সামালবং: এক পাহাড়ি গ্রামে



সম্প্রীতি চক্রবর্তী
সামালবং: এক পাহাড়ি গ্রামে। বার্তা২৪.কম

সামালবং: এক পাহাড়ি গ্রামে। বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাঙালির পাহাড় ভ্রমণের শখ মেটেনা আর আমরা কলকাতার মানুষ পাহাড় বলতে বুঝি রাতটা কোনমতে ট্রেনে কাটিয়ে দিয়ে ভোরের দিকে দার্জিলিং-কালিম্পং। সেবার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'দার্জিলিং' বইটা হাতে পেয়েছিলাম। এবারও ওটি খোঁজার ইচ্ছা ছিল, তবে কিভাবে জানি না হাতে এসে গেলো পরিমল ভট্টাচার্য্য এর লেখা 'দার্জিলিং'।

বইটি কিছুটা গোগ্রাসে গিলে বোঝা গেলো, এই লেখা পড়ে আর যাই হোক টুরিস্ট হিসেবে পাহাড়ে যাওয়া যায় না। বইটির আদ্যপান্ত জুড়ে পাহাড়ি মানুষ, তাদের জীবনশৈলী নিয়ে কথা; একবার একটি পাহাড়ি ছেলে লেখককে নিয়ে গেছিলেন তার নিজের গ্রামে, সেখানে আধুনিক সভ্যতা বলতে নাকি কেবল প্লাস্টিকের দ্রব্য পৌঁছেছে, মানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, জলের জোগান বা পরিমিত বিদ্যুৎ, এ সবের আগে যেটা তারা হাতে পেলো, তা রং বেরং-এর প্লাস্টিকের পাত্র, বাটি, গেলাস।

ছেলেটির সঙ্গে লেখকের সেভাবে আর পরে যোগাযোগ হয়নি, তবে উনি জানতে পারেন পুনেতে একটি ওষুধের কোম্পানিতে ছেলেটি কর্মরত, পাহাড় থেকে অনেক দূরে, কাজের চাহিদায় সে সমতলের মানুষ হয়ে উঠেছে, অন্তত হওয়ার চেষ্টা করেছে হয়তো।

বই-এর কিছুটা পড়ে আর সময় দেওয়া গেলো না, কারণ এবার রওনা দিতে হবে। মনে মনে ছবি আঁকছি পাহাড়ের আর সাথে ভাবছি এই আমাদের মতো হামলে পরা টুরিস্টদের কথা। মাঝরাতে জলপাইগুড়ি পৌঁছলাম, চারটে বাজতে না বাজতেই পাহাড়ের রাস্তা ধরা হলো। বিভীষিকা কাকে বলে! অন্ধকার পথ, বিশাল চাঁদ আর গাড়িটা সটাং উঠে যাচ্ছে ঢালে আবার কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই হুস করে নামছে। আলো থাকলে তাও সামনেটুকু দেখা যেত। তবে এই ভীষণ ওঠা-পরার মধ্যেও যেটা একমাত্র পাওনা, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর পূর্ণিমার চাঁদ, যা পাহাড়ের বাকে বাকে হঠাৎ দেখা দিয়ে অদৃশ্য হচ্ছে আর কি ভীষণ নীল আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। রাতের পাহাড় একদিকে যেমন বীভৎস আবার খুব আত্মবিশ্বাসী। প্রচুর উঁচুনিচুর মধ্যেও কেমন যেন জেদ চেপে যায়, রাস্তা শেষ হবেই, গন্তব্য আসবে, সে যতই চড়াই-উৎরাই থাকুক না কেনো।

দার্জিলিং কয়েকদিন কাটিয়ে আমরা গেলাম ছোট পাহাড়ি গ্রাম সামালবং-এ। কালিম্পং পৌঁছে ঘণ্টা দুই আরও লাগে গাড়িতে। যেহেতু একটু রিমোট এরিয়া তাই গাড়িতে আমরা বাদে আর সকলেই গ্রামের বাসিন্দা। পাহাড়ের সরু রাস্তা বেয়ে গাড়ি গিয়ে থামলো একেবারে নির্জন স্থানে। হোটেল বলতে একটাই, আর আশেপাশে দুটো দোকান, ব্যস।

দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে আমরা বেরোলাম একটু হাঁটতে। ক্রমশ সন্ধ্যে হয়ে আসছে, টর্চের আলোয় খুব বেশি দূর দেখা যায় না। নির্জন সন্ধ্যাবেলা, পাহাড়ি চুড়ো, শনশনে হাওয়ায় আমরা দু কাপ চা নিয়ে বসলাম। সময়ের অস্তিত্ব বোঝা কঠিন এখানে, আকাশের একফালি চাঁদ আর অনেক নিচে একটা নদী বয়ে যাওয়ার হালকা শব্দ ছাড়া আর কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। দোকানি একটা চেয়ার বাড়িয়ে দিলেন, সেটা নিয়ে পাহাড়ের ধারে বসার রীতি আছে। বিশেষ কিছু দৃশ্য উপভোগ করছি তা নয়, তবে রাতের পাহাড়, তার সমস্ত রহস্য নিয়ে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি।

দোকানি গল্প জুড়লেন, গ্রামের প্রচুর জমির মালিক উনি নিজেই। আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, এখন voluntary retirement নিয়ে গ্রামেই থাকেন। স্ত্রীর সঙ্গে দোকান দেখাশোনা ও চাষবাস করেন। বাংলা, হিন্দি দুটোতেই সড়গড়, বললেন আরও অনেক ভাষা জানেন, ভাষা শেখা ওনার অন্যতম শখ। এই গ্রামেই জন্ম, বড় হওয়া, এখান থেকে মূল শহর প্রায় দুঘণ্টার পথ। আশেপাশের জমিতে ধানচাষ হয়, বর্ষাকালে ভাতের জোগানে অসুবিধা হয় না, তবে বাকি রসদে টান পড়ে। ভীষণ বৃষ্টিতে মূল শহর থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কিছুদিনের জন্য, এটাই সমস্যা।

এরপর এক এক করে ছেলেবেলার গল্প, গ্রামের ইতিহাস, মানুষজন আসতে লাগলো কথাবার্তায়। তিরিশ, চল্লিশ বছর আগেকার সামালবং, পাহাড় ডিঙিয়ে যাতায়াত করতেন ওনারা জোয়ান বয়সে, পায়ে হেঁটে, নদী পেরিয়ে। এখনকার ছেলেমেয়েরা যদিও স্কুটি বা সাইকেল ব্যবহার করে।

পাহাড়ের ধারে বসে গল্প করছি, ইতিমধ্যে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। অদূরে সোনালী রঙের আলো, পাহাড়ের গায়ে, ভাঁজে ভাঁজে। আলোর দিকে তাক করে বললেন ওগুলো দাবানল। সারা রাত হয়তো জ্বলবে, গ্রামের লোকালয় গুলোতে গাছপালা কেটে দেওয়া হয় যাতে নিশুতি রাতে আগুন হানা না দিতে পারে। ধিকিধিকি আগুনের পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে আমরা যেখানে বসে আছি।

এর মধ্যেই বৃষ্টি নামলো। তাড়াতাড়ি ছুটলাম হোটেলের দিকে। ঘরের বিছানায় বসে বৃষ্টি দেখছি নীল পাহাড়ে, চা আর মোমো আছে সাথে। বিদ্যুৎ না থাকায় বেয়ারা এসে মোমবাতি দিয়ে গেলো। কেমন যেন নীল আভা চারিদিকে, বুঝলাম পাহাড়ে বৃষ্টির আওয়াজ অন্যরকম। কেমন সময়ের চাকা থেমে যায়। চা, বৃষ্টি, পাহাড়, প্রথম দিনটা একবারে মন মতো কাটলো। ইতিমধ্যে হোটেলের দুই পোষ্য আমাদের ঘরের সামনে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রাত প্রায় হয়ে এলো, আগুন নিভলো কিনা ভাবছি।

পরেরদিন সকালবেলা উঠে জায়গাটা ঘুরে দেখাই একমাত্র কাজ। কালিম্পং জেলার এই গ্রামটি এতটাই প্রত্যন্ত যে খুবই স্বল্প মানুষ বসবাস করেন এখানে। আমরা হেঁটে পাহাড়ের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম, একেবারে ধারে যেতে ভয় করে, যেন পৃথিবীর শেষ সীমানা, ভয়ঙ্কর সুন্দর, কাছে যেতে মন চায় আবার পরক্ষণেই পা হরকানোর ভয় চেপে ধরে।

