ইনফোসিস মাইশুরে মনোমুগ্ধকর এক বিকেল

  • এম এ আমিন রিংকু
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ইনফোসিস মাইশুরে মনোমুগ্ধকর এক বিকেল

ইনফোসিস মাইশুরে মনোমুগ্ধকর এক বিকেল

তন্দ্রা কাটলো পাশের সিটে বসা সতীর্থের ডাকে। চোখ কচলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বেশ খানিকটা আশ্চর্য হলাম। একগাদা বিস্ময় নিয়ে নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম 'এ কোথায় এলাম'? আশপাশে তাকিয়ে শত প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল মাথায়। বিস্ময় সামলে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। মনে মনে বলতে লাগলাম, 'ঘণ্টা খানেকের বাস যাত্রায় তো আর ভারতের মহীশুর থেকে ইউরোপের কোন শহরে চলে আসা যায় না!'

আমরা একশ তরুণ ভারতে এসেছি ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন টু ইন্ডিয়া প্রকল্পের আওতায় ভারত সরকারের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। আটদিনের এই রাষ্ট্রীয় সফরের প্রতিটি দিনই ছিল আমাদের কাছে স্বপ্নের মত। আর আমাদের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য পরের দিন কোথায় যাচ্ছি সেটি জানানো হত না। শুধু সকালে কখন বের হতে হবে সেই সময়টা জানিয়ে দেওয়া হত।

বিজ্ঞাপন

১৭ অক্টোবর সকালের ব্যস্ত শিডিউল শেষ করে মধ্যাহ্নভোজের পর মহীশুরের বিখ্যাত হোটেল গ্র্যান্ড মার্কিউর থেকে সারপ্রাইজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম পরবর্তী চমকের জন্য উদগ্রীব থাকা শত তরুণ। ভারতের টেক হাব হিসেবে খ্যাত কর্ণাটক রাজ্যের প্রায় সব শহরই অনেক গোছানো আর পরিপাটি। তবে মহীশুরকে অনেক বেশি পরিপাটি সবুজ আর নির্মল বায়ুর শহর মনে হল। চারিদিকের সবুজের মাঝে ছুটে চলা বাসে কখন চোখ ভারি হয়ে এসেছে বুঝতে পারিনি। সতীর্থের ডাকে চোখ খুলে বিস্মিত হয়েছি।

ইনফোসিস ক্যাম্পাস

ভারতের টেক জায়ান্ট ইনফোসিসের মহীশুর ক্যাম্পাস প্রায় সাড়ে ৩০০ শ একর জুড়ে। মূল ফটকের পরে আমাদের ফুলেল অভ্যর্থনা জানালেন ক্যাম্পাসের কর্মকর্তাবৃন্দ। ক্যাম্পাসের ভেতরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য আছে ইনফোসিসের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। কর্মকর্তারা জানালেন প্রথমে আমাদেরকে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাবেন তারা। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে ১০০টির মত বৃহদাকার বিল্ডিং আছে। এদের কোনটি ওয়ার্ক স্টেশন, কোনটি ট্রেনিং সেন্টার আবার কোনটি থিয়েটার। বাসে করে সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে যাবার সময় মনে হচ্ছিল ইউরোপের কোন শহরের মধ্যে আছি। ঝকঝকে তকতকে রাস্তার দুপাশে ইন্দো ইউরোপীয় স্থাপত্য কলায় নির্মিত আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব ভবনগুলোর শান শওকত দেখেই ইনফোসিসের অর্থনৈতিক ভিত্তি সম্বন্ধে বেশ ভালো ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল।

বিজ্ঞাপন

ভারতের সবচাইতে বড় এই তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির হেডকোয়ার্টার বেঙ্গালুরুতে। বিশ্বের ৫০টি দেশে শাখা অফিসে আছে তাদের। আর এসব শাখা অফিসে কাজ করেন ৩ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী । ইনফোসিসের টোটাল রেভিনিউ ১৬. ৯৭ বিলিয়ন ডলার! আর ভারতের জিডিপিতে ইনফোসিস এর অবদান ৮.৩৬ শতাংশ।

