে দৌড়ালে কোন পেশাই আর মহৎ থাকে না।

ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজকে ২০০২ সালেই গ্রহণ করেছে থাইল্যান্ড। এর কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে, জনগণকে যদি স্বাস্থ্য সুবিধা কম মূল্যে দেওয়া যায়, এতে সরকারেরই ব্যয় কমে। সাধারণ মানুষ যদি স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বহন করতেই জীবন অতিবাহিত করে দেয়, এতে রাষ্ট্রেরই অগ্রগতি থেমে থাকে।

বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন বড় সংখ্যক রোগী ভারতের পরই ব্যাংককে আসে চিকিৎসা করাতে। এখানে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কয়েকগুণ বেশি খরচে চিকিৎসা করান। কিন্তু এই রোগীরা বিদেশে আসছে, তার কারণ কিন্তু স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদেরই বের করতে হবে। আমি শুধু একটি কেস স্টাডি উল্লেখ করেছি।

পাখি ও বন্যপ্রাণীদের দুঃসময়



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

জলবায়ু পরিবর্তনে পাখিদের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। কমেছে পাখির আবাসস্থল। ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।

বৈশ্বিক পাখি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার প্রজাতি হুমকির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ২৮ ভাগ। বিগত দুশো বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। এভাবে চলতে থাকলে আগামী একশ বছরের মধ্যে এই বন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সুন্দরবনের খয়রাপাখা মাছরাঙা পাখি। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি বিশেজ্ঞরা বলছে, বনের ওপর মানুষের অধিক নির্ভরশীলতার কারণে ক্রমান্বয়ে এর আয়তন অতি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। বনের আয়তনের সাথে সাথে হ্রাস পাচ্ছে এর জীববৈচিত্র। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ, ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী প্রাণী হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সুন্দরবনে একাধিক অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হলেও কাজে আসছে না তার সুফল।

পাখি বিশেজ্ঞরা বলছেন, এক দিকে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে পাখি সংখ্যা কমলেও ভারত অংশে সুন্দরবনে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের পাখি-বৈচিত্র্যের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’। ‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামের সেই বইটিতে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রতিটি পাখি প্রজাতির ছবি-সহ বিশদ বর্ণনা নথিভুক্ত হয়েছে।

‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামক বই।

বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪২০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে সুন্দরবনে পরিযায়ী ও স্থানীয় পাখি মিলিয়ে রয়েছে ৪২৮টি প্রজাতি। দেশে প্রাপ্ত ১২টি প্রজাতির মাছরাঙার ৯টিরই দেখা মেলে এই অঞ্চলে। সেইসঙ্গে গোলিয়াথ হেরোন, স্পুনবিল স্যান্টপিপার, হুইমবেল, লার্জ ইগ্রেট, টেরেক স্যান্ডপিপার, প্যাসিফিক গোল্ডেন প্রোভারের মতো বিরল প্রজাতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই অঞ্চলে।

যা ইতিবাচক দিক হিসেবেই মনে করছেন ভারতের প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। ভারতে বর্তমানে ১৩০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই বাসিন্দা সুন্দরবনের। বৈচিত্র্যের নিরিখে গোটা ভারতের মধ্যে যা রয়েছে শীর্ষস্থানে। আবাসস্থল ও অবাধে চলাচলের জন্যে বাংলাদেশ অংশের পাখিরা ভারত অংশের সুন্দরবনে নিজেদের নিরাপদ মনে করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

অন্যদিকে, কমতে থাকায় বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০। এর মধ্যে পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭২১। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর অবস্থা কী - তা দেখার জন্য ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন এর ‘লাল তালিকা’ দেখা যেতে পারে। সেখানে রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায় ১২৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী হুমকি বা বিলুপ্তির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ১৪ ভাগ। গত ১০০ বছরে প্রায় ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে, যা এ দেশের মোট বন্যপ্রাণীর প্রায় ২ ভাগ।

;

হাকালুকিতে কম এসেছে পরিযায়ী পাখি



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

হাকালুকিতে পাখি শিকারিদের কারণে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে। যার কারণে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য অনেকটাই হুমকির মুখে।

হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, নদী দূষণ, জাল বিষ টোপ ও পটাশ দিয়ে পাখি শিকার। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিলে মাছ আহরণ, বিল শুকিয়ে মাছ নিধন, বিলে ২৪ ঘণ্টা পাহারা ও জলজ বৃক্ষ নিধনসহ রয়েছে নানান সমস্যা।