সামালবং এর এই view point এ দাঁড়িয়ে কালিম্পং শহরটাকে পুরো দেখা যায়। পাশেই চায়ের দোকান, আমাদের বয়সী এক দম্পতি ও তার ছোট মেয়ে রয়েছে টিনের ছাউনি দেওয়া দোকানে, পাশেই তাদের বাড়ি ও খামার। লাল চা নেওয়া হলো, অসম্ভব ভালো খেতে, অজানা কোনো মশলা দিয়েছে নিশ্চয়ই, কি ভীষণ সুবাস তার। তিন কাপ পরপর চললো, সাথে অমলেট। ছেলেটির সঙ্গে কথাবার্তায় জানা গেলো তাদের দোকানটি গ্রামের সদাই হিসেবে পরিচালিত হয়। টুরিস্ট-এর রমরমা নেই বলে গ্রামের লোকেরাই বিকেল করে আসেন দোকানে, চা খায়, আড্ডা দেয়। দূর থেকে দেখেছি সেই পাহাড়ি আড্ডা। শাল গায়ে দিয়ে প্রাপ্তবয়স্কের দল টিমটিমে আলোয় বসে আছে। হাসি ঠাট্টা মস্করা চলছে তাদের নিজস্ব ভাষায়।

পরের দিন আবার গেলাম সেই ভিউ পয়েন্টে। দোকানি দম্পতি জানালেন তারা মশলা, রান্নার সামগ্রী বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করেন। ওটাই তাদের আয়ের মূল উৎস। তাদের ছোট মেয়েটিকে আগের দিন দেখেছিলাম। সে সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, মা তাকে রোজ সকালে পৌঁছে দেন পাহাড়ি পথ হেঁটে। আর বাবা সকাল থেকে মুরগি, সবজি কেটে, বাসন ধুইয়ে দোকান খোলায় ব্যস্ত থাকেন। আমরা চা খাচ্ছি, মহিলা ইতিমধ্যে চলে এসেছেন মেয়েকে স্কুলে দিয়ে। গল্প করতে করতেই দেখলাম ভদ্রলোক বাসন ধুতে প্রায় পাহাড়ের খাদ বরাবর নামছে। কেন বুঝলাম না, মনে হলো আরে, একটু ওপরেও তো কাজটি করা যায়!
জিজ্ঞেস করলাম ভয় লাগে না আপনাদের এইভাবে নেমে যেতে? তার স্ত্রী বললেন, অনেকবার পড়ে গেছে, একেবারে নিচে গড়ানোর অবকাশ নেই, আবার পাহাড় বেয়ে উঠে আসতে পারবে, অসুবিধা নেই। মানে আমাদের কার্নিশ থেকে বল তোলবার মতো ব্যাপার, ভারী অদ্ভুত বিষয়।

কথা হচ্ছিলো গ্রামে জল সরবরাহ নিয়ে, আগে অনেক দূর থেকে জল বয়ে আনতে হতো, এখন দূরের ড্রাম থেকে পাইপ দিয়ে এক একটা স্থানে জল পৌঁছে যায়, কিন্তু প্রত্যেক বাড়ির আলাদা সময় বাঁধাধরা আছে। দোকানি দম্পতির রাতের বেলা স্লট, তাই অনেক ভোরে উঠতে হলেও রাতে জলের জন্য কিছুটা সময় দিতেই হয়।

পারিবারিক বিষয়ও কথা হচ্ছিল। ছেলেটির বাড়ি সিকিমে, আগে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কাজ করতেন, আপাতত সামালবং, তার শ্বশুরবাড়ি, সেই দোকানেই কাজ করেন স্ত্রী কন্যার সাথে। কথায় কথায় আমাদের ফোন নম্বর নিলেন, কখনো কলকাতায় আসলে যোগাযোগ করতে বললাম। বাচ্চা মেয়েটি খুব হাসিখুশি, কোনো জড়তা নেই, আমাদের দেখে লজ্জা না পেয়ে নিজের মনে খেলা করে।

সামালবং খুব ভালো লাগলো, নির্জন গ্রাম, সকলে মন খুলে কথা বলে, পাহাড়ে বেঁচে থাকার গল্প, জল, খাবার জোগান, নিজেদের খামারে মুরগি, ছাগল পুষে কিভাবে জীবন চলে তাদের। আমরা বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এক পরিত্যক্ত বাড়িতে, মনে হলো কোনোদিন হয়তো স্কুল ছিলো, এখন কোনো কারণে বন্ধ, পাহাড়ের চূড়ায় বেঞ্চি পাতা, তাতে বসে গল্প করছি, সারা শহরটা দেখা যাচ্ছে নিচে। সামনের রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর গ্রামের লোক হেঁটে যাচ্ছে, দু একটা গাড়িও চলছে। এক মহিলা তার ছোট মেয়েকে কাঁধে নিয়ে আসছেন, পাহাড়ি বাঁকে কোনো জড়তা নেই তাদের। মহিলা তার মেয়েকে ইংলিশ অ্যালফাবেট শেখাচ্ছেন, একটা করে পা ফেলা আর B for বলে থেমে গেলে মেয়ে উত্তর দেয় Bat.