এ ক্যাম্পাসের অপারেশন ম্যানেজার অনিল কার্গ । তিনি আমাদের ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখানোর পাশাপাশি বিস্তারিত জানাচ্ছিলেন প্রতিটি স্থাপনার সম্পর্কে। ক্যাম্পাসের ঠিক মাঝখানে জিইসি ভবন। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল রাজপ্রাসাদ। ভেতরে ঢুকে দেখলাম এখানের পরিবেশ আর সাজসজ্জাও রাজকীয়। মি. কার্গ জানালেন এই ভবনে একসাথে দশ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ভবন জুড়ে শুনশান নীরবতা অথচ করিডোর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় দেখছিলাম প্রতিটি কক্ষে একাগ্র চিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিটি কর্মী। এখানে কাজের পরিবেশ বিশ্বমানের। আর কর্মীদের আবাসন ব্যবস্থাও তারকা হোটেলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

সবুজকে প্রাধান্য দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে সব স্থাপনা

জিইসি ভবন থেকে বেরনোর পরে পড়ে স্পোর্টস কমপ্লেক্স। মর্ডান সুইমিংপুল, হাইলি ইকুইপড জিমনেশিয়াম আর বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ দেখে মনে হচ্ছিল একটা প্রতিষ্ঠান কতটা কর্মী-বান্ধব হলে এত সুযোগ সুবিধা দিতে পারে! মাঠ পেরুলেই সবুজে ঘেরা উঁচু নিচু টিলা। আর তার মাঝে মাঝে ইকো ফ্রেন্ডলি ভবন। এদের কোনটি শিক্ষার্থীদের জন্য আবার কোনটি কর্মকর্তাদের জন্য। ইনফোসিসের এই পুরো ক্যাম্পাসটি ইকো ফ্রেন্ডলি ও গ্রিন প্রটেকটেড। সবুজকে প্রাধান্য দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে সব স্থাপনা। ক্যাম্পাসের ভেতরেই- ভেহিক্যালস ছাড়া সব ধরনের যানবাহন প্রায় নিষিদ্ধ। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ই-বাইসাইকেল। কিছু দূর পরে পরেই আছে এসব বাইসাইকেলের জন্য নির্দিষ্ট স্টেশন। অ্যাপের মাধ্যমে আনলক করে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে চালানো যায় এসব ই-বাইসাইকেল।

ইনফোসিস ক্যাম্পাসের প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মুগ্ধতা। ঘুরে ঘুরে আমরা ঠাওর করতে পারছিলাম না আসলে কোনটির চাইতে কোনটিতে বেশি মুগ্ধ হব। মনোমুগ্ধকর স্পোর্টস কমপ্লেক্সের পরেই চোখ ধাঁধানো মাল্টিপ্লেক্স। উইকেন্ডে বিনোদনের জন্য কর্মীদের যেন বাইরে যেতে না হয় এ চিন্তা মাথায় রেখে বানানো হয়েছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এই মাল্টিপ্লেক্সটি। ছুটির দিনে দুটি শো দেখানো এখানে। মাস-জুড়ে মাত্র ১৫০ রুপির পাসে দেখা যায় সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া সব সিনেমা। মাল্টিপ্লেক্সের পাশেই ফুড় কোর্ট। পুরো ক্যাম্পাসে ১০টি ফুড় কোর্ট আছে। যেগুলোর একেকটিতে একবারে প্রায় দুই হাজার মানুষ খেতে পারেন। বিনোদনের পুরো প্যাকেজ রয়েছে ক্যাম্পাসে।

পড়ন্ত বিকেলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল অডিটোরিয়ামে। ইনফোসিসের জন্মলগ্ন থেকে বেড়ে ওঠা ও আজকের টেক জায়ান্ট হয়ে উঠার গল্প একটা ছোট ডকুমেন্টারিতে দেখানো হল। একটা মানুষ কতটা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও নিবেদিতপ্রাণ হলে এমন একটা বিজনেস ইমপায়ার দাঁড় করাতে পারে সেটা ইনফোসিস এর প্রতিষ্ঠাতা নাগাভার রামরাও নারায়ণ মূর্তি সাহেবের দিকে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ই-বাইসাইকেল