চলতি বছরের শীত মৌসুমের পাখিশুমারিতে সে তথ্যই জানান দিয়েছে। জানুয়ারি মাসের ২৮ ও ২৯ তারিখ দু’দিন ব্যাপী হাকালুকি হাওরে করা হয় পাখি শুমারি করে বন বিভাগ, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) যৌথ উদ্যোগে এ শুমারি করে।

বাংলাদেশে ৭১৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩৮৮ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। এরা শীতকালে পরিযায়ী হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসে বাংলাদেশে। আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় হাকালুকি হাওরের মতো জলাশয়। প্রায় ১৮১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ হাওরে রয়েছে ছোট-বড় ২৭৬টি বিল। পাখিশুমারিতে তাদের জরিপে হাকালুকিতে এ বছর এসেছে প্রায় ২৫ হাজার পাখি। যা বিগত বছর থেকে অনেক কম। যা ২০২০ সালে ছিলো প্রায় ৪০ হাজার ১২৬ পাখি। মাত্র কয়েক বছর আগে দেশে ৫-৬ লাখ পরিযায়ী পাখি আসতো। এসব পাখির বেশিরভাগ মৌলভীবাজার ও সিলেটের হাওরে অবস্থান করতো।

যুগল বেগুনি কালেমের সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এর পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ২০ বছরে সারা বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে ৩৫ শতাংশ। হাকালুকিতে কমেছে ৪৫ শতাংশ। ২০০০ সালের আগে হাওরে বিচরণ করতো প্রায় ৭৫-৮০ হাজার পাখি। তার ৮০ শতাংশই হাকালুকি হাওরে ছিলো।

পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাকালুকি হাওরে যে নদীগুলো মিলিত হয়েছে এখন সেই নদীগুলো প্লাস্টিক, পলিথিন, দূষিত পানি ও ময়লার ভাগাড়। পাখি কমার বিশেষ কয়েকটি কারণের মধ্যে এটি একটি। অরক্ষিত থাকায় দিন দিন কমেছে পাখির সংখ্যা। হাওরের পরিযায়ী পাখি রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, পাশাপাশি প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা থাকতে হবে। এতেই বাঁচবে পাখি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেট এর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর হাওরে বিল ইজারা দেওয়া হয়। এ বছরও হয়েছে। এতে বেশ লোকসমাগম ঘটে। দিনরাত পাহারা দেওয়া হয়। এসব কারণে পরিযায়ী পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে না। বিল শুকিয়ে মাছ আহরণের কারণে নষ্ট হচ্ছে হাওরের জীববৈচিত্র্য। ফলে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমছে।

;

লালসবুজ রঙের পাখি ‘সেকরা-বসন্ত’



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
আপন মনে গাছের ডালে বসে আছে সেকরা-বসন্ত। ছবি: এবি সিদ্দিক

আপন মনে গাছের ডালে বসে আছে সেকরা-বসন্ত। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

ছোট আকারের লাল-সবুজ রঙের বর্ণিল পাখি ‘সেকরা-বসন্ত’। এ পাখিটির ইংরেজি নাম Coppersmith Barbet এবং বৈজ্ঞানিক নাম Psilopogon haemacephala. এরা কাপিটোনিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মেগালাইমা গণের এক প্রজাতির সুলভ পাখি। এরা বাংলাদেশের স্থানীয় পাখি।

এদের দেশের সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। IUCN এই প্রজাতিটিকে Least Concern বা শঙ্কাহীন বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে এরা Least Concern বা শঙ্কাহীন বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, সেকরা-বসন্ত আকারে ছোট হয়। মাত্র ১৭ সেন্টিমিটার। দেহ মূলত সবুব। তবে এদের কপাল লাল রঙের। চোখের চারপাশে হলুদ দাগ দেখা যায়। গলার নিচে রঙিন দাগ দেখা যায়। দেহের উপরের অংশ সবুজ। ঠোঁট কালো এবং পা লাল বর্ণের হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই দেখতে একই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির গায়ের রঙ মলিন এবং এদের দেহে কোন লাল দাগ দেখতে পাওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, সেকরা বসন্ত সাধারণত একা, জোড়ায় বা ছোট দলে চলাফেরা করে। এদেরকে বাগানে, বনে বাদাড়ে দেখতে পাওয়া যায়। এরা বড় গাছের মগডালে রোদ পোহায়। গাছের গর্তে বাসা বানায় এবং সেখানে বিশ্রাম নেয়। শুষ্ক মরুভুমি ও জলাখভূমির বনে এদের সহজে দেখা যায় না।

পাখিটির খাবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রজাতির পাখিরা সাধারণত ফলাহারী। তবে এরা মাঝে মধ্যে পোকা বিশেষ করে উইপোকা খেয়ে থাকে। এদের খাদ্য তালিকায় থাকে বট গাছের ফল, জংলি গাছের ফল, জলপাই জাতীয় ফল এবং বেরি জাতীয় ফল। এরা ফুলে পাপড়িও খেয়ে থাকে।

সেকরা বসন্তের প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এরা গাছের সরু ডালের নিচে গর্ত করে বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি একসাথে ৩ থেকে ৪ টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলিতে তা বাবা পাখি ও মা পাখি উভয়ই দিয়ে থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রায় ২ সপ্তাহ সময় লাগে বলে জানান এ পাখি বিশেষজ্ঞ।

;

বিপদ টের পেলে ঝোপের মাঝে লুকিয়ে পড়ে ‘বাংলা কুবো’



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
বাংলা কুবোর উড়ন্ত সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

বাংলা কুবোর উড়ন্ত সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

বিপদের টের পেলে পাখিটি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। কখনো ছোট দূরত্বে উড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে বাঁশবনে। তখন আর কেউ তাকে দেখতে পায় না।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে অন্যতম এক পাখি ‘বাংলা কুবো’। বিভিন্ন বন-জঙ্গল তথা শালবন এবং চা বাগানে এদের বসবাস। অঞ্চলভেদে এ পাখির নাম কুবো, কুক্কা নামেও পরিচিত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কমরুল হাসান বলেন, এই পাখিটির নাম অন্যান্য বাংলা নামগুলো হলো কানকুয়া, কুক্কা, ছোট কোকা, কুক্কাল বা কানাকুক্কা। ইংরেজিতে একে Lesser Coucal বলে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Centropus bengalensis। কুবো মাঝারি গড়নের ভূচর পাখি। এদের লম্বা ও শক্তিশালী পা এবং লম্বা লেজ থাকে। এরা উড়তে পটু নয়। ছেলে ও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম। বড় কুবো কালো ও তামাটে রঙের লম্বা লেজওয়ালা পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ৪০ সেমি, ওজন ২৫০ গ্রাম। পিঠ তামাটে ও দেহতল চকচকে কালো। এ রকম দুটো প্রজাতি আমাদের দেশে পাওয়া যায়, একটি হলো বাংলা কুবো অপরটি বড় কুবো।

পাতার আড়ালে বাংলা কুবো। ছবি: এবি সিদ্দিক

পাখিটির স্বভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, ভূচর এ পাখি ওড়ার চেয়ে দৌঁড়াতে বেশ পটু। বাঁশঝাড়ে বসে থাকে চুপ করে। নিজেকে সবার থেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করে। এরা একটু লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। প্রয়োজনে এরা মাটিতে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘন ঝোপ, বাঁশবন ও খেজুরগাছের আগায় পেয়ালার মতো বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় তিন-চারটি। বনপ্রান্তে ও গ্রামাঞ্চলে এদের ঢের দেখা যায়। উঁচু ঝোপের মধ্য অগোছালোভাবে বাসা তৈরি করতে পছন্দ করে।

শারীরিক গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, উজ্জ্বল তামাটে কাঁধ-ঢাকনি ও ডানা ছাড়া পুরো দেহই কালো। চোখ লাল, ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা ও নখর কালো। সাধারণত একা বা জোড়ায় বিচরণ করে। মাটিতে ধীরে ধীরে হেঁটে শিকার খোঁজে। ঝোপের তলায় তলায় ঘুরে ওরা যখন খাবার খোঁজে, তখন দীর্ঘ পুচ্ছটি প্রায় মাটি ছুঁয়ে থাকে।

বেশ গভীর ও সুরেলা কণ্ঠে ধীরে ধীরে উক...উক... শব্দে ডাকে। অন্য রকম একটি ডাকও শোনা যায়। খুব দ্রুত সংগীতের ঝংকারের মতো কুপ..কুপ..কুপ করে ছয়-সাতবার ডাকে। গরমের দিনে বহুদূর থেকে ওদের ডাক শোনা যায় বলে জানান এ বন্যপ্রাণ গবেষক।

;