সন্ধ্যে হয়ে আসছে, এবার হোটেলের পথে ফিরবো, ভাবছি কাল এই সময় শহরে ঢুকে গেছি। এমন শান্তির বিকেল কতদিন কাটাইনি, হালকা ঠান্ডা, শনশনে হাওয়া, আর পাহাড়ের স্তব্ধতায় একঘেয়ে লাগলে গ্রামবাসীদের সাথে দু-চার কথা বলে নেওয়ার মুগ্ধতা, আজীবনের মহার্ঘ্য সঞ্চয়।

সম্প্রীতি চক্রবর্তী, ইতিহাস বিষয়ক গবেষক, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ।

পাখি ও বন্যপ্রাণীদের দুঃসময়



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

জলবায়ু পরিবর্তনে পাখিদের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। কমেছে পাখির আবাসস্থল। ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।

বৈশ্বিক পাখি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার প্রজাতি হুমকির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ২৮ ভাগ। বিগত দুশো বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। এভাবে চলতে থাকলে আগামী একশ বছরের মধ্যে এই বন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সুন্দরবনের খয়রাপাখা মাছরাঙা পাখি। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি বিশেজ্ঞরা বলছে, বনের ওপর মানুষের অধিক নির্ভরশীলতার কারণে ক্রমান্বয়ে এর আয়তন অতি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। বনের আয়তনের সাথে সাথে হ্রাস পাচ্ছে এর জীববৈচিত্র। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ, ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী প্রাণী হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সুন্দরবনে একাধিক অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হলেও কাজে আসছে না তার সুফল।

পাখি বিশেজ্ঞরা বলছেন, এক দিকে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে পাখি সংখ্যা কমলেও ভারত অংশে সুন্দরবনে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের পাখি-বৈচিত্র্যের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’। ‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামের সেই বইটিতে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রতিটি পাখি প্রজাতির ছবি-সহ বিশদ বর্ণনা নথিভুক্ত হয়েছে।

‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামক বই।

বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪২০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে সুন্দরবনে পরিযায়ী ও স্থানীয় পাখি মিলিয়ে রয়েছে ৪২৮টি প্রজাতি। দেশে প্রাপ্ত ১২টি প্রজাতির মাছরাঙার ৯টিরই দেখা মেলে এই অঞ্চলে। সেইসঙ্গে গোলিয়াথ হেরোন, স্পুনবিল স্যান্টপিপার, হুইমবেল, লার্জ ইগ্রেট, টেরেক স্যান্ডপিপার, প্যাসিফিক গোল্ডেন প্রোভারের মতো বিরল প্রজাতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই অঞ্চলে।

যা ইতিবাচক দিক হিসেবেই মনে করছেন ভারতের প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। ভারতে বর্তমানে ১৩০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই বাসিন্দা সুন্দরবনের। বৈচিত্র্যের নিরিখে গোটা ভারতের মধ্যে যা রয়েছে শীর্ষস্থানে। আবাসস্থল ও অবাধে চলাচলের জন্যে বাংলাদেশ অংশের পাখিরা ভারত অংশের সুন্দরবনে নিজেদের নিরাপদ মনে করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

অন্যদিকে, কমতে থাকায় বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০। এর মধ্যে পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭২১। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর অবস্থা কী - তা দেখার জন্য ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন এর ‘লাল তালিকা’ দেখা যেতে পারে। সেখানে রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায় ১২৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী হুমকি বা বিলুপ্তির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ১৪ ভাগ। গত ১০০ বছরে প্রায় ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে, যা এ দেশের মোট বন্যপ্রাণীর প্রায় ২ ভাগ।

;

হাকালুকিতে কম এসেছে পরিযায়ী পাখি



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

হাকালুকিতে পাখি শিকারিদের কারণে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে। যার কারণে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য অনেকটাই হুমকির মুখে।

হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, নদী দূষণ, জাল বিষ টোপ ও পটাশ দিয়ে পাখি শিকার। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিলে মাছ আহরণ, বিল শুকিয়ে মাছ নিধন, বিলে ২৪ ঘণ্টা পাহারা ও জলজ বৃক্ষ নিধনসহ রয়েছে নানান সমস্যা।

চলতি বছরের শীত মৌসুমের পাখিশুমারিতে সে তথ্যই জানান দিয়েছে। জানুয়ারি মাসের ২৮ ও ২৯ তারিখ দু’দিন ব্যাপী হাকালুকি হাওরে করা হয় পাখি শুমারি করে বন বিভাগ, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) যৌথ উদ্যোগে এ শুমারি করে।

বাংলাদেশে ৭১৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩৮৮ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। এরা শীতকালে পরিযায়ী হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসে বাংলাদেশে। আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় হাকালুকি হাওরের মতো জলাশয়। প্রায় ১৮১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ হাওরে রয়েছে ছোট-বড় ২৭৬টি বিল। পাখিশুমারিতে তাদের জরিপে হাকালুকিতে এ বছর এসেছে প্রায় ২৫ হাজার পাখি। যা বিগত বছর থেকে অনেক কম। যা ২০২০ সালে ছিলো প্রায় ৪০ হাজার ১২৬ পাখি। মাত্র কয়েক বছর আগে দেশে ৫-৬ লাখ পরিযায়ী পাখি আসতো। এসব পাখির বেশিরভাগ মৌলভীবাজার ও সিলেটের হাওরে অবস্থান করতো।

যুগল বেগুনি কালেমের সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এর পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ২০ বছরে সারা বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে ৩৫ শতাংশ। হাকালুকিতে কমেছে ৪৫ শতাংশ। ২০০০ সালের আগে হাওরে বিচরণ করতো প্রায় ৭৫-৮০ হাজার পাখি। তার ৮০ শতাংশই হাকালুকি হাওরে ছিলো।

পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাকালুকি হাওরে যে নদীগুলো মিলিত হয়েছে এখন সেই নদীগুলো প্লাস্টিক, পলিথিন, দূষিত পানি ও ময়লার ভাগাড়। পাখি কমার বিশেষ কয়েকটি কারণের মধ্যে এটি একটি। অরক্ষিত থাকায় দিন দিন কমেছে পাখির সংখ্যা। হাওরের পরিযায়ী পাখি রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, পাশাপাশি প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা থাকতে হবে। এতেই বাঁচবে পাখি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেট এর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর হাওরে বিল ইজারা দেওয়া হয়। এ বছরও হয়েছে। এতে বেশ লোকসমাগম ঘটে। দিনরাত পাহারা দেওয়া হয়। এসব কারণে পরিযায়ী পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে না। বিল শুকিয়ে মাছ আহরণের কারণে নষ্ট হচ্ছে হাওরের জীববৈচিত্র্য। ফলে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমছে।

;

লালসবুজ রঙের পাখি ‘সেকরা-বসন্ত’



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
আপন মনে গাছের ডালে বসে আছে সেকরা-বসন্ত। ছবি: এবি সিদ্দিক

আপন মনে গাছের ডালে বসে আছে সেকরা-বসন্ত। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

ছোট আকারের লাল-সবুজ রঙের বর্ণিল পাখি ‘সেকরা-বসন্ত’। এ পাখিটির ইংরেজি নাম Coppersmith Barbet এবং বৈজ্ঞানিক নাম Psilopogon haemacephala. এরা কাপিটোনিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মেগালাইমা গণের এক প্রজাতির সুলভ পাখি। এরা বাংলাদেশের স্থানীয় পাখি।

এদের দেশের সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। IUCN এই প্রজাতিটিকে Least Concern বা শঙ্কাহীন বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে এরা Least Concern বা শঙ্কাহীন বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, সেকরা-বসন্ত আকারে ছোট হয়। মাত্র ১৭ সেন্টিমিটার। দেহ মূলত সবুব। তবে এদের কপাল লাল রঙের। চোখের চারপাশে হলুদ দাগ দেখা যায়। গলার নিচে রঙিন দাগ দেখা যায়। দেহের উপরের অংশ সবুজ। ঠোঁট কালো এবং পা লাল বর্ণের হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই দেখতে একই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির গায়ের রঙ মলিন এবং এদের দেহে কোন লাল দাগ দেখতে পাওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, সেকরা বসন্ত সাধারণত একা, জোড়ায় বা ছোট দলে চলাফেরা করে। এদেরকে বাগানে, বনে বাদাড়ে দেখতে পাওয়া যায়। এরা বড় গাছের মগডালে রোদ পোহায়। গাছের গর্তে বাসা বানায় এবং সেখানে বিশ্রাম নেয়। শুষ্ক মরুভুমি ও জলাখভূমির বনে এদের সহজে দেখা যায় না।

পাখিটির খাবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রজাতির পাখিরা সাধারণত ফলাহারী। তবে এরা মাঝে মধ্যে পোকা বিশেষ করে উইপোকা খেয়ে থাকে। এদের খাদ্য তালিকায় থাকে বট গাছের ফল, জংলি গাছের ফল, জলপাই জাতীয় ফল এবং বেরি জাতীয় ফল। এরা ফুলে পাপড়িও খেয়ে থাকে।

সেকরা বসন্তের প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এরা গাছের সরু ডালের নিচে গর্ত করে বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি একসাথে ৩ থেকে ৪ টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলিতে তা বাবা পাখি ও মা পাখি উভয়ই দিয়ে থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রায় ২ সপ্তাহ সময় লাগে বলে জানান এ পাখি বিশেষজ্ঞ।

;

বিপদ টের পেলে ঝোপের মাঝে লুকিয়ে পড়ে ‘বাংলা কুবো’



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
বাংলা কুবোর উড়ন্ত সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

বাংলা কুবোর উড়ন্ত সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

বিপদের টের পেলে পাখিটি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। কখনো ছোট দূরত্বে উড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে বাঁশবনে। তখন আর কেউ তাকে দেখতে পায় না।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে অন্যতম এক পাখি ‘বাংলা কুবো’। বিভিন্ন বন-জঙ্গল তথা শালবন এবং চা বাগানে এদের বসবাস। অঞ্চলভেদে এ পাখির নাম কুবো, কুক্কা নামেও পরিচিত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কমরুল হাসান বলেন, এই পাখিটির নাম অন্যান্য বাংলা নামগুলো হলো কানকুয়া, কুক্কা, ছোট কোকা, কুক্কাল বা কানাকুক্কা। ইংরেজিতে একে Lesser Coucal বলে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Centropus bengalensis। কুবো মাঝারি গড়নের ভূচর পাখি। এদের লম্বা ও শক্তিশালী পা এবং লম্বা লেজ থাকে। এরা উড়তে পটু নয়। ছেলে ও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম। বড় কুবো কালো ও তামাটে রঙের লম্বা লেজওয়ালা পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ৪০ সেমি, ওজন ২৫০ গ্রাম। পিঠ তামাটে ও দেহতল চকচকে কালো। এ রকম দুটো প্রজাতি আমাদের দেশে পাওয়া যায়, একটি হলো বাংলা কুবো অপরটি বড় কুবো।

পাতার আড়ালে বাংলা কুবো। ছবি: এবি সিদ্দিক

পাখিটির স্বভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, ভূচর এ পাখি ওড়ার চেয়ে দৌঁড়াতে বেশ পটু। বাঁশঝাড়ে বসে থাকে চুপ করে। নিজেকে সবার থেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করে। এরা একটু লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। প্রয়োজনে এরা মাটিতে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘন ঝোপ, বাঁশবন ও খেজুরগাছের আগায় পেয়ালার মতো বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় তিন-চারটি। বনপ্রান্তে ও গ্রামাঞ্চলে এদের ঢের দেখা যায়। উঁচু ঝোপের মধ্য অগোছালোভাবে বাসা তৈরি করতে পছন্দ করে।

শারীরিক গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, উজ্জ্বল তামাটে কাঁধ-ঢাকনি ও ডানা ছাড়া পুরো দেহই কালো। চোখ লাল, ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা ও নখর কালো। সাধারণত একা বা জোড়ায় বিচরণ করে। মাটিতে ধীরে ধীরে হেঁটে শিকার খোঁজে। ঝোপের তলায় তলায় ঘুরে ওরা যখন খাবার খোঁজে, তখন দীর্ঘ পুচ্ছটি প্রায় মাটি ছুঁয়ে থাকে।

বেশ গভীর ও সুরেলা কণ্ঠে ধীরে ধীরে উক...উক... শব্দে ডাকে। অন্য রকম একটি ডাকও শোনা যায়। খুব দ্রুত সংগীতের ঝংকারের মতো কুপ..কুপ..কুপ করে ছয়-সাতবার ডাকে। গরমের দিনে বহুদূর থেকে ওদের ডাক শোনা যায় বলে জানান এ বন্যপ্রাণ গবেষক।

;