ইনফোসিস শুরু করার আগে নারায়ণ মূর্তি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট আহমেদাবাদের একজন সিস্টেম প্রোগ্রামার হিসেবে এবং পুনেতে পাটনি কম্পিউটার সিস্টেমে কাজ করেছেন। একটা সময় মূর্তির মনে হয়েছে পরিবর্তিত বিশ্বের প্রযুক্তি চাহিদা মেটানোর জন্য কিছু করতে হলে সেটি নিজ উদ্যোগে শুরু করতে হবে। ভারতের পুনের ছোট একটা ফ্লাটে মাত্র আড়াইশো ডলার মূলধন নিয়ে ১৯৮১ সালে ইনফোসিস শুরু করেন তিনি। ইনফোসিসের প্রথম প্রোডাক্ট ছিল ব্যাংকিং সলিউশন সফটওয়্যার 'ফিনাকেল'। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই ফিনাকেল এতটা জনপ্রিয় হয় যে নারায়ণ মূর্তিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ইনফোসিস আজ ৭১.৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কোম্পানি!

নারায়ণ মূর্তি ১৯৮১-২০০২ সাল পর্যন্ত সিইও হিসেবে এবং চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১১ সাল পর্যন্ত কাজ করছেন। ২০১১ সালে তিনি বোর্ড থেকে সরে দাঁড়ান এবং ইমেরিটাস চেয়ারম্যান হোন। ২০১৩ সালের ১ জুলাই তিনি ৫ বছরের জন্য নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। নারায়ণ মূর্তি ফরচুন ম্যাগাজিন কর্তৃক আমাদের সময়ের সেরা ১২ জন উদ্যোক্তার তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। ভারতে আউটসোর্সিংয়ে অবদানের জন্য তাকে টাইম ম্যাগাজিন ও সিএনবিসি ‘ভারতীয় আইটি সেক্টরের জনক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ভারতের অর্থনীতিতে বিপুল অবদান এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নারায়ণ মূর্তি ২০০০ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কার লাভ করেন।

 ইনফোসিস

ডকুমেন্টারি দেখে বের হবার পরে আমাদেরকে বিকেলের নাস্তা পরিবেশ করা হল। কফি পান করতে করতে গল্প হচ্ছিল ইনফোসিস মাইসূরের অপারেশন ম্যানেজার অনিল কার্গের সাথে। জিজ্ঞাসা করলাম তাদের সফলতার মূল মন্ত্র কী। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানালেন ‘আমরা মানুষের জন্য এবং সকলের কল্যাণের জন্য কাজ করি। কর্মীদের সাথে সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নেই। আমাদের আজকের 'আমরা' হয়ে উঠার মূলমন্ত্র এটাই’। পিঠ চাপড়ে আরও বললেন, ‘দেখো আমিন, তুমি যখন সবাইকে ভালবাসতে শিখবে, সবার কল্যাণে কাজ করে যাবে- জীবনের প্রান্তিলগ্নে গিয়ে দেখবে মানুষের ভালবাসায় তুমি একদম আকণ্ঠ ডুবে আছো! বিশ্বাস করো এর চেয়ে পরিতৃপ্তি জীবনে আর কিছুতে হতে পারে না!’

সন্ধ্যায় যখন হোটেলে ফিরছিলাম তখন সকলের চোখমুখে সারাদিনের ক্লান্তি ছাপিয়ে চিকচিক করছিল একরাশ মুগ্ধতা। আমাদের কেউ গুগলের ক্যাম্পাস ঘুরে দেখিনি তবে আমাদের বিশ্বস্ত প্রতিবেশী ভারতের ইনফোসিস ঘুরে দেখলাম। আগামীতে অন্য কোন টেক জায়ান্টের ক্যাম্পাস ঘুরে দেখলেও এ মুগ্ধতা ছাপিয়ে যাবে না। ইনফোসিস এর স্মৃতিগুলো চিরসবুজ থাকবে; অনুপ্রাণিত করবে আজীবন।

লেখক: সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী